এক ফালি সুখ পর্ব-৩৩

0
387

#এক_ফালি_সুখ🌼 |৩৩|
#তাসনিম_জাহান_মৌরিন
গাড়ি এসে থামলো একটা পুকুরপাড়ে। ঘাটের দু’পাশে বসার জায়গাও আছে। গাড়ির সামনের আলো ব্যতীত পুরোটাই অন্ধকার বলা চলে। গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো তূর্য, সঙ্গে নামলো মৌরিনও। এতক্ষন দুজনের মাঝেই নিরবতা বজায় ছিলো। তূর্য গিয়ে ঘাটের একপাশে বসলো, মৌরিন গিয়ে বসলো অপর পাশে। খানিকক্ষণ চুপ করে তার দিকে তাকিয়ে রইলো তূর্য। এরপর থুতনিতে হাত ঠেকিয়ে বললো,
_”মনে হচ্ছেনা, তোমার কিছু বলা উচিৎ?”

_”কি বলা উচিৎ?”

চিঠিটা খুললো তূর্য,মৌরিন এর দিকে তাকিয়ে বললো,
_”একটা লাইন অসম্পূর্ণ ছিলো, সেটাকে পূর্ন করা উচিৎ নয় কি?”

_”আমি কবে বললাম লাইন সম্পূর্ন করবো? কিছু কিছু বাক্য অসমাপ্ত ই সুন্দর।”

স্বাভাবিক কন্ঠে বললো মৌরিন। উঠে দাঁড়িয়ে তার সামনে এসে দাঁড়ালো তূর্য,ভ্রু কুঁচকে বললো,
_”চিঠির লাইনের পূর্নতা দরকার নেই, বাস্তব সম্পর্কের পূর্নতা হলেই চলবে।”

মৌরিন ও উঠে দাঁড়ায় এবার, জিজ্ঞাসু কণ্ঠে বলে,
_”কোনো সম্পর্ক ছিলো কি?”

_”ছিলোনা,তাও তোমার ইচ্ছেতে। অতীতটা তোমার মতে চলেছে,ভবিষ্যৎ টাও তোমার কথাতেই চলবে। তবে বর্তমান, সেখানে আর তোমার কথা শুনছিনা মৌরিফুল।”

_”আমি কাউকে বাধ্য করেছি?”

স্থির স্বর মৌরিন এর। তূর্য এগোলো কিছুটা, বিরক্তির ভাব নিয়ে বললো,
_”কথা ঘোরাচ্ছো? এটা তোমার সঙ্গে যায়না।”

_”কেন এনেছেন এখানে?”

_”জানোনা,কেন এনেছি?”

_”আমি তো আর মনোবিজ্ঞানী নই।”

কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে মুচকি হাসলো তূর্য। আবারো বললো,
_”আমার কথা আমাকেই ফিরিয়ে দিচ্ছো? বাহ,বেশ ভালো। তাহলে ম্যাডাম, ফাইনালি আপনার দূর্বলতা হতে পারলাম কি?”

মৌরিন লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে বলে,
_”আমি কাউকে নিজের দূর্বলতা বানাতে চাইনি।”

_”কঠিনতার সঙ্গী?”

_”ভাবিনি।”

_”দেন, ইউ লাভ মি?”

সরাসরি প্রশ্ন করলো তূর্য। মৌরিন ও সরাসরি ই উত্তর দিলো,
_”বলেছি কখনো?”

_”তোমার আমার মধ্যে ডিস্টেন্স কতটুকু?”

উত্তর দিলোনা মৌরিন। তূর্য নিজে থেকেই বললো,
_”সর্বোচ্চ কয়েক সেন্টিমিটার। তুমি আমায় ভালোবাসো না, অথচ আমায় সরিয়ে ও দিচ্ছোনা। মানেটা কি দাঁড়ায়?”

উত্তর না দিয়েই পুকুরের দিকে তাকায় মৌরিন। তূর্য নিজের গালটা বাড়িয়ে চোখ বন্ধ করে বলে,
_”কথা কিন্তু সত্যি,দু তিনটে থা’প্প’র খেতে খুব ইচ্ছে করছে।”

তূর্যের এমন কাণ্ড দেখে মুচকি হাসে মৌরিন। বুকে হাত গুঁজে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো সে। প্রায় ত্রিশ সেকেন্ড পর তূর্য চোখ খুলে বলে ওঠে,
_”থা’প্প’র না দাও একটা কিস তো দিতে পারতে।”

_”নাটক সিনেমার নায়িকা নই আমি।”

হাসে তূর্য,গলা খাকড়ি দিয়ে বলে,
_”নাটক সিনেমার নায়িকা হওয়ার প্রয়োজন নেই। আমার জীবনের নায়িকা হলেই চলবে।”

কিছুক্ষন থেমে তূর্য আবারো বলে,
_”কি দেখে যে এমন আনরোম্যান্টিক মেয়ের প্রেমে পরলাম আল্লাহ মাবুদ জানে।”

_”কি দেখে?”

বিরক্তি সরিয়ে গম্ভীর হয় তূর্য। সামান্য ঝুকে বলে,
_”গাম্ভীর্যতা, স্পষ্টভাষিতা, কঠিনতা, আত্মবিশ্বাস সর্বোপরি এক নারীর অসাধারণত্ব দেখে বাধ্য হলাম তাকে ভালোবাসতে।”

গাড়ির দিকে হাটা শুরু করলো মৌরিন। উল্টোদিকে ঘুরেই বললো,
_”বাসায় যেতে হবে আমার। নিয়ে গেলে চলুন,নাহয় আমি একাও যেতে পারবো।”

বিরক্ত হয়ে পাশে দাঁড়ায় তূর্য, মৌরিনের বাহু ধরে তার দিকে ঘুরিয়ে বলে,
_”আমি কিন্তু এবার আগের রূপ এ ফিরতে বাধ্য হবো। যা আমার চাই তা আমার চাই ই চাই। এত বছর অপেক্ষা করলাম আমি, আর এখন কিনা পালিয়ে যাচ্ছো?”

_”কে বলেছে আপনাকে অপেক্ষা করতে?”

তূর্য অসহায় কণ্ঠে বলে,
_”প্লিজ মৌরিন,পাল্টি খাবেনা একদম। আর কত ধৈর্য ধরাবে আমায়?”

এবারো কোনো না উত্তর না দিয়ে গাড়িতে উঠে বসে মৌরিন। তূর্য ও বাধ্য হয়ে এবার ড্রাইভিং সিট এ গিয়ে বসে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকে মৌরিন এর দিকে। এরপর কিছু না বলে গাড়ি স্টার্ট দেয় সে। এবার তূর্যর ও রাগ হচ্ছে কিছুটা, সবসময় এতো ভাব দেখাতে হবে কেন মৌরিন এর?

বিশ মিনিট এর মাথায় গাড়ি এসে থাকে মৌরিন এর বাসার সামনে। আগের সেই বিল্ডং এ এখন থাকেনা সে, নিজের কোচিং সেন্টার এর পাশেই বাসা ভাড়া নিয়েছে সে।
তূর্য নামলোনা গাড়ি থেকে। মৌরিন দরজা খুলে নামলো,তবে চলে গেলোনা। নিজের হাতব্যাগ থেকে একটা ভাজ করা কাগজ বের করলো সে। তূর্য তাকায় ও নি তার দিকে,সে গম্ভীর মুখ করে সামনের দিকেই তাকিয়ে আছে।

মৌরিন আবারো বসলো সিটে, তূর্য হাতে কাগজটা ধরিয়ে দিলো সে। তূর্য অবাক হয়ে তাকাতেই মৌরিন বেরিয়ে গেলো, যাওয়ার আগে মৃদু হেসে বললো,
_”লুকিয়ে দিলাম না,সামনাসামনি ই দিলাম। ইচ্ছে হলে পড়বেন, আসছি..”

তূর্য কিছু বুঝে ওঠার আগেই মৌরিন ভিতরে চলে গেলো। তূর্য একনজর চিঠিটার দিকে তাকিয়ে চটজলদি বেরিয়ে এলো গাড়ি থেকে। দরজাটা লাগিয়ে গাড়িতে হেলান দিয়ে দাড়ালো সে। এরপর চিঠিটা খুলে পড়তে শুরু করলো,

প্রিয় তূর্য,

অপ্রিয় বলার মতো কোনো কারণ আজ আমার শব্দভাণ্ডারে উপস্থিত নেই। ফলে প্রিয়ই বলতে হলো। আজকের দিনে এসে চিঠির প্রচলন নেই বললেই চলে, তবুও চিরকুট দেওয়াটা শুরু করেছিলেন আপনি নিজেই। আদিকালের এই ভাইবস টা খুব একটা খারাপ নয়। শুরুটা আপনার মাধ্যমে হলেও চিঠি দেওয়ার শেষটা আমার মাধ্যমেই হোক?
এর আগের চিঠিটা দিয়েছিলাম জড়তার কারণে, সামনে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলার কোনো ইচ্ছে আমার ছিলোনা। তবে আজ জড়তার কারণে নয়, চিঠি লিখছি শখের বসে। চাইলে কথাগুলো আপনার সামনে দাঁড়িয়েও বলতে পারতাম,তবে বলিনি। চারবছর আগে আপনাকে বলেছিলাম, আমার উদযাপনে সঙ্গি হতে চাইলে বাঁধা দেবোনা। পূর্ণ করলাম বাক্যটা, শত অপূর্ণতার মাঝে এই বাক্যটা পূর্ণতা পেলো। আজ আমার উদযাপনের দিন, আপনাকে সঙ্গি না বানালে আমায় আজ নিজের সঙ্গে নিয়ে যেতে পারতেন না। আমি পেরেছি নিজের লক্ষ্যে পৌঁছাতে, কারোর দয়ায় নয়, নিজের যোগ্যতায়। সেই অন্ধকার পথ আমি পারি দিয়েছি ঠিকই, সঙ্গে নিজেকে তৈরি করেছি আরো কঠিনভাবে।
আমার কঠিনতা আমার অহংকার, এই রূপ আমি কখনো বদলাবো না। এই পৃথিবীতে আমি নিজেকে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করি,সেই সঙ্গে বিশ্বাস করি আমার মা’কে। তাই আমায় যদি কখনো প্রশ্ন করেন,আমি আপনাকে বিশ্বাস করি কিনা? উত্তরে সিনেমার মতো, “নিজেত চেয়েও বেশি” কথাটা শুনতে পারবেন না তূর্য। আপনাকে আমি বিশ্বাস করি ঠিকই, সেটাও আপনি নিজে অর্জন করেছেন, তবে অন্ধবিশ্বাস নয়। আপনি যে আবারো কখনো পরিবর্তন হবেন না,এ বিষয়ে কোনো নিশ্চয়তা রাখছি না আমি। কারোর থেকেই রাখিনা।
আমি তেমন ভালোবাসা চাইনা তূর্য, যা আমায় দূর্বল করতে চায়। আমি তেমন ভালোবাসা চাই, যা আমার কঠিন রূপটাকেই সম্মান করে। আমি মেনে নিলাম, আপনার ভালোবাসা খাঁটি। তবে আমার ভালোবাসা এমন নাও হতে পারে। দুঃখের সঙ্গী হিসেবে আমি বরাবরেই নিঃসঙ্গতা কে প্রাধান্য দিয়েছি তূর্য। আপনাকে তাই আমার দুঃখের সঙ্গী হতে হবেনা। চাইলে কেবল আমার সুখের সঙ্গী হতে পারেন, বাঁধা দেবোনা তাতে।

ইতি
আপনার মৌরিফুল

মুখে খুশির ঝিলিক নিয়ে চারতলার বারান্দার দিকে তাকায় তূর্য। মৌরিন সেখানেই চেয়ারে বসে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তূর্য সঙ্গে সঙ্গে ফোন করলো মৌরিনকে, রিসিভ ও হলো সেই মুহূর্তেই। বারান্দার দিকে তাকিয়েই তূর্য বললো,
_”তাহলে কি সুযোগ দিচ্ছো আমায়?”

মৌরিন স্মিত হেসে উত্তর দিলো,
_”বোধ হয় না,সুযোগ দিচ্ছি নিজেকে।”

_”তাহলে বলো,ভালোবাসো আমায়?”

_”আমি হালাল ভালোবাসায় বিশ্বাসী।”

হাসি চওড়া হলো তূর্যের। পুনরায় জিজ্ঞেস করলো,
_”বিয়ে করবে আমায়?”

উঠে দাড়ালো মৌরিন। বারান্দার গ্রিল এ হাত রেখে শান্ত কণ্ঠে বললো,
_”ভেবে নিন আবারো, আমি কিন্তু বাকিদের মতো নই। গাম্ভীর্য, কঠোরতা কিন্তু আমার রন্ধ্রে মিশে আছে।”

_”তুমি গম্ভীর ই থেকো মেয়ে, কম কথাই বলো। আর তোমার কঠোরতা, তাই তো আমার সবচেয়ে পছন্দের।”

_”মন থেকে নয়, মস্তিষ্ক থেকে ভেবে বলছেন তো?”

_”শতভাগ। তুমি বরং প্রস্তুতি নাও, লাল নয়। হলুদ শাড়িতে বউ সাজার প্রস্তুতি নাও। ইলহাম আবসার তূর্যের বউ, সবদিক থেকেই ইউনিক থাকবে। বুঝলে মৌরিফুল?”

উত্তরে কেবলই মুচকি হাসলো মৌরিন। গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে তাকিয়ে রইলো তূর্যের দিকে। তূর্যও কান থেকে ফোনটা সরিয়ে নিলো। সম্পূর্ন মনোযোগ দিয়ে দেখলো সেই অসুন্দর অসাধারন মেয়েটিকে। যাকে সে ভালোবাসে, ভীষণ ভালোবাসে।

#চলবে?