কাগজের তুমি আমি পর্ব-০৬

0
2292

#কাগজের_তুমি_আমি
#দ্বিতীয়_অধ্যায়
#৬ষ্ঠ_পর্ব

হঠাৎ একটি মেয়ে স্টেজে উঠতেই অনলের মুখের ভাব বদলে গেলো। ধারার কাছে মেয়েটিকে বেশ চেনা চেনা লাগছিলো। অনলের গালে হলুদ দেওয়ার সময় ধীর কন্ঠে বললো সে,
– তাহলে বিয়েটা করছো! তোমার বিয়েতে দাওয়াতি হিসেবে আসবো ভাবি নি। অভিনন্দন রইলো।

খুব ধীরে বললেও ধারার কানে ঠিক ই গেলো কথাগুলো। মেয়েটির চোখ চিকচিক করছে। যেন এখনই অশ্রুধারাগুলো মুক্তি দিয়ে দিবে তার চোখ জোড়া। অনল নির্বিকারভাবেই বসে রয়েছে। ধারা একবার অনলের মুখ আর একবার মেয়েটির মুখ পানে চাওয়া চাওয়ি করছে। মনের মধ্যে একরকম অস্বস্তি কাজ করছে, মেয়েটির সাথে অনলের কি সম্পর্ক এটা জানার কৌতুহলে মনটা বারবার ব্যাহত হয়ে উঠছে। সে কি তার অনল ভাই এর জীবনে একটি অবাঞ্ছিত কাঁটা রুপে এসেছে! বুঝতে পারছে না। এতো সুন্দর সুপুরুষের কোনো প্রেমিকা থাকবে না এমনটা ভাবাও হয়তো বোকামি হবে।
– ধন্যবাদ আসার জন্য মাহি, ভেবেছিলাম তুমি আসবে না। তুমি আসাতে খুব ভালো লাগলো, আমাদের জন্য দোয়া করো। শামিম, রাফিদরাও এসেছে। তুমি ওদের সাথেই থেকো।

অনলের হাসিমুখে কথাগুলো শুনে আবার চিন্তায় পড়ে গেলো ধারা। লোকটা এমন ভাবে কথা বলছে যেনো মাহি নামক মেয়েটার উপস্থিতি তার কাছে ব্যাপার ই নয়, তার কিছুই যায় আসে না। মাহি মুখে মলিন হাসি একে ধারার উদ্দেশ্যে বললো,
– তুমি অনেক লাকি, অনল ভাই এর মতো একজনকে স্বামী হিসেবে পাচ্ছো। আমরা তো ভেবেছিলাম সারাজীবন একা একা ই কাটিয়ে দিবে সে। খুব জানার ইচ্ছে হয় কি জাদু করেছো সে অনল ভাই পুরো ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে গেলো। অবশ্য কিছুটা হলেও আঁচ করতে পারছি, যাক গে নিজের খেয়াল রেখো সাথে বাবুর ও। মাত্র তিন সপ্তাহ চলছে তো, এই সময় একটু রিস্ক থাকে।

বলেই মাহি স্টেজ থেকে নেমে গেলো। অনল চোয়াল এখনো শক্ত করে বসে রয়েছে, মাহির কথাটাগুলো তার পছন্দ হয় নি। ধারা মাথা নিচু করে আছে, এখন সে মেয়েটিকে চিনতে পেরেছে। মাহি তার কন্সাল্টেড ডাক্তার। তাকে চেকাপ সেই করেছে। কিন্তু হাসি মুখেও কিছু ঠেস মারা কথা বলেদিলো মেয়েটি। তার চোখে অনলের জন্য অন্য অনুভূতি অনুভব করলো ধারা। সে তো মেয়ে, একটা মেয়ের চোখ পড়া এতোটাও কঠিন নয় তার জন্য। খুব ইচ্ছে করছিলো অনলকে কিছু জিজ্ঞেস করতে, কিন্তু অনলের ওই এক দোষ; জিজ্ঞেস করলে ট্যারা কিছু কথা শুনিয়ে দিবে যা একেবারেই সহ্য হবে না অনলের। তাই মুখে কলুপ এটে বসে থাকাই শ্রেয়।

হলুদের অনুষ্ঠান প্রায় শেষের দিকে, অতিথিরা সবাই যে যার মতো চলে যাচ্ছে। অনল নিজেই তাদের বিদায় দিচ্ছে। সবাইকে বিদায় দিতে দিতে শামিম, রাফিদ, মাইসার সাথে দেখা। বেশ হাসি তামাশা করলো তারা। এরা তার হাসপাতালের কলিগ। বেশ ভালো সম্পর্ক তাদের সাথে তার। মাহিও আছে তাদের মধ্যা। মাহি একটা কথাও বললো না। সবাই সামনে এগোলে মাহি বলে উঠলো,
– তোমার সাথে কিছু কথা ছিলো, সময় হবে?
– কাজের কথা? প্যাশেন্ট রিলেটেড?
– নাহ, কিছু প্রশ্নের উত্তর চাই

অনলের বুঝতে বাকি রইলো না মেয়েটা কি বলতে চায়। সম্মতি জানিয়ে একটা ফাঁকা জায়গায় নিয়ে গেলো মাহিকে অনল। বেশ থমথমে গলায় মাহিকে বললো সে,
– বলো, কিসের উত্তর?
– আমি তো ভেবেছিলাম তুমি এমন পুরুষ যে একজনকে ভালোবাসলে যত কিছু হয়ে যাক না কেনো তার জায়গাটা কাউকে দিবে না। কিন্তু এখন তো দেখছি সেরকম কিছুই না

মাহির কথাটা কর্ণপাত হতেই বেশ ভ্রু কুচকে তার দিকে তাকায় অনল। মেয়েটাকে হাজারো বার বুঝালেও কেনো যানে তার মাথায় কিছু ঢুকে না হয়তো। ঠেস মারা কথায় যখন কিছু করতে পারে নি এখন অনলের কাটা ঘায়ে আঘাত করে মেজাজ তুঙ্গে তুলে দিলো অনলের। চোয়াল ক্রমশ শক্ত হতে লাগলো অনলের, চোখগুলো লাল হতে লাগলো। তার অতীতের ক্ষত এখন ও ততোটাই তাজা যতটা তখন ছিলো। মানুষের সামনে স্বাভাবিক মানুষের ন্যায় থাকলেও এখনো সেই ক্ষত বয়ে বেরোচ্ছে সে। অতীতের সুবর্ণ কথাগুলো মনে পড়তেই বুকটা হাহাকার করে উঠলো। শুন্যতা তাকে এতোটা কঠোর ভাবে জাকড়ে রেখেছে যে চাইলেও সেখান থেকে বের হতে পারবে না। বেশ ঠান্ডা থমথমে গলায় অনল প্রশ্ন ছুড়লো মাহির দিকে,
– কথাগুলোর মর্ম আমার মোটা মাথায় ঢুকছে না মাহি। তুমি এমনভাবে বিহেভ করছো যেনো আমি তোমাকে চিট করেছি বা তুমি আমার এক্স। এজ এ কলিগ, কথাগুলো বড্ড বেমানান হয়ে যায় না।

অনলের কথায় অনেকটা অপমানিত বোধ হয় মাহির। কথাগুলো সে এভাবে বলতে চায় নি। বারংবার অনলের কাছে তাকে অপমানিত হতে হয়। মাহি অনলের মেডিক্যাল কলেজের জুনিয়র। অনলের প্রতি তার অনুভূতিগুলো বরাবর ই তীব্র ছিলো। সে অনলকে এর আগেও নিজের মনের অনুভূতিগুলো ব্যক্ত করেছে কিন্তু অনল সবসময়ই নিজের বক্তব্য এ অনড়। নিজের বেহায়াপনায় নিজের ই লজ্জা লাগছে মাহির। চোখ নিচু মাহিকে অনলের ও ভালো লাগছে না। নিজের কন্ঠ স্বাভাবিক করে বলে সে,
– তোমার প্রশ্নটা এখনো করা হয় নি
– ধারাই কেনো? তুমি তো বলেছিলে তোমার মনে কোনো নারীর প্রবেশ ঘটবে না। তাহলে ধারা কেন?

বেহায়ার মতোই ভাঙ্গা কন্ঠে বলে উঠলো মাহি। মানুষকে এই ভালোবাসা নামক হৃদয় হর্ষক শব্দটা অনেকটাই বেহায়ার মতো বানিয়ে দেয়। মাহির ক্ষেত্রেও সেটাই খাটছে। মাহির এমন প্রশ্নে বেশ অপ্রস্তুত হয়ে হয়ে পরে অনল। সত্যি ই তো সেতো বলেছিলো কাউকে নিজের মনে ঠায় দিবে না। তার মনে একজন ই থাকবে, কিন্তু আজ ঠিক ই ধারাকে তার বউ এর জায়গা দিতে হচ্ছে। মানু্ষ তো বুঝছে না কি সংঘর্ষ মনের সাথে চলছে অনলের। যদিও মনকে সামলাতে বলছে না সে কখনোই ধারাকে মনে ঠাই দিবে না। কিন্তু একটা সুপ্ত ভয় থেকেই যাচ্ছে।
– কি হলো উত্তর দিচ্ছো না যে? যদি এটাই তোমার সাথী হতে করা লাগতো তবে আমিও তো করতেই পারতাম

মাহির কথাটা শুনে বেশ হতবাক হয়ে যায় অনল। বেশ কড়া কন্ঠেই বলে,
– এজন্য আমি ধারাকে বিয়ে করছি। সে তোমার মতো নিচ চিন্তা করে না। ভালোবাসে বলে কাছে এসেছে। আর কোনোই অন্তমর্ম তার ছিলো না। সে কাছে এসেছে কারণ আমি চেয়েছি। আর একটা কথা, ধারা আমার জীবনে না থাকলেও আমি তোমাকে নিজের ছোট বোনের মতোই দেখতাম। আমার তোমার প্রতি কখনোই কোনো অনুভূতি ছিলো না, হবেও না। রাত অনেক হয়েছে আস্তে পারো।

অনলের কথাগুলোয় পুনরায় অপমানিত বোধ হলো মাহি। তার উত্তর গুলো সে পেয়ে গেছে। মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে মাহির। ছুটে সেখান থেকে বেরিয়ে গেলো সে। দরজায় কোনায় দাঁড়িয়ে সব শুনছিলো ধারা। মুখ চেপে কান্না আটকালো সে। আজ তার জন্য অনলকে এমন কথাগুলো শুনতে হলো। যে পাপ সে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে আজ সেই পাপের অংশীদার অনল নিজেকে দাবি করছে। এই পাপের বোঝাটা সারাটাজীবন তাদের মাঝে থাকবে। সারাটাজীবন অনলের কাছে ছোট হয়ে গেলো ধারা।
– তুই তো মানুষ ভালো না, বউ হওয়ার আগেই টিপিক্যাল বউদের মতো স্পাইগিরি করছিস।

কথাটা কানে আসতেই…..

চলবে