ডাক্তার মিস পর্ব-১৬+১৭

0
597

#ডাক্তার_মিস
পর্ব ১৬

বুশরা ঘরে ঢুকে অন্ধকারে হাতড়ে লাইট জ্বালালো। রুকু গুটিশুটি মেরে শুয়ে ছিল। আলো চোখে লাগতেই উঠে বসল। রুকুর নিস্প্রভ চেহারা দেখে অবাক হল বুশরা।

“কিরে তোর শরীর খারাপ?”

“কই না তো!”

“তাহলে? চোখমুখের এমন হাল কেন?”

কি উত্তর দিবে ভেবে পেলনা রুকু। অবশেষে আমতা আমতা করে পুরো ঘটনা খুলে বলল প্রাণের বান্ধবীকে। বুশরার আশাহত চেহারা দেখে অসহায় বোধ করল রুকু।

“দোস্ত, তুই ট্রান্সফারের চেষ্টা কর।”

“দুচারজন মানুষের কথায় আহত হয়ে শত মানুষের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিব? এই গ্রাম আমাকে দুহাত ভরে দিয়েছে দোস্ত।”

রুকু চোখ নামিয়ে নিল। এই প্রশ্নের উত্তর ওর কাছে নেই। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বুশরা বলল,

“চিন্তা করিস না, রায়হান সাহেবের যাতে আর সম্মানহানি না হয় সেটা আমি দেখছি।”

জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বান্ধবীর দিকে তাকালো রুকু।

“থানা শহরে একটা বাসা ভাড়া নিয়ে সেখানে থাকবো। আসা যাওয়া সমস্যা হবে না, দূর না তো। আর চাচীআম্মার কথা মনে পড়লেই দৌড় দিয়ে চলে আসবো।”

রুকাইয়া উঠে গিয়ে বুশরাকে জড়িয়ে ধরলো।

এরপর কয়েকদিন গেল মাথাগোঁজার মত একটা ঠাই খুঁজতে। সারাদিন হসপিটালে থাকায় নিজে এদিকে সময় দিতে পারে না বুশরা। রুকু আর ওর এখানকার এক বান্ধবী মিলে তন্ন তন্ন করেও যখন একটা একলা মেয়ে থাকার মত বাসা খুঁজে পেল না তখন মুশকিল আসান হয়ে আসলো রায়হান। ওর এক বন্ধু থাকে বিদেশে, বাসায় বৃদ্ধা মা আর ছোট বোন থাকে, কোন পুরুষ মানুষ নেই। সচরাচর বাড়তি ফ্ল্যাটটা ভাড়া দেন না উটকো ঝামেলা এড়াতে। মেহমান আসলে ব্যাবহার হয়। নাহলে তালাবদ্ধ থাকে। শুধুমাত্র রায়হানের অনুরোধে বাসাটা ভাড়া দিতে রাজি হয়েছেন বন্ধুটির মা।

সুন্দর ছিমছাম একটা দুই রুমের বাসা, সাথে ছোট্ট এক চিলতে বারান্দা, রুকুর দেখেই পছন্দ হয়ে গেল। ভিডিও কলে বুশরাকে বাসাটা ঘুরে ঘুরে দেখালো রকু। বান্ধবীর সাথে কথা বলে পছন্দ হওয়ায় এক মাসের এডভান্সও দিয়ে গেল।

সেদিন রাতেই খাওয়ার টেবিলে বসে শিউলি বেগমকে চলে যাওয়ার বিষয়ে বলল বুশরা। এ কথা শুনে আকাশ থেকে পড়লেন শিউলি বেগম। মা মরা মেয়েটা অল্প কদিনেই খুব কাছের কেউ হয়ে গেছে। সেই মেয়ে হুট করে চলে যাবে শুনে অবাক হতেও ভুলে গেলেন তিনি।

রুস্তম শেখ রাশভারি কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন,

“তোমাকে কেউ কিছু বলেছে মা?”

বুশরা চুপ করে রইলো। শিউলি বেগম রুকুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “কি হইছে বলবি একটু তোরা? হুট করে একজন বলছে এখানে আর থাকবে না। শহরে চলে যাবে। গ্রামে মন টিকতেছে না?”

কেউ কিছু বলছে না দেখে শিউলি বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “বাড়িতে সবাই যার যার মর্জিমত আসে, যায়, যা মনে চায় করে, আমার হইছে যত জ্বালা।”

ছলছল চোখে মাথা নিচু করে বসে থাকলো বুশরা। আঙুল দিয়ে প্লেটের ভাত নাড়াচাড়া করছে শুধু।

রুকু ছোট্ট করে বলল, “ভাইয়া বলেছে ওকে গ্রাম থেকে চলে যেতে।”

মেয়ের কথা শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন শিউলি বেগম।

“তোমার ভাইকে বলে দিও সে গ্রামের চেয়ারম্যান হতে পারে, কিন্তু এই বাড়িটা আমার স্বামীর। তাই এই বাড়িতে কে থাকবে না থাকবে সেটা নিয়ে তার মাথাব্যাথার দরকার নাই।”

রুস্তম সাহেব বললেন,” এমনিই তো বাড়িতে সাহেবের চেহারা দেখা যায় না, সে চাইলে পার্মানেন্টলি ক্লাবঘরে আস্তানা গাড়তে পারে।”

অবস্থা বেগতিক দেখে রুকু ইতস্তত করে বলে ফেলল গ্রামে বুশরা আর রায়হানকে নিয়ে কি ধরনের জল্পনা কল্পনা আর কথা ছড়াচ্ছে। বুশরা শিউলি বেগমের হাত ধরে অনেক বুঝালো। সুযোগ পেলেই দেখা করতে চলে আসবে কথা দিল। আরো টুকটাক কিছু কথা হল তাদের মধ্যে।

“কবে যেতে চাচ্ছো?”

“কাল?”

“কোথায় থাকবে?”

” একটা বাসা ভাড়া নিয়েছি। পিচ্চি, সুন্দর।”

আর কেউ কিছু বললনা। চুপচাপ খেয়ে যার যার ঘরে চলে গেল।

সে রাতে কিছুতেই ঘুম আসলো না শিউলি বেগমের। ভোরবেলা রুস্তম শেখ নামাজ পড়তে উঠলে শিউলি বেগম বলে বসলেন,

“বুশরাকে আমি পুত্রবধূ করতে চাই।”

চলবে…

#ডাক্তার_মিস
পর্বঃ ১৭

সে রাতে কিছুতেই ঘুম আসলো না শিউলি বেগমের। ভোরবেলা রুস্তম শেখ নামাজ পড়তে উঠলে শিউলি বেগম বলে বসলেন,

“বুশরাকে আমি পুত্রবধূ করতে চাই।”

বুশরার প্রতি নিজের স্ত্রীর মাতৃসুলভ ভালবাসার কথা অজ্ঞাত হয় রুস্তম শেখের। তবু হঠাৎ এমন ইচ্ছের কথা শুনে থমকে গেলেন তিনি। না মেয়ে হিসেবে বুশরাকে অপছন্দ নয় তার। অপছন্দ করার মত মেয়ে নয় ও কোন দিক থেকেই। তবে রায়হানের পাশে কখনো কল্পনা করেননি বুশরাকে। উনার ঢৃড় বিশ্বাস যে তার সহধর্মিণীও সে পথে আজকের আগে পা বাড়ান নি। শুধু কন্যা সমতূল্য মেয়েটাকে আঁচলে বেঁধে রাখার জন্যই সমাধান হিসেবে এই চিন্তার উদ্ভাবন।

“কিছু বলতেছ না যে?”

স্ত্রীর ঠেলায় ভাবনার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসলেন রুস্তম শেখ।

“ভেবে বলতেছ তুমি? বিয়ে কি ছেলেখেলা?”

“ভেবেই বলতেছি। আমার নিজের মাথায় যেটা আসেনি, গ্রামের মানুষ চোখে আঙুল দিয়ে সেটাই দেখায়ে দিল।”

“বিয়ে তো অনেক পরের কথা তোমার ছেলেকে গত পাঁচ বছরে রাজি করাতে পারছো মেয়ে দেখতে যাওয়ার জন্য?”

“এবার আমি রাজি করাবো। তোমার চিন্তা করা লাগবে না।”

“আর বুশরা? মেয়েটার চাকরিজীবনের কেবল শুরু, এরপর পড়াশুনা করতে দেশ বিদেশ যাবে। আমাদের এই অজ পাড়াগাঁয়ে নিজের পুরো জীবন পার করবে কেন?”

“আমরা তো ওকে পেছন থেকে টাইনা ধরব না রায়হানের আব্বা। ওর যত পড়াশুনা করার করুক। দেশ বিদ্যাশ যাওয়া লাগলে যাক। নাতিপুতি হইলে আমি পাইলা পুইশা বড় করে দিবো। আমি তো আছি নাকি?”

গম্ভীর রুস্তম শেখ হেসে ফেললেন। এক হাতে স্ত্রীর কাঁধ জড়িয়ে ধরে বললেন,

“এত্তদূর যখন ভাইবা ফেলছো, আমি আর কি বলব। আমার কোন আপত্তি নাই। তোমার সংসার, তোমার ছেলে, মেয়েটাও তোমার। দ্যাখো কি বলে ওরা।”

স্বামীর কাছ থেকে মৌখিক সম্মতি পেয়ে কিছুটা ভারমুক্ত হলেন তিনি। ফজরের নামাজ পড়ে বালিশে মাথা রাখতেই রাজ্যের ঘুম নেমে এলো দুচোখ জুড়ে।

শিউলি বেগমের ঘুম ভাংলো একটু বেলা করে। রুকুর ঘরে গিয়ে দেখলেন তার মেয়েটা ঘুমাচ্ছে। বিছানার একপাশে বুশরার লাগেজটা প্রায় গোছানো। আর বুশরা রেডি হচ্ছে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য।

“চাচীআম্মা কিছু বলবা?”

“হ্যাঁ, তোর সাথে আমার জরুরী কথা আছে।”

লাগেজের চেইন লাগাতে লাগাতে বুশরা বলল, “তা বলো না…”

শিউলি বেগম একটা দম নিয়ে কথা শুরু করতে যাবেন ঠিক তখনই বুশরার ফোনটা বেজে উঠলো তারস্বরে।

“এক মিনিট চাচী…”

ফোনের ওপাশে যেই থাকুক কয়েকবার আচ্ছা আচ্ছা বলে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল বুশরা।

যাওয়ার আগে শুধু পেছনে ফিরে বলল, “এসে শুনবো চাচী।”

বুশরা চলে গেল। বিছানার এক পাশে বসলেন শিউলি বেগম। আড়মোড়া ভেঙ্গে ঘুম থেকে উঠলো রুকু। মাকে এই সময় নিজের ঘরে দেখে একটু অবাক হল। তার চেয়েও বেশি অবাক হল যখন ওর সবচেয়ে প্রিয় মানুষদুটোকে নিয়ে ওর মায়ের পরিকল্পনা শুনলো। হ্যাঁ না কিছু না বলে শুধু বলল,

“বুশরা তো আজকেই চলে যাচ্ছে মা। দেখতেছোনা, গোছগাছ সব শেষ। আর ভাই কি মানবে?”

অবুঝের মত করে তিনি বললেন, “আমি এত কিছু জানিনা।”

শিউলি বেগমের দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো অবাধ্য মুক্তোদানারা। রুকুর মনে পড়ল ওর মা শেষ এভাবে কেঁদেছিল যেদিন ও এডমিশন টেস্টের কোচিং করতে বাড়ি ছেড়েছিল অজানার উদ্দেশ্যে। অথচ এই অল্পদিনে মেয়েটা কি গভীর মায়ার বেঁধে ফেলেছে এই মানুষটাকে।

“আচ্ছা আম্মা, আপাতত বুশরাকে যেতে দাও। তাড়াহুড়া করোনা। আমরা আবার বুশরাকে নিয়ে আসবো। সসম্মানে। আমার উপর ভরসা রাখো।”

মেয়ের কথায় আশ্বস্ত হয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালেন তিনি। সবটুকু মায়া ঢেলে রান্না করলেন বেশ কয়েকপদ। অবশই সবগুলো পদ বুশরার প্রিয়। রান্না শেষ সব একটু একটু করে টিফিন ক্যারিয়ারে উঠালেন তিনি। তারপর কফিল চাচাকে দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন হাসপাতালে।

দুপুরে রাউন্ড শেষে ডেস্কে এসে বুশরা দেখলো টিফিন ক্যারিয়ার রাখা। হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসল ও। বক্সগুলো খুলতেই বেরিয়ে এলো বুশরার প্রিয় খাবারগুলো। মৃদুহেসে খেয়ে নিল বুশরা।

রোগীর চাপ বেশি না থাকায় তাড়াতাড়ি বাড়িতে ফিরলো বুশরা। লাগেজপত্র আরেকবার চেক করে কফিল চাচার হাতে নিচে পাঠয়ে দিল ও। হ্যান্ডব্যাগটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। রুকুও একটা ব্যাগ হাতে নিয়ে এগোলো বুশরার সাথে।

শিউলি বেগমকে বাইরে না পেয়ে ঘরে গেল ওরা দুজনে। প্রিয় চাচীকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো বুশরা। শিউলি বেগম ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।

“কাঁদে না মা। মন কেমন করলেই চলে আসবি। মানুষের মুখ কিভাবে বন্ধ করা লাগে সেটা আমি বুঝবো।”

কিছুক্ষণ থেমে রুকুকে বললেন আলমারি থেকে একটা কাঠের বাক্স বের করে নিয়ে আসতে। বাক্স থেকে একটা সোনার চেইন বের করে বুশরার গলায় পরিয়ে দিলেন। মুহুর্তের বিষ্ময় কাটিয়ে বুশরা বলল,

“একি চাচীআম্মা। এসব কেন?”

“আমার মন চাইছে তাই।”

রুকাইয়া বলল, “নিয়ে নে বুশরা। দেখ আমার গলারটা ও একই রকম। আমার জন্মের সময় বানানো।”

বুশরা খেয়াল করল, চেইনটা, এমনকি লকেটটাও একদম রুকাইয়ারটার মত, ঠিক যেন দুই মেয়ের জন্য একসাথে বানানো।

“সন্ধ্যা হয়ে যাবে চাচীআম্মা। আমি তাহলে রওনা দেই।”

“সাবধানে যাস। রুকু, গাড়ি বাইরে দাঁড়ানো। লাগেজপত্র গাড়িতে পাঠায়ে দিছি। উঠায়ে দিয়ে আয়।”

রুস্তম শেখের সাথে দেখা করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসলো দুই বান্ধবী। বুশরার মনটা খারাপ। কখনো পরিবার ছিল না মেয়েটার। জীবনের এই পর্যায়ে এসে অনেক মায়া আর ভালবাসায় কাটিয়েছে গত কয়েক মাস। বাড়িটার প্রতি, মানুষগুলোর প্রতি জন্মে গেছে মন কেমন করা মায়া। আর কোন কারন ছাড়াই একজন বিশেষ মানুষের প্রতি অজানা ঘোর।

যাওয়ার আগে ভুলেও একটাবার দেখা হলোনা মানুষটার সাথে। কোন কারন নেই তবু বুশরার না চাইতেও মন কেমন করছে এটা ভেবে। গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে অনেক পাকা পাকা উপদেশ দিল রুকাইয়া। গাড়ি চলতে শুরু করতেই অবসাদে চোখ বন্ধ করলো বুশরা। গালবেয়ে ঝরতে লাগলো অবাধ্য জলধারা। গাড়ি গ্রাম পেরিয়ে মাঠের মাঝ দিয়ে ছুটতে শুরু করতেই ড্রাইভিং সিটে বসা মানুষটা বলল,

“বেশি মন খারাপ লাগছে মিস?”

অনাকাঙ্ক্ষিত কন্ঠ শুনে অবাক দৃষ্টিতে চোখ খুললো বুশরা।

ব্যাস্ততা আর অসুস্থতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে লিখে ফেললাম অল্প কিছুটা। পাঠকের কাছে প্রশ্ন, বুশরাকে দেওয়া চেইনটার রহস্য কি? অনাকাঙ্ক্ষিত কন্ঠটি কার? গল্প কি চলবে?