#চন্দ্রপ্রভা_রজনী
#পর্বঃ১
লিখাঃসামিয়া খান
“আপনি বলতে চাচ্ছেন আমি আমার জন্য যে স্লাট গুলোকে ভাড়া করে নিয়ে এসেছিলাম তাদের জায়গায় ভুলে আপনি এসে পড়েছেন?”
দিহানের কথায় একটা শুকনো ঢোক গিললো মায়া।এসি রুমে বসে আছে সে।তারপরও দরদর করে ঘামছে।কিছু টাকার আশায় অডিশন দিতে এসে এক অজানা চোরাবালিতে আটকে গিয়েছে, এমন মনে হচ্ছে তার এখন।কোনোরকম শুধু নিজের মাথা একবার উপর নিচে দুলিয়ে সস্মতি প্রকাশ করলো মায়া।
“বাট এটা তো পসিবল না।বিকজ ওগুলো ব্রোথেলের মেয়ে ছিলো।আপনার নিজেকে কি তাদের সমতুল্য মনে হয়?”
“নো স্যার।”
“তাহলে তাদের সাথে রিপ্লেস হলেন কিভাবে?”
“একচুয়েলি স্যার আমি নাচতে পারি।আমি ভেবেছিলাম হয়তো নাচের কোনো কম্পিটিশন হবে।তার জন্য একটা অডিশন দিতে এসেছিলাম।”
“নাচতে পারেন তাই বলে যেখানে সেখানে নাচতে চলে আসেবেন।কেমন মেয়ে আপনি?”
দিহানের কথায় কোনো উত্তর দিলো না মায়া।এতদিন যাবত এ মানুষটিকে বড় পর্দার স্ক্রিনে দেখে এসেছে সে।
জনপ্রিয় সুপারস্টার দিহান আহসান।আর সব মেয়েদের মতো মায়ার কাছেও এই মুখটা এবং নামটা অনেক প্রিয়।কোনোদিন হয়তো সে কল্পনায়ও করতে পারেনি দিহানের সাথে এমন পরিস্থিতে পরতে হবে।
“মেয়ে আপনার নামটা কি?”
“মায়া।”
“মা–য়া। তা কি এমন আছে আপনার মধ্যে যে নাম মায়া রাখা হলো?আপনি কি দেখতে মায়াবী।”
“জানিনা স্যার।”
“নাচটা কি শখের বসে করেন নাকী পেট চালানোর জন্য?”
“নিজের খরচ চালানোর জন্য।”
“কেনো বাবা-মা খরচ দেয়না?”
দিহানের এই চটা চটা কথায় কান্না উপচে আসছে মায়ার।প্রথম দেখায় কেউ এভাবে কথা বলতে পারে তা জানা ছিলনা তার।রুমের মধ্যে অনেকগুলো মানুষ আছে।এতগুলো মানুষের সামনে দিহান এরকমভাবে কথা বলছে।ঠোঁট কামড়ে কোনমতে নিজের কান্না চাঁপার চেষ্টা করলো মায়া।কিন্তু সে ব্যর্থ হলো।শরতের আকাশ থেকে যেরকম ঝুপ করে বৃষ্টি নামে।ওরকম মায়ার চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো।
“এই মেয়ে কাঁদছেন কেনো?আমি কাঁদার মতো কি এমন বলেছি।”
“আমি সত্যি স্যার বুঝতে পারিনি যে এমন হবে।আসলে আমার টাকার খুব দরকার।টিউশনি করিয়ে যতো টাকা পাই তাতে হয়না।একটু বাড়তি টাকার জন্যই এসেছিলাম।”
“বাড়তি টাকার জন্য এসেছিলেন তাই বলে নিজের কমনসেন্স তো খাটাবেন।ওই মেয়েগুলোর ড্রেস এবং হাবভাব দেখেও বুঝেননি যে ওরা কিরকম।আজ যদি আমার জায়গায় অন্য কেও থাকতো তাহলে কি হতো সেটা একবার ভেবেছেন।গাধা মেয়ে কোধাকার।”
অনেকটা উত্তেজিত হয়ে দিহান কথাগুলো উচ্চারণ করলো।বেশ হাইপার হয়ে গিয়েছে সে।চেয়ারে হেলান দিয়ে ব্লেজারের বোতাম গুলো আলগা করা শুরু করলো।
“মাহসিন!মাহসিন।”
দিহানের ডাকে তড়িঘড়ি করে তার দিকে এগিয়ে আসলো মাহসিন।মাহসিন দিহানের পার্সোনাল পিএ।বলতে গেলে দিহানের ডান হাত।
“স্যার।”
“মাহসিন ওইযে ওই ব্রোথেলের মেয়ে গুলোকে নিয়ে আসা হয়েছে।তাদের প্রাপ্য টাকা দিয়ে বিদায় করে দেন।যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব।”
“ইয়েস স্যার।”
মাহসিন চলে গেলে মায়ার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিপাত করলো দিহান।একটা অফ হোয়াইট কালারের ড্রেস পড়েছে মায়া।মুখে কোনো প্রসাধনীর ছাপ নেই। এমনকি চোখে কাজল পর্যন্ত নেই।চুলগুলো কোনোরকম হয়তো হাত খোঁপা করা।রোজ দিহানের সাথে যেসব মেয়েদের উঠাবসা হয় তাদের সামনে বড়ই নগন্য মায়া।তারপরেও ওই সব চকচকে ঝলমলে নারীদের থেকে এই সাধারণ নারীটাকে বেশ ভালো লাগলো দিহানের।
“পানি খাবেন মায়া?”
মাথা নাড়িয়ে সস্মতি প্রদান করলো মায়া।দিহান মায়ার দিকে পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিলো।পানির গ্লাসটা হাতে নিয়েই এক শ্বাসে পুরোটা শেষ করলো মায়া।এই পুরো সময় দিহানের দৃষ্টি মায়ার গলার দিকে ছিলো।কেমন যেনো নেশা লাগছে দিহানের।এমন তো হওয়ার কথা ছিলনা।পানি খেয়ে গ্লাসটা টেবিলে রেখে নিজেকে সংযত করে বসলো মায়া।
“আপনি তো কথা বলতে পারেন।তাহলে সব এমন ইশারা দিয়ে বলেন কেনো মেয়ে?”
“দুঃখিত স্যার।”
“এখানে আবার দুঃখিত হওয়ার মতো কি হলো।”
“জানিনা স্যার।”
মায়ার কথায় বেশ বিরক্তবোধ করলো দিহান।এরকম জ্বী হুজুরী তার একদম পছন্দ না।কিছুক্ষণ পুরো পরিবেশটা শান্ত ছিলো। কেও কোনো কথা বলছেনা।নিরবতা ভেঙে দিহান আগে কথা বলল,
“আপনার কি জবটা খুব বেশী প্রয়োজন?”
“জ্বী স্যার।”
“আমার তো মনে হয়না।”
“কেনো।”
“বাম হাতটা টেবিলের উপরে রাখুন।”
দিহানের কথামতো মায়া তার বাম হাতটা টেবিলের উপরে রাখলো।তার বাম হাতের অনামিকা তে একটা আঙটি ঝলমল করছে।সেদিকে কিছুসময় তাঁকিয়ে দিহান তার ডান হাতের তর্জনী ওই আঙটির উপর রাখলো।
“যদি আমি ভুল না করে থাকি তো এটা হীরার। এম আই রাইট?”
“জ্বী স্যার।”
“হীরার আঙটি হাতে পড়ে চাকরীর গাঁথুনি গাচ্ছেন।বিষয়টা হাস্যকর না?”
“এটা আমাকে আমার ভালোবাসার মানুষ দিয়েছে।”
“ওহ।তাহলে তো চাকরীর প্রয়োজন নেই আপনার। আপনার ভালোবাসার যথেষ্ট সার্মথ্য আছে আপনার খরচ চালানোর।”
“হুম ছিলো।কিন্তু বর্তমানে সে আমার প্রাক্তন।আজ তার বিয়ে ছিলো।”
“কেনো আপনার থেকে বেটার অপশন পেয়েছিলো বুঝি?”
এ পর্যায়ে মায়া বেশ চটে গেলো।ঝাঁঝালো কণ্ঠে দিহানকে জবাব দিলো,
“দ্যাটস নান অফ ইওর বিজনেস স্যার।”
“ওকে।বাট আই হ্যাভ এ অফার ফর ইউ।”
“কি!”
“আপনাকে একটা কন্টাক্ট পেপারে সাইন করতে হবে।সাইন করার পর মূহুর্ত থেকে আপনার সবকিছুর উপর নিয়ন্ত্রণ শুধু আমার থাকবে।এই যেমন -আপনি কি খাবেন, আপনি কি পড়বেন,আপনি কখন ঘুমাবেন,কার সাথে কথা বলবেন পুরো বিষয়।শুধু তাই নয় আমার যাবতীয় কাজ আপনার করতে হবে।যা একজন স্ত্রী তার স্বামীর জন্য করে।শুধু পার্থক্য একটাই আমার সাথে কখনো বিছানায় যেতে হবেনা আর তাছাড়া সব করতে হবে।মানে ঠিক মালিল-ভৃত্যের সম্পর্কের মতো।”
কথাটা বলে থামলো দিহান।মায়া কি রিয়াকশন দিবে বুঝতে পারছেনা।এত বড় মাপের মানুষ তাকে এমন প্রস্তাব কেনো দিচ্ছে।
“আমার এরকম কিছুর প্রয়োজন নেই স্যার।”
“এমনি এমনি তো আর হচ্ছেনা।এজন্য আপনি সব পাবেন।এই যেমন-নাম,ফেম,টাকা সব।তাহলে ক্ষতি কি?আর আগেও অনেক মেয়ে এমন ছিলো।আমার যাকে পছন্দ হয় তাকে সাব বানাতে দ্বিধাবোধ করিনা।”
দিহানের কথাগুলো বারবার মায়ার কানে বাজছে।তার সামনে দামী পোশাক পড়া,পরিপাটি হয়ে বসে থাকা বিখ্যাত ব্যাক্তি যে এরকম একটা প্রস্তাব করতে পারে তা চিন্তার বাহিয়ে ছিলো তার।লজ্জায় তার কান লাল হয়ে যাচ্ছে।কোনো মতে নিজেকে সামলে ভেজা কণ্ঠে উত্তর দিলো মায়া,
“আমি পণ্য নই স্যার যে নিজেকে টাকা বা বিত্তের বিনিময়ে বিক্রি করে দিবো।না নষ্ট পাড়ার মেয়ে।তাই আপনার এই প্রস্তাবে রাজি হতে পারলাম না।মাফ করবেন।”
,
,
,
ফুলের গন্ধে ম ম করছে পুরো রুম।সাদা শুভ্র বিছানায় গোলাপির পাপড়ি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।আর তার মধ্যেখানে লাল বেনারসি পড়ে বধূবেশে বসে আছে সুবাহ।প্রত্যেক নারীর জীবনে বহু কাঙ্ক্ষিত রাত হচ্ছে এই বিয়ের প্রথম রাত।
সুবাহার জীবনেও তাই।বুকের ভিতর ঢিপঢিপ শব্দ করছে তার।এক আলদা ভয় মিশ্রিত ভালোলাগা কাজ করছে তার মনে।
হুট করেই দরজাটা খুলে ভিতরে কেও প্রবেশ করলো।বেড়ে যাওয়া স্পন্দন জানান দিচ্ছে রুমের মধ্যে প্রবেশকারী ব্যাক্তিটি কে।
রুমে ঢুকে বিছানার দিকে একবার তাঁকালো আরিয়ান।লাল টুকটুকে শাড়ী পড়ে বিছানায় গোল হয়ে বসে আছে সুবাহ।সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে সোজা ব্যালকনিতে চলে গেলো আরিয়ান।ব্যালকনিতে অবস্থিত দোলনায় ধপ করে বসে পরলো আরিয়ান।বড্ড ফাঁকা লাগছে তার বুকে।একমাস আগেও ঠিক এসময়ে এই ব্যালকনিতে বসে নিজের প্রেয়সীর সাথে ফোনালাপে ব্যাস্ত ছিলো সে।আর একমাস পরে পুরো চিত্রই ভিন্ন।আরিয়ানের বড্ড টেনশন হচ্ছে মায়ার জন্য।মায়ার কাছে যে চলার মতো টাকা নেই সে সম্পর্কে খুব ভালোভাবে অবগত সে।অথচ মায়া তার থেকে একটা টাকাও নিচ্ছে না।হতাশ হয়ে মায়ার নাম্বারে আবার ডায়াল করলো আরিয়ান।কিন্তু ফোনের অপরপাশ থেকে কোনো জবাব আসলো না।
“আপনি এখানে কি করছেন?”
হঠাৎ করা প্রশ্ন ঘাড় ঘুরালো আরিয়ান।সুবাহ দাড়িয়ে আছে।মেয়েটার চোখে মুখে এক আলাদা রকমের উজ্জ্বল্যতা ফুটে উঠেছে।অথচ আজ ওর জায়গায় অন্য কারো থাকার কথা ছিলো।
“আমি এখানে কি করছি তা কি তোমাকে কৈফিয়ত দিবো সুবাহ?”
“কৈফিয়ত কেনো দিবেন।জিজ্ঞেস করেছি শুধু।অনেক রাত হয়েছে ঘুমাবেন না?”
“কেনো শরীরের জ্বালা উঠেছে।কন্ট্রোল হচ্ছেনা?”
আরিয়ানের কথা শুনে চমকে উঠলো সুবাহ।বাসর ঘরে স্বামীর মুখে এরকম কথা শুনতে হবে তা হয়তো সে ভাবতেও পারেনি।
“এভাবে বলছেন কেনো?”
“তাহলে কীভাবে বলবো তোকে?সোনা-ময়না বলে বলবো।এখান থেকে যা।তোকে আমার সহ্য হচ্ছেনা।যা বলছি।”
আরিয়ানের ধমকে খুব ভয় পেলো সুবাহ।জীবনে বকাবকি তার মা-বাবাও করেনি আর কাওকে করতেও দেয়নি।সেখানে আরিয়ান দাসীর মতো আচরণ করলো তার সাথে।কাঁদতে কাঁদতে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লো সুবাহ।কেনো জানি ভবিষ্যতে নিজের ভয়ংকর পরিস্থিতির আবাশ পাচ্ছে সে।
,
,
,
“মাহসিন তোমার কি মনে হয় মায়া নামের মেয়েটা কি রাজী হবে?”
“বুঝতে পারছিনা স্যার।যেভাবে গেলো হয়তো রাজী হবেনা।”
মাহসিনের কথায় কোনো জবাব দিলোনা দিহান।চুপচাপ ফোন টিপায় ব্যস্ত হয়ে গেলো।কিছু একটা বলার জন্য হাসফাস করছে মাহসিন কিন্তু বলতে পারছেনা।
“কিছু বলবে মাহসিন?”
“আসলে স্যার আজকে সুবাহ ম্যাম এর বিয়ে ছিলো।”
ক্ষণিকের জন্য থামলো দিহান।কিন্তু পরক্ষণেই আবার ফোন টিপায় ব্যস্ত হয়ে গেলো সে।
“মাহসিন তোমার কি মনে হয় আমার পাওয়ার কম?আমি আগে থেকেই জানি আজকে আমার বোনের বিয়ে ছিলো।অথচ দেখো আমাকে বলার প্রয়োজনবোধটুকু কেও করেনি।বিষয়টা হাস্যকর না।”
কথাটা বলে গা দুলিয়ে হাসলো দিহান।তাও খুব জোড়ে।দিহানের জন্য খুব খারাপ লাগছে মাহসিনের।মানুষটা সব পেয়েও কেমন যেনো কিছুই পায়নি।দিহানকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই মাহসিনকে থামিয়ে দিলো সে।
“আপাতত এ বিষয়ে আমি কোনো কথা বলতে চাইনা।তাই অফ যাও।আর মেয়েটার সম্পর্কে যাবতীয় ইনফরমেশন চাই আমার।এনি হাও।”
“ওকে স্যার।”
আর কোনো কথা বলল না দিহান।শুধু গুনগুন করে গান গাওয়া শুরু করলো।
“নেশা লাগিল রে,নেশা লাগিল রে।বাঁকা দু নয়নে নেশা লাগিল রে।”
চলবে।