গোধূলি রাঙা আলোয় পর্ব-০৫

0
333

#গোধূলি_রাঙা_আলোয়
#পর্ব_৫

আতিকার আজ কাজে মন বসেনি। মনে মনে যত দোয়া পড়া যায় পড়েছে। ব্যাগের সবকিছু উল্টেপাল্টে দেখেছে বহুবার। কাজে ভুল হয়েছে। সহকর্মীর সাথে ঝগড়া হয়েছে। নিজের হতাশা রাগ ঝেড়ে ফেলেছে রোগীর লোকের উপর। এক রোগীর স্বজন, বার বার জিজ্ঞেস করছিল”ডাক্তার কখন আসবে?”
আতিয়া প্রথমে একবার বলছে, “রাউন্ড শুরু হলে আসবেন।”

এরপরও যখন কয়েকবার আসলেন, তখন একটা ঝাড়ি দিয়ে দিলো। রোগীর স্বজন তো রেগে গেলেন। বলেই ফেললেন, “এমন ভাব করছেন যেন বিনা পয়সায় হাসপাতালে আছি। প্রাইভেট হাসপাতালে এত টাকা দিয়ে যদি রাগ দেখতে হয় তাহলে তো হবে না।”

সেই রোগীর স্বজন আবার প্রভাবশালী ছিলেন। তিনি ঘটনা অফিসে জানালেন। আতিয়াকে অফিসে ডেকে নিয়ে সাবধান হতে বলা হলো। সেই স্বজনের কাছে ক্ষমাও চাইতে হলো। এমনিতে নিরীহ রোগী আর তাদের লোকজনকে কতদিন কত বিষয়ে রেগে কথা বলেছে কিছু হয়নি। আর আজ সামান্য বিষয়ে অফিস পর্যন্ত তলব হবে ভাবতে পারেনি আতিয়া। আতিয়া শারীরিক অসুস্থতার বাহানায় এই যাত্রায় অফিস থেকে সহজে ছাড়া পেল।

আশিক আজ প্রথম বেতন পেল। গত একমাস বেশ খাটুনি গিয়েছে। সকাল দশটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত, টানা দশ ঘন্টার ডিউটি। দুপুরে লাঞ্চ ব্রেকে বাসায় গিয়ে খেয়ে আসতো। ভাগ্য ভালো বসুন্ধরা থেকে কাঁঠাল বাগানের দূরত্ব বেশি নয়। বাসায় কাউকে বলেনি এই কাজের কথা। আগে নিজে করে দেখতে চেয়েছে কাজটা করতে কেমন লাগে। একটা শপে, শপ এসিস্ট্যান্ট এর কাজ নিয়েছে আশিক। অনেক শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা এখন এই কাজ করছে। আগের মতো ‘দোকানে কাজ করা ছেলে’ বলে মনে হওয়া দিন নেই। ব্রান্ডের শপগুলোয় তো রীতিমতো স্মার্ট, শুদ্ধ কথা বলতে পারে, শিক্ষিত এমন ছেলেমেয়েদের রিক্রুট করা হয়। আশিকের অনার্স শেষ হয়েছে। চাকরির চেষ্টাও করছে। বড়ো বোন আতিয়া চেয়েছিল হসপিটালে ঢুকিয়ে দিতে। কিন্তু পিয়নের কাজ আশিক করতে পারবে না৷ প্রাইমারি নিয়োগ পরীক্ষার রিটেন দিলো। ভাইবার পর চাকরিটা যদি হয়ে যায়, সবকিছু অনেক সহজ হবে। কিন্তু ঢাকা শহরে প্রাইমারি নিয়োগ হওয়া কঠিন। আশিক তাই বাবার দেশ নোয়াখালী দিয়েছে জেলা হিসেবে। চাকরি হলে নোয়াখালী চলে যেতে হবে। ওখানে সেই ছোটোবেলায় যেত। এখন কারও সাথে যোগাযোগও নেই। মায়ের বাড়ি ঢাকাতেই। মানে সেই ছোটোবেলায় নানা নানী সব ছেড়ে ঢাকার পাকাপোক্ত বাসিন্দা হয়েছেন। গ্রামে নানার বাড়ি বলতে এখন কিছু নেই।

এই চাকরিটা আশিক বাধ্য হয়ে নিয়েছে। হাত খরচ চালানো মুশকিল হয়ে গিয়েছিল। বড়ো বোন আতিয়ার আয়ে সংসার চলছে ঠিকই, কিন্তু তাতে কোন গতি নেই। আতিয়া বাবা হামিদ আলীর মতো চালু নয়। বাড়তি পয়সা রোজগারের পথ ওর জানা নেই। বাড়তি পয়সা আয়ের নানা পথ জানতে হয়, শুধু চাকরির পয়সার উপর নির্ভর করে চলা যায় না এই শহরে। এই বিষয়টা আশিক বুঝলেও মা দেলোয়ারা বেগম যে বোঝেন না তা জানে আশিক। মা ভাবেন একই হাসপাতালে কাজ করে স্বামী ভালো চালাতে পারলে, মেয়ে কেন পারে না! বোনের সাথে খুব বেশি সখ্যতা নেই আশিকের। হয়তো বয়সের পার্থক্যের জন্য! তবে বোনের উপর অযথা সবার অভিমান ওকে পোড়ায়। ঘরোয়া কুট কাঁচালি ওর ভালো লাগে না বলে, মা বোনদের ঝামেলা ও এড়িয়ে যায়। তবে ওর সাথে কেউ আতিয়ার বদনাম করতে আসলে ও আতিয়ার দিকটা বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করে। আতিয়ার সাথে ভাইবোন সবারই বয়সের পার্থক্য অনেক বেশি। আতিয়ার জন্মের পর আরও দুটো ছেলে হয়ে মারা যায় দেলোয়ারা বেগমের। প্রায় দশ বছর পর আশিকের জন্ম হয়। এরপর আয়েশা আর আলো আসে। আশিক তাই দেলোয়ারা বেগমের খুবই আদরের ছেলে। এই যে চাকরিবাকরি হচ্ছে না, তাতেও দেলোয়ারা বেগম কঠিন কোন কথা শোনান না। দুপুরে আশিক খেতে গেলে যা থাকে, তাই দিয়ে গুছিয়ে আদর করে খাওয়ায়। ভালো খাওয়াতে পারছে না বলে আফসোস করে। মায়ের এই মমতাময়ী রূপের জন্য আশিক চাইলেও মাকে কিছু বলতে পারে না। তবে মাঝেমাঝে পরিস্থিতি বোঝানোর চেষ্টা করে।

আজ বেতনের ষোল হাজার টাকা হাতে নিয়ে মনটা ভালো হয়ে যায়। যদিও দশঘন্টা কাজ করে ষোল হাজার বেতন কিছু না। তবুও বেকার ছেলের জন্য অনেক কিছু। তাছাড়া এই দোকানে কাজ করে আশিকের ভালো লেগেছে। রকমারি জিনিসের দোকান। পারফিউম, কসমেটিকস, মেয়েদের কানের দুল,চুলের ব্যান্ড সহ সাজসজ্জার জিনিস আছে। একপাশে বাচ্চাদের জামাকাপড় আর খেলনাও রাখা। আশিকের কাজ দোকানে আসা লোকজনকে জিনিস দেখানো। আশিকের সাথে আরেকজন কাজ করে। দোকানের মালিক মিসবাহ শরীফ, আশিকের মিসবাহ ভাই বেশ ভালো মানুষ। ক্যাশের সামনে বসে থাকেন। কর্মচারী কম, ছোটভাই হিসেবেই দেখেন। আশিকের বন্ধু হাসানের বড়ো ভাই মিসবাহ ভাই। হাসানের মাধ্যমেই এই দোকানে আসা, কাজ নেওয়া। যদিও শুরুতে লজ্জা লাগছিল। বন্ধুর ভাই মালিক মানে বন্ধুও মালিক। হঠাৎ করে বড়ো ভাই আর বন্ধুর সাথে মালিক ভৃত্যের সম্পর্কে যাওয়াটা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছিল না। কাজটা করবে কী করবে না দ্বিধায় ছিল। দ্বিধা কাটিয়েছেন মিসবাহ ভাই। এত ভালো ব্যবহার করেন যে আশিকের অস্বস্তি চলে গিয়েছে। টাকাটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকে আশিক। এই টাকায় কী কী করা যায় ভেবে ফেলে। আট হাজার মায়ের হাতে দিবে। মা খুশি হবে অনেক। দুই হাজার আতিয়াকে। আলো আর আয়েশাকে এক হাজার করে দিবে। ওরা ওদের পছন্দে কিছু কিনবে। যদিও আয়েশা এক এ মানবে বলে মনে হয় না। ওর চাওয়ার অভ্যাসটা বেশি। মনে করে হেসে দেয় আশিক। আর চার হাজার টাকা নিজের কাছে রাখবে। হাত খরচ।

আতিয়ার দিনটাই আজ খারাপ ছিল। তীব্র রোদে মেইনরোড থেকে বাসায় হেঁটে এসে আরও তেতে যায়। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই বিরিয়ানির গন্ধ নাকে ধাক্কা দেয়। বাজার হয়নি। বাসায় বিরিয়ানি আসলো কই থেকে! আতিয়া দেখে সবাই খেতে বসেছে। আজ ওর ওভারটাইম ছিল। একবারে রাত আটটায় আসার কথা। কিন্তু মন ভালো ছিল বা বলে অসুস্থতার কথা জানিয়ে শেষ মুহূর্তে ডিউটি পাল্টে নিয়েছে অন্য সহকর্মীর সাথে। যদিও এরজন্য আরেকদিন ঐ সহকর্মীর ওভারটাইম করে দিতে হবে। হাসপাতালে আপাততঃ সিস্টার সংকট চলছে। সিস্টারদের তাই ঘুরেফিরে ওভারটাইম করতে হচ্ছে।

আতিয়াকে এই মুহূর্তে আশা করেনি দেলোয়ারা বেগম। মেয়ে আয়েশা আর জামাই খলিলকে ফোনে ডেকে এনেছেন। আশিক প্রথম বেতনের টাকা এনে মায়ের হাতে দিয়েছে। দিয়ে বলেছে “আম্মা, এই আট হাজার আপনার। আপনার যা মন চায় খরচ কইরেন।”

এই এক কথায় দেলোয়ারা বেগম আপ্লূত হয়ে গিয়েছেন। স্বামী হামিদ আলী বেঁচে থাকতে হঠাৎ হঠাৎ এভাবে এক দুই হাজার টাকা এনে হাতে দিতেন। আর বলতেন নিজের মন মতো কিছু খরচ করতে।বহুদিন পর কেউ এভাবে দিলো। তাও আবার আট হাজার! তিনি ঠিক করলেন আজ সবাইকে নিয়ে বিরিয়ানি খাবেন। আতিয়া যেহেতু রাতে আসবে, আতিয়ার বিরিয়ানি তাই তুলে রাখবেন। আলো বলে গিয়েছিল এসএসসির আগে স্কুলে ছুটির পর বাড়তি কোচিং করাচ্ছে সবাইকে। সেটাও ফ্রি। তাই কোচিং শেষে আসতে দেরি হবে। আলোও তাই বাসায় নেই।ওর বিরিয়ানিও তুলে রাখতে হবে। আয়েশা, খলিলকে নিয়ে আতিয়া থাকা অবস্থায় রাতে বাসায় আসবে না। তাই এই দুপুরেই তাদের জরুরি ভাবে আসতে বললেন। আশিক নিজে গিয়ে সবার জন্য কাচ্চি বিরিয়ানি আর সেভেন আপ নিয়ে এসেছে। সবাই মিলে আমোদ করে বসতে না বসতেই আতিয়ার আগমন। আয়েশা মায়ের দিকে তাকায়। দেলোয়ারা বেগম চোখের ইশারা করেন। সবই খেয়াল করে আতিয়া। দেলোয়ারা বেগম বলেন,

“তুই না রাতে আসবি বলে গেলি। তাই তোকে ছাড়া বসে গেলাম। দুপুরে আসবি যে একটা ফোন দিয়ে জানাবি না! যা মুখ হাত ধুয়ে আয়। তোর জন্যও বিরিয়ানি আছে। আমি সবার জন্য আনাইছি বিরিয়ানি।”

“তুমি আনাইছ! টাকা কই পাইলা আম্মা? আমার এত কষ্টের টাকা বাসা ভাড়া আর বাজারের জন্য দিলাম। সেই টাকা তুমি কী করছো সকালে তার হদিস দিতে পারো নাই। অথচ আমার মাথার ঘাম পায়ে ফেলা টাকা দিয়া তোমরা আমার আড়ালে আনন্দ উত্সব করো! আমাকে বললা সমিতি থেকে টাকা তুলে বাসা ভাড়া দিতে। অথচ এখানে লুকিয়ে বিরিয়ানি, সেভেন আপ খাইতেছ। ভাবছো আমার তো ওভারটাইম চলে। আমি তো আাসায় আসবো না। সত্যি তোমাদের দেখলে জোঁকও লজ্জা পাবে আম্মা। এমনে একটা মানুষের রক্ত চুষে জোঁকও খায় না। ভাড়ার টাকা গায়েব করে সুখ হয় নাই যে ব্যাগেও হাত দিতে হইলো? না বইলা ব্যাগ থেকে টাকা নেওয়াকে চুরি বলে জানো তো?”

“তুই এইভাবে কথা বলতেছিস ক্যান? আমি তোর ব্যাগ থেইক্কা টাকা নিছি? ঐ কয় টাকা নিছি তোর ব্যাগ থেইক্কা? কত লাখ টাকা রাখছোস তোর ব্যাগে? শুনছোস আশিক? তুই না খালি বোনের হইয়া আমারে বুঝাস। আমি যেন মাথা ঠান্ডা রাখি। দেখ তোর বইনের কথা। আমি বলে টাকা চুরি করছি। ঐ আতিয়া টাকা খালি তোর একার আছে? এই বিরিয়ানির টাকা আমার ছেলে দিছে।”

“আম্মা, আমি তোমারে চোর বলি নাই। কিন্তু আমার ব্যাগ থেকে তিন হাজার টাকা চুরি গেছে। কেউ না কেউ টাকা না নিলে টাকা তো উড়ে যায় নাই। প্রথমে আমার গয়না তুমি আমাকে জিজ্ঞেস না করে আয়েশাকে দিলা। তোমার গলায় চেইন বানালা। বাড়ি ভাড়ার পনেরো হাজার কাকে দিছ তুমি জানো। আমি তো একটা মানুষ। তোমরা আমাকে এই ভাবে ব্যবহার করো।”

“আপা, আমরা কেউ তোর টাকা নেই নাই। আর তোর কষ্ট হয় আমি বুঝি। কিন্তু তুই যেটা বলছিস, খুব খারাপ কথা বলতেছিস। বাসা ভাড়ার বিষয় হলে আমরা সমাধান করবো। আম্মা, তোমকে যে আট হাজার দিলাম সেখানে আর কত আছে? সাত হাজার আছে না? আমাকে দাও, আমি আর তিন হাজার মিলিয়ে বাসা ভাড়া দিয়ে দিচ্ছি। তারপরও আপা তুই আমাদের আর চোর বানাইস না।”

আতিয়া অবাক মুখে তাকিয়ে থাকে। একমুহূর্তের জন্য বোঝে না, ঠিক কী হচ্ছে। সে কী আসলেই খুব বেশি বলে ফেলেছে!