গোধূলির শেষ আলো পর্ব ২৫ +২৬

0
670

২৫+২৬
গোধূলির শেষ আলো?
পর্ব ২৫
Writer Tanishq Sheikh Tani

সকালের ঘুমের রেশ কাটতেই মোবাইলটা হাতে নিলো তাজ।মোবাইল অন করতেই দেখে তাতে ৩৬ মিসড কল উঠে আছে।তাজ মিসড কল অপশনে গিয়ে দেখে সোহাগ এতোগুলো কল করেছে।তাজ তড়িঘড়ি উঠে ফ্লোরে ছড়িয়ে থাকা কাপড় উঠিয়ে পড়ে নেয়।তাজ কে কাপড় পড়তে দেখে সালমা লেপ জড়ানো শরীরে উঠে বসে।
“- কই যাও এতো বিহান বেলা?
“- কাজ আছে।তুই শুয়ে থাক।
“- একটু বসো। আমি ভাত তরকারি গরম করে দেই খায়ে যাও।
“- না! তুই ঘুমা।আমি গেলাম।তাজ আর কথা না বাড়িয়ে দরজা খুলে গায়ে শাল টা জড়িয়ে নজু মিয়ার বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়।সালমা মুখটা পানসে করে আবার শুয়ে পড়ে কিন্তু ঘুম আর চোখে আসে না।
ফজরের পর পরই তানি উঠে পড়েছে।আজ কায়েনাত বড্ড জ্বালিয়েছে। মেয়েটার ইদানিং রাতে রাতে গা পুড়িয়ে জ্বর আসছে।আজ জ্বরের তাপটা বোধহয় বেশিই ছিল।ঐটুকুনি মেয়ে সারারাত জ্বরের ঘোরে কেঁদেছে শরীরের যন্ত্রনায়।মা হয়ে তানি কেঁদে কেঁদে সারারাত মেয়ের গা মাথা মুছে আল্লাহ কাছে মেয়ের সুস্থতা কামনা করেছে।খালিদের উপর জন্মানো অভিমান এখন রাগে রূপ নিয়েছে। আজ চারদিন হলো তানির না হোক নিজের সন্তানের তো একটা খোঁজ নিতে পারতো?কিন্তু নেই নি খালিদ।বাপ হয়ে কোনো দায়িত্বশীলতা পর্যন্ত দেখালো না।তানির সাথে যা করেছে সব কিছুর জন্য হয়তো একসময় ক্ষমা করে দিতো খালিদকে কিন্তু মেয়ের কিছু হলে খালিদকে তানি কোনোদিন ক্ষমা করবে না।
সকালের দিকে মেয়েটার গায়ের তাপটা একটু কমতেই বহুকষ্টে তানি মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে পাকের ঘরের চুলায় রান্না বসায়।
ভাতটা চড়িয়ে দিয়ে এটো প্লেট গামলা,কড়াই জমা করে কলপাড়ে নিয়ে আসে। ঘরের ভেতরে পানির ট্যাপ থাকলেও খাদিজা এসব ধোঁয়া মোছার জন্য ট্যাংকের পানি খরচ করবে না।তার এক কথা টিউবওয়েল থাকতিও কেন কারেন্ট খরচ করে পানি ঢালতি হবি।গা গতর খাটিয়ে সংসারের খরচ না বাচালি তো খালিদের উন্নতি কোনোদিন হবি না।সব তো আরাম আয়েশেই তানি উড়িয়ে দেবে।তার ছেলে এতো কষ্ট করে দূরদেশে থেকে আয় করবে আর বউ তা পায়ের উপর পা রেখে শেষ করবে তা খাদিজা হতে দেবে না।ট্যাংকির চাবি ঘুরিয়ে পানি বন্ধ করে রাখে।ছাদের দরজায় তালা মেরে রেখে দেয় যাতে তানি ছাঁদে গিয়ে চাবি না ঘুরাতে পারে। তানি এসব দেখে আর তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে।জীবন আজ কতোভাবে মানুষের রূপ উন্মোচন করছে।কাছের মানুষগুলোর মুখোশের আড়ালের নিষ্ঠুর আর পাষন্ড রূপটা সহসায় উন্মোচন হলো জীবনের এই নিদারুণ মুহুর্তে এসে।তানি বাবা মাকেও এসব বলতে চাই না।নিয়তির উপর প্রচন্ড ক্ষোভ তানির।ভেঙে চুড়ে শেষ হয়ে যাবে তবুও মাথা নত করবে না কারো সামনে।দেখি নিয়তি তাকে আর কতো ঠকায়।আর কতো ধৈর্যের পরীক্ষা নেয়।তানি সব কষ্ট হলাহলালের মতোই পান করে নিয়তির মুখোমুখি দাঁড়াবে।কল চেপে চেপে সব ধুয়ে আবার পাকের ঘরে নিয়ে আসে। ততক্ষণে ভাতের পানি টগবগ করে ফুটছে।শীতের সকাল হলেও তানি শীতকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েই পাতলা সুতি শাড়ি আর হাফ হাতা ব্লাউজ পড়েই এতো কাজ করে।মনে হয় শীত ওর কাছে পরাজিত।চুলার পাশে পিঁড়িতে হাঁটু ভাঁজ করে বসে জ্বলন্ত চুলোর মুখে শুকনো পাতা দিতেই নিভু নিভু আগুনটা ধপ করে চুলাময় জ্বলে উঠলো।যেমনটা তানির বুকে খালিদ আগুন জ্বালিয়েছে ঠিক তেমনটা এই শুকনো পাতা চুলাতে জ্বালালো।ভাত ফুটে আসলে জ্বাল কমিয়ে চুলোয় বসিয়ে রাখে ভাতের পাতিল।হেঁটে লাউ জাংলায় গিয়ে কচি কচি কতোগুলো লাউ পাতা নিয়ে ধুয়ে আধা সিদ্ধ ভাতের মাঝে মাঝে ছোট্ট গর্ত মতো হয়ে ওঠা ফ্যানে বুদবুদ চাপা দিয়ে ঢাকনা তুলে দেয়। আজ তিনদিন নিরামিষ তরকারি,আর ভর্তা ভাত খাচ্ছে তানি।বাপের ঘরে সে এমন খাবার জীবনেও খায় নি।বাপের ঘরে যারা নাকি সুখ করে স্বামীর ঘরে এসে তারাই নাকি কষ্টের জীবন দেখে।তাহলে কি তানি বাপের ঘরে সুখ করে ভুল করেছে? এসব আগে জানলে তানি বাপের ঘরেই কষ্টের দিন পাড় করা শিখে আসতো। তাহলে আজ এই কষ্ট সহ্য করতে চোখের পানি নাকের পানি এক করতে হতো না।

শ্বাশুড়ির খাবার বেড়ে টেবিলে রেখে মেয়ের জন্য সিদ্ধ ডিমটা ভেঙে জুড়াতে লাগলো।শ্বাশুড়ি তার ভাই বাড়ি গেলে বড় মোরগটা তানি বেঁচে দেওয়ার পরিকল্পনা করে মনে মনে। মোরগটার দাম ৩শর কাছাকাছি তো হবেই।তাতেই এক কেজি দুধ আর মেয়ের ডাক্তার দেখানো হয়ে যাবে। তানি জমা টাকা দিয়ে ৩টা মুরগি আর একটা মোরগ কিনে পুষে সেগুলো বাচ্চা দিয়ে এখন ৭/৮ টা মুরগি ও ২ টো মোরগ হয়েছে।এসব তানির হলেও কতৃত্ব সব খাদিজারই।সব কিছু খাদিজার কাছে চেয়েই নিতেই হয়।অসুস্থ মেয়েকে ডাক্তার দেখাবে বলে টাকা চাইলে খাদিজা খেঁকিয়ে ওঠে,
“- মাসের শেষ এহন টাহা কই পাবো?
“- মেয়েটার খুব জ্বর আসে রাতে।সারা রাত ঘুমাতি পারে না। একটা ডাক্তার দেখানো হলি ভালো হতো মা!
“- সামনের মাসে খালিদ টাকা পাঠাক তহন ডাক্তার দেহাস।
“- তালি বড় মোরগটা বেঁচে দেই মা!
“- ক্যা! খবরদার এই কাজ করলি তোর দেহিস কি করি? ঐ মোরগটা আমার আরশ পছন্দ করছে।ও নানা বাড়িত তে আসলিই মোরগরা জবেহ করে ছিটা রুটি দিয়ে খাওয়াবো। ওর খুবই পছন্দের খাবার।ওর পছন্দ জেনেই তুই এমন কতা কলি তাই না?জায়ের ছেলেকে এতো হিংসে তোর?সব বুঝি আমি।যা তো তুই আমার সামনে তে।
তানি জানে খাদিজাকে মেয়ের অসুখ নিয়ে আর কিছু বলায় বাহুল্য।খালিদ মাসে ২০ হাজার টাকা পাঠায়।মাসের ২৫ দিন নিরামিষ , ডিম তরকারি খেয়ে কিভাবে ২০ হাজার টাকা ফুরিয়ে যায় তানি বুঝেও না বোঝার ভান করে বসে থাকে। মাজিদের ধানের ব্যবসা আজকাল বেশি ভালো যাচ্ছে না। মাকে এসে ধরলে খাদিজা ছেলের সাথে সম্পর্ক ঠিক করার লোভে খালিদের পাঠানো টাকার সবটাই বড় ছেলের হাতে তুলে দেয়।মাজিদ কে টাকা দিতে তানি নিজে চোখে দেখেছে যখন মাজিদ এ বাড়ি প্রথমবার এসেছিল।এরপর তো রোজই আসা যাওয়া মাজিদ মাজিদের বউ ছেলের।ছেলেটা তানির মেয়ের কাছে আসতে চাইলেও আসতে দেয় না মাজিদের বউ মুন্নি।মাজিদ খালিদের টাকায় বড় মাছ গোশত কিনে খায় আর মায়ের জন্য নিয়ে আসে।খাদিজা নিজে খাই ছেলেকেও খাওয়ায় আর যেটুকু বাচে মনচাইলে কায়েনাত কে দেয় নয়তো কুকুর মুরগিকে।তানির এতে কষ্ট দুঃখ কিছুই লাগে না।যার স্বামীই এখন পর তার জন্য তো দুনিয়ার সবই পর।মেয়ের ঘুম ভাঙার শব্দে তানি ডিমের বাটিটা হাতে নিয়ে ঘরে চলে যেতেই খাদিজা বের হয়।টেবিলে রাখা আলু ভর্তা,শাক ভর্তা দেখে নাক সিটকায়।মনে মনে ভাবে আজকের সকাল সে মাজিদের বাড়িই খাবে।দুপুরের আগে আগেই তো ভাই বাড়ি চলে যাবে।শাড়িটা ঠিক করে কয়লার মাজন দিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে মাজিদের বাড়ির পথে হাঁটে। তানি মেয়ের মুখ ধুইয়ে ব্রাশ করিয়ে কোলে নিয়ে উঠোন ঘুরে ঘুরে ডিমটা খাওয়ানোর চেষ্টা করে।কায়েনাত জ্বর মুখে কিছুতেই ডিম খাবে না।পেট ফুলে বমি আসার ভাব করে।তবুও মা জোড় করে ডিম মুখে দেয়।কান্নার জলে চোখ ভিজে যায় কায়েনাতের।এক খাবার রোজ রোজ কেন যে মা তাকে দেয়? মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বুকটা ফেটে যায়।শুকিয়ে এতোটুকু হয়ে গেছে মেয়েটা তার।বুকের হাড্ডি সহজেই গোনা যায়। মা হয়ে না পারছে একটু ভালো খাবার তুলে দিতে না পারছে পথ্য তুলে দিতে।কি দূর্ভাগ্য তানির মাতৃত্বের!
“- মা! দুদুভাত থাবো! দিম থাবো না।
“- রাতে দিবানে মা! এহন একটু খা।ভাত মেখে আনি আলু, শাক দিয়ে?
“- না থাবো না! থাবো না।
“- একটু খা সোনা।রাত্তিরেই দুধ ভাত খাওয়াবো।একটু আলু ডিম দিয়ে ভাত মেখে খা।
“- না! না!
মেয়েকে কোমড়ে ঠেকিয়ে অনেক বুঝিয়েও কিচ্ছুটি মুখ দিতে পারে না।বাপে পায় লাখ টাকা আর মেয়ে খায় শাক পাতা।হায়রে নিয়তি! তানির মেয়েকে খাওয়াতে গিয়ে খেয়ালই করে নি তাজ আধঘন্টা যাবত কিছুদূরে দাড়িয়ে ওকেই আপাদমস্তক বুভুক্ষিত নজরে দেখছিল।একসময় ঠিক পেছনে এসে দাড়িয়ে বহুদিনের জড়তা কাটিয়ে বললো,,
“- কেমন আছিস তানি?
“- কিডারে! তুই!তাজ কে এমন বুভুক্ষু নজরে তাকিয়ে থাকতে দেখে আৎকে ওঠে।তাড়াতাড়ি শাড়ির আঁচল টা মাথায় টেনে নেয়।
“-হা!হা!হা! ভুলে গেছিলি নাকি?
“- তোর মতো শয়তানরে মানুষ ভুলতে চালিউ কি ভুলতি দিবি?এহানে আইছিস ক্যা?
“- তোরে দেকতি! কেমন শুকায়ে গেছিস? খালিদ কি টাকা পয়সা দেয় না?
“- আমারে দেহার এতো সখ জাগলো ক্যা তোর? আমি শুকায়, মোটা হই তা দিয়ে তোর কি কাম? পাছে কেউ তাজের সাথে তানিকে দেখে দুকথা রটায় তার আগেই তানি মেয়েকে কোলে নিয়ে ঘরের দিকে ছুটতে গেলো।তাজ কি করে যেন তানির অব্যক্ত কথা বুঝে আগে ভাগেই পথ রুদ্ধ করে দাড়ালো।
“- কি হচ্ছে কি? এমনে দাড়াইছিস ক্যা।পথ ছাড়।
“- পথ তো ছাড়ার জন্য ধরি নাই সখি।
“- লাত্থি দিয়ে তোর মুখ ভাঙে দিবো হারামি।সখি কারে কইস?
“- দে না লাত্থি!দে! তাজ মাটিতে বসে তানির পা টেনে ধরে।তাজের হাত তানির শাড়ির নিচ দিয়ে নগ্ন পায়ের উপরে উঠতে গেলেই তানি ঝটকা দিয়ে পা ছাড়িয়ে দৌড়াতে যায়।
তাজ তানির আঁচল ধরে এমন জোরে টান দেয় যে তানি আর নড়তে পারে না।এতোদিন মুখের কথায় তাজকে যে সাহস দেখিয়েছে আজ তাজের বাড়াবাড়ি রকম সাহস আর নির্লজ্জতা দেখে সব সাহস তানির ভয়ে পরিবর্তন হলো।এদিক ওদিক ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে মেয়েকে একহাতে শক্ত করে ধরে অন্য হাতে তাজের হাত থেকে আঁচল ছাড়ানোর চেষ্টা।
“- তাজ! বেশি করছিস কলাম।এতো স্পর্ধা কি করে করলি? ছাড় কচ্ছি।
“- এতো তেজ ক্যা তোর?সব জানি আমি বুঝলি? তোর স্বামী তোর শ্বাশুড়ির খবর।আমি তোরে চাই তানি।তুই চলে আয় আমার কাছে।
“- কি কইস এসব?এসব পাপ তাজ! আল্লাহর দোহায় লাগে ছাড় আমারে তুই। কিছুই নেই আমার।কি জন্যি আমার পিছে এহনও ঘুরিস ক?তোর পায়ে পড়ি ছাড়ে দে আমার আঁচল।
“- নে ছাড়ে দিলাম!তোর যা আছে তাই আমার চাই।তোরে আমার চাই রে তানি।
তানি আঁচল ছাড়া পেয়ে দৌড়াতে গেলে তাজ আবার তানির হাত ধরে ফেলে।ছোট্ট কায়েনাত কৌতুহল চোখে মায়ের অসহায়ত্ব বোঝার চেষ্টা করছিল।মায়ের চোখে ভয়,জল দেখে ফুঁপিয়ে কেদে ওঠে সেও।
“- বাহ! তোর মেয়েটা তোর মতোই হয়ছে।তুই যদি আমারে মাইনে নিতি তালি এই মেয়ে আমার হতো।সমস্যা নাই।তোর মেয়ে আমারও মেয়ে।খালিদ তোরে ধোঁকা দিছে তানি।আমি দেবো না।তোর মলিন হওয়া সোনার অঙ্গ আবার ফুলের মতো সুন্দর করে দেবো আমার ভালোবাসা আর আদর সোহাগ দিয়ে।
“- খালিদ যদি সব পাইয়েও ধোঁকা দেয়। তুই তো আরও আগে দিবি।তোরা সব এই দেহের পাগল।মনের সাথে তোগের কোনো সম্পর্ক নেই।চাই না তোকে! চাই না খালিদ কেও।তোরা সব পুরুষ এক।
“- তুই যা ভাবিস তাই।তবুও তোরেই আমার চাই।তোর কষ্ট আমার সহ্য হয় না।কতোদিন স্বামীর আদর পাইস নে।আজ আসবো তোর ঘরে হুমম।বলনা?তাজ তানির গাল টা ছুয়ে কাঁধে হাত দেয়। তানি আর সহ্য করতে পারে না তাজের অশ্লীল ইংগিতবাহী কথা আর অসভ্য নোংরা স্পর্শে।রাগে,অপমানে হাত ঘুড়িয়ে চড় বসিয়ে দেয় তাজের গালে।
“- কুত্তার বাচ্চা! লম্পট স্বর্গ থেকে ঘুরে আসলিও লম্পট থাকে।তুইও তাই।তোর চোখে নারীর জন্যি প্রেম না লোভ দেখা যায়।
আর কোনোদিন যদি আমার ধারের কাছে তোরে দেখি থানায় যাইয়ে রিপোর্ট করতি আমার দু মিনিট সময় লাগবি না।
তানি কথাটা শেষ করেই কাঁপা কাঁপা শরীরে ঘরের ঢুকে দরজা বন্ধ করে মেয়েকে বুকে চেপে কাঁদতে থাকে।
তাজ মুখে যতোই যা বলুক কোনোদিন আশাও করে নি তানি এভাবে চড় মারবে।আজকে ভয় দেখিয়ে তানিকে দূর্বল করতে চেয়েছিল।কিন্তু উল্টো অপমানিত হতে হলো।তাজ আগের মতো হজম করতে পারলো না তানির থাপ্পড়।
আজকের চড় তাজের আত্মসম্মানে গিয়ে লাগে।রাগে চোখ লাল হয়ে যায়।দাঁত কটমট করে তানির ঘরের দিকে একবার তাকিয়ে চলে যায়।
খালিদের দিন রাত সব মধুর মনে হলেও কোথাও যেন একটা শূন্যতা অনুভব করে।বুকটা খা খা করে।পাপ কর্মে আনন্দ লাভ করলেও যে শান্তি পাওয়া যায় না।খালিদ শূন্যতা কাটাতে জাহানকে কল করে মাথা থেকে ভাড় ভাড় হওয়া জড়তা কাটাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।জাহানের বোনের ছোট্ট একটা মেয়ে আছে।বয়স কায়েনাতের মতোই হবে।আজ জাহান ভিডিও কলে কথা বলার সময় বোনের মেয়েটাকে কোলে নিয়ে বসে।বাচ্চাটাকে দেখে খালিদের কথা এলোমেলো হয়ে যায়।জাহানের সাথে ঐদিন আর কথা বলতে পারে না।বাচ্চার মুখটা দেখে খালিদের বুকের বাম পাশে মৃদু টান লাগে।পিতৃত্বের টান।
গোধূলির শেষ আলো?
পর্ব ২৬
Writer Tanishq Sheikh Tani

খাদিজা মাজিদের বাড়ি খেয়ে দেয়েই নতুন শাড়ি পড়ে ভাইয়ের বাড়ি রওনা হয়।সাথে বড় বউ আর নাতি আরশও যায়।নাতিকে নিয়ে খুশিতে এতোই গদগদ হয়ে যায় যে নাতনী আর ছোট বউয়ের কথা বেমালুম ভুলে যায়।ভুলে যায় ছাঁদের দরজায় তালা দিয়ে চাবি নিয়ে যাচ্ছে।৩/৪ দিন ভাই বাড়ি বেড়ানোর খুশিতে তানি রাতে ট্যাপের পানি ছাড়া কি করে কাটাবে সেটাই মনে থাকে না।
খাদিজা চলে যাওয়ার পর তানি বাড়ি ঘর পরিষ্কার করে সব জিনিস আগেই ঘরে তুলে রাখে।কারন রাতে একা ঘর থেকে সে কোনোমতেই বেরুনোর সাহস করবে না।মোরগ বেঁচে মেয়ের ওষুধ কিনবে কিন্তু কার কাছে বেচবে সেটাই বুঝে উঠতে পারছে না তানি।আল্লাহর কৃপায় তখনই বাড়ির পাশ দিয়ে আদিলকে যেতে দেখে ডাক দেয় তানি।
“- আসসালামু আলাইকুম ভাবি! কেমন আছেন?
“- জ্বী ভাই আছি কোনোমতে। ভাই একটা উপকার করতি পারবেন?
“- এভাবে কেন বলছেন ভাবি? ভাই বললেন আবার সংকোচও করছেন? বলেন কি লাগবে আপনার?
তানি দৌড়ে মোরগটা নিয়ে আসে।
“- এই মোরগটা বেঁচে দেবো ভাই।কিন্তু কার কাছে বেচবো বুঝতেছি নে। আপনি যদি বেচে দিতেন?
“- এ আর এমন কি কাজ? দিন আমি বিকেলেই বেচে দেবো।
“- আমার যে টাকাটা এখনই লাগবি।
“- কোনো সমস্যা ভাবি? আমাকে বলুন যদি বলার মতো যোগ্য মনে করেন?
“- আপনার ভাতিজির শরীর ভালো না ভাই।রাতে রাতে খালি জ্বর আসে। উনি তো টাকা পাঠাতে পাঠাতে সামনের মাস।এতোদিন মেয়েটা কষ্ট করবে তাই?
“- ছি! ভাবি আপনি এজন্য আমাকে দিয়ে মোরগ বেচাচ্ছেন? আপনি মনি রে নিয়ে রেডি থাকেন আমি বাড়ি থেকে আসছি।একটু পরই ডাক্তারের কাছে যাবো।
“- না! ভাই।দরকার নাই।আমিই যাবানে।আপনি মোরগটা বেঁচে দেন।
“- ভাবি কি হয়েছে? বলেন না? আমি কি পর? খালিদের ভাই আমি।বলেন?
“- এজন্যই তো বলবো না।আপনার ভাইয়ের কিছুই আমার লাগবি নে ভাই।আমি পরশু বাপের বাড়ি চলে যাবো। মেয়েরে নিয়ে মানুষির বাড়ি কাম করে খাবো তবুও কারো ঘাড়ে বোঝা হয়ে থাকবো না।তানি কথাগুলো বলে মুখে আঁচল গুঁজে কেদে ওঠে। মনের চাপা কষ্ট কাওকে বলবে না ভেবেও আদিলের জোড়াজুড়িতে বলেই দিল।বুক ভেঙে কান্না ঢলে আসছে তানির চোখে।এতো লজ্জা, এতো অপমান নিয়ে আদিলের সামনে দাঁড়াতেও কষ্ট হচ্ছে।
“- ভাবি কাঁদবেন না।কি হয়েছে খুলে বলেন? আমি কাওকে বলবো না।খালিদ কিছু করেছে? ঐদিন হাসপাতালেও আপনার চোখে মুখে বিষন্নতা দেখেছিলাম আমি।বলেন ভাবি?
“- কিছু না ভাই।আমার কাওকে কিছু বলার নাই।তারপরও যদি কিছু জানতে হয় আপনার ভাইয়ের কাছে জিজ্ঞেস কইরেন।সাথে এও জিজ্ঞেস কইরেন সে আমার জীবন নষ্ট করে কি সুখ পালো।
“- কি বলছেন?আমি কিছু বুঝতে পারছি না। কাকি কই?
“- লিজাদের বাড়ি।
“- আপনাকে একা রেখে গেছে?
“- কপালই তো আমার একা থাকার।আচ্ছা বাদ দেন ভাই।বেঁচে দেন দয়া করে।বিকেলের আগেই দিয়েন।মেয়েডা আমার দুধ খাইতে চাইছে রাতে।বাপ হয়ে আপনার ভাই মেয়েকে ভুললেও আমি মা হয়ে নিজের সন্তানরে ভুলতে পারি না।আসি ভাই।
তানি আদিলকে কথার বলার সুযোগ না দিয়ে চোখ মুছতে মুছতেই বাড়ির ভেতর চলে গেলো।
আদিল ছটফটানো মোরগটা হাতে নিয়ে মূর্তিমান হয়ে দাড়িয়ে রইল।খালিদ এমন করতে পারে স্ত্রী সন্তানের সাথে আদিল এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না।তানির পাড় ছেড়া পড়নের শাড়ি,মেয়েকে একটু দুধে ভাতে খাওয়ানোর কথা বলে তানির চোখের জল আদিলের অবিশ্বাসকেও বিশ্বাস করিয়ে ছাড়ে।রাগে মোরগের পাখনা চেপে ধরতেই মোরগ কক কক করে ওঠে।মোরগের রুক্ষ ডাকে আদিলের ঘোর কাটে।এক হাতে মোরগ অন্য হাতে মোবাইল বের করে খালিদের নাম্বার ডায়াল করতে করতে সামনে চলতে থাকে।
আদিল চলে যাওয়ার কিছু সময় পরই তানির নাম্বারে খালিদের কল আসে।কায়েনাতকে ঘুম পাড়িয়ে তানি চুলায় জ্বালানোর জন্য খড়ি গুছিয়ে রাখছিল।তখনই মোবাইলে খালিদের নাম্বার ভেসে আছে।আদিল নিশ্চয়ই খালিদকে কিছু বলেছে নয়তো এই সময় হঠাৎ কল দেওয়ার মানুষ খালিদ না।অন্তত বর্তমান প্রেক্ষাপটে তো একদমই না।তানি নিজেকে শক্ত করে বসিয়ে রাখে।মোবাইল সে ধরবে না পণ করে।কিন্তু মনটা মুহূর্তে গলে জল হয়ে যায় ভালোবাসা লিখে সেভ করা নাম্বারটা দেখে।খালিদই নাম্বার টা ভালোবাসা নামে সেভ করে দিয়েছিল।নাম একই আছে কিন্তু মানুষ পাল্টে গেছে।তানির চোখ দুটো জলে ভরে আসে।খালিদ কল দিতেই থাকে।৪ বারের বার তানি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনা।কল টা ধরে কানে নিয়ে মানুষটার গলা শুনে অন্তর জুড়ায়।ভালোবাসার টান এমন কেন? কেন ঘৃণা করা হয়ে ওঠে না মানুষটাকে?
“- আসসালামু আলাইকুম।
“- তুমি আদিলকে কি বলেছ?
“- মোরগ বেচতে? কেন কি হয়েছে?
“- মোরগ বেচতে বলেছিস কেন? তোরে টাকা পয়সা পাঠাই না আমি? মানুষকে বলে বেড়াস আমি খারাপ!তোদের না খাইয়ে রাখি।ছি! এতো নিচ তুই।
“- নিশ্চুপ
“- কথার জবাব দে তানি! কায়েনাতের কি হয়েছে?আমার মেয়ের অসুখ আর সেটা আমাকে আরেকজনের কাছে শুনতে হয়?
“- কার মেয়ে! হা! হা! হা!
“- থাপ্পড় দিয়ে দাঁত ফেলে দেবো নাটক করলে? ভঙ ধরছো তাইনা? আসি আমি বাংলাদেশ সব ভঙ ছুটিয়ে দেবো তোমার?
“-এসে যদি না পান? যদি মরে যাই।মরে গেলেই ভালো হবে তাই না? আপনার পথের কাটা সরে যাবে।
“- তানি! তানির কথা শুনে খালিদের বুকটা হঠাৎ কেঁপে ওঠে।এতোদিনের চাপা পড়া টান টা মুহূর্তে উন্মুক্ত হয়ে সজোরে হৃদপিণ্ডের শিরায় শিরায় টান মারে।
“- পরশু আমি চলে যাবো।আপনি যে আমাকে আর চান সেটা আমি বুঝে গেছি।তা আমার সতীনের নাম কি? আমাকে তালাক দিয়েই বিয়েটা করবেন না বড় বউ রেখেই করবেন? তা যাই করেন আমার সমস্যা নেই।আমি আমার মেয়েকে নিয়ে চিরতরে আপনার জীবন থেকে চলে যাবো।হাসি মুখেই খালিদকে গড় গড় করে কথাগুলো বলে কেমন যেন প্রশান্তি পেলো।
“- তুই কি বলছিস এসব? দ্যাখ মেজাজ খারাপ করিস নে।কি হয়ছে বল? কে কি বলছে? খালিদের গলার স্বরটা কেঁপে ওঠে।শরীর ঘামতে থাকে কি এক অজানা ভয়ে।কি যেন হারিয়ে যাওয়ার ভয় আঁকড়ে ধরেছে হঠাৎই।
“- আমার মন বলেছে।আমার মন বলছে আপনি আমারে আর চান না।আমার মন বলছে আপনাকে আমি আমার মরার মুখ ও যেন না দেখায়।আমার মন আপনার মতো মিথ্যুক আর ধোঁকাবাজ না।তাই কোনো মিথ্যুক ধোকাবাজের ছায়াতেও সে থাকতি চাচ্ছে না।ভালো থাকবেন।ও হ্যা ভয় পাবেন না যেন? আমি আপনার নামে কেস টেস কিছুই করবান না।নিশ্চিন্তে আমার সতীন নিয়ে ঘর করতি পারেন।আর শোনে!কারো সাথে কথা কইলি তার সালামের জবাবটা অনন্ত দিয়েন।সে যে কিছুই না আপনার জীবনে এভাবে না বোঝালেও পারেন?
“- তানি!!চিৎকার করে ওঠে খালিদ।
“- ঠুটটটট,,,,ওপাশ থেকে তানি কাঁদতে কাঁদতে খালিদকে মনের সব কথা বলে কলটা কেটে দিল।মনে হচ্ছিল আরও কিছুক্ষণ ঝগড়া করতে।তাতে অন্তত মানুষটার গলা শোনা যেত।কিন্তু রাগ টা যে খালিদকে সহ্যই করতে পারছে না।ভালোবাসি ভালোবাসি বলে জীবনটাই শেষ করে দিল যে তার সাথে কিসের ভাব? কোনো আপোষ করবে না খালিদের সাথে তানি।মনে মনে একপ্রকার জেদ নিয়ে আসে।এদিকে খালিদের মনটা হঠাৎ করেই দূর্বল হয়ে গেলো।তানি যে এতো শক্ত করে কথা বলবে তা খালিদ কস্মিনকালেও ভাবে নি।খালিদ ভেবেছে ওর পাপ ওর পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। তানিকে দেওয়া ধোঁকা তানির মতো বোকা সোকা গায়ের মেয়ে টেরও পাবে না।তাছাড়া জাহানকে সে কি আর বউ বানাতো? প্রেম তো শুধু সময় কাটানোর ছুতা একটা।বউ তো তানিই তার।বাইরে একশটা সম্পর্ক থাক ঘরের রাণী তো তানিই।কিন্তু এই বোকা রানীটা যে এতো চতুর হয়ে নিজের অধিকার বুঝে গেছে তা খালিদ স্বপ্নেও ভাবতে পারে নি।আত্নসম্মানি হয়ে উঠে তার সকল অন্যায়ের মুখে চপেটাঘাত করে চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিল তানি ছাড়া খালিদের গতি নেই।এখন তার মন কাঁদে। বাচ্চাদের মতো হাত পা ছুড়ে কাদে বুকের ভেতর।তানির বলা প্রতিটি কথাই তার মনকে দুমড়ে মুচড়ে ফেলে।তানির প্রতি পুরোনো ভালোবাসা আবার জেগে ওঠে তানিকে হারানোর ভয়ে।সে সব হারাবে কিন্তু তানিকে হারাতে পারবে না।নিজেই নিজেকে লানত দেয় এতোবড় অঘটন ঘটানোর জন্য।এতো বড় অন্যায় আর পাপে লিপ্ত হওয়ায়। তানিকে যে করেই শান্ত করতে হবে।তানিকে ছাড়া খালিদের চলবে না।দরকার হলে জাহানের সাথে সব সম্পর্ক চুকিয়ে ফেলবে।আবার আগের মতো ভালোবাসবে তানিকে। তবুও তার গৃহলক্ষ্মীকে তার হারানো যাবে না।মেয়েজাত ভালোবাসার কাতর।নিশ্চয়ই ভালোবাসা দিলে আবার আগের মতোই বিশ্বাস করবে।
নয় ছয় পার করে তানির মন জয় করার বুদ্ধি খুজতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো খালিদ।

সন্ধ্যার আজানের আগ দিয়েই তানি মেয়েকে ডাক্তার দেখিয়ে এক কেজি গরুর খাটি দুধ কিনে আনে।আদিল তানিক মোরগ বেচার এক টাকাও খরচ করতে দেয় নি।নিজেই ভাজিতিকে ডাক্তার দেখিয়ে, বাজার থেকে দুধ,একটা বড় ইলিশ কিনে তানির হাতে জোর করে ধরিয়ে দেয়।তানি মেয়েকে বারান্দায় খেলনা সহ বসিয়ে ইলিশ মাছ কাটতে বসেছে।কি ঘ্রাণ ইলিশের! কতোদিন পর ইলিশ খাবে তানি? দুটো বড় বড় ডিমও হয়েছে ইলিশের।আজ প্রথম মেয়েকে ইলিশের ডিম দিয়ে ভাত খাওয়াবে।কায়েনাত নিশ্চয়ই মুরগির ডিম ভেবে খেতে চাইবে না।কিন্তু তানি ইলিশের ডিম মাখা ভাত মেয়ের মুখে দিতেই মেয়ে খুশি হবে।তানির দৃঢ় বিশ্বাস ওর মেয়ে খুবই মজা করে ভাত খাবে আজ।মুখে থাকবে শান্ত নদীর জলের মতো টলটলে হাসি।কতোদিন খাওয়ার সময় মেয়েকে হাসতে দেখে নাই।মাছ ধুতে ধুতেই আজান দিয়ে দিলো।বাইরের চুলোয় আর রান্না বসালো না।রান্না বলতে আর কি? মাছ গুলো ভেজে রাখবে আর বুটিকাটা লেজ, একটা পেটির অংশ সহ তেল,পিয়াজ,জিরা, কাচামরিচ, হলুদ,লবন দিয়ে হাতে মাখিয়ে ঝোল করবে।প্রিয় খাবার এই ঝোল টা তানির।সিলিন্ডারের চুলায় কড়াই বসিয়ে দরজা জানালা সব বন্ধ করে কেচি গেট লাগিয়ে আবার রান্না ঘরে ঢুকলো।মাছ ভাজতে ভাজতে মেয়েকে হাসি মুখে ঝুনঝুনি,পুতুল নিয়ে খেলতে দেখলো।আজ কায়েনাতের কাকা কায়েনাত কে এসব কিনে দিয়েছে।খেলনাগুলো হাতে পেয়ে তার মুখে চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো খুশি উপচে পড়েছে।তানি মেয়ের এই খুশিটুকুই বার বার দেখছে।নিজেই নিজেকে আবার বলছে”- এতো দেহিস নে লো! নজর লাগে যাবি।
মাছগুলো ভেজে একটা বাটিতে ঢেকে রাখলো।কাল আদিল তানির হাতের রান্না খাবে বলেই মাছটা কিনে দিয়েছে।আসলে আদিল ইচ্ছা করেই মাছটা কিনে দিয়েছে।তানি এটা ভেবেই লজ্জা পায় যে আদিল ওকে দয়া করেছে এই দুরবস্থা দেখে।
মেয়ের জন্য প্রথমে ভাত আর মাছের ডিম নিয়ে ঘরেই যাবে তখন দেখে জগে একফোটাও পানি নাই।এসব খুশিতে পানি ভরার কথা ভুলেই গেছিল।এদিকে গোধূলির শেষ আলো মুছে চারিদিকে ঘন অন্ধকার নেমে আসছে।

চলবে,,,,,