গোধূলি রাঙা আলোয় পর্ব-০৪

0
283

#গোধূলি_রাঙা_আলোয়
#পর্ব_৪

সকালে যখন আতিয়ার ব্যাগ থেকে টাকাটা সরায়, আলোর তখন ভীষণ ভয় লাগছিল। কিন্তু কী করবে, রাতুলের জন্মদিন আগামীকাল। রাতুলের জন্য গিফট কিনতে হবে, কেক কিনতে হবে। ওর জন্মদিনে রাতুল কত বড়ো একটা রেস্টুরেন্টে খাওয়াতে নিয়ে গিয়েছিল। দামি একটা আঙটি গিফট করেছে আড়ং থেকে। রাতুল অবশ্য জামা কিনে দিতে চেয়েছিল। আলোই দেয়নি। জামা লুকিয়ে রাখা যাবে না। কেউ না কেউ দেখে ফেলবে। আঙটি লুকিয়ে রাখা সহজ। তাছাড়া আসল মুক্তা, রূপা এসব হুট করে বোঝা যায় না। বললেই হবে নিউমার্কেট থেকে কেনা!

আলো এইবার এসএসসি পরীক্ষা দেবে। ষোল, সতেরো বছর বয়সী মেয়েদের কত রকম শখ থাকে। সাজগোছ, জামাকাপড়, ঘুরতে যাওয়া, বন্ধু বান্ধবের সাথে সিনেমা দেখা, আড্ডা দেওয়া। অথচ আলোর সেসব কিছু করার উপায় নেই। সাত বছর আগে বাবা হামিদ আলী যখন মারা যায়, আলো তখন সবে ক্লাস ফোরে উঠেছে। বাবার মৃত্যুর পর প্রথমে বাসা পাল্টানো হলো। তারপর স্কুল। সবচেয়ে কম খরচে কোথায় পড়ালেখা করানো যায়, আলোর বড়ো আপা আতিয়া সেটাই খুঁজে বের করলো। ভালো জামা কেনা শুধু ঈদের জন্য বরাদ্দ হলো। জুতো এক ঈদে কিনলে, অন্য ঈদে কেনা হয় না। চুড়ি, কানের দুল কোন কিছুই মন মতো কেনা হয় না। আলো একটু বড়ো হলে আতিয়া, আয়েশা আর আলো ঘুরেফিরে একই ভালো জামাগুলো পরেছে। তবে আতিয়া খুব গাঢ় রঙ পরে না। বিধবা আর বয়স হয়েছে বলে একটু হালকা রঙ পরে। আলোর আবার উজ্জ্বল রঙ পছন্দ। আয়েশারও তাই ছিল। কিন্তু বিয়ের পর যখন তখন আয়েশার কাপড়গুলো পরতে পারে না। আয়েশা শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার সময় নিজের ভালো জামা, জুতো সব নিয়ে গিয়েছে। এত হিংসুক আয়েশা। খালি বাবার বাড়ি থেকে এটা সেটা বের করার তালে। কিন্তু এক পয়সা খরচ করতে রাজি না। আলো তাই আয়েশার চেয়ে আতিয়াকে বেশি ভালোবাসে। কিন্তু তারপরও সেই বোনের ব্যাগ থেকে টাকা সরায়। না সরিয়েও উপায় নেই। স্কুলের বেতনের বাইরে হাত খরচ কিছু পায় না বললেই চলে। অথচ একটা ভালো ছেলে পটাতে হলেও টাকা লাগে। আয়েশা তো তিন বোনের ভেতর সবচেয়ে সুন্দর। তাই ঠিক প্রেম করে ছেলে ঝুটিয়ে নিয়েছে। টাকা পয়সার সমস্যা, বাবা নাই এগুলো নিয়ে আয়েশা আপার শ্বশুর বাড়ি গাইগুই করলেও মেনে নিয়েছে। কিন্তু আলো তো অত সুন্দর না। শ্যামলা রঙের মেয়ে। শুধু প্রেম দিয়ে কি ছেলে পাবে! মাঝেমাঝে রাতুলের জন্য একটু টুকটাক খরচ না করলে রাতুল তো মনে কষ্ট পাবে।।বিশেষ করে জন্মদিনে। রাতুলের বিভিন্ন বন্ধুর জন্মদিন যায়, আর রাতুল শোনায় কার গার্লফ্রেন্ড মোবাইল গিফট করেছে, কার গার্লফ্রেন্ড ব্রান্ডের পারফিউম গিফট করেছে!
রাতুল তো আর জানে না আলোর এসবের সামর্থ্য নেই।

রাতুলের সাথে আলোর পরিচয় ফেসবুকে। তারপর দেখা, আর প্রেম। ফেসবুকে আলোর ছবি দেখে আলোর লাইফস্টাইল নিয়ে কেউ ধারণাও করতে পারবে না। একটা কল্পনার স্বপ্নরাজ্য তা আলোর। তাই পরিবারের কাউকে নিজের ফেসবুকে রাখেনি। পরিবারের সাথে যে টুকটাক ছবি ফেসবুকে দেয়, সেগুলোও কোন অনুষ্ঠানে তোলা। ওদের প্রেম হয়েছে সবে সাত মাস। ডেটিং এ যায় লুকিয়ে। এখনো বান্ধবীদের সাথেও পরিচয় করায়নি রাতুলের। একবারে বিয়ে পর্যন্ত না যাওয়ার আগে করাবেও না। কেউ রাতুলকে কিছু বলে বিভ্রান্ত করুক, তা আলো চায় না। তাই তো রাতুলের জন্মদিনের জন্য টাকা জোগাড় করতে হন্যে হয়ে গিয়েছে। রোজই আপার ব্যাগ ঘাটছিল। কিন্তু একশো, দুইশোর বেশি আপা ব্যাগে কিছু রাখে না। এর ভেতরও কখনো দশ, কখনো বিশ করে সরিয়ে পাঁচশো টাকা হয়েছে। স্কুলের পরীক্ষা ফি এর কথা বুঝিয়ে মায়ের কাছ থেকে নিয়েছে পাঁচশো। আর আজ একদানে আপার ব্যাগ থেকে তিন হাজার। সত্যি বলতে এই তিন হাজার টাকা না নিলে কাল রাতুলকে মুখ দেখাতে পারতো না।

দেলোয়ারা বেগম চিন্তায় শেষ। খলিলকে এতোগুলা টাকা দিয়েছে শুনলে আতিয়া বাড়ি মাথায় তুলবে। মেজো মেয়ে আয়েশাকে ফোন দেয় দেলোয়ারা বেগম।

“হ্যালো, আয়েশা। কেমন আছস? মায়ের কথা মনে পড়ে না। বিয়া হইছে বইল্লা বাপের বাড়ি ভুইল্লা যাবি?”

“আম্মা, ঢং কইরো না। এই কয়দিন আগে বাপের বাড়ি আসলাম বড়ো মুখ করে। কী হইলো? বাপ না থাকলে কি আর বাপের বাড়ি থাকে! বাপ না থাকলে শ্বশুর বাড়িতেও সম্মান থাকে না। আজ আমার আব্বা থাকলপ কয়টা টাকার জন্য এমনে কথা শুনতে হইতো না। তোমাদের জামাই কত কষ্ট পাইলো। আমার শাশুড়ি কত কথা শুনাইলো। এরপর কি যখন তখন বাপের বাড়ি যাওয়ার কথা বলা যায়। খোঁটা দিয়ে শেষ করবে শাশুড়ি। আর মেয়ে একটা তো আজীবনের জন্য তোমার কাঁন্ধে আছে। আরেকটাও চলে আসার কথা ভাইবো না। তওবা করো।”

“সেসময় হাতে টাকা আছিল না। তাই দিতে পারি নাই।কিন্তু দুইদিন আগেই তো খলিল বাসায় আসলে ওরে টাকা দিলাম। নগদ বিশ হাজার, স্বর্নের তিন আনার কানের দুল। সব মিলায়ে প্রায় ৪০ হাজারের মতো। তোরে কয় নাই?”

“না তো। আমাকে তো কিছু বলে নাই। আচ্ছা রাতে আসলে জিজ্ঞেস করবো নে। ধন্যবাদ আম্মা। তুমি জানো না, কত কথা শুনলাম এই জন্য।”

“এত কথা কেন শুনবি? প্রেম করে বিয়ে কইরা আবার কথা কেন শুনাইবো? প্রেম করার সময়ই তো জানতো তোর বাপ নাই। যখন তখন টাকা চাইলে দিতে পারবো না। এখব শোন। খলিলের কাজ হইয়া গেলে দশ হাজার আমারে দিয়া যাইতে কইছ। আইজ না হোক এই সপ্তাহে দিয়া গেলে হইবো।”

“কী বলো আম্মা। টাকা নিতে না নিতেই ও ফেরত দিবে কোত্থেকে? সময় লাগবে তো।”

“সব দেওন লাগবো না। খালি দশ হাজার। বাসা ভাড়ার টাকা। আতিয়া জানে না খলিলরে টাকা দিছি। বাড়ি ওয়ালা আইলে বাসা ভাড়া দেওন লাগবো।”

“তোমার বড়ো মাইয়া কিন্তু এখনি বদলে গেছে আম্মা। অথচ আব্বা মারা যাওয়ার পর যখন এই চাকরি তারে দিছে, তখন এই জন্য দিছে যে সে আমাদের দায়িত্ব নিব। তার পিছনে তোমাদের কম যায় নাই। একবার পড়ালেখা করিয়ে বিয়া দিলা। টাকা নগদ দিছে আব্বা এক লাখ। গয়না দিছে তিন ভরি। ফার্নিচার দিছে। জামাই খাইয়া যখন ফিরে আসলো, আবার প্রাইভেটে নার্সিং এ পড়াইলো আব্বা। ওর চাকরির জন্য জায়গায় জায়গায় তদবির করলো। টাকা দিলো। ওর জন্য যা করছো তুমি আর আব্বা, কলিজা কাইট্টা দিলেও তো তা শোধ হইবো না। অথচ দুইদিন চাকরি করতে না করতে সে ভাব নেয় কত। বাসা তার ইনকামে চলে এই ভাব নেওয়ার আগে ভাবতে পারে না আজ সে চাকরি করে কার জায়গায়! কার সাহায্যে! ওর মতো এত টাকা আর কারও পিছনে খরচ হয় নাই। আমার বিয়াতে চল্লিশ হাজার টাকা দিতে ওর কলিজা ছিঁড়ে গেল। আমি তো সব বুঝছি। হিংসা করে আমাকে। খলিলকেও বলছি আপা থাকা অবস্থায় বাসায় না যাইতে। শেষে আমার সংসারে নজর দিলে আমার সংসারও বরবাদ হয়ে যাইবো।”

“আল্লাহ মাফ করুক। আসলে আমিও বুঝি জোয়ান মাইয়া। বাইচ্চা কাইচ্চা নাই। আবার ঘর সংসার করতে চায়। কিন্তু আমরা তো ওর বিয়ার চেষ্টা কম করি নাই। ওর পোড়া কপাল। বিয়া দেওনের আগে পোলা গেল মইরা। একবার জামাই মরছে, পেটে বাচ্চা মরছে। আরেকবার বিয়া ঠিক করার পর সুস্থ পোলা হার্ট অ্যাটাক করছে। এরপর তো আর কেউ বিয়ার জন্য আগাইলোই না। কিন্তু ও ভাবে আমরা ওর কামাই খাইতে চাই, তাই ওর বিয়া দেই নাই। মেয়েটার মইধ্যে এই শোকর নাই যে আমরা পরিবার ওরে জায়গা না দিলে কই যাইতো। এখনো মাথাত বিয়ার ভুত আছে। তোর আব্বার হাসপাতালের জমিলা সিস্টাররে ধরছে একটা পোলা ঠিক করে দিতে। চিন্তা কর। এইটা চিন্তা করে না একটা ভাই এখনো দাঁড়ায় নাই। ছোটো বোনের বিয়া দিতে হইবো। আমার কথা তো বাদই দিলাম।”

“এখনো বিয়া করার শখ যাই নাই! আমার বিয়া দেইখা নতুন করে ভুত মাথায় উঠছে আমি বুঝছি। আম্মা, তুমি যাই কও আমি খলিলরে নিয়ে তোমাদের বাসায় যাব না। জামাই দাওয়াত দিলে এমন দিনে দিবা, যেদিন আপা নাইট ডিউটিতে থাকে। আপাকে বইলো এই বয়সে যে তার অতীত জেনেও তাকে বিয়া করতে চাইবো, সে আসবো তার কামাই খাইতে। আর এমন ব্যাটা বাড়িতে ঢুকলে তোমাদের কপাল পুড়বো কইলাম। ভালোয় ভালোয় আলোর বিয়া আগে দাও। আর পড়ায়ে কাজ নাই। এসএসসি দিলেই বিয়ার চেষ্টা লাগাও।”

আয়েশার ফোন রেখে দেলোয়ারা বেগম টাকার চিন্তা বাদ দিয়ে অন্য চিন্তা করতে বসেন। যত দিন যাচ্ছে, বড়ো মেয়ে আতিয়ার সাথে ওনার সম্পর্ক জটিল হয়ে যাচ্ছে। কেন জানি স্বামীর মৃত্যুর পর মেয়ের উপর মায়া আস্তে আস্তে হারিয়ে ফেলেছেন। ভাবতে চান না। তবু আর দশজনের জথায় ওনারও মনে হয় আতিয়া অপয়া। আতিয়া যতদিন ছিল না, ওনার ঘরে সুখ সমৃদ্ধি ছিল। আতিয়া ফিরে এসে একে একে সব গিলে নিয়েছে। যে কথাটা একসময় আতিয়ার শাশুড়ি বলেছিলেন। সেই কথাটা এখন দেলোয়ারা বেগমেরও মনে হয়। তবে চিন্তা হলো ভাড়ার টাকা কী করবেন। আপাততঃ বাড়ি ওয়ালার কাছে এক সপ্তাহের সময় নিয়েছেন। খলিল এর ভেতর দিয়ে দিলেই হলো। বাজারটা না হয় এই সপ্তাহে শাক সবজি দিয়ে চালাবেন। আগামী সপ্তাহে আতিয়া আবার বাজারের জন্য দুই হাজার টাকা দিবে। মাছ, মুরগী কিছু তখন কেনা যাবে। কিন্তু সমস্যা হলো তিনি নিজেও শুধু শাক ভাত খেতে পারেন না। সবসময় ভালো রেঁধে, ভালো খেয়ে অভ্যাস। এখন এত পাই পাই হিসেব করে খেতে ওনার কষ্ট হয়। বিরক্ত মুখে রান্না চড়ান। আজ বুটের এর ডাল দিয়ে পাট শাক রান্না করবেন। সাথে মরিচ পোড়া। এই দিয়ে দুই বেলা চলতে হবে। একটু সকালের জন্যও রাখতে হবে। আতিয়া ডিউটিতে যাবার সময় নিয়ে যাবে। মনে মনে তিনিও ঠিক করেন, আতিয়া এসে আবার টাকা পয়সা নিয়ে কিছু বললে, তিনিও ছেড়ে দিবেন না। মেয়েকে মনে করিয়ে দিতে হবে,কার জোরে কোথায় দাঁড়িয়ে আছে। বারবার কান্নাকাটি করে লড়াই জিতবেন না। এবার মুখে মুখেই উচিত জবাব দিবেন।

(চলবে)