#কাগজের_তুমি_আমি
#দ্বিতীয়_অধ্যায়
#৫ম_পর্ব
শেষবারের জন্য একটাবার কথা বলতে ইচ্ছে করছে। জানাতে ইচ্ছে করছে তার বাচ্চাকে বাঁচানোর উপায় খুঁজে পেয়েছে ধারা। কথাটা ভাবতেই ফোনটা হাতে নিলো ধারা। এতোদিন ফোন অফ করে রেখেছিলো ধারা। ফোনটা অন করতে না করতেই মোবাইল স্ক্রিনে দিগন্তের নামটি ভেসে উঠলো। ফোন রিসিভ করতেই ওপর পাশ থেকে শুনতে পায়,
– তাহলে অবশেষে ফোনটা রিসিভ করলে
দিগন্তের থমথমে গলার কথাটা শুনার মাত্র চোখের কোনে পানি জমতে লাগলো ধারার। ইচ্ছে করছিলো গলা ছেড়ে কাঁদতে, নালিশ করতে, বলতে দেখো আজ তোমার জন্য আমার কি অবস্থা। কিন্তু পরবর্তীতে দিগন্তের কথাগুলো শুনে সব যেনো গলাতে এসেই আটকে গেলো। ধারার উত্তরের অপেক্ষা না করেই দিগন্ত বলতে লাগলো,
– খুব তো ভালোই আছো, বিয়ে করছো শুনলাম। তা তোমার উড বি বর জানে তো ইউ আর নট ভার্জিন।
– মানে?
– মানেটা খুব সোজা, তুমি যে বিয়ের আগেই অন্য ছেলের বেডে উঠেছো, প্রেগন্যান্ট ও হয়েছো এই কথাগুলো কি তোমার হবু বর জানে? তোমার হবু বরের জন্য আমার সত্যি ই কষ্ট হচ্ছে। বেচারা তোমার সুন্দর মুখটা দেখে বিয়েতে রাজী তো হয়ে গেছে, কিন্তু সে তো জানে না তোমার এই ভালো মানুষী চেহারাটার পেছনে একটা চরিত্রাহীন নারী লুকানো। কি জাদু করে তাকে নিজের জালে ফাসিয়েছো?
দিগন্তের কথাগুলো এক একটা বিষতীরের মতো ধারার হৃদয়ে লাগছে। ঠোঁট চেপে কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে কিন্তু বেহায়া চোখ গুলো কারোর বাধন শুনতে নারাজ। নিজের মতোই বয়ে যাচ্ছে অবিরাম। এই মানুষটাকে সে বিশ্বাস করেছিলো, এই মানুষটাকে? বুক থেকে চাপা আর্তনাদ বের হচ্ছে। আবার কোথাও না কোথাও একটা প্রশান্তি ও আছে; সময় থাকতে দিগন্তের চেহারাটা তার দেখা হয়ে গেছে। তার সন্তান নাই চিনলো তার বাবাকে, এমন বাবাকে চেনার চেয়ে না চেনাটাই উত্তম। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধারা বললো,
– তুমি কি আমাকে এই কথাগুলো বলতেই ফোন দিয়েছো? আমিতো সেদিন বলেই দিয়েছিলাম, আমাদের নিয়ে তোমাকে আর ভাবতে হবে না। তাহলে কেনো ফোন করেছো?
– শুধু একটা প্রশ্নের উত্তর চাইতে, সেদিন আমার সামনে এতো সতী সাজছিলে, বাচ্চাটাকে তুমি নষ্ট করতে চাও না। তাহলে আজ ঠিক ই বাচ্চাটাকে নষ্ট করে বড়লোক কাউকে বিয়ে করার কথা চিন্তা করছো। শুনেছি সে একজন ভালো ডাক্তার। এটাই যদি তোমার মনে ছিলো তবে আমার সাথে সম্পর্কে জড়ালে কেনো? কেনো আমাকে নিজের মায়ায় বাধলে? আসলে আমার ই ভুল তোমার ইনোসেন্ট মুখটা দেখে কখনো ভাবি ই নি তুমি এতোটা স্বার্থপর হতে পারো। তোমার সরল মুখের পেছনের কুটিল ধারাকে বিশ্বাস করতে বেশ কষ্ট হচ্ছে।
দিগন্তের কথা জড়িয়ে যাচ্ছে, বারবার গলা ধরে আসছে। খুব কষ্ট হচ্ছে যা বলে বুঝাতে পারছে না। চোখগুলো জ্বলছে, বারবার ভিজে আসছে। রাগে, দুঃখে সব তছনছ করে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। ধারা কিছুক্ষণ চুপ থাকলো। এরপর নীরবতা ভেঙ্গে ঠান্ডা গলায় বললো,
– তুমি বারবার আমাকে অনুভব করিয়ে দাও আমি আবেগে ভেসে কতোটা বড় ভুল করেছি, ঠিক বলেছো আমি স্বার্থপর, খুব স্বার্থপর। আজ নিজের স্বার্থপরতার কারণে আমার এই পরিণতি। তবে কি জানো আমার মনে কোথাও একটা খারাপ লাগা কাজ করছিলো, তোমাকে ঠকাচ্ছি নাতো এটা ভেবে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বেশ করেছি বিয়েতে রাজী হয়ে। যাকে আমি বিশ্বাস করে সর্বস্ব দিতেও পিছ পা হই নি সেই মানুষটা যখন আমাকে নিয়ে এতো বাজে কথা বলতে পারে, তখন আমার সত্যি নিজের উপর ধিক্কার দিতে ইচ্ছে হয়। কি ভুলটাই না করেছি। যাক আমার মতো কুটিল মেয়ে তোমার জীবনে আর কোনোদিন কোনোকিছুর দাবি নিয়ে দাঁড়াবে না। আশা করি সুখে থাকবে। আর আমার বিয়ে এসো। সত্যি আমি একজন ভালো মানুষকে নিজের জালে ফেলেছি। তাকে দেখেও যেও সাথে বিয়েটাও খেয়ে যেও। রাখছি।
বলেই ফোনটা রেখে দেয় ধারা। সেখানেই ধপ করে বসে পড়ে সে। পেটে হাত দিয়ে ধরা কন্ঠে বলে,
– আমি ওকে কোনোদিন জানতে দিবো না তোর অস্তিত্ব। কোনোদিন না। সে যদি মনে করে তুই নেই, তবে তাই সই। তাই সই
বলেই হু হু করে কেঁদে উঠলো সে। অপরদিকে রাগে ক্ষোভে হাতে থাকা ফোনটা ছুড়ে ফেলে দিগন্ত। নিজের ব্যাথিত মনকে কিছুতে শান্ত করতে পারছে না। সব কিছু একটা সপ্তাহে উলট পালট হয়ে গেলো। কেনো যেনো সব কিছু এলোমেলো লাগছে। ধারাকে সে সত্যি ভালোবেসেছিলো, খুব ভালোবেসেছিলো। এমনটা কেনো করলো ধারা এটা ভেবেই বুকটা হু হু করে উঠছে দিগন্তের। চোখটা বন্ধ করলেই সেই শুভ্র নারীর প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠছে। রাগ উঠছে কিন্তু তার চেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছে দিগন্তের। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে একের পর এক দেয়ালে আঘাত করছে কিন্তু মনকে শান্ত করতে পারছে না। কিছুতেই না_______
__________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________
সন্ধ্যা ৭টা,
স্থানঃ ধারাদের বাসা
হলুদের অনুষ্ঠান খুব না হলেও মোটামোটি জাকজমকভাবেই হচ্ছে। সেলিম সাহেবের যদিও এতোটা জাকজমক ভাবে করার ইচ্ছে ছিলো না। কিন্তু সুভাসিনী বেগমের একটাই কথা, তার একমাত্র ছেলের বিয়ে বলে কথা, সে কোনো কমতি রাখবে না। আর ধারার জীবনে ও এই বিয়েটা প্রথমবারই হচ্ছে সুতরাং এসব সাদামাটাভাবে বিয়ের আয়োজন তার একেবারেই পছন্দ হয় নি। সেলিম সাহেবের আপত্তি ছিলো যেহেতু এখন ধর্মীয়ভাবে বিয়েটা গ্রহণযোগ্য নয়, তাই লোক দেখানো আয়োজনের কি দরকার। কিন্তু সুভাসিনী বেগমের কথা তখনের কথা তখন দেখা যাবে, দরকার হলে বাচ্চাটা হবার পর আরো ধুমধাম করে তাদের বিয়ে দিবেন। সুভাসিনী বেগমের আগ্রহ দেখে অনল ও কোনো আপত্তি জানায় নি। তার মাকে এতোটা খুশি বিগত ক বছরে দেখেছে কিনা সন্দেহ আছে। তার মাকে প্রাণবন্তভাবে হাসতে দেখে তার ও মনে একটা স্বস্তি কাজ করছে, বিয়ের বুদ্ধিটা এতোটাও খারাপ নয়।
ধারার রুমে যেতেই সুভাসিনী বেগম দেখলেন, তার বান্ধবীরা তাকে সাজাতে ব্যস্ত। কাঁচা হলুদ কাতানের শাড়িতে কি অপরুপ লাগছে ধারাকে। ফর্সা গায়ে হলুদ রংটা যেনো মিলে আছে। সুভাসিনী বেগম নিজে পছন্দ করেছেন এই শাড়িটা। চোখে মোটা করে কাজল দিয়ে দিয়েছে, ঠোটে কড়া লাল লিপস্টিক, গা ভর্তি সাদা ফুলের গহনা। কাল অবধি মেয়েটাকে একটা জ্যন্ত লাশের মতো লাগছিলো তার কাছে। কিন্তু আজ কি মায়াবীটাই না লাগছে। কিন্তু মুখটা তবুও শুকনো করে রেখেছে। অন্যমনস্ক হয়ে জীবনের হিসাব মিলাতে যেনো ব্যস্ত। কাছে যেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে গলায় বললেন,
– আমার বউমাটাকে কি মিষ্টি না লাগছে
সুভাসিনী বেগমের কথাটা কর্ণপাত হতেই মাথা তুলে তাকায় ধারা। ছলছল নয়নে তার প্রতি অনুগত প্রকাশ করে সে, আজ তার জন্যই ধারার বাচ্চাটা নতুন জীবন পাওয়ার আশ্বাস পেয়েছে। সুভাসিনী বেগম মুচকি হাসি দিয়ে বলেন,
– নতুন বউ এর কি কাদতে আছে রে পাগলী
– তুমি এতো ভালো কেনো ফুপি?
সুভাসিনী বেগমের মাজা জড়িয়ে বলে ধারা। সুভাসিনী বেগম তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,
– আমি ভালো নই রে, খুব স্বার্থপর। নিজের স্বার্থে তোকে আমার ঘরে তুলে নিয়ে যাচ্ছি। বয়স তো কম হলো না, ছেলেটার জীবনটা সাজিয়ে দিতে চাই। আমার বিশ্বাস তুই পারবি ধারা, আমার ইট পাথরের বাড়িটাকে সংসার করে তুলতে। কাঁদিস না। এখনও অনেক লড়াই বাকি
সুভাসিনী বেগমের কথাগুলোর মর্ম ধারার বোধগম্য হলো না। অবাক নয়নে শুধু দেখতে লাগলো তাকে। তার চোখে একটা শুন্যতার ছোঁয়া আছে যা ধারার হৃদয়কেও নাড়িয়ে দিলো___
হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হলে বর, কনেকে একই সাথে স্টেজে আনা হলো। পাশাপাশি বসে রয়েছে অনল, ধারা। আড় চোখে একবার একে অপরকে দেখে নিলো তারা। অনলকে বেশ মানিয়েছে সাদা পাঞ্জাবিতে, তার উপরে একটা কোটি পরা। হাতা কনুই অবধি ফোল্ড করে রেখেছে, হাতে কালো একটা টাইটান ঘড়ি। চুল গুলো বেশ সুন্দর করে স্টাইল করে রেখেছে সে। অনলের সাথে চোখে চোখ পরতেই চোখ সরিয়ে নিলো ধারা। যেনো চোর ধরা পরেছে, এমন লাগছে নিজের কাছে। সবাই একে একে হলুদ দিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ একটি মেয়ে স্টেজে উঠতেই অনলের মুখের ভাব বদলে গেলো। ধারার কাছে মেয়েটিকে বেশ চেনা চেনা লাগছিলো। অনলের গালে হলুদ দেওয়ার সময় ধীর কন্ঠে বললো সে…………
চলবে