ওড়নার দোষ (৩য় অংশ)

0
999

গল্পঃ ওড়নার দোষ
(৩য় অংশ)

ইসরাত জাহান

“দাদীবু তুমি খাচ্ছোনা কেন?”
“মেঘা তোর মাকে ডাক।”
গম্ভীর গলায় বলল দাদীবু।মেঘার ডাকার আগেই মল্লিকা এসে বলল,
“কিছু লাগবে আম্মা?”
“বলছি তোমার কী রান্না করতে বর্তমান আলসেমি লাগে?বাইরের লোক ডেকে এনে কেন রান্না করাচ্ছো?”
খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে চলে গেল দাদীবু।রুমেন সাহেব খাওয়া ছেড়ে বলল,
“ব্যাপারটা কী হলো?আম্মা খাবার ছেড়ে উঠে গেল কেন?”
মিশু বাবাকে বলে উঠল,
“দাদীবুর বোধহয় ভালো খাবার সহ্য হয়না।”
ডাইনিং এ উপস্থিত সবাই মুখ চেপে হাসা শুরু করল।দাদীবু ঘরে ঢোকার আগে মিশুর কথা শুনে চোখ পাকিয়ে তাকাল ওর দিকে।তারপর বলল,
“যার তার হাতের রান্না আমার সহ্য হয়না।মল্লিকা ওকে বলে দাও যেখান থেকে এসেছে সেখানেই যেন ফিরে যায়।”
“রুবা এসেছে রুবেল?”
“হুম।”
“তুই ওকে গিয়ে নিয়েসেছিস নাকি ও নিজেই এসেছে?”
বড় ছেলের কথার উত্তর দিয়ে দাদীবু বলল,”সে তো বেহায়া কারো সাথে আসা লাগেনা তার।”
রুবা আড়ালে দাঁড়িয়ে সব শুনছে।কিন্তু চোখে তার এক ফোটাও পানি নেই। তার স্বামী রিফাত মারা যাওয়ার পর থেকে সে নানারকম ঝড়-ঝঞ্ঝাট একাই সামলিয়েছে। তবে আজ এই বাড়ির বড় মেয়ে মেঘা অনেক বড় একটা ঝড় একাই সামলে ফেলল। সবার সামনে ফুপিকে টেনে এনে বাবা আর দাদীবুকে বলল,
“ইনডিরেক্টলি কোনো কথা বলবেনা তোমরা।এই মানুষটাকেই তো বলছিলে এতকিছু।নাও এবার তাকে সরাসরি বলো। কম কষ্ট এই মানুষটা জীবনে ভোগ করেনি।তোমাদের দেওয়া এটুকু ব্যাথাও আজ সে সহ্য করে নিবে।তার জীবনে এখন সবই আছে।টাকা পয়সা,বাড়ি গাড়ি,এমনকি খুব সুন্দর দুটো ছেলে মেয়েও আছে।শুধু নেই একটু কষ্টটা ভাগ করে নেওয়ার মত কেউ।তের বছর আগে যে মানুষটা বাড়ি ছেড়েছিল যার হাত ধরে।সেই মানুষটাও আজ তার পাশে নেই।এই মানুষটা শুধু সবাইকে ভালোবেসে যাচ্ছে।কিন্তু তাকে ভালোবাসা দেওয়ার মত সেই আপন মানুষগুলো তার পাশে নেই।তোমরা সেই তের বছর আগের স্মৃতি মনে রেখে ভেতরে জেদ পুষে,রাগ পুষে এখনো তাকে কষ্ট দিচ্ছো।তোমরা কত বড় মনের মানুষ সেটাও প্রমাণ করে দিলে।প্রতি বছর ঈদে কত দূর সম্পর্কের আত্মীয়রাও আমাদের বাড়িতে তাদের ছেলে মেয়ে নিয়ে বেরাতে আসে।কিন্তু এই মানুষটার কোনো জায়গা নেই তার ছেলেমেয়েকে নিয়ে আপন কারো কাছে বেড়াতে আসার।সে তো তার অযোগ্য কাউকে বিয়ে করেছিলনা।তার দোষ ছিল সে একজন পিতৃ-মাতৃহীন ছেলের হাত ধরেছিল।যার দেশে চার কুলে কেউ ছিলনা পরিচয় দেওয়ার মত।সে যাই হোক,তোমরাই ভালো জানো তোমরা কতদিন ক্ষোভ পুষে রেখে তাকে দূরে সরিয়ে রাখবে।তার ছেলে মেয়ে দুটোও আসেনি কারণ তারা হয়তো জানতো তার মাকে কতটা অপমান হতে হবে।আর তারা সেটা সহ্য করতে পারতোনা।
ভালোই করেছে তারা আসেনি।তারাও জানবে যে তাদের মাও তাদের বাবার মত হয়তো পিতৃ-মাতৃর পরিচয়হীন হয়েই থাকবে সারাজীবন।ফুপি তুমি কী কিছু বলবে? যদি বলতে চাও বলো।বলা শেষ হলে আমি তোমাকে নিজে গিয়ে তোমার ছেলে মেয়ের কাছে পৌঁছে দিয়ে আসব।”
রুমান সাহেব আর দাদীবু সহ প্রায় সবার তাক লেগে গেছে সতেরো বছর বয়েসী এই ছোট মেয়েটার কথা শুনে।অবশ্য এটাও রুবেলের প্ল্যানের একটা অংশ ছিল। যেটা রুবা নিজেও জানতো না।কিন্তু রুবেল এটাও জানতোনা যে মেঘা শেখানো কথাগুলো এত সুন্দর গুছিয়ে বলতে পারবে।রুবা কিছুই বললোনা ওদের উদ্দেশ্য করে।শুধু দাদীবুর একটা ছবি তুলে নিল।এটা দেখে সবাই একটু চমকে তাকাল।তারপর রুবা বলল,
“ওদেরকে আমি জানাতে চাই যে আমি পিতৃ-মাতৃহীন নই।আমার মা আছে।”
কথাগুলো বলতে গিয়ে রুবার গলার স্বর কেঁপে উঠল।তারপর মেঘার কাছে গিয়ে ওর কপালে একটা চুমু খেল।মিশুকেও কাছে টেনে ওর মাথায় চুমু খেয়ে বড়ভাইকে বলল,
“অনেক আগেই আমি তোমার কাছে মৃত হয়ে গেছি।মৃত মানুষের দিকে তাকাতেও তোমার ঘেন্না লাগছে ভাইয়া?”
রুমেন সাহেব কোনো কথা বললনা।চোখ বন্ধ করে কপালে দু হাতের অনামিকা আঙুল ঠেঁকিয়ে বসে রইল।মেঘা বলল,
“আমাকে মাফ করে দিও ফুপি।আমি চাইনি তুমি এতটা কষ্ট পাও।এমনকিছু হবে জানলে আমি তোমাকে কোনোদিনও নিয়ে আসতাম না।চলো তোমাকে পৌঁছে দিই।”
রুবা যাওয়ার সময় বলল,
“আমাকে পৌঁছে দিতে হবেনা মা।জীবনের অর্ধেকটা জীবন একা হেঁটেই পার করেছি।বাকিটাও ইনশাআল্লাহ্ পারবো।তবে একটা জিনিস আমি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ভুলবোনা।আমার হাতের রান্নাটা যে আমার ভাইটা মুখে তুলেছে এটা মনে করেই আমি তোমাদের ছাড়াই বাকি জীবন পার করতে পারবো।”
দরজা পার করে চলে যেতেই রুমেন সাহেব তার স্ত্রীকে বলল,
“ওকে ভেতরে নিয়ে এসো মল্লিকা।”
কথাগুলো বলেই রুমেন সাহেব ওপরে চলে গেলেন।এলিনা আর মল্লিকা দৌঁড়ে গিয়ে ননদকে টেনে আনল ভেতরে।দুজনে তাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করল কিছুক্ষণ।দাদীবুও চোখ মুছতে মুছতে ঘরে ঢুকে গেল।মল্লিকা বলল,
“আপা আম্মার কাছে যাও।তাকে একবার গিয়ে জড়িয়ে ধরো।দেখবে সব রাগ অভিমান উধাও হয়ে যাবে।”
রুবা ছুটে মায়ের ঘরে চলে গেল।রুবেল এসে মেঘার কাঁধে হাত রেখে ওকে বিজয়ের প্রতীক দেখাল।মেঘাও হেসে দিল।আজ যেন বাড়িতে মেলা বসেছে। সারাদিন হই হুল্লোড় চলছে।বাড়িতে নতুন তিনজন মানুষ যোগ হচ্ছে।সবাই বাড়িটাকে সাজাচ্ছে নতুন আরো দুজন মানুষকে অভ্যর্থনা জানিয়ে বরণ করে নিবে বলে।খুশিতে আজ রুবা অনেক বছর পর কেঁদে ফেলল।
“এই ভাইয়া?আমরা কী ভুল এ্যাড্রেসে চলে এলাম?”
“ভুল এ্যাড্রেসে আসব কেন?ড্রাইভার নিজে নিয়ে এসেছে আমাদের।উনি কী ভুল জায়গায় নিয়ে আসবেন নাকি?”
“বিয়ে বাড়ির মত এভাবে সাজানো কেন?”
“জানিনা।”
“তুমি হাত থেকে ফোনটা রেখে ড্রাইভারের কাছে জিজ্ঞেস করো।”
“হ্যালো আঙ্কেল।এটাই কী আমাদের নানুবাড়ি?”
“জ্বী স্যার।আমরা চইলা আইছি।”
ড্রাইভার নেমে গাড়ির দরজা খুলে দিলো। ওরা দু ভাইবোন নেমে সামনে এগিয়ে যেতেই মল্লিকা,এলিনা,রুমেন সাহেব,রুবেল,আফিয়া আর বাড়ির পিচ্চিগুলো ওদের ঘিরে ধরল।ওদের সত্যি একদম বরণ করে ঘরে তুলল।সবাই তো মেয়েটার চেহারা দেখে অবাক।একদম মায়ের মত হয়েছে।কিন্তু ছেলেটার সঙ্গে চেহারায় একটুও মিল নেই রুবার।বাবার মতও তো হয়নি।তবে যাইহোক,ছেলেটা দেখতে ভারী সুন্দর হয়েছে।রুবেল একটু খুঁটেই খুঁটেই দেখছে ছেলেটার পা থেকে মাথা অবদি।রুবেল এভাবে ওকে দেখছে বলে ও রুবেলকে জিজ্ঞেস করল,
“আঙ্কেল কিছু বলবেন?”
“আরে বলার তো আছে অনেক কিছুই। চলো আগে ভেতরে তারপর কথা হবে।”
মেঘা তখন ওর দাদীমার পায়ে তেল মালিশ করছে ঘরে বসে।নাতনিদের আসার কথা শুনে দৌঁড়ে যেতে গিয়ে পা মচকে নিয়েছে।আর সেই পা কে মালিশ করতে হচ্ছে মেঘাকেই।আফিয়া দাদীবুর ঘরে দৌঁড়ে এসে বলল,
“ও আম্মা আপনার নাতনি দুটো তো একদম চাঁদের কণা গো।কী সুন্দর দেখতে হইছে গো।”
“কই রে আফিয়া ওদেরকে আমার কাছে একটাবার নিয়ে আয় রে।”
“দাদীবু তুমি এত অস্থির হইয়োনা।তুমি বসো ওরা এখনি চলে আসবে।”
মেঘা উঠে লিভিংরুমে গেল।
“বাবাহ্ সবাইতো একদম চাঁদেরহাট বসিয়েছে।আমার সাথে কেউ একটু কথাও বলিয়ে দিলোনা।”
পেছন থেকে চাচ্চু মেঘাকে ডেকে বলল,
“মেঘা তোর সঙ্গে কথা আছে।ওপরে আয়।”
“যাচ্ছি যাও।”
“আরে এখনি।এখানে কথাগুলো বলা যাবেনা।”
মেঘা চাচ্চুর কান্ড দেখে মাঝেমাঝে ভাবে এই লোকটার বয়স মোটেও ছত্রিশ নয়। ভাব-সাভ একদম চব্বিশ পঁচিশ বয়সের ছেলেদের মত।মেঘার ঘরে ঢুকে চাচ্চু মেঘাকে বলল,
“তুই কী আপার ছেলেকে দেখেছিস?”
“দেখলাম তো।কেন কী হয়েছে?”
“না কিছু হয়নি।তোর সেই ডিবির চেহারার বিবরণের সাথে আপার ছেলের চেহারার একটু মিল পাচ্ছিলাম।তাই জিজ্ঞেস করলাম।”
মেঘা নরমাল এক্সপ্রেশানে পড়ার টেবিলে বসে বই খাতা গোছাতে গোছাতে বলল, “মিল পাওয়ার কিছু নেই চাচ্চু।উনিই সেই।”
মেঘার বলার ভঙ্গী আর ও কথা শুনে রুবেল হা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।চাচ্চুর মুখের এমন ভাব দেখে মেঘা বলল,
“কাম অন চাচ্চু।এমনটা হওয়ার কথা ছিল আমার।তুমি এমন হা হয়ে থাকলে কেন?”
“তুই হচ্ছিসনা বলেই তো আমার হতে হলো।এই ব্যাপারটা এত স্বাভাবিকভাবে হজম করলি কী করে বলতো?”
টেবিলের উপর ভর দিয়ে মেঘার দিকে ঝুঁকে বলল চাচ্চু।মেঘা কিঞ্চিত হেসে বলল,
“আমি ব্যাপারটা হজম করেছি সেই সকালেই যখন ফুপির মেয়ে রুশাকে দেখি ওর রুমে।ধাক্কাটা সামলাতে একটু জোড় পেতে হয়েছিল।তবু সামলে নিয়েছি।কারণ তুমি তো জানোই এ বাড়িতে এমন ধরনের সম্পর্ক কোনোদিন মেনে নিবেনা।তাও যদি সে দূর সম্পর্কের ভাই হতো একটু চান্স পাওয়া যেত।কিন্তু না তাকে সোজা আমার দাদীবুর পেটের মেয়ের ছেলেই হতে হলো।আর তারউপর সকালে গাড়িতে আসতে আসতে ফুপি ওনার ছেলের সম্পর্কে যা সব গল্প করল তা শুনে আমার হয়ে গেছে।পুরো বাউন্ডুলে। তবে পথে ঘাটে ঘুরে বেড়ায় না।জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়।তারজন্য ফুপি তাকে কান ধরে দেশে নিয়েসেছে দেশের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে ছেলেকে ঘরে ফেরাবে। আর তার ছেলে কী বলে জানো?সে বাঙালী মেয়ে তো একদমই পছন্দ করেনা। ওরা নাকি খুব লোভী আর খারাপ প্রকৃতির হয়।সে দেশের মেয়ে বিয়ে করলেও সেই মেয়ের সাথে সংসার করতে হবে তার মাকে।সে যেমন ছিল তেমনই থাকবে।তাই বলে ফুপিও হাল ছেড়ে দেবেনা।এমন মেয়ে নিয়ে যাবে দেশ থেকে যার টানে তার ছেলে সুড়সুড় করে বউয়ের কাছে আসবে।তুমি ভাবো এই ছেলেকে নিয়ে আমার আর একটা মিনিটও আর ভাবা উচিত?”
চাচ্চু কড়া গলায় বলল,
“একদমই না। আমি তো এতকিছু শোনার পর ওই ছেলের জন্য তুই সুইসাইড এটেম্পট করলেও তুলে দিতাম না।”