চাঁদের আলো পর্ব ০২

0
1284

চাঁদের আলো
পর্ব ০২
Writer Tanishq Sheikh

দুপুরে পাশের বাড়ির পুকুরে গোসল করতে যায় জরিনে।জরিনেকে দেখে গোসল করতে আসা গ্রামের বউ ঝি রা ফিসফিস করে।বল্টুর মা শুনিয়ে শুনিয়ে বলে,
“সোয়ামী কি সাধে ভাগছে?এসব কুকর্ম দেখেই ভাগছে।ছি! ছি!”
” বুজি মুখ সামলায় কতা কইও।মাইনষের কানপড়া শুনে এমন দুর্নাম রটাইয়ো না।আল্লাহ সহ্য করবো না।”জরিনে মিনারার মুখের দিকে তাকিয়ে বল্টুর মাকে জবাব দেয়।বল্টুর মা তাতে যেন আরও রেগে যায়
“তুই রাত বিরাতে পর পুরুষের সাথে ফষ্টি নষ্টি করতে পারস আর আমরা বলতে গেলেই সহ্য হইবো না?ভালো সাজা বন্ধ কর।”
বল্টুর মার কথা শুনে জরিনের কান্না পায়।দুই ডুব দিয়েই চলে আসে বাড়ি।এই শাড়ি বদলে ছেঁড়া শাড়িটা পড়ে নেয়।এই দুখান শাড়িই অবশিষ্ট আছে।হাসির জন্য জাউভাত রান্না করে ঘর দোর পরিষ্কার করে নেয় জরিনে।সামনের পুঁই মাচানজুড়ে পুঁইয়ের লতা পাতা ছড়াচ্ছে।দু’একটা মুরগী হলে কোনমতে ঠিক চলতে পারতো জরিনে।কিন্তু সে ভাবনা শুধুই অবান্তর এখন।অনেকক্ষণ হয়ে গেলেও হাসি জাগলো না দেখে জরিনে ঘরে গেল।মেয়ের শিওরে বসল।হাসির কপালে হাত রাখতেই বুকটা শূন্যতায় খা খা করে উঠলো।ঠান্ডা বরফ হয়ে আছে হাসির শরীরটা।জরিনে নির্বাক নিস্তব্ধ হয়ে যায়।হুশ ফিরতেই হাসিকে টেনে কোলে তুলে কান্নামিশ্রিত স্বরে ডাকতে লাগলো।
” ও মা,মাগো।ও হাসি চোখ খোল মা।”হাসি আর চোখ খোলে না।চিরতরের জন্য সে সকল ব্যথা বেদনা পেছনে ফেলে চলে গেছে বহুদূর।জরিনে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে মেয়ের ফ্যাকাশে মুখপানে।হঠাৎই আর্তনাদ করে ওঠে,
” আল্লাহ গো!আমার সব শেষ হয়ে গেল।আমার হাসি,,, ”
জরিনে পাগলিনী বেশে, দুয়ারে বাঁশের খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে আছে।উঠানে হাসির লাশ রাখা হয়েছে।মিন্টুর ভাইয়েরা একনজর দেখেই চলে গেছে।দু’একজন পাড়া প্রতিবেশী ছাড়া সবাই যার যার বাড়ি ফিরেছে।মসজিদের ইমাম সাহেব এসে তাগাদা দিল লাশ দাফনের জন্য।কিন্তু সমস্যা হলো কাফনের কাপড় কেনা নিয়ে।গতরাতের ঘটনার পর সবাই মুখ ফিরিয়ে নিল।মাতুব্বরের চক্রান্তে পুরো গায়ের মানুষ জরিনের বিপক্ষে।কেউ এই বিপদে জরিনের পাশে দাঁড়ায় না, এক হামজা মাস্টার ছাড়া।উঠানে দাঁড়ানো ঈমাম সাহেব আর হামজা মাস্টার।ঈমাম সাহেব অসহায় দৃষ্টিতে হামজার দিকে তাকাল।হামজা মোটা ফ্রেমের চশমাটা খুলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। গম্ভীরমুখে বললো,
” আপনি লাশ গোসলের ব্যবস্থা করান আমি আসছি।”
জরিনের সখি পারুল খবর পেয়ে পাশের গ্রাম থেকে ছুটে আসে।জরিনে উদভ্রান্ত দৃষ্টিতে জড়পদার্থের মতো বসে আছে।পারুল নিজে হাতে হাসিকে গোসল করায়।হামজা মাস্টার কাফনের কাপড় এনে ঈমাম সাহেব কে দেয়।জানাজা শেষে লাশ দাফন করা হয়।সবাই চলে গেলেও পারুল আর হামজা মাস্টার যায় না।পারুল জরিনের পাশে বসে বলে,
” ওঠ জরি!ঘরে চল।”
” আমার হাসি কি উঠছে রে পারু?একটা মুরগা ধরে নিয়ে আসি।আমার মাইয়্যাডা মুরগা খাইতে চাইছে।যাই।”জরিনে এলোমেলো পায়ে উঠতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে যায়।পারুল ধরে উঠিয়ে দাওয়া বসায়।
বান্ধবীর এমন দশায় পারুল কেঁদে বুক ভাসায়।অনেক কষ্টে জরিনেকে শান্ত করায়।হামজার কথায় আজ পারুল এ বাড়ি থেকে যায়।হামজা ওদের খাবার কিনে দিয়ে বাড়ির পথে পা বাড়ায়।
হামজা শুকনো মুখে বাড়ি ফেরে।উঠানে দাঁড়িয়ে সন্তানের কান্নার আওয়াজে থমকে দাঁড়ায়।হামজার মা নাতীকে কোলে তুলে নাচাচ্ছে।তবুও শান্ত করতে পারছেনা।দুধের শিশু মা ছাড়া কি করে শান্ত হয়? হামজাকে দেখে এগিয়ে আসে কান্নারত নাতীকে কোলে নিয়েই।
“লাশ দাফন হয়ে গেছে বাপ।”
” হ্যাঁ ” হামজা সন্তানকে কোলে তুলে নিয়ে বারান্দায় বসে।বুকে জড়িয়ে আদর করে।
পিতার কোল পেয়ে থেমে থেমে কাঁদে শিশুটি।
” তুই রাজি হইলে ক। আমি কালই জরিনের সাথে কথা কই।”
” তুমি কি পাগল হয়েছ মা!জরি আমার ছাত্রী ছিল।তাকে আমি কি করে বলি জরি তুমি আমার বাচ্চার মা হবে?”
” তুই না পারিস আমি কই।ছাত্রী ছিল এখন তো নেই।পোলাডার দিকে চাইয়া দেখ।মা মরা পোলাডারে আমি কেমনে বাচামু?
” আল্লাহ আছে মা।আল্লাহই দেখবে।দুনিয়াতে তো ও একা মা হারা না।”
ছেলেকে কোলে নিয়ে গম্ভীরমুখে ভিতরে চলে যায় হামজা।হামজার মা দাওয়ায় দাড়িয়ে চিৎকার করে নেকি সুরে বলে,
” পাষান তুই।পোলাডার কষ্ট তোর চোখে পড়ে না।রাজি হইলে ঐ মাইয়্যাডাও একটা আশ্রয় পাইবো।চারপাশে শিয়াল কুকুর ওঁৎ পাইতা আছে।ওরে কি ছাড়বো?তোর কি! তুই থাক তোর নীতি লইয়া।”
রাতে না খেয়েই শুয়ে পড়ে হামজা।তার কিছুই ভালো লাগছে না।সদ্য বিপত্নীক হওয়ার শোক এখনও কাটাতে পারে নি সে।বুকটায় গভীর শূন্যতা অনুভব করে স্ত্রী সাবিহাকে মনে পড়লে।এই তো সেদিন এসেছিল বউ হয়ে সাবিহা।বধূ সেজে বসে ছিল এই খানে।হামজা লজ্জা আর সংকোচ নিয়ে বাসর ঘরে বসেছিল।হামজাকে লজ্জা পেতে দেখে সাবিহার সে কি হাসি?হামজার কানে যেন এখনও ধ্বনিত হচ্ছে সে হাসির ঢেউ।চোখ ভিজে আসে হামজার।সাবিহার বালিশটা বুকে জড়িয়ে চাঁপা কান্নায় ভেঙে পড়ে।
জরিনের শোক এখনও কাটে না।খেয়ে না খেয়ে দিনাতিপাত করে সে।হামজার মা,পারুল মাঝে সাঝে এসে খাবার দিয়ে যায়।সারাদিন ঘরে মৃত মেয়ের ব্যবহৃত জিনিসপত্র নিয়ে কেঁদেই তার দিন কাটে।।
একমাস কেটে যায়।জরিনের বুক শূন্য হলেও টিকে থাকার লড়াইয়ে সে আবার স্বাভাবিক হয়।এ বাড়ি ও বাড়ি কাজ করে কোনোরকমে চলে।এরমধ্যে একদিন হামজার মা জরিনেকে নিজের মনের কথাটা জানায়।জরিনে সরাসরি না করে দেয়।তার এক কথা মিন্টু আসবে।জরিনের ভালোবাসা সত্যি হলে মিন্টু আসবে।মিন্টুর জন্য পথ চেয়ে জরিনে মরে যাবে তবুও এ ভিটে ছেড়ে যাবে না।হামজার মা হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরে আসে।হামজাকে লুকিয়েই সে গিয়েছিল কথাটা বলতে।বড় আশা ছিল জরিনের হ্যাঁ এর।কিন্তু আশাপূরণ হলো না।হামজার মা নাতির হাত পা ছুঁড়ে কান্না করা মুখটার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে।জরিনে আশায় বুক বেঁধে অপেক্ষা করে মিন্টুর জন্য।তার ভালোবাসা সত্যি করে মিন্টুকে যে আসতেই হবে। অবশেষে জরিনের প্রতিক্ষার অবসান হয়।মিন্টু বাড়ির উঠানে এসে দাঁড়ায়। জরিনের চোখ দুটো খুশিতে ঝাপসা হয়ে আসে।ঠিকমতো দেখতে পায় না মিন্টুর চেহারাটা। তবে বুঝতে পারে মিন্টু বদলে গেছে।গায়ে রঙিন পোশাক।মুখে অনাবিল হাসি।জরিনে এক বুক আশা নিয়ে মিন্টুর সামনে দাঁড়ায়। কতো বদলে গেছে এই চার বছরে মানুষটা।জরিনে অপলক চোখে চেয়ে দেখে তার মিন্টুকে।আচমকা মিন্টুর গলা জড়িয়ে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে সে।

চলবে,,,,