কুহেলিকা পর্ব-০১

0
2522

#কুহেলিকা
#পর্ব_১
#Munni_Akter_Priya

গলা কাঁটা লাশ মাটিতে পড়ে আছে। লাশটি একটি মেয়ের। শরীরের গঠন দেখে মনে হচ্ছে ১৫/১৬ বছর বয়সী কোনো কিশোরী। গ্রামে এটা নতুন নয়। প্রায়শই এমন লাশ পাওয়া যায় এই গ্রামে। ধারণা করা হয় গ্রামটিতে কালো যাদুর প্রকোপ রয়েছে। সাথে আছে কুসংস্কারে বিশ্বাস। তবে কে বা কারা এর সাথে জড়িত আছে তার কোনো ক্লু তদন্ত করেও পাওয়া যায়নি। গ্রামের স্থানীয় পুলিশেরা নানাভাবে তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ লাভ কিছুই হয়নি। বরং বছরের পর বছর এসব ঘটেই যাচ্ছে।

আইনি চোখে এটাকে বলা হয় খুন বা মার্ডার। আর এই কেসটা তদন্তর দায়িত্ব পড়েছে এখানকার স্থানীয় পুলিশ দিদারের উপর। দিদার খুব ভালো করেই জানে যারা এই খুনের সাথে জড়িত তারা খুব চতুর ও সতর্ক। তাই তাদের ধরা অতবেশি সহজ হবে না। এজন্যই দিদার সাহায্য নিয়েছে ডিটেকটিভ বন্ধু মুহিবের কাছে। মুহিব পার্মানেন্ট কোনো ডিটেকটিভ নয়। শখের ডিটেকটিভ বলা যায়। ছোট বেলা থেকেই মুহিবের রহস্য উদঘাটনে ব্যাপক ঝোঁক। এই পর্যন্ত যতগুলো কেস হাতে নিয়েছে ব্যর্থ হয়নি একটাতেও। এখন দিদারের একমাত্র ভরসা হচ্ছে মুহিব।

মুহিবকে আরো আগেই ফোন করা হয়েছে। মুহিব জানিয়েছে মুহিব আসছে। লাশটাকে পোস্টমর্টেম করতে নেওয়া হয়েছে। মুহিব সোজা থানায় যায়। দিদার তখন থানাতেই ছিল। থানার বাহির থেকেই মুহিব দিদারকে ফোন দেয়। দিদার ফোন তুলে বলে,
“কতদূর এসেছিস?”
“আমি তোর থানার সামনেই।”
“ভেতরে আয়।”
“না। ভেতরে যাব না। তুই বাহিরে আয়। বাহিরে বসেই সব শুনব।”
“আচ্ছা।”
মিনিট দুয়েকের মধ্যেই দিদার বাহিরে এসে হাজির হয়। মুহিব বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। দিদারকে আসতে দেখে বাইকে উঠে বসে বলে,
“বাইকে উঠ।”
“যাবি কোথায়?”
“যেখানে খুন হয়েছে সেখানে।”
“এভাবে বাইকে যাওয়াটা আমার ঠিক হবে না। আমার গাড়িতে চল।”
“শালা! তোদের পুলিশের কাহিনী এখনো বুঝলাম না। চল।”
দিদারের গাড়িতে করেই ওরা ঘটনা স্থলে পৌঁছায় যেখানে খুনটা করা হয়েছিল। জায়গাটা ভালো করে দেখে মুহিব বলে,
“রক্ত তো তেমন দেখছি না এখানে।”
“মাথা কেঁটে তারপর লাশ ফেলে গেছে এখানে।”
“কোনো শত্রুতার বশে কি এমনটা করেছে?”
“তেমনটা হওয়ার কথা নয়। শত্রুতা থাকলে এভাবেই তো মেরে ফেলা যায়। মাথা কেটে নেবে কেন?”
“প্রশ্নটা তো এখানেই।”
“এই গ্রামে কালো যাদুর প্রচলন অনেক। জানিস সেটা?”
“কিহ?”
“হ্যাঁ কালো যাদু। অর্থাৎ ব্ল্যাক ম্যাজিক। তবে যারা এই কাজের সাথে জড়িত তারা গোপনীয়তা বজায় রাখে। এত বছর ধরেও এদের ধরা যায়নি।”
“তোর কি মনে হচ্ছে এই খুনটা ব্ল্যাক ম্যাজিকের জন্যই করা হয়েছে?”
“আমার তো তাই মনে হয়।”
মুহিব কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
“মেয়েটার পরিবারে কে কে আছে?”
“বাবা-মা কেউ বেঁচে নেই। সৎ ভাই আর ভাবির কাছে থাকত।”
“আই সি! আচ্ছা এমনও তো হতে পারে ওর ভাই-ভাবিই কাজটা করেছে? কারণ তারা খুব ভালো করেই জানে গলা কাটা লাশ দেখলেই সবাই ভাববে ব্ল্যাক ম্যাজিকের জন্য কেউ খুনটা করেছে?”
“তাই বলে নিজের লোক এমনটা করবে?”
“করবে বলিনি। করতেও তো পারে। তারমধ্যে আপন ভাই না। আগে আমাদের জানতে হবে ওদের মাঝে সম্পর্ক কেমন ছিল। তারপর বিষয়টা নিয়ে ভাবতে হবে।”
“এখন কি মেয়েটার বাড়িতে যাবি?”
“হ্যাঁ চল। বাই দ্যা ওয়ে, মেয়েটার নাম কী”
“গঙ্গা।”
“হিন্দু?”
“হুম।”
“ওকে।”
——————————————-
“জয় দুগ্গা ঠাকুর,
ঢ্যাম কুড়াকুড়
তুই তো সবার মা,,
“তুই কোন লেবেলের
কোন খিলাড়ি,
কেউ তো জানে না।”

সাউন্ড বক্সে উচ্চস্বরে গানটা বেজেই চলেছে। গানের শব্দে ঘুম ভেঙে যায় নন্দিনীর। চোখ মেলে আশেপাশে ভালো করে তাকিয়ে দেখে নন্দিনী বিছানায় শুয়ে আছে। তাড়াতাড়ি উঠে বসে। মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে। পানিতে পড়ার কারণেই মূলত এমন হচ্ছে। পেটের মধ্যে ক্ষুধায় চোঁ চোঁ করছে। মাথার চুলগুলো মুষ্টিবদ্ধ করে মাথা নিচু করে বসে থাকে। তখনই একজন পুরুষ ঘরে ঢোকে। নন্দিনীর উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দেয় প্রশ্ন।
“এখন কেমন আছেন?”
নন্দিনী ফিরে তাকায় তার দিকে। ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ বাঁকা করে বলে,
“আপনি কে?”
“আমি রিশাদ।”
নন্দিনীর কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল রিশাদ। নন্দিনী চুপ করে রইল। রিশাদ আবার বলল,
“নদীতে ঝাপ দিয়েছিলেন কেন?”
“বেঁচে থাকার ইচ্ছে নেই তাই।”
“সবাই জীবন উপভোগ করতে চায়। আর আপনি মরতে চান?”
“হ্যাঁ চাই। কারণ এভাবে জীবন চলে না।”
“মরার আগে পরিবারের কথা ভেবেছেন?”
“পরিবার থাকলে তো ভাবব।”
“মানে? আপনার পরিবারে কেউ নেই?”
“না। মা তো জন্মের সময়ই মারা যায়। বাবা ছিল। কিন্তু অসুস্থ হয়ে মারা যায় চিকিৎসার অভাবে। তারপর থেকেই চারপাশের মানুষের কুনজর পড়ে আমার উপর।”
“এজন্য মরতে যাচ্ছিলেন?”
নন্দিনী একবার রিশাদের দিকে তাকিয়ে আবার মাথা নিচু করে রাখে। রিশাদ আর কিছু না বলে বাহিরে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর একজন মহিলাকে সাথে নিয়ে ফিরে আসে। মহিলাটি হিন্দু। হাতে শাখা-পলা, সিঁথিতে সিঁদুর। দুহাত আঁকড়ে ধরে আছে খাবারের প্লেট। তিনি প্লেটটা নন্দিনীর সামনে রেখে বলেন,
“খিদে পায়নি মেয়ে? খেয়ে নাও। আর ভুলেও দ্বিতীয়বারটি মরার কথা ভেবো না যেন।”
তিনি রিশাদকে বললেন,
“আমার অনেক কাজ পড়ে আছে বুঝলি। ওর খাওয়া শেষ হলে বাহিরে নিয়ে আসিস। সবার সাথে মিশলে ভালো লাগবে।”
“আচ্ছা।”
মহিলাটি চলে যাওয়ার পরই খাবারের প্লেটে হাত বাড়াল নন্দিনী। গরম গরম কচুরীর সাথে ডালটা বেশ লাগছে খেতে। গাপুসগুপুস খাচ্ছে। সামনে যে একজন অপরিচিত ছেলে সেদিকে যেন একদমই হুশ নেই।
শেষ কচুরীটা মুখে একসাথে পুরে গাল দুটো ফুলিয়ে রিশাদকে বলে,
“একটু পানি দেন প্লিজ।”
রিশাদ জগ থেকে পানি ঢেলে গ্লাসটা নন্দিনীর দিকে দেয়। খাওয়া শেষে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে বলে,
“এত জোরে গান শুনছে কেন সবাই?”
“বিয়ে বাড়ি যে তাই।”
“কার বিয়ে?”
“আমার বন্ধু রোহিতের বিয়ে।”
“ওহ।”
“তারপর? কোথায় যাবেন ভাবছেন?”
“জানিনা।”
“জানতে হবে না।বিয়ে পর্যন্ত এখানেই থাকুন। তারপর না হয় একটা ব্যবস্থা করা যাবে।”
উত্তরে মিষ্টি হাসে নন্দিনী। রিশাদ বলে,
“চলুন বাহিরে যাই।”
“ঠিক আছে।”
রুম থেকে বের হয়েই দেখতে পায় বাড়িটা খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। উঠোনে অঞ্জলি দেওয়া হয়েছে। ছোট বাচ্চারা দৌঁড়ে দৌঁড়ে খেলছে। রোহিত, তোয়া আর হাসিব একসাথে দাঁড়িয়ে গল্প করছিল। রিশাদ নন্দিনীকে সেখানে নিয়ে যায়। রোহিত হেসে বলে,
“এখন কেমন লাগছে?”
“জি ভালো।”
“নাম কি তোমার?”
“নন্দিনী।”
“অনেক সুন্দর নাম। ওদের সাথে পরিচিত হও। ও রিশাদ, ও হাসিব আর ও তোয়া। আমরা চারজন খুব ভালো বন্ধু।”
“আপনাদের সাথে পরিচিত হয়ে ভালো লাগল।”
রিশাদ বলল,
“তোরা এখানে থাক। আমি ওকে পুকুর পাড় থেকে ঘুরিয়ে আনি।”
রিশাদ আর নন্দিনী যাওয়ার পর তোয়া বলে,
“মেয়েটাকে নিয়ে রিশাদ একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করছে।”
রোহিত হেসে বলে,
“জ্বলছে নাকি তোর?”
“বাজে বকিস না তো। খুন করে ফেলব একদম।”
হাসিব আর রোহিত একসাথে হেসে উঠল।

সন্ধার পর গ্রাম ঘুরে বাড়িতে ফিরে দুজন। একটু পরই গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হবে। গায়ে হলুদের আয়োজন করা হয়েছে বাড়ির বিশাল ছাদটিতে। বাড়ির উঠোনে এসে রিশাদ বলে,
“একটু দাঁড়ান আসছি।”
“কোথায় যাবেন?”
উত্তরে রিশাদ কনিষ্ঠ আঙুল তুলে দেখায়। নন্দিনী তুলশী গাছের প্রদীপটা হাতে তুলে দেখছে। রিশাদকে আসতে দেখে প্রদীপটা রেখে দেয়। তারপর দুজনই সোজা ছাদে চলে যায়। সবাই রোহিতকে খুঁজছে। রোহিতের মা বলছেন,
“এতক্ষণ তো এখানেই ছিল। কোথায় গেল হঠাৎ?”
হাসিব বলল,
“নিচে যায়নি তো? আমি দেখে আসছি।”
হাসিব নিচে যায় রোহিতকে খুঁজে। বাসায় খুঁজে না পেয়ে বাড়ির পেছনটায় যায়।
তখনই হাসিবের আত্মচিৎকার শোনা যায়।অনেকেই ছাদ থেকে উঁকি দেয়। কিন্তু নিচে অন্ধকার থাকায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সবাই দ্রুত নিচে নামে। একটা লাশ পড়ে আছে। কিন্তু মাথা নেই। রিশাদ গিয়ে লাশের দিকে ফোনের আলো ফেলে। সবাই চমকে যায়। রোহিতের লাশ! রোহিতের মা চিৎকার করে কান্না শুরু করে। বিয়ের রাতে বরের লাশ!!