গোধূলির শেষ আলো?
পর্ব ১৯ +২০
Writer Tanishq Sheikh Tani
সকাল থেকেই মাথাটা ঝিমঝিম করছে সাথে পেটে ব্যথা তো আছেই।রাত থেকে পেট খারাপ তানির।বিছানার একপাশে কাত হয়ে নিস্তেজ শুয়ে আছে।খাদিজার প্রচন্ড খারাপ লাগলেও তানির প্রতি আসা মায়াটাকে অন্তরে শক্ত করে দাবিয়ে রেখেছে।খালিদ মোবাইল করলে ইনিয়ে বিনিয়ে অনেক কথা বলে তানির চুপচাপ থাকা নিয়ে।এমনভাবে তানির নামে খালিদের কাছে নালিশ করে যেন খাদিজা অসহায় কথাটা না বলতে পারলে আবার তানির নির্বুদ্ধিতার জন্য তিনিও লজ্জিত হন। মানুষ স্বার্থের খাতিরে কতোটা রং বদলাতে পারে তা হয়তো সে নিজেও জানে না।খালিদ তানির অভিমান ভাঙার প্রতিক্ষা গোনে।সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে মধ্য রাত খালিদ যখনি একটু সময় পায় তানিকে খোঁজে। কিন্তু পায় না।পায় শুধু বিরহ দহন জ্বালা।এই দহন জ্বালা একটু একটু করে সম্পর্কের ভিত নড়বড়ে করতে থাকে।খালিদের উদাসীনতা দেখে কৌশলে সহকর্মী বাবুল নিজের সুন্দরী শিক্ষিতা শ্যালিকা জাহান সাথে মোবাইলে খালিদকে আলাপ করিয়ে দেয়।খালিদের শূন্যতায় একটু একটু করে জাহান নিজেকে বসাতে থাকে।দুটি ভালোবাসায় ভরা প্রান তৃতীয় পক্ষের কুটবুদ্ধিতার স্বীকার হয়ে ক্রমশ দূরে যেতে থাকে।আজ তিনদিন হলো তানির নাওয়া খাওয়ার ঠিক নাই।তারউপর খালিদের হঠাৎ পরিবর্তন তানির রাতের ঘুম দিনের স্বস্তি উড়িয়ে নিলো।খালিদ গেলো ৭/৮ দিন হলো এর মধ্যে একদিন একটু কথা বলেছিল অভিমান নিয়ে।অভিমানের মেঘ সরতেই খালিদকে আবার মোবাইল করতে গিয়েই দেখে মোবাইল চুরি হয়ে গেছে। মোবাইলটা ঘর থেকে কি করে চুরি হলো তানির মাথায় আসে না।কারন মোবাইল টা নিখোঁজ হওয়ার মিনিট পাঁচেক আগেও এ বাড়িতে তানি আর তানির শ্বাশুড়ি ছাড়া তৃতীয় কেউ পা রাখে নি।তানির স্পষ্ট মনে আছে ঘরে জানালা বন্ধ ছিল তখন।খালিদের বিরহে কেঁদে কেঁদে চোখ মুখ ফুলে উঠেছিল তাই চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিতে বাথরুমে ঢুকেছিল।পানির ঝাপটা দিয়ে আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজেকে শক্ত করলো খালিদের সাথে কথা বলার জন্য। কিন্তু তা আর হয়ে উঠলো না তানির।কারন ততক্ষণে সেই অঘটন টা ঘটে গিয়েছিল যার প্রত্যাশা তানির ছিল না।দৌড়ে শ্বাশুড়ির ঘরে গিয়ে সবটা বলার আগেই তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে শ্বাশুড়ি মা।নিজের চুরি ঢাকতে তানির অসচেতনতা ও নির্বুদ্ধিতার জন্য ইচ্ছামতো কথাশুনিয়ে তানিকে দুর্বল করে দেন।বেচারি তানি মাথা নিচু করে শ্বাশুড়ির সকল গঞ্জনা শুনে নিজের রুমে চলে আসে।দুহাতে মুখ ঢেকে সেদিন খুব কেঁদেছিল।তানির আজ কেন যেন শ্বাশুড়িকে সন্দেহ হলো মোবাইল নিখোঁজ হওয়ায়।পরক্ষনেই নিজেকে ধিক্কার জানালো এতোবড় পাপ মনে আনার দোষে।পেটে গুড় গুড় শব্দ হতেই দুর্বল শরীর নিয়ে দেয়াল ধরে ধরে বাথরুমে যায় তানি।এ কদিনেই পুতুলের মতো গোলগাল শরীরটা রোগে শোকে শুকিয়ে মলিন হয়ে গেছে।
খাদিজা সকাল থেকেই ভাবছে একবার তানির ঘরে গিয়ে তানিকে দেখে আসবে।মেয়েটার উপর নির্যাতন মনে হয় বেশি হয়ে যাচ্ছে। এতোদিনের আদুরে মেয়েটা হঠাৎ অনাদরের হয়ে গেলেও কোথাও একটু মায়া এখনও অবশিষ্ট রয়ে গেছে হয়তো। যার কারনে খাদিজার মন তানির দুরবস্থা দেখে কষ্ট পাচ্ছে।যাবো যাবো সংকোচে দুপুরের দিকে তানির ঘরে ঢু মারতেই চমকে ওঠে খাদিজা।মনের কোনে যে শঠতা ছিল এক নিমিষেই মমত্বে পরিণত হয়ে ছুটে যায় তানির অচেতন হয়ে পড়ে থাকা দেহটার পাশে।
“- ও মা! মাগো! কতা কও মা।ও মা কি হয়ছে মা?কান্নাজড়িত কন্ঠে আর্তনাদ করে ওঠে খাদিজা।খারাপ কিছুর আশংকায় মুহুর্তেই অনুতপ্তের অনলে দগ্ধ হতে থাকে।নিজেই নিজেকে শাপ দিতে থাকে।খাদিজা দৌড়ে দুমিনিটের দুরুত্বে বসতিওয়ালা বাড়িগুলোতে গিয়ে কাদে।নিজের ভাসুরের ছেলেদের হাতে পায়ে ধরে নিয়ে আসে অচেতন পুত্রবধূকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য।বড় মিয়ার ছেলেরা কাকিকে যথেষ্ট সম্মান করে।তাদের মা বাবা মৃত কাকার পরিবারের সাথে সম্পর্ক না রাখলেও বড় মিয়ার দুই ছেলে আদিল,আমির যতোটুকু পারে রাখার চেষ্টা করে।বয়োবৃদ্ধ পিতাকেও বোঝায় আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন কারীকে জান্নাতে প্রবেশের করতে দেওয়া হবে না।কিন্তু বৃদ্ধ পিতা বয়সের ভারে নুয়ে পড়লেও পঙ্গুত্ববরণের শোকে শক্ত হয়ে থাকেন এসব নসিয়ত শোনার বিষয়ে।তার এক কথা কেয়ামত হলেও সে এটা কখনোই মানবে না।তাছাড়া সে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজি। আল্লাহ নিশ্চয়ই তার এই অপরাধ মার্জনা করবেন।কিন্তু বড় মিয়া এটা ভুলেই গেলেন তার সব আমল শেষ হয়ে গেলো এই কখনোই না মানার অহংকারের দরুন।আদিল কালই শহর থেকে ফিরেছে একটা থানার কলেজের প্রফেসর হয়ে।বাবা বাড়িতে না থাকায় দু ভাই তাড়াতাড়ি ভাবনা চিন্তা ছাড়াই কাকির সাথে দৌড়ে যায় ভাবিকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য। আদিল সুঠামদেহি সুদর্শন পুরুষ।একাই ভাবিকে পাজাকোলে করে ভ্যানে তুলে দুভাই কাকিকে অভয় দিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে ছুটে চলে।খাদিজা কাঁপা কাপা শরীরে ধপ করে বসে পড়ে ঘরের সামনের ছোটো সিঁড়ির রেলিংএ।কিছুটা দম নিয়ে কান্নাভেজা চোখে কলপাড়ে ছুটে যায়।ওজু করে জায়নামাজে বসে আল্লাহর দরবারে হাত তুলে কাঁদতে থাকে পুত্রবধূর আরোগ্য কামনা করে।কেঁদে মোনাজাতে বলে,
“-ও গাফুরুর রাহিম,ও মালিকুল মুলক ক্ষমা করো আমারে।আমার পাপের শাস্তি ঐ নির্দোষ মায়েটারে দিও না আল্লাহ। আমি তওবা করছি আর কোনোদিন ওর খারাপ চাবো না।কোনোদিন কষ্ট দেবো না আর ওরে মালিক।তুমি আমাকে মাফ করো গাফুরুর রাহিম।আমারে শাস্তি দাও তবুও ওরে সহি সালামত ফিরায়ে দাও।অঝোরে কাঁদতে থাকে খাদিজা।নিজের সকল পাপ হঠাৎই চোখের সামনে দর্পন হয়ে ভেসে ওঠতে লাগলো।অনুতপ্ত হয়ে সেজদায় পড়ে কাঁদতে লাগলেন তিনি।
তাজ সারাদিন পুলিশ স্টেশনে দৌড়া দৌড়ি করছে। দুদিন আগেও যারা সমিহ করে কথা বলতো আজ তারাই তাজকে চোখ দেখাচ্ছে।মা তো চলে গেছেই বাপটাকে তাজ হারাতে পারবে না।থানায় একটা বেঞ্চে বসে গম্ভীরমুখে নানা চিন্তায় ডুবে যায় তাজ।
“- এখানে আব্বাস জোয়ার্দারের আত্মীয় কে?
“- আমি! আমি!তাজ সচকিত হয়ে দাড়িয়ে হড়বড়িয়ে জবাব দেয়।
“- আসুন!তাজের জবাবে হাবিলদার মুখে বিরক্তের ছাপ এনে বলে।
“- জ্বী।
হাবিলদারের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তাজ নতুন লেডি ইন্সপেক্টর মুনিয়ার কেবিনে ঢোকে।সালাম দিয়ে সামনে দাঁড়াতেই মুনিয়া তীক্ষ্ণ চোখের চাহনীতে সামনে দাঁড়ানো তাজের দিকে তাকিয়ে ভ্রুকুটি করে বলে,
“- আপনি!
“- ম্যাডাম ঐ যে আব্বাস! হাবিলদার কে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে থামিয়ে দিলো
“- ওহ! আপনিই ঐ নিকৃষ্ট মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষটার ছেলে।সরি টু সে এভাবে বলার জন্য। আমি জানি কোনো সন্তানই তার পিতা সম্পর্কে খারাপ মন্তব্য শুনতে চাই না।বাট কি করবো? যে খারাপ তাকে খারাপ বলাটায় আমার পেশা।সে যা হোক। আরে দাড়িয়ে কেন বসুন না।
“- জ্বী! তাজ রাগে চোয়াল শক্ত করে ফেলে এই ত্রিশ ছুঁই ছুঁই মেয়েলোকের কথা শুনে।
“- উমমম!তো বলে ফেলুন আমার কাছে কেন এসেছেন?
“- জ্বী আমার আব্বা।
“- করম ভাই যান তো এককাপ কফি নিয়ে আসুন।মাথা ধরেছে খুব।
“-জ্বী ম্যাডাম।
“- হ্যাঁ বলুন। কি বলছিলেন?
“- আমার আব্বাকে আজ সকালে হুট করেই গ্রেপ্তার করে আনা হয়েছে,,
“- গ্রেপ্তার তো হুট করেই হয় তাই না? নাকি নতুন নিয়ম চালু হয়েছে ঢাকঢোল পিটিয়ে দশদিন জাঁকজমক অনুষ্ঠান করে তার পর গ্রেপ্তার করতে হবে?
“- আমি সেটা বলি নেই।আমি বলতে চাইছি কিসের ভিত্তিতে আপনারা আমার আব্বারে থানায় ধরে এনেছেন।
“- ভিত্তি টিত্তির হিসাব চাইতে এসেছেন? তাহলে শুনুন।আপনার পিতা একজন চোরাকারবারি,সন্ত্রসী এবং ক্ষমতার অপব্যবহার কারী আরও কুকর্ম করেছে যা সন্তান হিসেবে আপনি শুনতে পারবেন না। সেকশনের ধারায় বলতে গেলে,, হুমম না থাক আপনি বুঝবেন না।সহজ ভাষায় শুনুন! আপনার বাবা একজন অসৎ লোক।আর বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আপনার জানা আছে নিশ্চয়ই অসৎলোক সমাজে সভ্য মানুষের মাঝে নয় জেলহাজতেই ভালো মানায়।
তাজ এবার আর রাগ চেপে রাখতে পারে না।লেডি ইন্সপেক্টর মুনিয়ার পিতার নামে ব্যঙ্গ করে বলা কথাগুলো তাজের শরীরে সুচ হয়ে বেঁধে। রক্ত গরম হয়ে ওঠে।হুঙ্কার দিয়ে চেয়ার ছেড়ে দাড়িয়ে পড়ে।
“- মেয়েলোক বলে কিছু বলছি না বলে ভেবে নেবেন না আমি চুপচাপ আমার আব্বার নামে এসব নোংরা কথা শুনবো।অভদ্রতার একটা সীমা আছে কিন্তু!আপনি নতুন তো তাই আমার আব্বাকে চেনে না। ভালোয় ভালোয় বলছি ছেড়ে দিন তাকে।
“- ও মাই গুডনেস! আপনার বাবাকে আমি নোংরা কথা বলেছি তাই না মি.জোয়ার্দার? লিসেন! আপনাকে যে আপনি করে বলছি এটাই আমার ভদ্রতা।আপনাকে সামনে সহ্য করছি এটাই আমার ধৈর্য।আপনার বাবা মানে আব্বাস জোয়ার্দারকে সঙ্গে সঙ্গে এনকাউন্টার করি নাই তো ঐ কুত্তারবাচ্চার লাক।আপনার লজ্জা করে না ঐ কুত্তার বাচ্চাকে বাপ ডাকতে?আমার ভালো নিয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না।নিজের ভালো বুঝুন যান!
“-আবারও বলছি ভদ্র ভাবে কথা বলেন আপনি ম্যাডাম।তিনি আমার পিতা হন।আপনার পরিনতি নয়তো বহুত খারাপ আছে।
“- ভদ্রভাবেই বলছি নেক্সট টাইম থানার চৌহদ্দির সীমানায়ও যেন তোকে না দেখি।বাপের জন্য কাফনের কাপড় রেডি রাখ যা! আঙ্গুলে তুড়ি বাজিয়ে দরজা দিকে ইশারা করে মুনিয়া।
“-মেয়েমানুষ বলে এ যাত্রায় কিছু বললাম না ম্যাডাম তাই বলে ভাববেন না আপনার করা অপমান ভুলে যাবো।কোনোদিন না।আব্বাস জোয়ার্দারের ছেলে হয়ে থাকলে এর জবাব একদিন অবশ্যই পাবেন আপনি।
“- ওয়েলকাম এ্যান্ড নাও গেট লস্ট।আউট!
“- ওহ! ওয়েট মি. জোয়ার্দার! আপনার মায়ের নাম যেন কি?
“- সেটা বলার প্রয়োজন মনে করলাম না।চলি।
“- শুনলাম আপনার মা নাকি সুইসাইড করেছেন? সত্যি কি তাই?
লেডি ইন্সপেক্টরের শেষ কথায় থেমে গেলো তাজ।কৌতূহল চোখে ঘুরে তাকিয়ে মুনিয়ার ঠোঁটে ব্যঙ্গাত্মক হাসি দেখে রাগে গজগজ করতে করতে চলে যায় তাজ।অপমানে শরীরের রক্ত টগবগিয়ে ফুটছে তাজের।সামান্য মেয়েমানুষের কাছে আজ অপমানিত হতে হলো এ জ্বালা পুড়িয়ে ছাই করে দিচ্ছে তাজকে।
তানিকে হাসপাতালে নিয়ে এসে ভর্তি করিয়ে দেয় আদিল।আমির ডাক্তারের পিছু পিছু ছুটছে রিপোর্ট নিয়ে।অবশেষে ডাক্তার যা বললো তা শুনে দু ভাই কিছুক্ষণ মৌন থেকে খুশিতে লাফিয়ে ওঠে।তারা চাচা হতে যাচ্ছে। তাদের প্রিয় ভাই বন্ধু খালিদ বাবা হবে এই খুশিতে আদিল তৎক্ষনাৎ মিষ্টি এনে হাসপাতালের বিতরণ করে।তানি তখনও মুখটা মলিন করে শুয়ে আছে।হাতে স্যালাইন চলছে তানির।এতোবড় খুশির খবর অথচ খালিদ তানির পাশে নাই।আদিল ভাবিকে মিষ্টি খাওয়াতে আসলে দরজার আড়ালে দাড়িয়ে দেখলো ভাবির চোখ বেয়ে অশ্রুফোটা গড়াচ্ছে।আদিলের খুশিতে ভরা মনটা পরক্ষনেই ব্যথাতুর হয়ে গেলো।মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে চুপচাপ চলে গেলো।
চলবে,,,গোধূলির শেষ আলো?
পর্ব ২০
Writer Tanishq Sheikh Tani
মোবাইলে আদিল কাকিকে সব জানালে খাদিজা উৎফুল্ল চিত্তে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করে দু’ফোটা অশ্রু ফেলে।
তানির বাবা মাকেও নিজে এই খুশির খবর দেন।কিছু সময় বাদেই তানির মা রান্না বান্না করে টিফিন বাটি নিয়ে তানির শ্বশুরবাড়ি আসে।তানির বাবা খুশিতে কেঁদেই ফেলে।খাদিজা বেয়াই বেয়াইনের হাত ধরে নিজের ভুলের জন্য অনুতপ্ত হয়।ক্ষমা চাই তাদের কাছে।ফজিলা বেয়াইনকে জড়িয়ে ধরে বলে
“- ও বু! এমন খুশির দিনে চোখের পানি ফেলে না তুমি।আমি সব ভুলে গেছি।তুমিও ভুলে যাও।
তিনজন বাড়িঘর তালা বন্ধ করে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা হয়।হাসপাতালে ঢুকে তানির মা মেয়েকে চিনতেই পারে না।তার পুতুলের মতো ফুটন্ত ফুলটা এখন নির্জীব মলিন হয়ে হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে।মেয়েকে দেখে হাওমাও করে কেঁদে ওঠে ফজিলা।খাদিজা পাপবোধে দূরে তানির পায়ের কাছে বেডে বসে মা মেয়ের আলিঙ্গন দেখে।তানি খাদিজার দিকে তাকিয়ে মলিন হাসি দিয়ে মাথা নিচু করে বসে থাকে।তানির মা খুশির খবর শুনে পোষা কচি মুরগিটা জবাই করে তাড়াতাড়ি ঝোল করে নিয়ে আসে।ভাত, ডিম সিদ্ধ। ঘরে রান্না বড়ি দিয়ে নিরামিষ তরকারী সব নিয়ে আসে।নিজ হাতে মেয়ের মুখে ভাত মেখে তুলে দেয়।তানি অল্প কিছু খেয়ে আর খেতে পারে না।তারপর আবার গুটিশুটি হয়ে শুয়ে পড়ে দুর্বল শরীর নিয়ে।তখনি আদিল হাস্যোজ্জ্বল মুখে ছুটে আসে,
“- ভাবি ওঠেন! খালিদ কথা বলবে।
তানি কিছুক্ষণ চুপ থেকে মাথায় শাড়ির আচল টেনে ধীরে উঠে বসে।মাথা নিচু করে হাত বাড়ায়,
“-দিন ভাইয়া!
“- না এভাবে নয়!
“- একটু হাসুন আগে।আপনার চাঁদ মুখে মলিনতা একটুও মানাচ্ছে না।একটু হাসুন তো?
“- জ্বী! তানি মুখে জোর করে হাসি এনে মোবাইলের জন্য হাত বাড়ায়।
“- নিন।আমি বাইরে আছি।প্রয়োজনে ডাক দিয়েন।
“- হুমম।
মোবাইলটা হাতে নিতেই তানির মা ঘর থেকে বেড়িয়ে যায় খাদিজার সাথে।তানি মোবাইলে ভেসে আসা খালিদ নামটা দেখে নিঃশব্দে কাঁদে। ঢোক গিলে একটা দীর্ঘশ্বাস নেয় তারপর কানে লাগিয়ে বলে,
“- আসসালামু আলাইকুম।
“- ওয়ালাইকুম আসসালাম।
“- দুপাশেই ক্ষনিক নিরবতা নেমে আসে।তানি আর সহ্য করতে পারে না খালিদের নিরবতা।নিজেই নিরবতা ভাঙে শান্ত গলায়।
“- কেমন আছেন?
“- সে খবর কারো প্রয়োজন আছে কি?
“- খাইছেন?
“- জানি না
“- কি করেন?
“- জানি না।
“-আচ্ছা তাহলে ভালো থাকেন।
“- হুমম।
আবার নিরবতা নেমে আসলো দু পাশে।তানি দাঁত কামড়ে অশ্রু নিবারণের চেষ্টা করছে।কিন্তু পারছে না।খালিদ রেগে আছে তানি স্পষ্ট বুঝতে পারছে।তানি নিজের অপারগতার কথা বলতে চেয়েও বলতে পারছে না।বলতে পারছে না আপনাকে ছাড়া আমি মরতে বসেছি দেখেন!খালিদের গম্ভীরতা একটুও সহ্য হচ্ছে না আর। কান্নার রোল গলা অব্দি উঠে এসেছে তানির।কিন্তু খালিদকে নিজের কষ্ট বুঝাবে না তানি। অভিমানে কন্ঠ ভারী হয়ে আসে।ভারী স্বরে বলে,
“-কিছু বলবেন?
“- না!
“- তাহলে কল কেটে দেন।
“- এই কুত্তার বাচ্চা! এই এতো তেজ কিসের তোর? কেন আমার ঈমান নষ্ট করছিস? তোকে ভালোবাসার এতো কঠিন শাস্তি কেন দিচ্ছিস আমাকে? বল! তানিকে অবাক করে দিয়ে বাচ্চাদের মতো শব্দ করে কাঁদতে থাকে খালিদ।কথা বলতে চেয়েও এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে শব্দ গুলো।তানিও এবার গলা অব্দি আসা কান্নার রোলের বাঁধন খুলে দেয়।দুজনেই মোবাইলের দুপাশে কাঁদতে থাকে।
“- আপনি কাঁদছেন কেন?
“- খুশিতে!
“- ওহ!
“- আবার ওহ! বলিস? সামনে থাকলে থাপ্পড় দিয়ে তোর দাঁত ফেলে দিতাম।
“- ফোকলি বউকে ভালো লাগবি তখন?
“-না লাগলে না লাগবে।
“- ও বুঝেছি।আবার একটা বিয়ে করবেন তখন তাই না?
“- হ্যাঁ তবে একটা বিয়ে না একশ টা করবো।
তানি এবার কান্নার মধ্যেই ফিক করে হেসে দেয়।
“- হাসিস কেন তুই?
“- একটা বউয়ের জ্বালা সহ্য না করতে পারে কাদে ফেলছেন।একশটা হলে তো! হি! হি!
“- মজা করছিস তাই না? আমার ফিলিংসের কোনো দাম নাই তোর কাছে।এজন্যই এমন করতে পারলি।আমি মরলে বুঝবি।
“- বালাই শাট! কি বলেন এসব? আপনি অনেক খারাপ হু
“- তুই তো ভালো।যা ভালো নিয়েই থাক।
“- সত্যি তো?
“- কি সত্যি!
“- এ যে বললেন ভালো নিয়ে থাকতি।
“- আবার! আমি কিন্তু সত্যি তোকে মেরে ফেলবো এমন কথাবার্তা বললে।
“- কেন মারবেন?নিজের দোষ তো চোখে দেখেন না।সব আমার দোষ তাই না? আমি যদি মরে যেতাম তবে? আজ আদিল ভাই মোবাইল করে যদি বলতো আপনার বউ মরে গেছে তবে কারে এতো বকা দিতেন শুনি?
“- তোরে কবর থেকে উঠিয়ে এনে থাপ্পড়াতাম বুঝলি।ফালতু কথা বলিস।আমাকে ছেড়ে কই যাবি তুই হুম।আল্লাহ কে আমি রোজ ডাকি আর বলি আল্লাহ তানির আগে আমাকে নিও।
“- ছি! কিসব বলেন এসব?
“- ছি! কিসের।আমার আগে কোথাও যাওয়া হবে না আপনার বুঝেছেন তানি?
“- আপনি এসব বলবেন না আমার খারাপ লাগে
“- আর তুমি যখন বলো তখন বুঝি মজা লাগে আমার?
“- ক্ষমা করে দেবেন আমাকে। আমি আর কখনোই রাগ করবো না আপনার সাথে।
“- কসম খাও
“- আল্লাহর কসম।
“- মনে থাকে যেন! শরীর কি খুব খারাপ তানি?আমি খুব অন্যায় করে ফেলেছি।মাফ করে দিও।একটু আগে রাগের মাথায় বকাও দিয়েছি তার জন্যও ক্ষমা করে দিও।
“- ছিল! এখন ভালো হয়ে গেছে।মাফ চাওয়া লাগবি নে আর।
“- মানে!
“- মানে ঘোড়ার ডিম।
“- আবার!এমন কেন করেছিলে তুমি? তোমার কিছু হলে আমি কি নিয়ে বাঁচতাম বলো?দোষ আমারও ছিল।আমি মা’ কে,,
তানি শ্বাশুড়ি বিষয়ে তার ছেলের মুখ থেকে খারাপ কিছু শুনতে চাচ্ছে না বলে দ্রুত খালিদের কথা থামিয়ে অন্য কথা বললো,
“- এ শুনুন না!আপনি!
“- আমি কি!
“- যাহ! লজ্জা করে।
“- আমার এখন কি ইচ্ছা করছে জানো?
“- কি!
“- তোমাকে অনেক আদর করতে।বুকের পাঁজরের হাড্ডির মজ্জায় মজ্জায় মিশিয়ে রাখতে।তানি!
“- হুম।
“- মা’ কে বলে আমি চলে আসবো খুব দ্রুত। ততদিন নিজের আর আমার অনাগত সন্তানের খেয়াল রেখো লক্ষীটি।
“- হুম।
“- একটা কথা বলি তানি? ভুল বুঝবে না তো আমাকে?
“- কসম খেয়েছি তো! বুঝবো না ভুল বলেন।
খালিদ একবার ভাবলো তানিকে জাহানের বিষয়ে সব বলতে। মেয়েটার সাথে দুদিন ক্যাজুয়ালি কথা বলতেই মেয়েটা ইনিয়ে বিনিয়ে খালিদের উপর প্রভাব খাটাতে লাগলো। সহকর্মী বাবলু বলেছিল তার শ্যালিকা ঢাকার একটা কোম্পানিতে জব করে।বাবলু খালিদের একটা চাকরির ব্যবস্থা করার জন্য শ্যালিকাকে শুপারিশ করে।সেই সুবাদেই খালিদকে কথা বলতে বলে।খালিদ প্রথম প্রথম বাবলু ও জাহানের মতলব বুঝতে না পারলেও ক্রমেই জাহানের অন্য সাইডে কথা বলা,খালিদের ওয়াটসাআপে খোলামেলা ছবি দেওয়াতে ওদের মতলব ক্লিয়ার হয় খালিদের।নিজের অজান্তে খালিদও জাহানের সাথে বন্ধুত্ব করে ফেলেছিল যেমনটা খালিদ কখনোই করে নাই কোনো মেয়ের সাথে।মেয়েটা প্রচন্ড ধুরন্ধর।দুনিয়াতে শয়তানের পর যদি কেউ মানুষকে জাহান্নামে নেয় তবে এই জাহানের মতো মেয়ে মানুষই সে কাজ করবে।খালিদের মতো ছেলেকে কথার জালে দুর্বল করে দিয়েছিল।খালিদের নিঃসঙ্গতা ভরিয়ে তুলেছিল কথার ফুল ঝুড়িতে জাহান।খালিদ সম্মোহিত হয়ে গিয়েছিল জাহানের কথার মাঝে।যা তানির কাছে কামনা করে মনে উতলা ছিল সে সব জাহান না চাইতেই দিতে প্রস্তুত ছিল।কিন্তু মেহেরবানী আল্লাহ পাকের নয়তো খালিদ নিজেও পাপ করে বসতো।সারারাত কাল কেঁদেছে নিজের ভুল বুঝতে পেরে।তানির উপর অভিমান ক্ষোভে নিজেই নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল। তানিকে কি করে বলবে জাহানের কথা?আজ তানির এ অবস্থার জন্য খালিদ নিজেকে দায়ী করে।কোনোমতেই নিজেকে ক্ষমা করতে পারে না।কাল রোজা রাখার নিয়ত করে পাপ মোচনের জন্য।তানিকে কষ্ট দেওয়ার শাস্তি নিশ্চয়ই চাই খালিদ।খালিদকে ওপাশে চুপ থাকতে শুনে তানি অভিমানি সুরে বললো,
“- কি হলো? বলেন।
খালিদ কথা কাটাতে কি বলবে ভেবে পায় না।অপরাধবোধ কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। ভালোবাসি বলতেও আজ সংকোচ হচ্ছে। তবুও বললো,
“-অনেক ভালোবাসি তোমাকে আমার বাচ্চা মা।
“- যা! লজ্জা লাগে না আমার।
“- এক বাচ্চার মা হয়ে যাচ্ছে তবুও লজ্জা যাচ্ছে না বেগমসাহেবার।আসি এবার তারপর সব হিসাব বুঝে নেবো।
“- কচু নেবেন।
“- তাই!। আচ্ছা খাইছো কিছু?
“- হুমম।
“- বেশি বেশি করে খাবে এসময়। আমি আদিলকে বলছি আজই একটা মোবাইল কিনে দিতে। আর এটাও হারালে আদিলকে বলবে ঠিক আছে?
“- হুম।ঠিক আছে।
“- এখন ঘুমাও।একদম চিন্তা করবে না।
“- আচ্ছা
খালিদ মোবাইল কেটে দেওয়ার আগে ওপাশ থেকে দীর্ঘ একটা ভালোবাসা চুম্মন দেয় তার অনাগত বাবু জন্য। তানি লজ্জায় মিটমিটিয়ে হাসে।মোবাইল শিয়রে রেখে হাসি মুখে তাকিয়ে থাকে।চোখে খালিদের দুষ্টু মিষ্টি চেহারা ভাসে।একটু আগেও অনেক অভিমান জমেছিল মানুষটার উপর কিন্তু এখন তার রেশমাত্র নেয়।সম্পর্কের মায়া বুঝি এমনই হয়।যার দূরত্বে অভিমান, কাছে আসায় নিগূঢ় ভালোবাসা।
তাজ কোটকাচারি করেও আব্বাস কে ছাড়াতে পারছে না।সবাই বলছে এই লেডি ইন্সপেক্টর মুনিয়া অনেক পাওয়ারফুল ও জাদরেল।অন্যায়ের সাথে বিন্দুমাত্র আপোষ নাই তার।বিয়ের আসরে হবু স্বামীর অ্যাফেয়ার্সের কথা শুনে চুপচাপ উঠে চলে আসে।তারপর আর বিয়ের কথা চিন্তাও করেন নি।ধোঁকা জিনিসে তার প্রচন্ড এলার্জি। আব্বাস চেয়ারম্যানের ব্যাপারে ক্ষেপেছে কেন তা এখনও কেউ আন্দাজ করতে পারছে না।তবে সবাই নিশ্চিত আব্বাস এবার শেষ।মুনিয়া কারো পিছে লাগা মানেই তার দি ইন্ড।তাজ হতাশ মুখে বাড়ি ফিরতেই নুরি উউউ করে কেঁদে ওঠে।ইনিয়ে বিনিয়ে আব্বাসের কথা স্মরণ করে।তাজকে উসকাতে থাকে আব্বাসকে যে করেই হোক ছাড়িয়ে আনার জন্য। কিন্তু তাজ নুরির কথায় হা না কোনো উত্তর না দিয়ে বারান্দায় বসে থাকে।তখনি তাজের বন্ধুরা বাড়িতে ঢোকে।নুরির সাথে ইশারা বিনিময় হতেই তাজকে তারা তাদের প্লান জানায়।
“- অসম্ভব! কি বলিস এসব? এতো বড় ঝুঁকি নেওয়া কি ঠিক হবে?
“- অবশ্যই হবে।আমরা কাকার সাথে এতোদিন থেকেছি। আর আজ কাকার দুঃসময়ে তাকে বিপদে ফেলে হাত গুটিয়ে বসে থাকবো?
“- কিন্তু!
“- কোনো কিন্তু না।ওঠ তুই।চল আমাদের সাথে।ছেলে হিসেবে এতোটুকু ঝুঁকি তোকে নিতেই হবে।
“- আমি কি পারবো?
“- আমরা আছি তো তোর পাশে।তোকে জোয়ার্দার বাড়ির যোগ্য উত্তরসূরি বানিয়ে ছাড়বো চল।
তাজকে নিয়ে আলো থেকে অন্ধকারের পথে মিলিয়ে গেলো তাজের তথাকথিত বন্ধুরা।
চলবে,,,