কাগজের তুমি আমি পর্ব-১৬

0
2770

#কাগজের_তুমি_আমি
#দ্বিতীয়_অধ্যায়
#১৬তম_পর্ব

বর্তমান,
অনলের গলা ধরে গেছে। অনল কথা থামিয়ে চুপ করে থাকে। ধারার চোখ বারবার ভিজে যাচ্ছে। অনলের কথাগুলো শুনে বুকের মাঝে একটা চিনচিনে ব্যাথা অনুভব হতে থাকে ধারার। হঠাৎ আনমনেই অনল বলতে থাকে,
– জানিস ধারা, অনন্যা ই প্রথম নারী যাকে আমি “ভালোবাসি” কথাটা বলেছিলাম। এবং সেটাই আমার প্রথম এবং শেষ “ভালোবাসি” বলা ছিলো। অনন্যা সব সময় আমাকে একটা প্রশ্নই জিজ্ঞেস করতো,
“ভালোবাসো”
আমি কখনো সেটার উত্তর দিতে পারতাম না। যখন ও আমায় ছেড়ে চলে গেলো আমি চিৎকার করে ভালোবাসি বলেছি ওকে; কিন্তু ও ফিরে আসলো না। এই হাত দুটোতে ওর নিথর দেহটা ছিলো। আমার নিজেকে তখন পৃথিবীর সবথেকে অপারগ ডাক্তার লাগছিলো। আমি চেয়েও কিছুই করতে পারছিলাম না। এখন বারবার মনে হয় কেনো ভালোবাসি বলতে গেলাম। সেদিন যদি না বলতাম হয়তো অনন্যা আমাকে ছেড়ে যেতো না। ওর অবস্থা বেশ স্টেবল ছিলো জানিস। আমি কি ভুল করেছিলাম যে আল্লাহ অনন্যাকে কেড়ে নিলো। অনন্যা আমার রুক্তে মিশে ছিলো জানিস। ও না অন্য মেয়েদের মতো ছিলো না, আমার চোখ দেখেই বুঝে যেত আমার কোথায় কষ্ট। যেদিন তোর সাথে আমার বিয়ে হয় আমি ওর সাথে অনেকক্ষণ কথা বলেছিলাম। ও হাসপাতালে ভর্তির সময় শুধু বলতো, ওর কিছু হলে যাতে আমি একা না থাকি, ওর নাকি কষ্ট হবে তাতে। আচ্ছা আমার সাথে এমন কেনো হয় বলতো!!

অনলের পাগলের প্রলাপ গুলো চুপ করে শুনছিলো ধারা। অনলের জীবনের সাথে এতোকিছু হয়েছে ব্যপার গুলো ধারার অজানা ছিলো। তখন ও মাত্র এস.এস.সি পাশ করে কলেজে উঠেছিলো। অনলের কলমা হয়ে গেছে ব্যাপার গুলো তার বাবা-মা জানলেও সে জানতো না। তার অনল ভাই এর বিয়ে ঠিক হয়েছে, ধুমধাম করে বিয়ে হবে ব্যাপারটা তার জানা ছিলো কিন্তু পরে বিয়েটা কেনো হলো না এটা কখনো জানা হয় নি। আসলে যাকে জমের মতো ভয় পেতো তার পারসোনাল ব্যাপারে কখনোই ধারার ইন্টারেস্ট ছিলো না। একবার শুনেও ছিলো অওভার ড্রাগ করে আই.সি.উ তে ভর্তি হয়েছে অনল। ভেবেছিলো অনলের এসব কাজের কারণে বউ পালিয়ে গেছে। এখন সুভাসিনী বেগম এবং সুরাইয়া বেগমের কথাগুলোর মর্ম বুঝতে পারছে। অনলের জীবনে এতো কিছু হয়ে গেছে সেটা না জানার আফসোসটা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে ধারাকে। তখন অনল ধীর কন্ঠে বলে,
– তোকে আমি কখনোই বিয়ে করতে চাই নি, অনন্যার জায়গা আমি তোকে কেনো কাউকে দিতে পারবো না। কিন্তু মা বলেছিলো তোকে বিয়ে করলে হয়তো আমি বাঁচার কোনো কারণ পাবো। মা সত্যি বলেছিলো। আজ যখন তোর বাচ্চার হার্টবিটটা শুনেছি, তুই ইমাজিন করতে পারবি না আমার বুকের মাঝে কি অনুভব হচ্ছিলো। অনন্যা যাবার পর এই প্রথম আমি সুখ অনুভব করেছিলাম। আবার ইচ্ছে হয়েছিলো আমি কারোর জন্য আমি বাঁচি। তোর বাচ্চাটা যেনো আমার সব দুঃখের মলম, ওকে কেন্দ্র করে আমি বাঁচতে পারবো। তুই আমাকে একটা কথা দিবি? তুই তোর বাচ্চাকে কখনো আমার কাছ থেকে কেড়ে নিস না। আমি ওকে কেন্দ্র করে বাঁচতে চাই ধারা। আমি বাঁচতে চাই।

ধারার হাতদুটো নিজের মুঠোতে নিয়ে কপাল থেকে বলতে থাকে অনল। সে কাঁদছে। সাথে ধারাও। আজ অনলের কষ্টগুলো ধারা অনুভব করছে নিজের হৃদয় দিয়ে। হয়তো এই অশ্রুই তাদের সম্পর্কের সূচনা ঘটাচ্ছে যেখানে দুজন একটা সুতোয় বাধা, ধারার অনাগত সন্তানটি হয়তো তাদের সেই সুতো________

রাত ৮টা,
অনল ধারা কেউ ফোন ধরছে না দেখে বেশ চিন্তায় পড়ে গেলেন সুভাসিনী বেগম। এমনেই তাদের মধ্যে কিছু ঠিক নেই। এর উপরে সেই দুপুরে বের হয়েছে এখনো ফিরার নাম নাই। টেনশনে তার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। বলা তো যায় না; বিপদের তো হাত পা নেই। আর ধৈর্য ধরতে না পেরে অনলকে ফোন দেন সে। অনল ফোন ধরছে না বলে তার টেনশন যেনো আরো বেড়ে গেছে। না জানি অনল ধারা কোথায় আছে!!

রাস্তায় পাশাপাশি হাটছে অনল ধারা। দুজনের চোখ মুখ ফুলে রয়েছে। দুঃখের ভার কমিয়ে বাড়ির পথে রওনা দিয়েছে তারা। নিতান্ত পরিবহণ না পাওয়ার জন্য হাটা লাগছে তাদের। বহুদিন পর আবার কেঁদেছে অনল। তবে মনটা বেশ হালকা লাগছে। অনল ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না এই অনুভূতিটা কেনো হচ্ছে? বহুদিন পরে কেঁদেছে বলে নাকি ধারাকে নিজের চাঁপা কষ্ট গুলো খুলে বলেছে বলে; উত্তরটা তার জানা নেই, খুজতেও চায় না অনল। হঠাৎ খেয়াল করলো ধারা রাস্তার এক কোনায় দাঁড়িয়ে পড়েছে। অনল কাছে যেতেই দেখে সে লোভনীয় দৃষ্টিতে ফুচকার ঠেলার দিকে তাকিয়ে আছে। অনল হালকা ধাক্কা দিয়ে বললো,
– কি হইছে? পা আটকে গেছে নাকি রাস্তায়? চল হাটি একটা রিক্সা পাইলে উঠে যাবো৷
– অনল ভাই

ধারার মুখের করুণ স্বরে ডাক শুনে পেছনে ফিরে তাকায় অনল। ধারাকে একটা কিউটের ডিব্বা লাগছিলো অনলের কাছে। খুব হাসি পাচ্ছিলো তখন অনলের। ঠোঁট চেপে হাসি আটকে বললো,
– কি হয়েছে?
– আমাকে একটু ফুচকা কিনে দিবে? তোমার তাড়াহুড়োর জন্য পার্সটাও আনি নি। আমার খুব ফুচকা খেতে মন চাচ্ছে।

চোখ কুচকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি প্রয়োগ করে অনল বললো,
– কতোটা আনহাইজিনিক জানিস? আমার প্রিন্সেস কোনো আনহাইজিন খাবার খাবে না।
– হ্যা?? কে বলেছে আনহাইজিন? সারাজীবন খেয়ে বড় হলাম কই তখন তো হাইজিন ওর আনহাইজিনের কথা ভাবি নি। আর এক মিনিট মাত্র তো সাত সপ্তাহ এর একটু বেশি হয়েছে বাবুর বয়স। জানলে কি করে সে প্রিন্স না প্রিন্সেস?
– আমি জানি, ও প্রিন্সেস ই হবে। যাক গে জিভ থেকে লোল না ফেলে চল তাড়াতাড়ি। মোবাইলের নেটওয়ার্ক ও নেই। মা টেনসন করবে।
– এক প্লেট ফুচকা, এর পর জোরে জোরে হাটবো। প্রমিস
– একটা ও না। পরে আমাশা হয়ে বাথরুমে দৌড়াতে হবে। আর এখন মিসক্যারেজ হবার চান্স অনেক বেশি। আমি চান্স নিতে চাই না। মাত্র ওর হার্ট বিট পাওয়া গেছে। সি ইজ নট থ্যাট মাচ স্ট্যাবল।

বলেই হাটা শুরু করলো অনল। ধারার খুব ফুচকা খেতে মন চাচ্ছিলো। কিন্তু এই পাজি লোকটা, উফফ সব কিছু তার মতো হওয়া চাই। কেনো বাবা একটু ফুচকা খেলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত? না তার প্রিন্সেস নাকি আনহাইজিনিক জিনিস খাবে না। ধুররর ভালো লাগে না। এই খচ্চর লোকটা সারাক্ষণ দাদাগিরি করে। ধারার ইচ্ছে হচ্ছিলো অনলের মানিব্যাগটা মেরে ফুচকা খেতে। পরমূহুর্তে মনে হলো, সে যা করবে বাচ্চাও তাই শিখবে। আর নিজের বরের পকেট মারাটা কেমন হয়ে যাবে না!!
– আমাকে গালানো শেষ হলে কষ্ট করে কি হাটবেন?

অনলের কথা কানে আসতেই তাড়াতাড়ি হাটা শুরু করলো ধারা। এই লোক কিভাবে জানে মন ও পরতে পারে। সাংঘাতিক লোক!! লোকটার জন্য মনে মনেও কিছু চিন্তা করা দায় হয়ে উঠেছে ধারার___

যখন বাসায় পৌছায় তারা, তখন ঘটির কাটার নটা ছুই ছুই। সুভাসিনী বেগমের কাছে ধুমায় বকা খেতে হয়েছে অনল ধারাকে। এতোক্ষণ চিন্তায় অস্থির হয়ে ছিলেন তিনি। প্রেগ্ন্যাসির সময় কিছু খাওয়ার ক্রেভিং উঠলে সেটা থামানো অনেক কষ্টকর হয়ে যায়। ধারার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। ফুচকা খাবার ইচ্ছেটা এখনো বেশ প্রবল ভাবে জেকে বসেছে মাথায়। উপরে ফুপির বোকায় আরো মন খারাপ হতে লাগে তার। মুখ কাচুমাচু করে মাথা নিচু করে রাখলে সুভাসিনী বেগম বলেন,
– হয়েছে বর কে বকছি বিধায় তোমার মাথা নিচু করা লাগবে না। রুমে যেয়ে ফ্রেস করে নাও।

ধারাও ভদ্র বাচ্চার মতো রুমে চলে যায়। ফুপিকে তো বোঝাতে পারছে না তার যে ফুচকা খাবার ক্রেভিং উঠছে। ধারার রুমে যাবার পর ই অনল বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। ছেলেটাকে আজ অন্য রকম লাগছে সুভাসিমী বেগমের। কেনো যেনো মনে বেশ প্রশান্তি লাগছে সুভাসিনী বেগমের। আজ ছেলেটার চোখ মুখে নতুন করে বাঁচার ইচ্ছের ঝলক ছিলো। তবে কি তার ছেলে অনন্যার স্মৃতিকে ফেলে সামনে এগিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে!!

রাত ১১টা,
অনল এখনো ফিরে নি, ধারার বেশ চিন্তা লাগছে। লোকটা সেই বেরিয়েছে এখনো আসার নাম নেই। সুভাসিনী বেগমকে জোর করে ঘুমাতে পাঠিয়ে দিয়েছে সে। বেশি রাত জাগা তার স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়, বয়স হয়েছে বলে কথা। তাই ধারাই অনলের ফিরার অপেক্ষা করবে। লোকটা ফোন ও নিয়ে যায় নি। চিন্তার প্রহর যেন কাটছেই না। তখনই কেঁচিগেট খোলার শব্দ পায় ধারা। দরজায় বেল বাজার আগেই দরজা খুলে দাঁড়িয়ে যায় সে। অনল তখন কেবল সিড়িতে। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত অবস্থায় সিড়ি দিয়ে উঠতেই খেয়াল করলো একজন রমনী দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ মনে হলো যেনো অনন্যাই দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। পরমূহুর্তেই চোখের ভুলটা ধরা পড়ে যায়। দরজা ধরে অনন্যা নয় ধারা দাঁড়িয়ে আছে। নীল শাড়িতে মেয়েটাকে খুব সুন্দর লাগছে। নিজের অবাদ্ধ মনকে খুব ক্রে কড়া শাসন করে দিলো অনল। আজকাল মনটা ধারার মাঝে অনন্যাকে খুজছে। এটা তো কখনোই সম্ভব না। ঘরে ঢুকতেই বেশ শাসানো গলায় বলে উঠে ধারা,
– একটু তো বুদ্ধি নিয়ে কাজ করবা নাকি? একটু ফোনটা সাথে নিয়ে গেলে কি হতো। ফুপি চিন্তা করছিলেন। আমি জোর করে তাকে শুতে পাঠিয়ে দিয়েছি। মানুষের চিন্তা হয় তো নাকি, রাত কটা বাজে খেয়াল আছে?

তখন ই……..

চলবে