#ডাক্তার_মিস
পর্বঃ ১৮
গাড়ি চলতে শুরু করতেই অবসাদে চোখ বন্ধ করলো বুশরা। গালবেয়ে ঝরতে লাগলো অবাধ্য জলধারা। গাড়ি গ্রাম পেরিয়ে মাঠের মাঝ দিয়ে ছুটতে শুরু করতেই ড্রাইভিং সিটে বসা মানুষটা বলল,
“বেশি মন খারাপ লাগছে মিস?”
অনাকাঙ্ক্ষিত কন্ঠ শুনে অবাক দৃষ্টিতে চোখ খুললো বুশরা।
“আপনি?”
“গাড়িটা আমার ম্যাডাম। ভুলে গেছেন?”
“সরি। না মানে… আপনি তো ব্যাস্ত থাকেন। আমি ভেবেছিলাম ড্রাইভার চাচা।”, আমতা আমতা করে বলল বুশরা।
মিররের ভেতর দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রায়হান বলল,
“এমা সরি বলছেন কেন? আমার জন্য আপনাকে গ্রাম ছাড়তে হলো। ভীষণ খারাপ লাগছে আমার। তাই ভাবলাম পৌঁছে দেই।”
বুশরা স্মিত হেসে বলল, “আর আমার জন্য যে আপনার মত গন্য মান্য ব্যাক্তির গায়ে কাদা ছোঁড়াছুড়ি হচ্ছে।”
“পুরুষ মানুষের গায়ে বদনাম লাগে না।”
“আপনি বলছেন এ কথা?”
“উঁহু… এটা সমাজ বলে, যে সমাজে আমরা বাস করি।”
“আর আপনি?”
“আমি কি?”
“কি ভাবেন?”
“আমাএ মত ক্ষুদ্র মানুষের ভাবনাতে কি আসে যায়?”
বুশরা সহসা উত্তর দিল না। বিড়বিড় করে বলল, “কারো হয়ত এসে যায়।”
“সরি?? কিছু বলছেন?”
“কই, কিছু না তো।”
দুজনেই সহসা আর কোন কথা বলল না।
কিছুক্ষণ বাদে বুশরা বলল, “আচ্ছা আপনি বলেছিলেন, আপনার রাজনীতিতে আসা কেউ বাঁধা দিয়েছিল।”
“হ্যাঁ বলেছিলাম।”
“কে তিনি? কিভাবে মানালেন?”
“মানানোর সুযোগ পেলাম কই?”
মুহুর্তের জন্য আনমনা হলো রায়হান। হালকা স্বরে বলল, “আচ্ছা মিস আমি কি খুব খারাপ কিছু করি? চুরি? ডাকাতি? বাটপারি? অর্ধ যুগের সম্পর্ক ভুলে একটা মানুষ চলে যায় শুধু রাজনীতি করতে চাই বলে? এমপি মিনিষ্টার হওয়ার এম্বিশন না রেখে গ্রামে ফিরতে চাই বলে? ”
এরকম কিছু আন্দাজ করেছিল বুশরা। তবে এই মুহুর্তে রায়হানের আহত কন্ঠস্বর শুনে দিশেহারা বোধ করছে ও। যে মানুষটাকে নিজের অজান্তেই পছন্দ করে ফেলেছে তাকে প্রাক্তনের দিয়ে যাওয়া আঘাতের শান্তনা দেওয়ার ভাষা ওর কাছে নেই।
“আপনি খুব মহৎ একজন মানুষ। শেকড়ের মানুষগুলোকে নিয়ে আপনার মত কয়জন ভাবে? রাজনীতি মানেই তো এখন মানুষের কাছে পাওয়ার, বড় বড় পদ, ক্ষমতা অপব্যাবহারের লিপ্সা। আপনি তাদের চেয়ে আলাদা। অনেক আলাদা। শী ডাজন্ট নো, হোয়াট শী হ্যাভ লস্ট।”
একহাতে স্টিয়ারিং ধরে আরেকহাতের উল্টোপিট দিয়ে চোখের কোনায় জমে থাকা খুচরো অনুভূতিকে মুছে ফেললো রায়হান। এ সমাজ তো পুরুষের এসব অনুভূতির উপর কারফিউ দিয়েছে সেই কৈশরেই। বাকি পথ আর তেমন কথা হল না তাদের।
গন্তব্যের কাছাকাছি পৌঁছাতে খুব বেশি সময় লাগলো না ওদের। নতুন বাসায় গিয়ে রান্নার ব্যাবস্থা করা কঠিন হবে বুশরার জন্য। তাই শিউলি বেগম বারবার বলে দিয়েছেন রায়হানকে, আগে একটা রেস্টুরেন্টে রাতের খাওয়াদাওয়া করে তারপর যেন বাসায় পৌঁছে দেয় বুশরাকে। তিনি চাইলেই টিফিন ক্যারিয়ারের পথ ধরতে পারতেন। কিন্তু তার মনোবাসনা তো তিনিই ভালো জানেন।
মফস্বলে রেস্টুরেন্টের প্রচলন হয়েছে বেশিদিন হয়নি। তবে কাজের খাতিরে দুয়েকটা ভাল রেস্টুরেন্টের খোঁজ জানে রায়হান। তারই একটাতে নিয়ে গেল বুশরাকে। দিনের বেলা রমরমা থাকলেও এই ভর সন্ধ্যে বেলায় খুব একটা ভীড়ভাট্টা নেই। একটা কোনার টেবিলে বসে খাবার অর্ডার দিল রায়হান। বুশরাকে জিজ্ঞাসা করেছিল কি খাবে। সদুত্তর না পেয়ে নিজের পছন্দসই আইটেমগুলোই অর্ডার করেছে। খাবার আসতে একটু দেরি হলেও দুজনের কেউই কোন কথা বলল না।
খাবার সার্ভ করার সময় বুশরার গলার চেইনটা খেয়াল করল রায়হান। মূলত স্পেশাল ডিজাইনের লকেটটার জন্যই চিনতে পারলো। ভেবে পেলনা এই চেইন বুশরার গলায় কেন? আবার ভাবলো, হয়ত রুকুর গলায় দেখে পছন্দ হয়েছে দেখে একই রকম করে বানিয়েছে। মেয়েদের তো কত রকম শখ থাকে। খাওয়ার মন দিল রায়হান। তবে মনের মধ্যে খচখচ করতে লাগলো। আমতা আমতা করে বললো,
“আপনার গলার চেইনটা……. সুন্দর।”
“ও.. এইটা। চাচীআম্মা দিয়েছে। আমি তো এসব পরিনা। কিন্তু চাচীআম্মা জোর করে পরিয়ে দিল।”
“ও আচ্ছা।”
খটকা টা দানা বাঁধতে বাঁধতে পাহাড়সম হয়ে উঠলো রায়হানের মনে। মায়ের মনে কি চলছে জানার জন্য অস্থির হয়ে উঠলো ও। তবে বুশরাকে আর কিছু বলল না এই বিষয়ে।
খাবারের বিল মিটিয়ে বুশরাকে বাসায় পৌঁছে দিল রায়হান। শুভকামনা জানিয়ে বিদায় নিল।
বাড়ি পৌঁছে মায়ের ঘরে হানা দিল রায়হান। একথা সেকথার পরে বললো,
“মা, ওই চেইনটা কোথায়?”
“কোন চেইন?”
“যেটা আমার বৌয়ের জন্য বানিয়েছিলে?”
উদ্বিগ্নস্বরে শিউলি বেগম বললেন, “হঠাৎ ওটার খোঁজ কেন? কাওকে পরাতে চাও।”
মাথা নেড়ে রায়হান বলল, “না। এমনি।”
“তাহলে নিশ্চিন্তে থাকো। যথাস্থানেই আছে।”
তিক্ত স্বরে রায়হান বলল, “তাহলে ওটা মিস বুশরার গলায় কেন?”
এত তাড়াতাড়ি বিষয়টা সামনে চলে আসবেন ভাবেননি শিউলি বেগম। চোরের মত ইতিউতি তাকালেন তিনি। সদুত্তর না পেয়ে অধৈর্য হয়ে রায়হান বলল, “চুপ কেন মা? উত্তর দাও।”
“কারন বুশরাকে এ বাড়িতে ফিরিয়ে আনতে চায় তোমার মা। আর আমার তাতে পূর্ণ সম্মতি আছে।”
দরজায় কখন রুস্তম শেখ এসেছেন খেয়াল করেননি মা ছেলে কেউই। বাবার কথার মানে বুঝে উঠতেই বজ্রাহতের মত থমকে গেল রায়হান।
#ডাক্তার_মিস
পর্বঃ ১৯
“কারন বুশরাকে এ বাড়িতে ফিরিয়ে আনতে চায় তোমার মা। আর আমার তাতে পূর্ণ সম্মতি আছে।”
দরজায় কখন রুস্তম শেখ এসেছেন খেয়াল করেননি মা ছেলে কেউই। বাবার কথার মানে বুঝে উঠতেই বজ্রাহতের মত থমকে গেল রায়হান। দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতে দেরি হল না বিচক্ষণ রায়হানের।
অসহায় কন্ঠে বলে উঠলো,
“আমার সাথে একবার কথা বলার প্রয়োজন মনে করলে না আম্মা? জীবনটা তো আমার নাকি? আমার মতামতের কি কোনও দাম নাই?”
এতক্ষনে নিজেকে সামলে নিয়েছেন শিউলি বেগম। শান্ত কন্ঠে বললেন,
“তোমার মতামতের দাম আছে বলেই গত পাঁচ বছরে আমি বা তোমার আব্বা তোমার উপর কিছু চাপিয়ে দেইনি। কখনো জিজ্ঞাসা করিনি কেনো তোমার এই বৈরাগ্য। এমনকি এখনও যদি তুমি বলো তুমি অন্য কাওকে বিয়ে করতে চাও আমরা সসম্মানে তাকে ঘরে তুলে আনবো।”
“কিন্তু আম্মা… আব্বা একটু আম্মাকে বুঝাও না। বিয়ে তো ছেলেখেলা নাহ…”
রুস্তম শেখ নিজেও চান তার একমাত্র ছেলে জীবনে থিতু হন। তিনি নিযে কখনো ছেলেকে জোর করতে পারেননি কোন বিষয়ে। তবে আজ যখন তার সহধর্মিণী শক্ত হাতে ছেলের জীবন গুছিয়ে দিতে চাচ্ছেন তখন তাতে বাগড়া দেওয়ার কোন ইচ্ছে নেই তার।
রুস্তম শেখ বললেন, “দেখো বাবা। আমরা বুড়ো হচ্ছি। আজ আছি, কাল নাই। বাবা মা হিসেবে কি আমরা চাইতে পারি না যে আমাদের ছেলেমেয়েগুলো জীবনে সুখী হোক? অন্তত চেষ্টা তো করুক?”
শিউলি বেগম ছেলের হাত ধরে বললেন, “বাবামায়ের শান্তির জন্য একটু সুখী হওয়ার চেষ্টা করতে পারবি না বাবা?”
বাবা মায়ের সম্মিলিত ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলের মুখে রায়হান দিশেহারা বোধ করছে। শিউলি বেগমের চোখে পানি। এ জগতে যে কজনার চোখে পানি সহ্য করতে পারে না রায়হান, ওর মা তাদের মধ্যে সবার উপরে। মা অন্তপ্রাণ বলতে যা বোঝায়, রায়হানকে তা ই বললে খুব একটা ভুল হবে না।
“কিছু বল বাবু..”
“আম্মা আমাকে একটু সময় দাও প্লিজ।”, এটুকু বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল রায়হান। এক ছুটে চলে গেল সেই যায়গায়, যা কিনা রায়হানের সব মন খারাপের সাক্ষী।
সেই শান বাধানো পুকুর পাড়। বিষন্ন রায়হান। সারা রাত ঠায় বসে থাকলো ওখানেই। তবে আজ জানালা থেকে স্থির দৃষ্টিতে বিষন্ন পুরুষের দিকে তাকিয়ে থাকার মানুষটি নেই। সে তো জানেও না যে তাকে নিয়ে শেখ বাড়িতে কি ঠান্ডা যুদ্ধটাই না চলছে।
ভোরের দিকে একটা জরুরি ফোন পেয়ে বাড়ি ফিরলো রায়হান। বাইক নিয়ে বেরিয়ে গেল ঝড়ের বেগে। বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে এলোমেলোভাবে বাইক চালাতে গিয়েই বাধলো বিপত্তিটা। রাস্তায় খড় বিছিয়ে রাখা ছিল শুকানোর জন্য। খড়ের পরতের নিচেই ছিল আত্মঘাতী খাদটা। মড়ার উপর খাড়ার ঘা হিসাবে তার পাশেই ছিল একটা সাড়াশি, খড় দিয়ে ঢাকা। বাইকটা উলটে পড়ে গেল রাস্তর একপাশে। রায়হান ছিটকে পড়লো সাড়াশি টার উপর।
সকাল বেলা হওয়ায় রাস্তায় বিশেষ কেউই ছিল না। দুটো ছোট্ট বাচ্চা রাস্তার পাশে খেলছিল। ঘটনার আকষ্মিকতা বোঝার মত বয়স হয়নি তাদের। বহু কষ্টে বাম হাতে পকেট থেকে ফোনটা বের করে রায়হান। পিচের রাস্তার উপর আছড়ে পড়ায় স্ক্রিণ ফেটে চৌচির। কাঁপা কাঁপা হাতে লাস্ট ডায়াল কলের মানুষটাকে ফোন করল রায়হান।
পথের আন্দাজ সেরকম না থাকায় হাসপাতালে আসতে বেশ দেরী হল বুশরার। ডিউটিতে আসতেই বুশরার কানে আসে রায়হানের খবরটা। দেরি না করে দুই নাম্বার কেবিনে ছুটে যায় ও। রুস্তম শেখ বাইরে বসে আছেন। বুশরা মৃদু হেসে সাহস জোগানোর চেষ্টা করলো উনাকে।
কেবিনে ঢুকে দেখলো শিউলি বেগম ছেলের মাথার কাছে একটা চেয়ারে বসে নিঃশব্দে কাঁদছেন। ঘুমের ইঞ্জেকশনের প্রভাবে রায়হান ঘুমাচ্ছে বেঘোরে। হাতে, পায়ে কপালে ব্যান্ডেজ। বেশ ভালো ভাবেই যখম হয়েছে এটা বুঝতে বেগ পেতে হলো না অভিজ্ঞ চোখদুটার।
শান্ত পায়ে এগিয়ে গিয়ে চাচিআম্মাকে জড়িয়ে ধরল বুশরা। একটা নির্ভরতার অবলম্বন পেয়ে নিঃশব্দে কেঁপে কেঁপে উঠছেন তিনি। বেশ কিছুক্ষন পরে বাধন আলগা করল বুশরা। মৃদুস্বরে সান্ত্বনা দিয়ে কান্না থামাতে বলল।
রোগী দেখার ফাঁকে ফাঁকে এসে রায়হানকে দেখে যাচ্ছিল বুশরা। দুপুর তিনিটায় শিউলি বেগমকে অনেক কষ্টে বাড়িতে পাঠিয়েছে বুশরা। আঃশ্বাস দিয়েছে যে তিনি গোসল করে, খাওয়াদাওয়া করে আসা পর্যন্ত আশেপাশেই থাকবে ও।
রায়হানের ঘুম ভাংলো তিনটার একটু পরেই। ওকে ধাতস্থ হওয়ার সময় দিল বুশরা।
তারপর আলতো স্বরে বলল,
“কেমন লাগছে এখন?”
“ভালো।”, ছোট্ট করে উত্তর দিল রায়হান। যা বোঝার বুঝে নিল বুশরা।
” আমাকে বলেন আমি চোখে দেখিনা, আর আপনি দুইদিন পরপর এক্সিডেন্ট করেন। ব্যাপারটা কেমন হয়ে গেলো না?”
চোখ মুখ কুচকে মৃদু হাসলো রায়হান। তারপর চোখ বন্ধ করল। বেশ কিছুক্ষন সাড়া শব্দ না পাওয়ার বুশরা ভাবলো আবার হয়ত ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু ওর ধারণা ভুল প্রমান করে চোখ বন্ধ করেই মুখ খুলল রায়হান।
“আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে।
“এই অবস্থায়? একটু সুস্থ হয়ে নিন আগে।”
“জরুরি কথা।”
“আচ্ছা বলুন।”
“আমি বিবাহিত।”
কেমন দিলাম বন্ধুগণ?