#চন্দ্রপ্রভা_রজনী
#পর্বঃ২
লিখাঃসামিয়া খান
ক্ষুদার যন্ত্রণা এখন বড্ড অসহ্য লাগছে মায়ার কাছে।দুপুরে খাওয়ার পরে আর খাওয়া হয়নি।তার কাছে এখন আর খুব বেশী টাকা অবশিষ্ট নেই।যতো টাকা আছে তা দিয়ে কয়দিন চলতে পারবে সে নিজেও জানেনা।
পেটের উপর বালিশ দিয়ে চুপচাপ শুয়ে আছে মায়া।মাথায় হাজারটা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে।মাস শেষ হওয়ার আর মাত্র কয়টা দিন বাকী।তারপর বাসা ভাড়াও দিতে হবে।আরো অন্যান্য খরচ তো আছেই।এতগুলো টাকা কীভাবে সে জোগার করবে তা জানেনা।
পাশ ফিরে মায়া ফোনটা হাতে নিলো।পাওয়ার বাটনে চাপ দিতেই আরিয়ান আর তার ঝলমলে হাসিমাখা মুখের ছবি ভেসে উঠলো।এ ছবিটা তুলেছিলো মায়ার জন্মদিনের দিন।সেদিন আরিয়ান তাকে বিয়ের জন্য প্রোপজ করে।কিন্তু তা শুধু প্রোপজ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল। বিয়ে আর হলো না।হঠাৎ ফোনে কল আসায় চমকে গেলো মায়া।ঘড়ির দিকে তাঁকিয়ে দেখে রাত একটা বাজে।ফোনের স্ক্রিনে তাঁকিয়ে দেখে একটা কোরিওগ্রাফারের এসিস্ট্যান্টের ফোন এসেছে।তাড়াতাড়ি শুয়া থেকে উঠে মায়া ফোনটা রিসিভ করল,
“জ্বী ভাইয়া বলেন।”
“এই মায়া বলছো?”
“হুম।”
“তোমার জন্য কালকে একটা কাজ আছে।করবে।”
“কি কাজ?”
“কালকে একটা শ্যুটিং আছে।সেখানে মূলত এক গানের শ্যুটিং হবে।ব্যাক ডান্সারের সর্ট পড়ে গিয়েছে।যদি ফ্রী থাকো তো আসতে পারো কালকে।”
“অবশ্যই ভাইয়া পারবো।কিন্তু জায়গাটার নাম?”
“চন্দ্রপ্রভা স্টুডিও।”
চন্দ্রপ্রভা নামটা শুনে মায়ার শরীরে এক আলাদা শিহরণ বয়ে গেলো।
“দিহান আহসান এর স্টুডিও।চন্দ্রপ্রভা!”
“হ্যাঁ তুমি তো চিনো তাইনা?”
“জ্বী ভাইয়া।”
“তাহলে ঠিক কালকে দশটায় চলে এসো।”
“ঠিক আছে ভাইয়া।”
ফোনটা রেখে মায়া আবার বিছানার নিজের শরীরটা এলিয়ে দিলো।চোখ বন্ধ করতেই দিহানের সেই অদ্ভুত চাহনির মুখটা ভেসে উঠলো।মায়ার দিকে তাঁকানো সেই ক্ষিপ্র দৃষ্টিপাত,সুললিত কণ্ঠে বলা কথাগুলো সব যেনো স্পষ্ট মনে করতে পারছে মায়া।
,
,
,
এক আলাদা ধরণের ঘ্রাণ নাকে আসছে সুবাহার। ঘুমের মধ্যে তা একদম স্পষ্ট।এক জোড়া শক্ত হাত তাকে বেস্টনী করে ঘুমিয়ে রয়েছে।আস্তে আস্তে সুবাহ চোখ খুলে দেখতে পেলো এতক্ষণ সে আরিয়ানের বুকে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছিল।এটা বুঝতেই তার মধ্যে এক আলাদা শিহরণ বয়ে গেলো।কিন্তু পরক্ষণেই কালকে রাতে তার প্রতি আরিয়ানের বিরুপ আচরণ মনে পড়ে যাওয়ায় ভালোলাগার জায়গায় বড্ড অভিমান এসে জমা হলো।তাড়াতাড়ি করে আরিয়ানের বাহুডোর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো।অভিমানে এখন বড্ড কান্না পাচ্ছে তার।সারারাত কাঁদিয়ে এখন ভালোবাসা দেখাচ্ছে।বিছানা থেকে নেমে সুবাহ ওয়াশরুম এর দিকে পা বাড়ালো।
গোসল করে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে সুবাহ দেখতে পেলো দরজায় কে যেনো কড়া নাড়ছে।হাতে থাকা টাওলটা ডিভানের উপরে রেখে দরজার খুলে দিলো সুবাহ।দরজার ওপাশে আরিয়ানের বড় বোন অরী দাড়িয়ে আছে।তার কোলে এক বছরের একটা বাবু।এটা অরীর মেয়ে।সুবাহকে দেখেই মেয়েটা হাত বাড়িয়ে দিলো তার কোলে আসার জন্য।সুবাহাও হাত বাড়িয়ে কোলে নিয়ে গালে আদর করে দিলো।কালকে বিয়ের পুরোটা সময় অরীর মেয়ে মানহা সুবাহার কোলে ছিলো।
“বাহ আমার মেয়ে তো দেখছি একদিনেই মামীর ভক্ত হয়ে গেলো।”
“আমি মানহা সোনার ভক্ত হয়েছি বুবু।পুরাই পুতুল একটা। ভেতরে আসো বুবু।”
“নাহ এখন যাবো না।তা আপনার স্বামীকে ঘুম থেকে ডেকে তুলেন।আর কতো ঘুমাবে স্যার।”
“ঠিক আছে বুবু।”
“মানহাকে রাখবি নাকী নিয়ে যাবো।”
“না থাক।”
“ঠিক আছে।তাড়াতাড়ি ডেকে তুল।”
অরী চলে গেলে মানহাকে কোলে নিয়ে সুবাহ বেডের কাছে আসলো।আরিয়ানকে ঘুম থেকে ডাকবে কীনা ভাবছে।যদি বকা দেয় রাতের মতো।এজন্য সুবাহ আস্তে করে মানহাকে আরিয়ানের উপরে ছেড়ে দিলো।ইদানীং কেবল মানহার দাঁত গজানো শুরু হয়েছে।তাই যাই পায় তা কামড়ানো শুরু করে।মানহার স্বভাবসুলভ আচরণ থেকেই আরিয়ানের গালে সে কামড় বসিয়ে দিলো। যদিও দাঁত তেমন না উঠায় ব্যাথা পাওয়া যায়না।গালের মধ্যে গরম পিচ্ছিল জাতীয় বস্তুর আবাস পেয়ে আরিয়ানের বুঝতে বাকী রইলো না এটা মানহার কাজ।চোখ না খুলেই মানহাকে ভালো করে নিজের বুকে নিয়ে নিলো।
“সুবাহ নেক্সট টাইম মানহাকে দিয়ে আমার ঘুম ভাঙানোর ট্রাই করবেনা।আর আমি প্রতিদিন সাত টায় উঠি।তো বিষয়টা মাথায় রাখবে।”
আরিয়ানের কথায় সুবাহ শুধু মাথা উপর-নিচে দুলালো।এই মানুষটাকে বড্ড ভয় পায় সে।অথচ এটা বলে তার স্বামী।কর্মক্ষেত্রে সুবাহকে সবাই ভয় পায় কিন্তু রিয়েল লাইফে সে নিজের স্বামীকে বিয়ে হওয়ার চব্বিশ ঘণ্টা না হওয়ার আগে থেকেই ভয় পাচ্ছে।একেই বলে কপাল!
,
,
,
দিহানের সব সখ আভিজাত্যের মধ্যে পড়ে।এই যেমন সবসময় ব্র্যান্ডেড কাপড় পরিধান করা।দামী জুতা, ঘড়ি এমনকি গ্লাসেস গুলোও একেকটা এলিগেন্ট জিনিস।তার মধ্যে ৫.৯ ফুট লম্বা,গায়ের রং একদম কাঠ বাদামের মতো।কথা বলার স্টাইল,ভয়েস টোন সব এক আলাদা লেভেলের।এজন্যই হয়তো এত ডিমান্ড নায়ক হিসেবে।
দিহানের দৈনন্দিন রুটিনের মধ্যে অন্যতম অংশ হচ্ছে রোজ সকালে অপরাজিতা চা খাওয়া।যদিও স্বাদ তেমন একটা ভালো লাগেনা তার কাছে কিন্তু এটা এখন অভ্যাস।চায়ের মধ্যে একটু অরিগ্যানো এবং লেবুর রস মিশিয়ে পান করে সে।মাহসিনের কাছে এই চা টা দেখলেই হেমলক বিষের কথা মনে হয়।কেমন বিদঘুটে একটা নীল কালার।আর লেবুর রস দিলে কালার চেঞ্জ হয়ে যায়।
“কী হে মাহসান!এত কি চিন্তা করো?”
“স্যার আপনি এটা ক্যামনে খান।কেমন বিষের মতো দেখতে।”
“ভুল মাহসান।চা খায় না পান করে।আর বিষ সচরাচর বর্ণহীন হয়।”
“তাও স্যার।মনে হয় হেমলক পান করছেন।”
“তাহলে তো আমি সক্রেটিস হয়ে গেলাম।”
“স্যার হেমলক পান করলেই যদি সক্রেটিস হওয়া যেতো।”
“তাহলে তো হতোই তাইনা।আপাতত এ টপিক বাদ।আজকে ওই মেয়েটা আসছে?”
“কোন মেয়েটা স্যার।”
“আপাতত একটা মেয়ে।মায়া নাম তার।”
“মনির বলল তো আসবে।এখন দেখি আসে কীনা।”
মাহসিনের কথা শুনতে শুনতে দিহান ল্যাপটপের দিকে তাঁকালো।তার কাছে পুরো চন্দ্রপ্রভার সিসিটিভি ফুটেজ আছে।সেখান থেকেই সে দেখতে পেলো মায়া রিক্সা থেকে নামছে।হাল্কা হেসে মাহসিনকে দিহান বলল,
“মনিরকে কল করো।তাকে বলো মায়াকে থার্ড ফ্লোরে ৯ নাম্বার স্পটে পাঠিয়ে দিতে।এবং পুরা স্পট খালি করাও।”
“জ্বী স্যার।”
রিক্সা থেকেই নেমে মায়ার সর্বপ্রথম অনেক বড় করে লেখা “চন্দ্রপ্রভার”দিকে নজর গেলো।দেশের অন্যতম সেরা মাল্টিমিডিয়া নাম হচ্ছে চন্দ্রপ্রভা।আর এটার হেড দিহান।যদিও তার সাথে শেয়ারে আছে একজন।
মায়া অনেকটা নার্ভাস ফিল করছে।বিশেষ করে দিহানের জন্য।শুধুমাত্র টাকার কারণে সে এখানে এসেছে। টাকার যে বড্ড প্রয়োজন তার।
” এই মায়া না তুমি?”
“জ্বী। আপনি মনির ভাই?”
“হুম।তুমি এক কাজ করো থার্ড ফ্লোরের ৯ নাম্বার স্পটে চলে যাও।সিড়িটা ওদিকে।”
“ধন্যবাদ ভাইয়া।”
নয় নাম্বার স্পটে পৌঁছে মায়া দেখতে পেলো পুরো ফাঁকা জায়গাটা।একটা মানুষও নেই।শুধু নানারকম স্যুটিং এর সরাঞ্জাম ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।তার আরো ভয় লাগছে এখন।হুট করে হাতে টান লাগায় একটা চিৎকার দিলো সে।
“মেয়ে চিল্লানো অফ করো।তা নয় মানুষ ভাববে তোমাকে রেপ করছি আমি।”
“ছি এগুলো কি বলেন স্যার।আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।ভয় পেলে চিল্লানো স্বাভাবিক। ”
“তাই!তাহলে পুরা ফাকা রুমে দুটো প্রাপ্ত বয়স্ক নারী পুরুষের একা থাকলে তাদের মধ্যেও কিছু হওয়া স্বাভাবিক। তাইনা মেয়ে?”
“ছি স্যার আপনি কি অশ্লীল।আমি আপনাকে ভালো ভেবেছিলাম।কালকে রাতের ঘটনার পরেও ভালো ভেবেছিলাম। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি আপনি পুরাই আস্ত একটা বান্দর।একটা মেয়েকে একা পেয়ে শুধু কু প্রস্তাব দেন।”
“আমি বান্দর হলে তুমি বান্দরনী।”
“স্যার মুখ সামলে কথা বলেন।আমার ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিয়েন না।”
“আচ্ছা মুখ সামলায় কীভাবে?”
“স্যার প্লিজ।থামুন।”
“এখনো তো শুরুই করলাম না।”
“স্যার অফ যান।”
“বাই দ্যা ওয়ে মেয়ে তুমি তিতা,মিষ্টি নাকী টক।”
দিহানের কথায় আর রাগ সামলাতে পারলো না মায়া।নিজের ছোট ছোট হাত দিয়ে দিহানের প্রশস্ত বুকে কয়টা ঘুষি মেরে দিলো।এতেও শান্ত হলো না সে।দিহানের হাতটা নিজের মুখের কাছে নিয়ে খুব বড়সড় একটা হা করে তার হাতে কামড় বসিয়ে দিলো।
চলবে,,