গোধূলি রাঙা আলোয় পর্ব-০৬

0
263

#গোধূলি_রাঙা_আলোয়
#পর্ব_৬

“আপা আসেন আসেন। কী দেখবেন আপা?” দোকানের ছেলেটা এগিয়ে যায়, ক্যাশে বসে থাকা লোকটার ইশারায়।

“না কিছু দেখবো না। একজনের কাছে এসেছি। আশিক কি এই দোকানে কাজ করে?”

“জ্বি। আপনের কী হয়?”

“আমার ছোটো ভাই।”

“আসসালামুয়ালাইকুম আপা। এইদিকে আসেন। আমি মিসবাহ। এই দোকান আমাদের।” বিল কাউন্টারের সামনে থেকে আতিয়াকে ডাক দেয় মিসবাহ।

“ওয়ালইকুম সালাম। না আসলে আশিককের সাথে একটু কথা বলতে আসলাম।”

“সমস্যা নাই বসেন। ও তো বাসায় খেতে গিয়েছিল। খাওয়া শেষে আমাদের দোকানের কিছু মালামাল নিয়ে আসার কথা। চলে আসবে এখুনি। আপনি বসেন।”

মিসবাহ দোকানের অন্য ছেলেটাকে ইশারায় কিছু আনতে বলে। আতিয়া মানা করে ওঠে,

“না না কিছু লাগবে না। কিছু খাব না। আমি ডিউটি থেকে সরাসরি এখানে আসলাম। বাসায় গেলে হয়তো আশিককে পেতাম না। হয়তো খেয়ে বের হয়ে গিয়েছে এতক্ষণে। সেজন্য এখানে আসা।”

“কোন বিপদ আপদ হয়নি তো? দোকানে চলে আসতে হলো, রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারলেন না! ফোন দিতে পারতেন তো। কিছু মনে করবেন না। সমস্যা থাকলে আমাকে খুলে বলেন। দেখি কী করতে পারি।”

“না সেই রকম কিছু না। আসলে বিষয়টা পারিবারিক। বাসায় কথা বলা সহজ হবে না ভেবে দোকানে আসলাম। ফোনে বলার চেয়ে সামনাসামনি কথা বলা ভালো মনে হলো।

আতিয়া অনেক অস্বস্তি নিয়েই দোকানে এসেছে। সেদিন বিরিয়ানির টাকা নিয়ে জবাবদিহি করে সে নিজেই যেন সবার কাছে খারাপ হয়ে গিয়েছে। আয়েশার স্বামী খলিল খাওয়া রেখে উঠে গিয়েছিল। আয়েশাও বোনকে দু’চারটা কথা শুনিয়ে দিয়ে খলিলের সাথে চলে গিয়েছে। মা দেলোয়ারা বেগম তো মৃত স্বামীকে ডেকে ডেকে কান্নাকাটি করে মেয়েকে একগাদা অভিশাপ দিলেন। আশিকও খায়নি। আতিয়া এত হতভম্ব হয়েছে যেন সমস্ত অপরাধ তার। টাকা হারিয়েছে তার দোষ। টাকা হারানোর কথা বাসায় বলেছে সেটাও তার দোষ। কেউ খেতে পারেনি সেটাও তার দোষ। তারচেয়েও খারাপ হলো রাতের বেলা যখন আয়েশা ফোন করে দেলোয়ার বেগমকে বললেন খলিলের থেকে থেকে বমি হচ্ছে। আতিয়া নাকি খলিলের খাওয়ায় নজর দিয়েছে!

“আম্মা, এত গরমে বিরিয়ানি খেয়েছে। গরমে হয়তো বিরিয়ানি টকে গিয়েছে। তাই ফুড পয়জনিং হইছে। বমি হচ্ছে সেজন্যে। বমি, পেট খারাপ বিরিয়ানি খাওয়ার জন্য হইছে, কারও নজরে না। আয়েশা লেখাপড়ায় তো গোল্লা আছিল। তাই সহজ কথাও মাথায় ঢুকে না।”

“তোর পায়ে পড়ি আতিয়া। আর কারও জীবন খাইছ না। তোর জামাই, বাইচ্চা, বাপ সব খাইছস। ভাই-বোনগুলারে আর খাইচ না। আয়েশার সংসারে অশান্তি তোর লাইগ্গা।”

“আমার জন্যে আয়েশার সংসারে অশান্তি! আমি আয়েশার সংসারে কী করছি? বিয়ের অনুষ্ঠানের পর কোনদিন ওর শ্বশুরবাড়িতে পর্যন্ত যাই নাই। একটা কথা বললেই হইলো!”

তারপরও কথা কাটাকাটি চলে। দেলোয়রা বেগম আতিয়ার সাথে কথা বলা বন্ধ রেখেছেন। আতিয়াও আর মান ভাঙাতে যায়নি। বাসা ভাড়া আশিক দিয়ে দিয়েছে। আর বাজারের জন্য দিয়েছে দুই হাজার। আতিয়া মানা করেনি। কেননা এমুহূর্তে বারো হাজার বাড়তি খারচ সে করবে না। ধারের সুদ টানা অনেক কষ্ট। কিন্তু এই বারো হাজারের জন্য বারো ভুতের অত্যাচার সহ্য করতে হচ্ছে। বাসার সবাই এমন ভাব করছে যেন আতিয়া এতদিন কিছুই করেনি। মায়ের স্বভাবের সাথে আতিয়া পরিচিত। তাই কিছু মনে করছে না। কিন্তু নিজে মনে মনে ঠিক করেছে আশিকের সাথে কথা বলবে। প্রথম আয় করে সবার জন্য কিছু করতে চাইলো। আর সব এভাবে নষ্ট হলো। বাসায় তো কথা বলতে পারে না সহজ ভাবে। সুযোগও পায় না। তাই দোকানে আসা। সামনাসামনি দুটো কথা বলবে।

“জুস নেন। এই যে। আপনার নাম তো জানি না?”

“আতিয়া আমার নাম। আপনি আবার জুস আনালেন কেন?”

মিসবাহ একটা জুসের গ্লাস এগিয়ে রেখেছেন। আতিয়া আসলেই ক্লান্ত। ডিউটি শেষে বাসে করে কারওয়ান বাজার সিগন্যালে নেমে এপথটুকু হেঁটে আসতেই ঘেমে-নেয়ে গিয়েছে। টিস্যু নেই। ওড়নার আঁচল দিয়েই ঘাম মুছছিল আর ভাবছিল। মিসবাহ খেলায় করেছেন বলেই হয়তো চায়ের বদলে জুস আনিয়েছে। দোকানের একজন কর্মচারীর বোনের জন্য যে দামী জুস আনাতে পারে, সে লোক নিঃসন্দেহে ভদ্রলোক। এই জুসগুলোর দাম আতিয়া জানে, গ্লাস প্রতি একশো ষাট থেকে একশো আশি। আগে বসুন্ধরা আসলে কেনাকাটা করার চেয়ে এসব হাবিজাবি খাওয়ার শখ ছিল বেশি। এখন বসুন্ধরা আসে না বছর হলো। মনের সব রঙ যেন তার মতোই মলিন হয়ে গিয়েছে!
জুস মুখে দিয়ে আতিয়ার কলিজা ঠান্ডা হয়ে যায়। কোন ফলের জুস বুঝতে পারছে না। তবে বেশ লাগছে।

“চাকরি করেন মনে হয়। কোথায় কাজ করেন?”

“আমি মিলেনিয়াম হাসপাতালে আছি। নার্সিং পেশায় আছি।”

“ভালো ভালো। মানুষের সেবা করা পূণ্যের কাজ। অনেক পরিশ্রমের পেশা আপনাদের। আমার আব্বাকে নিয়ে দশদিন হাসপাতালে ছিলাম ওয়ার্ডে। তখন কাছ থেকে খেয়াল করলাম যে গণ ওয়ার্ডে এত রোগী। আপনারা ঠিকমতো বসে পানি খাওয়ারও সময় পান না।”

আতিয়ার মন ভালো হয়ে যায়। হাসপাতালে কাজ করে শুনলেই আগে মানুষ নেগেটিভ কথা বলে। কে কবে কোথায় চিকিৎসা নিতে গিয়ে হেনস্তা হলেন তার বয়ান থাকে। আর ডাক্তার, সিস্টারদের ব্যবহার নিয়ে তো সমালোচনা কখনোই শেষ হয় না। কথা সব ভুল তা নয়। বরং সত্যি সেবাদানকারী পেশায় সবাইকে আরও সহনশীল হতে হবে। আতিয়া নিজেও ব্যক্তিগত হতাশা রোগীর লোকজনের উপর ঝেড়ে ফেলে।

“ভাই। আমি উঠি। আশিক আসতে মনে হয় দেরি হবে। আপনার সময় নষ্ট করলাম। বাসায় যাব।”

“আর কিছুক্ষণ বসতে পারেন। আমাদের সমস্যা নেই। দুপুরে এই সময় কাস্টোমার থাকে না। লাঞ্চের সময় তো। চারটা থেকে আবার লোকজন হয়। আপনার বাসা কই?”

“আমাদের বাসা কাঁঠালবাগানে। ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে। গলির ভেতরে।”

“আচ্ছা। তাহলে তো মায়ের বাসার কাছাকাছি থাকেন। ভালো ভালো।”

“আমি মায়ের সাথেই থাকি। আমার স্বামী মারা গিয়েছেন। আমি বিধবা।”

“আমি দুঃখিত। আসলে বুঝে বলিনি।”

মিসবাহ বিব্রত হয়ে যায়। আসলে এই জন্য হুটহাট কথা বলা ঠিক না।

“না কোন সমস্যা নাই। আপনি তো আর জানেন না। আচ্ছা যাই। শুনেন আশিক এলে বলার দরকার নাই আমি এসেছিলাম। আবার চিন্তা করবে শুধু শুধু। রাতে বাসায় গেলে কথা বলবো ইনশাআল্লাহ।”

আতিয়া বের হয়ে যায়। কী মনে করে মিসবাহও দু মিনিট পর দোকান থেকে বের হয়ে দূর থেকে আতিয়াকে লক্ষ্য করে। আতিয়ার কালো বোরখার সাথে কমলা ওড়না পেঁচিয়ে পড়েছে। উজ্জ্বল কমলা রঙ তাই দূর থেকে নজর কাড়ে। রাস্তায় নেমে রাস্তা পার হয় আতিয়া। মিসবাহও একটু দূরত্ব রেখে পার হয়।

আতিয়া রিকশার সামনে গিয়ে দরদাম করে। দাম বনে না। আর কোন রিকশাকে জিজ্ঞেস না করে হাঁটতে শুরু করে। মিসবাহর খুব ইচ্ছে করে একটা রিকশা ডেকে আতিয়াকে উঠিয়ে দিয়ে বলে, “ভাড়াটা আমি দেই প্লিজ। আপনি বাসায় যান।”

কিন্তু লোকলজ্জায় কত কিছুই আমাদের বলা হয় না।

আশিক ফিরে প্রায় রাত দশটায়। ঐ দিনের ঘটনার পর আশিক একটু রাত করেই বাসায় আসতো। আতিয়া ক্লান্ত থাকে, তাই রাতে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে। আশিক বাসায় এসে খেয়ে ঘুমিয়ে যায়। সকালে আতিয়া যখন ডিউটিতে যায় তখন ঘুমিয়ে থাকে। আতিয়া কাজে যাওয়ার আরও বেশ কিছুক্ষণ পর উঠে নাস্তা করে দোকানে চলে যায়। আতিয়া তাই কথা বলারই সুযোগ পায় না। আজ আশিক তাড়াতাড়িই আসলো। আতিয়াও আজ বসে ছিল। রাত বেশি হলেও আশিকের সাথে কথা বলেই ঘুমাবে ঠিক করেছিল।

” আশিক, তোর সাথে কথা ছিল।”

“আমারও। তুই মিসবাহ ভাইকে চিনিস আপা?”

“তোর দোকানের মালিক? না আজই দেখা হলো। তোর খোঁজে গিয়েছিলাম। ওনাকে বললাম আমার কথা না বলতে। আমি হঠাৎ দোকানে গিয়েছি শুনলে তুই চিন্তা করবি।”

“আপা, মিসবাহ ভাই তোকে বিয়ে করতে চায়। বিয়ে করবি?”

আতিয়ার মুখে কথা সরে না।

(চলবে)