কাগজের তুমি আমি পর্ব-১৭

0
2464

#কাগজের_তুমি_আমি
#দ্বিতীয়_পর্ব
#১৭তম_পর্ব

নিজের অবাদ্ধ মনকে খুব কড়া শাসন করে দিলো অনল। আজকাল মনটা ধারার মাঝে অনন্যাকে খুজছে। এটা তো কখনোই সম্ভব না। ঘরে ঢুকতেই বেশ শাসানো গলায় বলে উঠে ধারা,
– একটু তো বুদ্ধি নিয়ে কাজ করবা নাকি? একটু ফোনটা সাথে নিয়ে গেলে কি হতো। ফুপি চিন্তা করছিলেন। আমি জোর করে তাকে শুতে পাঠিয়ে দিয়েছি। মানুষের চিন্তা হয় তো নাকি, রাত কটা বাজে খেয়াল আছে?

তখনই অনল হাতের বাজারের ব্যাগ ধারার হাতে ধরিয়ে দেয়। হিনহিনে গলায় বলে ধারাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
– যার জন্য করি চুরি সে বলে চোর, বাহ কি নিষ্ঠুর দুনিয়া। নে নে ধর
– আমার জন্য তুমি চুরি করতে গেছিলে বুঝি? সেখান থেকে এতো এতো বাজার নিয়ে এসেছো।

ধারার কথা শুনে চোখ মুখ খিচে তীক্ষ্ণ গলায় বললো অনল,
– খিক খিক হাসা থামিয়ে খাবার দে, ক্ষিদেয় পেটের ইদুরগুলো নাচানাচি শুরু করে দিয়েছে। আর শোন ।

রান্না ঘরে যেতে যেয়েও থেমে গেল ধারা। পেছন ফিরলে অনল বলে উঠে,
– ফুচকার সব সরঞ্জাম নিয়ে এসেছি। খাওয়ার পর বানিয়ে দিচ্ছি।
– তুমি বানাবে ফুচকা?
– তোমার ওই ঠেলামামার থেকে ভালোই বানাবো। না জানি আদৌ হাত ধোয় কি না। আমার প্রিন্সেসের ব্যাপারে আমি কোনো রিস্ক নিতে চাই না। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। তুই খাবার গরম কর।

বলেই নিজের রুমে রওনা দিলো অনল। ধারার কোনো কথা শোনার অবকাশ আছে তার। সে তো তার মতো করেই ভাববে আর সেভাবেই কাজ করবে। ধারা মুচকি হেটে রান্না ঘরে বাজার গুলো খুলতে লাগলো। এলাহি কান্ড করেছে অনল। ধারার যা কিছু খেতে ভালো লাগে সব কিনে এনেছে। সাথে তেতুল, জলপাই, চালতা। আচার বানানোর কোনো সরঞ্জামের কমতি রাখে নি। ধারার মনে মনে হাসি ই পেলো। লোকটা দু ঘন্টা যাবৎ এই মহান কাজ করেছে। লোকটার উপর মাঝে মাঝে খুব রাগ উঠে ধারার, মনে হয় রাগে মাথাটাই ফাটিয়ে দিবে সে। আবার মাঝে মাঝে এতোটা ভালো লাগে যে বলে বোঝানো যাবে না। যেমনটা এখন লাগছে। এক অজানা ভালোলাগায় মনটা ভরে যাচ্ছে। এটা কি মুড সুইং এর অংশ নাকি অন্য কিছু সে জানে না, হয়তো জানতে চায় ও না।

রাত ১২টা,
রান্নাঘরের টুলের উপর পা উঠিয়ে বসে আছে ধারা। আর সামনে বেশ ঢাল তলোয়ার নিয়ে ফুচকা বানানোর প্রচেষ্টা করে যাচ্ছে অনল। ইউটিউব থেকে ভিডিও দেখে দেখে বানাচ্ছে সে। ধারা যখনই সাহায্য করতে চাইছে তখন বজ্রকন্ঠে বকা শুনতে হচ্ছে। তাই বৃথা চেষ্টা করা থামিয়ে চুপচাপ বসে রয়েছে সে। মটর সিদ্ধ করে আলু সিদ্ধতে দিয়েছে অনল। হঠাৎ দেখলো ধারা রীতিমত হাই তুলছে। ব্যাস হুংকার দিয়ে বলে উঠলো,
– অই আমি এখানে ঘেমে একাকার আর তুই বসে বসে হাই তুলছিস?

অমনি যেই হাইটা বের হতো সেটা আবার ভেতরে নিয়ে ধারা বললো,
– আজিব আমি কি তোমাকে বলেছি গরমের মধ্যে ফুচকা বানাও। আমাকে বকছো কেন? তখন কিনে দিলেই পারতে এখন হাই আসলে আমি কি করবো?
– কি ফাযিল মেয়ে রে তুই? একে কোথায় আমাকে একটু সাহায্য করবি তা না?
– বেশ পাল্টিবাজ তো তুমি অনল ভাই! আমি কি মানা করেছি তোমাকে সাহায্য করতে। আমি তো বলেই ছিলাম দাও আলু গুলো কেটে দেই। কি ধমকটাই না দিলে। এখন আমাকে বকছো।
– হয়েছে হয়েছে বকিস না তো। উট্টিন্না মেয়ে, পরে হাত ফাত কেটে ফেললে? থাক ভাই আমি ই করি। নেহাত আমার মেয়ে খেতে চেয়েছে। নয়তো কখনোই তোর জন্য আমি বানাতাম না।

বলেই পেয়াজ কাটায় মন দিলো অনল। টপ টপ করে তার চোখ থেকে পানি পড়ছে এটা দেখে ধারার বেশ খারাপ লাগতে লাগলো। অমনি বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো ধারা। চুল গুলো খোপা করে অনলের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো, কড়া কন্ঠে বললো,
– হয়েছে অনেক কেঁদেছো। সরো তো সরো। আমি পেয়াজ কেটে দিচ্ছি। তুমি বাকি কাজ করো।
– তুই পারবি না।
– চুপ, দাও বলছি। সরো। আমাকে কাজ শিখিয়ো না। একে নাকের জল, চোখের জলে একসার। আসছে।

ধমকে কাজ দিলো, অনলের হাত থেকে ছুরিটা নিয়ে একেবারে গিন্নির মতো কাজ করছে ধারা। মাথায় খোপা, কোমড়ে ওড়না গোজা। মাঝে মাঝে অবাদ্ধ ছোট চুলগুলো চোখে মুখে পড়ছে। চুল থেকে ঘামের রেখা ঘাড় অবধি বহমান। নারীর এই প্রতিচ্ছবিটা সবথেকে সুন্দর হয়। অনল অবাক চিত্তে ধারার এই প্রতিচ্ছবি দেখে যাচ্ছে। এক মোহ তার চোখজোড়াকে ঘিরে ধরেছে। কিছুতে চোখজোড়া সরাতে পারছে না। সময়টা যেন থেমে গেছে। অনল নিজের অজান্তেই ধারাকে লক্ষ্য করে যাচ্ছে।
– কি দেখছো?

ধারার অবাক নয়নে করা প্রশ্নে স্বম্বিত ফিরে অনলের। মাথা নাড়িয়ে নেতিবাচক উত্তর দেয় সে। নিজের মনেও একটা প্রশ্ন উদয় হয় আসলে কি দেখে যাচ্ছিলো সে। এতো মন্ত্রমুগ্ধের মতো ধারাকে দেখার কি আছে! প্রশ্নের উত্তর খুজেও কিছুই হাতে পেলো না অনল। আজকাল মনটা শুধু অবাদ্ধ কাজ করে যাচ্ছে। কখনো ধারার মাঝেই অনন্যাকে খুজতে থাকে তো কখনো কোনো কারণ ব্যাতীত তাকে নিয়ে ভাবতে থাকে। উফফফ কি জ্বালা হয়েছে_____

ফুচকা বানানো যখন শেষ হলো তখন ঘড়ির কাটা দেড়টা ছুই ছুই। রান্নাঘরের টুলের উপর বসেই বাচ্চাদের মতো ফুচকা খাচ্ছে ধারা। আর সেটা মুখে হাত দিয়ে দেখে যাচ্ছে অনল। এসব খাবারের প্রতি কখনোই কোনো আগ্রহ তার ছিলো না। সে শুধু তার সামনে বসা মেয়েটাকে খেতে দেখেই খুশী। হুট করেই ধারার গালটা টিপে দিলো। ধারা অনলের কেমন কাজে বেশ অবাক হয়েই বললো,
– এটা কি হলো?
– তুই এতো কিউট কেনো বল তো? কে বলবে আর তুই মা হতে চলেছিস? কিছুদিনপর বাচ্চা হলে কি করবি এটাই ভাবছি। বাচ্চা সামলাবে বাচ্চা। হাহাহা
– আমি মোটেই বাচ্চা নই।
– শোন তুই ষাট বছর হয়ে গেলেও না আমার কাছে বাচ্চাই থাকবি ঠিক আছে। মুখ ধুয়ে ঘুমাতে যা। কাল কলেজে আমি তোকে পৌছে দিবো।
– হঠাৎ? আমি তো সারার সাথেই যাই
– আমি বলেছি ব্যাস আমি নিয়ে যাবো। আর কোনো কথা শুনতে চাই না।

বলেই হাটা দিলো অনল। ধারাও আর কথা বাড়ালো না। অনলের সাথে তর্কে জড়ানো মানে নিজের পায়ে কুড়াল দেওয়া। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুভাসিনী বেগমের রুমে হাটা দিলো ধারা। হাত মুখ ধুয়ে বারান্দায় দাঁড়ালো সে। ঠান্ডা ঝিরিঝিরি হাওয়ায় খারাপ লাগছে না। একটা কথা ভেবে মনে মাঝে সুখ দুঃখের সংমিশ্রণ অনুভূতি হচ্ছে তার। আজ যেই কাজ গুলো দিগন্তের করার কথা ছিলো সেই কাজ গুলো অনল করছে। কি অদ্ভুত না, অবশ্য এটা বেশ ভালো হয়েছে। দিগন্ত এই বাচ্চাটাএর অস্তিত্ব সম্পর্কেই অজানা থাকুক। এটাই হয়তো সবার জন্য ভালো হবে। হঠাৎ করেই একটা ভয় মনে জেকে বসেছে ধারার। যদি কোনোদিন দিগন্ত জেনে যায় বাচ্চাটা বেঁচে আছে এবং সে যদি তার দাবি চেয়ে বসে। কি করবে ধারা!

সময়ের স্রোত বহমান। দেখতে দেখতে মাস পার হতে হতে পাঁচ মাস হয়ে এসেছে। ধারার পেটটাও খানিকটা বড় হয়ে এসেছে। এখন বুঝা যাচ্ছে সে মা হতে চলেছে। অনল আরো বেশী নজরদারী হয়ে উঠেছে বাচ্চাটার প্রতি। এখন আর ভার্সিটি যাওয়া হয় না তার। অনল কথা বলে নিয়েছে স্যারদের সাথে। বাসায় বিশ্রাম করে ধারা। অনল আর ধারার সম্পর্কেও খানিকটা পরিবর্তন হয়েছে। আজকাল ধারার গহীন চিত্তে অনলের বসবাস যেনো সর্বক্ষণ। কিন্তু অনলের সামনে গেলেই সব কিছু গবলেট হয়ে যায়। মাঝে মাঝে ভয় ও হয়। অনলের কাছে বলতে গেলে হিতে বিপরীত হলে, তাই কিছুই বলা হয়ে উঠে না। আর অনল সে তো নতুন করে বাঁচার চাহিদায় আছে। ধারাকে আজকাল সে যেনো চোখে হারায়। এটা কেনো সে নিজেও জানে না। এটা কি বাচ্চাটার প্রতি ভালোবাসা নাকি ধারার প্রতি দূর্বলতা তার জানা নেই। থাক না সম্পর্কটা এভাবেই অহেতুক প্রশ্নের উত্তর খুজতে গেলে যদি সম্পর্কটাই না থাকে। একবার ভালোবাসি বলে হারিয়েছে অনন্যাকে, ধারাকে হারাতে একেবারেই রাজী নয় সে।

সকাল ৯টা,
নাস্তার টেবিলে বসা সবাই। হঠাৎ কলিংবেলের শব্দ কানে আসায় ধারা দরজাটা খুলতে যায়। দরজাটা খুলতেই দেখে একজন মধ্যবয়স্কা মহিলা এবং একজন মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এদের কাউকেই ধারা চিনে না। অবাক নয়নে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকলে…………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি