এক ফালি সুখ পর্ব-৩১

0
81

#এক_ফালি_সুখ🌼 |৩১|
#তাসনিম_জাহান_মৌরিন
_”আমি কি একবার মারুফার সঙ্গে কথা বলে দেখবো তূর্য?”

_”হুম?”

চোখ খুলে তাকায় তূর্য, ইলমা তার পাশেই বসে ছিলেন। দুদিন হলো জ্বরে পরেছে তূর্য,তাও আবার যে সে জ্বর নয়। অধিকাংশ সময় ১০৪ ডিগ্রি এর উপরে জ্বর থাকছে। জ্বরের ঘোরে নানান কথা বলছে সে, ইলমা তাই ছেলের এই অবস্থা সহ্য করতে না পেরেই কথাটা বলে বসলেন।

শুকনো ঢোক গিলে ধীরেধীরে উঠে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে তূর্য। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলে,
_”না আম্মু,মৌরিন নিজে রাজি না থাকলে শুধুশুধু আন্টির সঙ্গে কথা বলবে কেন?”

_”আমি এই কথাটাই তোকে বলেছিলাম তূর্য। তোর ফোনে মৌরিন এর ছবি দেখেই তো বুঝতে পেরেছিলাম ও মারুফার মেয়ে, যার কথা জানিয়েছিলাম তোকে। ও অনেক কঠিন মনের মেয়ে,এত সহজে ও তোকে বিশ্বাস করে নেবেনা। কিন্তু মারুফা বললে হয়তো..”

_”বললাম তো আম্মু, আমি চাই মৌরিন নিজের ইচ্ছেতে আমায় বিয়ে করুক। অন্য কারোর কথাতে নয়, আর সেটা ও করবেও না।”

তূর্যের হাতের উপর হাত রাখলো ইলমা। তার গালে হাত দিয়ে বললেন,
_”এটা কি আমার সেই জেদি ছেলে? যেটা তার চাই,সেটা তার যেকোনো মূল্যেই চাই! এই কথা বলা ছেলে কিনা আজ একটা মেয়ের জন্য এত ধৈর্য ধরছে?”

স্মিত হাসে তূর্য। ধৈর্য তো সে ধরেছে,নিজের স্বভাবের বাহিরে গিয়েই ধৈর্য ধরেছে সে। তবে এক্ষেত্রে ধৈর্যের ফল কি আসলেই মিষ্টি হবে?

_____
শুটিং শেষ হলো মাত্র, সূর্য ডুববে কিছুক্ষন এর মধ্যেই। মাঠের আশেপাশে থাকা মানুষজন ও শুটিং দেখে এখন বাড়ি ফেরার জন্য পা বাড়াচ্ছেন। মৌরিন আগে থেকেই ব্যাগ কাঁধে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি, পরনে লাল রঙের গোল জামা,ওড়নাটা গলায় ঝুলিয়ে রাখা। আর বরাবরের মতোন ই চুলে বিনুনির সঙ্গে কপালে কালো রঙের টিপ।
জ্বরের ধাক্কা থেকে উঠে আজই শুটিং সেট এ এসেছে তূর্য, খানিক দূরের চেয়ারে বসেই অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মৌরিন এর দিকে। ভালো লাগছে তাকিয়ে থাকতে। আচ্ছা মৌরিনকে এখন কেমন লাগছে? সুন্দর? তা কি করে হয়? অসুন্দর মেয়েকে আবার সুন্দর লাগতে পারে নাকি? নাহ, তা নয়। অনেক ভেবে তূর্য আবিষ্কার করলো, কোনো কারণ ই নেই, অকারণেই তার মৌরিনকে দেখতে ভালো লাগছে। দেখুক, চোখের দেখাতে তো আর কোনো বারণ নেই।
অনেক্ষন তাকিয়ে থেকে একটা জিনিস অদ্ভুত লাগলো তূর্যের,মৌরিন হাসিমুখে সবার থেকে বিদায় নিচ্ছে। তূর্য উঠে দাড়ালো চেয়ার থেকে,ভ্রু কুঁচকে রাতুলের কাছে যেতেই মৌরিন ও উপস্থিত হয় সেখানে। রাতুলের উদ্দেশ্যে বলে,
_”বিয়ের ইনভিটেশন পাচ্ছি তো ভাইয়া?”

রাতুল হাসে সামান্য। মাথা চুলকে বলে,
_”নেক্সট মানথ ইনশাল্লাহ। আর তুমিতো স্পেশাল গেস্ট, তন্নি তো বলেই দিয়েছে। দুদিন আগে থেকে থাকতে হবে তোমায়,রিমির ও কড়া আদেশ। সো,তুমি না থাকলে বিয়েটাই না ক্যানসেল হয়ে যায়!”

মৌরিন বেশ হেসে বললো,
_”আপনার বিয়েতে যাবোনা আমি? বলতে গেলে আপনার জন্যই তো অর্ধেক শহর চিনতে পেরেছি আমি,বড় ভাইয়ের বিয়েতে না গিয়ে পারি?”

_”তা ঠিক,তবে তোমায় কিন্তু খুব মিস করবো মৌরিন। শুধু আমি না সবাই মিস করবে। বাট আই প্রে ফর ইউ,অনেক বড় হও। এন্ড খুব জলদি তোমাকে নিজের সহকর্মী হিসেবে দেখতে চাই কিন্তু, ইউ হ্যাভ দ্যাট ট্যালেন্ট। যেকোনো হেল্প লাগলে আমি তো আছিই।”

_”ইনশাল্লাহ..”

তূর্যের এতক্ষনে বুঝতে বাকি রইলো না মৌরিন কাজ ছেড়ে দিচ্ছে। আর সেটা বুঝতেই সে মৌরিন এর উদ্দেশ্যে বলে,
_”তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।”

মৌরিন নির্দিধায় বলে,
_”হ্যা বলুন”

_”এখানে নয়,আলাদা কথা আছে।”

রাতুল কাজের কথা বলে অন্যদিকে চলে গেলো। মৌরিন বরাবরের মতো আজ প্রতিত্তর করলো না। আশেপাশে তেমন কেউ নেই,সবাই বেশ দূরে। তূর্যের দৃষ্টি এলোমেলো, মৌরিন যথাযথভাবে শান্ত। তূর্য গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
_”কাজটা ছেড়ে দিচ্ছো কেন?”

মৌরিন ঘাসের দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে উত্তর দেয়,
_”সেটা আমার ব্যাপার।”

_”কারণটা কি আমি?”

_”আপনি? আপনি কেন কারণ হতে যাবেন?”

জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভেজালো তূর্য, হাত নাড়িয়ে বললো,
_”মৌরিন সেদিন রাতের ঘটনার জন্য আমি..”

_”প্লিজ তূর্য, আমি আগেও বলেছি ওটা কেবলই একটা এক্সিডেন্ট ছিলো। আমি আপনার উপর কোনো দোষ দিচ্ছি না, দোষটা আমারো কিছুটা হলেও ছিলো অবশ্যই। আর সেই ঘটনার জন্য কাজ ছাড়তে হলে তো আরো আগেই ছাড়তে পারতাম।”

তূর্য করুন কণ্ঠে বলে,
_”তাহলে কেন ছাড়ছো?”

প্রশ্ন করলেও তূর্য জানতো মৌরিন উত্তর দেবে না। তবে তাকে ভুল প্রমাণিত করে মৌরিন উত্তর দিলো,
_”একটা কোচিং সেন্টারে জয়েন্ট করছি, ভার্সিটি ও আছে। সব মিলিয়ে আর এখানে সময় দেওয়া সম্ভব হচ্ছনা।”

নির্বাক রইলো তূর্য, মৌরিন তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে,
_”নিজেকে দোষি ভাববেন না। দোয়া করবেন আমার জন্য, ভালো থাকবেন।”

_”কত্ত ভালো আছি আমি, তা তুমি বুঝতে পারছো না?”

মৌরিন শান্ত স্বরে উত্তর দেয়,
_”আন্তরিকতার খাতিরেই বলেছি কথাটা। এরচেয়ে বেশি কিছু বোঝার ইচ্ছে নেই।…আসছি।”

মৌরিন উল্টোদিকে ঘুরে চলে যেতে নিলেই তূর্য বলে ওঠে,
_”আর একবার ভেবে দেখা যায়না মৌরিফুল? আই প্রমিস, এরপর আর বিরক্ত করবোনা তোমায়।”

পিছন ফিরলোনা মৌরিন,প্রতিত্তর ও করলোনা। ধীর পায়ে স্থান ত্যাগ করলো সে। মৌরিন সচরাচর কথা এড়িয়ে যায়না, আজ সে তাই করলো। এছাড়াও আজ তার কণ্ঠস্বর অন্যরকম ছিলো,বরাবরের সেই তেজী ভাব থাকলেও তার পরিমান স্বল্প ছিলো। অন্যসময় হলে হয়তো তূর্য খেয়াল করতো বিষয়গুলো,তবে আজ তার নজরেই এলোনা এগুলো। নিজের সুখী জীবনটাতে যেন এখন এক ফালি সুখ খুজে পেতেও হিমসিম খেতে হচ্ছে তাকে।

সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো তূর্য, মেঘ করেছে আকাশে। মাঠে থাকা দু একজন লোকও এখন ফিরে যাচ্ছে। শুটিং সেট এর অধিকাংশ মানুষ বিদায় নিয়েছে,রাতুল এসে তূর্যের কাঁধে হাত রাখলো। তবে কিছু বললোনা, এতদিনে কম বোঝায়নি সে তূর্যকে,তাই আজ আর নতুন করে কিছু না বলে সেও বিদায় নিলো।

বিষাদে আচ্ছন্ন মন নিয়েই ঘাসের উপর বসলো তূর্য। মনটা ভীষণ খারাপ লাগছে আজ, বাড়ি গিয়ে মন খারাপের সঙ্গি বানাবে মা’কে। তবে এখন বাড়িও যেতে ইচ্ছে করছে না। কয়েক সেকেন্ড পেরিয়ে যেতেই তূর্যের চোখ যায় তার পাশেই ঘাসের উপর পরে থাকা এক ভাজ করা কাগজের দিকে। একটু আগেতো এটা ছিলোনা এখানে। ভ্রু কুঁচকে কাগজটা হাতে নিলো তূর্য। কাগজের ভাজ খুলতেই চোখ কপালে উঠে যায় তার। অনেক বড় একটা চিঠি বলা চলে, হাতের লেখাটা চিনতে পারলো সে। এমন গোলগোল করে মৌরিনই লেখে দেখেছিল। সঙ্গে সঙ্গে সোজা হয়ে বসে তূর্য। এক মুহূর্ত অতিবাহিত না করে পড়তে শুরু করলো চিঠিটা।

প্রিয় কিংবা অপ্রিয় তূর্য,

চিঠিটা দেখেই প্রথমে অবাক হবে জানি, তারপর অবাক হবে প্রথম বাক্যটি পড়ে। হ্যা, আজ তুমি করেই বলি নাহয়। তুমি আমার প্রিয় নাকি অপ্রিয় তা নিয়ে এখনো সন্দিহান আমি,তাই তোমার বলা কথাকেই কপি করলাম।
আমায় খুব কঠোর মনে হয় তাইনা? ঠিকই তো ভেবেছো, আমি আসলেই কঠোর। কঠোরতা আমার রন্ধ্রে মিশে আছে,যা আমার পছন্দের। ছোটবেলা থেকে নিজেকে ভালোবাসতে শিখেছি আমি, সকল কুপ্রবৃত্তি থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছি। বলতে গেলে এমন পরিস্থিতি তে আমায় খুব একটা পরতেও হয়নি। বিশ্বাস করবে কিনা জানিনা,তবে এর আগে আমি কারোর থেকে চিঠি,চিরকুট কিছুই পাইনি। চাইও নি, খুশিই ছিলাম,এসব ঝামেলা থেকে বেঁচে গিয়ে আনন্দে থাকতাম।
যা আমার কঠোরতায় প্রভাব ফেলে,আমি তা থেকে বরাবরেই দূরে থাকতে ভালোবাসি। ভেবেছিলাম তোমার চিরকুট গুলোকেও আমি সেভাবেই অবহেলা করতে পারবো। এই এক ক্ষেত্রে আমি ব্যার্থ হলাম তূর্য। না চাইতেও সবগুলো চিরকুট আমি খুলেছি বারবার।
একটা কথা জানো কি, তুমি আমায় যতটা কঠোর ভাবো আমি বাস্তবে তার চেয়েও বেশি কঠোর, তোমার সামনে কেবল সবটা প্রকাশ করতে পারিনি। আমি ভালোবাসতে ভয় পাইনা তূর্য, আমি সম্মান করি তাকে, তবে আমি ভয় পাই দূর্বলতাকে। যতবার আমি তোমায় নিয়ে ভাবার চেষ্টা করেছি,ততবার মনে হয়েছে এই ভাবনা আমায় দূর্বল করে দিচ্ছে। ভিতর থেকে যেন নিজের কঠিনতার সত্ত্বাকে হারিয়ে ফেলবো ধীরেধীরে,এই চিন্তা ক্রমশ আমায় ঘিরে ধরেছে। আমি চাইনা এই মুহূর্তে তুমি আমার দূর্বলতার কারণ হও।
আমার চলার পথটা মোটেই সহজ নয় তূর্য, এই পথের মাঝখানে বিষাক্ত কাটা বিছানো, সামান্য সরু পথ চলার জন্য। নিজ বুদ্ধিতে আমায় এই পথ পার করতে হবে। তুমি মাঝপথে এসে আমায় সাহায্য করতে চাইছো ঠিকই, তবে আমার মতে এত সরু পথে দুজনের চলাটা সম্ভব নয়। আমি চাইও না সেটা।
তবে হ্যা,যেদিন আমি এ পথ অতিক্রম করতে পারবো সেদিন আমি মন খুলে উদযাপন করবো। যদি তখন আমার উদযাপন এর অংশীদার হতে চাও..
বাক্যটা অপূর্নই থাক। বেঁচে থাকলে হয়তো তোমার সঙ্গে আবারো দেখা হবে আমার, তবে ভুলেও এই চিঠির কথা মুখে এনোনা যেন। এই কথাগুলো কাগজের পাতায় বন্দি থাক নাহয়।

ইতি
তোমার মৌরিফুল

বাকি চিঠিটা শান্ত মনে পড়তে পারলেও শেষ শব্দটা পড়ে এক ঝটকায় উঠে দাঁড়ায় তূর্য। “তোমার মৌরিফুল” দ্বারা মৌরিন কি বোঝালো? উত্তর টা বুঝতেই আশেপাশে তাকায় তূর্য। চোখেমুখে যেন তার খুশি উপচে পড়ছে। প্রায় ফাঁকা মাঠেই এদিক ওদিক তাকালো তূর্য, নাহ মৌরিনকে দেখা যাচ্ছে না। তবে তূর্যের মনে হচ্ছে,মৌরিন আশেপাশেই আছে।
তূর্য কয়েক সেকেন্ড বাদেই গলা ছেড়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো,
_”তুমি কোথায় মৌরিন? প্লিজ কাম হেয়ার..”

কোনো প্রতিত্তর এলোনা। তূর্য এবার ঘাসের মাঝে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লো। চোখ বন্ধ করে চিৎকার করে বললো,
_”শুনতে পাচ্ছো মৌরিফুল? আমি অপেক্ষায় থাকবো… আই লাভ ইউ মৌরিফুল.. আই লাভ ইউ সো মাচ..”

প্রতিধ্বনি শোনা গেলো দু একবার। হয়তো আড়ালে দাঁড়িয়ে মৌরিন ও শুনলো এই ডাক,হয়তো শুনলো না। তবুও আজ খুশি তূর্য, কিছুক্ষন আগের দুঃখী জীবনটা যেন মুহূর্তেই সুখে ভরে উঠলো। আর এর কারণ? তারই মৌরিফুল…

#চলবে?