তুই আমার কাব্য পর্ব-৫৩ এবং শেষ পর্ব

0
1924

#তুই_আমার_কাব্য 🍂

#Writer: Anha Ahmed
#Part: 53 ( Last Part)
.
🍁
.

– ইস্! কি সব গান বাজছে। তোদের ঘড়ির সময় কি ষাট দশকে ফিরে গেলো নাকি? ওই আমার ফোন নে।

দু হাত ভর্তি করে মেহেদি পড়া অবস্থায় সিঁড়ি থেকে নামতে নামতে তনুর চিৎকার শুনে মেঘলা উল্টো চিল্লিয়ে বলে ওঠে,

– ওই চিল্লাছিস কেনো? তোর চিল্লানোর জন্য তো বাড়ির ছাদে পাখিও বসবে না।

তনু কোমরে হাত রেখে পেছন ঘুরে তাকিয়ে মেঘলাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে কুটনৈতিক ভঙ্গিতে বললো,

– তুই এখানে কেনো? কি চাই? বিয়ের কনে তুই, রুমে থাকবি। সারা বাড়ি চরকির মতো ঘুরছিস কেনো? লাজ লজ্জা হাটে বেঁচে এসেছিস নাকি?

– লজ্জা পাওয়ার কি আছে? আমি কি ব্যংক লুট করে ধরা খেয়েছি নাকি যে লজ্জায় মুখ গুজে রুমে বসো থাকবো? আজ আমার বিয়ে। তাও আবার দ্বিতীয় বার মানে একই ব্যক্তির সাথে দ্বিতীয় বার। খুশির দিন। এমন ভাগ্য কতজনের হয় বলত? এমন সুযোগ হাত ছাড়া করবো নাকি?

– তোর তো পুরোনো জামাই। দু বছর প্রেম করে শখ মেটে নি আরো আনন্দ করার শখ জাগে?

– থাপড়া দিয়ে দাঁত বাকায়ে দিবো। প্রেম কি? এতো সুন্দর হালাল সম্পর্ককে হারাম বানায়ে দিস।

– একশোবার বলবো প্রেম করেছিস।

– হুহ! বেশ করেছি প্রেম করেছি করবোই তো। লিগ্যাল জামাইয়ের সাথে প্রেম করেছি।

– সর তুই চোখের সামনে থেকে। দেখতে ইচ্ছে করে না। বেষ্টফ্রেন্ডকে একা রেখে বিয়ে করে নিতে তোর লজ্জা করে না? ছিহ্! বান্ধবী নামের কলঙ্ক তুই মেঘলা।

– হো হো এই ব্যপার? আমি প্রেম করলে তোমার কেনো জ্বলে রে বন্ধু তোমার কেনো জ্বলে?

– ছিহ্! কিসব গান।

– এখন তো কিসবই লাগবে। আচ্ছা শোন পানি খাওয়া আমাকে।

– তোমার সাধের জামাইকে ঢেকে নাও।

মেঘলার উপর রাগের বোঝা ফেলে হন হন করে চলে গেলো তনু। মেঘলা সোফায় গিয়ে বসে তনুর দিকে তাকিয়ে থেকে দুবার চোখের পলক ফেলে ফিক করে হেসে দিলো।

তখনই হই চই করে একদল মানুষ দরজা দিয়ে ঢুকলো। যেনো ডাকাত পড়েছে। মেঘলা হকচকিয়ে ওঠে দরজার দিয়ে পলকহীনভাবে তাকিয়ে আছে কি হলো বোঝার চেষ্টায়। কিন্তু বোঝার আগেই সবাই ওকে ঘিরে চিল্লিয়ে বলছে ‘ হলুদের সময় হয়ে গেছে ‘।

কোনো মানে হয়? হলুদের সময় হয়েছে সেইটা এইভাবে বলার কোনো দরকার ছিলো? বর আসলেও তো মনে হয় না এইভাবে চিল্লায়। হৃদরোগী থাকলে নিশ্চিত তার প্রাণসংশয় হতো। মেঘলা বোকার মতো মুখ করে সবার দিকে তাকিয়ে অবশেষে একটা হাফ ছেড়ে বেচারি হয়ে বসে রইলো।

পায়ে আলতা, হাতে ভরা মেহেদি বেলিফুল ও ডালিয়া ফুলের গহনা ও গায়ে জড়ানো কাঁচা হলুদ রংয়ের জামদানী। বেলি মোড়ানো বেনিটা ঘাড়ের একপাশ হয়ে সামনে কোমর ছুঁই ছুঁই। গায়ে বিয়ের হলুদ লাগার সাথে সাথেই মেয়েদের রূপ বৃদ্ধি পায় এইটা মেঘলাকে দেখে আবারো প্রমাণিত হয়ে গেলো। দুই গালে হলুদের উপস্থিতিতে রূপ রং চোখে লাগছে।

মেঘলার পাশেই বসে আছে তনু। গোলাপি ও হলুদ রংয়ের মিশ্রণে শাড়ি পড়ে। চুলগুলো খোলা। একদমই সাদাশিদে। তবুও বেশ মিষ্টি মিষ্টি একটা ভাব আসছে। দুজনে কিছু একটা নিয়ে গল্প করছে ঠিক তখনই চোখে আলো পড়তেই সামনে তাকিয়ে রৌশানকে চোখে পড়লো। গলায় ক্যামেরার ফিতা ও হাতে ক্যমেরা। ক্যমেরাটা ওদের দিকে তাক করে রাখা। মেঘলা ও তনু তাকানোর সাথে সাথে এক গাল হেসে দিয়ে বলে,

– বাহ্ বাহ্! কি ছবি? শ্রেষ্ট একটা ছবি ভাবি। ফ্রেমে দুই শ্রেষ্ট রমনী। কিন্তু আফসোস! কেহই আমার না। বড্ড দেরি করে ফললাম গো।

রৌশানের কথা শুনে মেঘলা আর তনু দুজনেই আবারো হেসে ওঠলো। রৌশান মেঘলার কাছে এসে হলুদ ছুঁয়ে দিতে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,

– বিনোদিনী রাইয়ের অপেক্ষায় বংশীধারি কানাই একলা বাঁশি বাজায়। বলতো কোথায়?

মেঘলাও সাথে সাথে প্রশ্ন করে,

– কোথায়?

– তোমার গৃহবাসে।

মেঘলা ভাবলেশভাবে তাকিয়ে রইলো রৌশনের দিকে। রৌশান ইাশারা দিয় মেঘলার ঘর দেখানোর সাথে সাথে মেঘলার চোখ ছানাবড়া হয় যায়। রৌশন হাসতে হাসতে ওখান থেকে চলে যেতেই মেঘলা চোখ বন্ধ করে এক দীর্ঘ শ্বাস ফেলে চোখ খুললো। আশেপাশের পরিবেশ বেশ ভালো মতো লক্ষ করছে মেঘলা। সুযোগ বুঝেই ধীর পায়ে ওপরে চলে আশে। নিজের ঘরের দরজা খুলতেই ঘর ফাঁকা আবিষ্কার করলো। চোখ ঘুরিয়ে আশেপাশে কাউকে না দেখে ঘরের ভেতরে ঢুকতেই দরজার আড়াল থেকে ঝড়ের গতেতে কেউ এসে মেঘলার হাত টান দিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। একমুহূর্তের জন্য যেনো মেঘলা নিঃশ্বাস নিতেই ভুলে গেছে। আয়না ভেদ করে কাব্যর দিকে তাকিয়ে আছে চোখ বড় বড় করে। কি অপূর্ব সে পুরুষ! কাচা হলুদ পাঞ্জাবির উপরে সোনালী রঙের কোর্ট ও পাজামা। চুলগুলো সামনের থেকে পেছনে নেওয়া। সামনের বরাবরের অবাধ্য সিল্কি কয়েকটা চুল এলোমেলো হয়ে কপালে পড়ে আছে। এতোটুকুতেই এতো আর্কষণীয়! এতো সৌন্দর্য নেওয়া যায় না। বুকের ভেতর মোচর দিয়ে উঠছে মেঘলার। ইস্! এই মানুষটা তার নিজের মানুষ। একান্ত নিজের। ভাবতেই মেঘলার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুঁটে ওঠে। আয়না ভেদ করে কাব্যর দিকে তাকিয়ে মৃদু কন্ঠে বলে,

– এভাবে যে এলেন কেউ দেখে ফেললে কি ভাববে মানুষ?

– যা খুশি ভাবুক। আমার কি? আমি আমার বউয়ের কাছে এসেছি। এতে কেউ কিছু কেনো বলবে? আর বললেই আমি শুনবো কেনো?

মেঘলা মুচকি হেসে নিচের দিকে চোখ নামিয়ে ফেললো। কাব্য এক হাত দিয়ে পকেট থেকে মোবাইল বের করে দুজনের একটা ছবি তুলে মোবাইলটা বিছানায় ধীরে ছুড়ে দিলো। মেঘলা মাথাটা উচু করে কাব্যর দিকে প্রশ্নসূচক তাকাতেই কাব্য নাকে নাক ঘসে চোখের পলকেই কোলে তুলে গোসলে ঢুকে দরজা আটকে দিলো। মেঘলা অবাক হয়ে কাব্যর দিকে তাকিয়ে জোড়ে কিছু বলার আগেই কাব্য মুখ আটকিয়ে ওপড়ের ঝর্ণা ছেড়ে দিলো। ঝরঝর করে পানি দুজনের গা ভিজিয়ে দিলো। ঠান্ডা পানির পরশ পেতেই মেঘলা কাব্যর পাঞ্জাবির হাতা খামছে ধরে। কাব্য মেঘলার কোমড় আরো নিজের কাছে টেনে নিয়ে কপালে কপাল ঠেকিয়ে দেয়। মেঘলার নাক ও ঠোঁট বেয়ে পানি গলিয়ে পড়ছে। শাড়িটাও ভিজে শরীরের সাথে লেগে গিয়েছে। কাব্যর চুল থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। কাব্যর ভেজা ঠান্ডা হাত মেঘলার পেটে স্পর্শ পেতেই মেঘলা দুই হাত দিয়ে মেঘলার বুকের কাছের কোর্টের কাপড় আকড়ে ধরে। দুজনের নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে একসাথে। নিস্তব্দ পরিবেশ। কেউ কোনো কথা বলছে না। শুধু পানি পড়ার টুপটাপ শব্দ।

বেশ কিছুক্ষণ থাকার পর মেঘলার হাত কাঁপছে শীতে। হাত কাব্যর বুকের কাছে থাকায় সাথে সাথে বুজতে পেরে চোখ মেলে তাকায়। ঠান্ডায় মেঘলার ঠোঁট লাল হয়ে গেছে। দ্রুত পানি বন্ধ করে মেঘলাকে দাঁড় করিয়ে দরজা খুলে তাওয়াল এনে মেঘলার গায়ে জড়িয়ে দিয়ে বললো,

– তাড়াতাড়ি চেঞ্জ করে নাও। ঠান্ডা লেগে যাবে। আমি আসছি।

কাব্য চলে যাচ্ছে তখনই মেঘলা হুড়মুড়িয়ে বের হয়ে বলে,

– যাচ্ছি মানে? এই ভেজা কাপড়ে কোথায় যাবেন? বাড়ি যেতেে যেতে শরীরেই ভেজা কাপড় শুকিয়ে গেলে আমার না বরং আপনারই ঠান্ডা লাগবে। দাঁড়ান একটু।

মেঘলা ভেজা পায়েই বের হয়ে যায়। আলতা পড়া ভেজা পায়ে মেঝেতে পায়ের ছাপ বসে যায়। সেদিক লক্ষ করে কাব্য মেঘলার পায়ের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। হালকা হালকা লাল ভাব পায়ে। তার ওপর ভেজা পা। কাব্য ত্কিয়ে থাকতে থাকতেই মেঘলা একটা লাকেজ থেকে সাদা পাজামা ও নীল পাঞ্জাবি বের করে সামনে ধরে বললো,

– নিন এইটা পড়ে নিন। তারপর বের হন তাড়াতাড়ি।

কাব্য পাঞ্জাবির দিকে তাকিয়ে এক ভ্রূ উঁচু করে মেঘলার দিকে তাকিয়ে বলে,

– কার পাঞ্জাবি আমাকে দিচ্ছেন আপনি?

– কারো না। এইটা আপনার জন্যই কেনা হয়েছিলো। আপনাকে আজকে রাতে দেবো ভেবেছিলাম কিন্তু এখনই কাজে লেগে গেলো। এখন কথা না বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি চেঞ্জ করে নিন।

– তুমি যাও চেঞ্জ করে নাও। আমি ছেলে মানুষ। এখানে করলেও সমস্যা হবে না। আমি চেঞ্জ করে চলে যাবো তোমার বের হতে হতে। দ্রুত যাও।

– পাক্কা?

– হুম।

সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা। পুরো বাড়িতে ফুল ও আলোর খেলা। চারিদিকে ছোট ছোট বাচ্চাদের চিৎকার। সবার হইহই চইচই। বড়রা একবার এদিকে আরেকবার ওদিকে দিশেহারা হয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে। এরইমাঝে হুজুর ঢাক পাঠালেন কনেকে। তাড়া পড়ে গেলো মেঘলাকে আনার। কাব্য খয়েরি ও কালো রঙ্গের মিশ্রনে অসাধারণ একটা শেরওয়ানি পড়ে বসে আছে। সামনে লাল রঙের একটা পাতলা ওড়না। সেইটা ভেদ করে আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে মেঘলাকে সিঁড়ি থেকে নামানো হচ্ছে। লাল খয়েরি রঙের বেনারসি। বাঙালিভাবে পড়ানো। গায়ে লেপ্টে আছে ভারি গহনা। হাত ভর্তি চুড়ি। লাল ওড়না দিয়ে মুখটার অর্ধেক আবৃত করা। খোপায় লাল টুকটুকে গোলাপ গুচ্ছ। কাব্য পলকহীনভাবে তাকিয়ে আছে। ধৈর্যও যেনো বাঁধ মানছে না। সামান্য একটা ওড়না শুধু বাঁধা। ধীরে ধীরে মেঘলার আবছা কায়া একদম নিকটে এসে সম্মুখে বসে পড়লো। হুজুর বিয়ে পড়ানো শুরু করলেন। একে একে তিনবার কবুল পড়ানোর পর্বও শেষ হলো। বিদায়ের সময় ঘনিয়ে এলো। মেঘলার বুকের ভেতর বার বার মোচর দিয়ে ওঠছে। তীব্র যন্ত্রণা। এক স্থান ফাঁকা করে অন্য স্থান পূর্ণ করতে যাচ্ছে। পর হয়ে যাচ্ছে নিজের বাড়ি। এখনো কি নিজের বাড়ি আছে? নিজের বাড়ি তো এখন সেইটা যেইটায় সে যাচ্ছে। তবে কি সত্যিই এইটা ছোট থেকে বেড়ে ওঠার বাড়িট্ আর তার নয়? আর কি পারবে অবাধে ছুটতে এখানে? আর কি বাপার কোলে বসে সকালের খাবার খাওয়া হবে? আর কি রান্নাঘরে মায়ের আঁচল ধরে দাঁড়িয়ে চুলায় উঁকি মারা হবে? আর কি রাতে ভয়ে পেলে মা বাবার মাঝখানে আশ্রয় হবে? চোখ বেয়ে অবাধে পানি ঝরছে। থামছেই না কোনো মতে। উল্টো আরো গতি বেয়ে যাচ্ছে। গাড়িতে ওঠে আর নিজেকে সামলে রাখতে না পেরে কাব্যকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লো। কাব্য বাঁধা দিলো না তাকে। কান্না করুক। মাঝে মাঝে কান্না করলে বাঁধা দিতে নেই। কাব্য মেঘলাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখে মাথায় হাত বুলাতেই ঘুমিয়ে পড়লো মেঘলা।

বাড়ির সামনে এসে মেঘলাকে আলতো করে ঢেকে তুলে। মেঘলা পৌছানোর কথা শুনে হুড়োহুড়িয়ে ওঠে পড়ে। কাব্য মেঘলার চোখের নিচটা মুছে দিয়ে কপালে এাটা চুমু খেয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেলো। এরপর মেঘলাকে নামিয়ে বাড়ির সামনে যেতেই সবাই এসে উপস্থিত বরণের জন্য। আস্তে আস্তে বরণের পর্ব সহ আরো বিভিন্ন রেওয়াজ শেষ করে অবশেষে দুজনকে পাঠানো হলো বাসর ঘরে। পুরোটা বেলফুল ও গোলাপ দিয় সাজানো। ঘরে ঢুকতেই মেঘলার মন ভালো হয়ে যায়। কি সে সুবাস! এরমধ্যেই হালকা ভেসে আসে বকুলের ঘ্রাণ। মেঘলা একটু এগিয়ে গিয়ে দেখলো একটা টেবিলে পুরোটা বকুল দিয়ে সাজানো আর মাঝখানে মোমবাতি। কি যে অপরূপ দৃশ্য! মেঘলা বকুলগুলো মুঠোয় নিয়ে পেছন ঘুরতেই কাব্য উধাও। আশেপাশে তাকিয়ে ফলাফল শূন্য দেখে মেঘলা ফুলগুলো রেখে দরজার কাছে যেতেই কাব্য দরজা দিয়ে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিলো। মেঘলা কাছে গিয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই কাব্য বলে ওঠলো,

– কিছু বেড়াল তাড়াতে গিয়েছিলাম।

– ওমা! বেড়াল আছে নাকি আপনাদের বাড়িতে? আগে তো দেখেনি।

– আগ্গে এ বেড়াল সে বেড়াল না। মানুষ বেড়াল।

– মানে?

– বাসর রাতে যেসব বেড়াল ওকি দেয় সেসব বেড়াল।

– এএএ! কোথায়? আমি তো দেখলাম না।

– দেখবাও না। কাউকে না দেখে প্রথমেই আমার সন্দেহ হয়। তাই প্রথমেই সর্তক হয়ে এলাম।

– কিভাবে?

– ঘরে ঢুকে ডিস্টার্ব করার মতো এতো চিপ আইডিয়া ওরা ফলো করবে না আমি সিউর। মাথায় নিশ্চিত অন্যকিছু ঘুরছে। তারই প্ল্যাণ করছে এবং সেইটা হলো ভুতের ভয়। দুর্ভাগ্যবশত জেনে গিয়েছি এবং সমাধানও খুঁজে নিয়েছি।

– কি করবেন?

– এই ছোট্ট মাথায় ওসব ঢুকিয়ে জ্যাম বাঁধাতে হবে না। আপাতত তুমি এসব চেঞ্জ করে এসো।

মেঘলা চোখ বড়বড় করে কাব্যর দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,

– মানে?

– মানে এই ভারি গহনা আর লেহেঙ্গা খুলে নাও। ওয়াশরুমে আমি ড্রেস রেখেছি দ্রুত ফ্রেস হয়ে পড়ে বেড়িয়ে এসো। সময় মাত্র দশমিনিট।

– কিন্তু কেনো?

– প্রশ্ন কম। যা বলছি কর দ্রুত। যাও।

মেঘলা কাব্যর দিকে তাকাতে তাকাতে ওয়াশরুমে মুখ গোমড়া করে ঢুকে পড়লো। ঢুকেই পেছন ঘুরতেই থ।

ঠিক দশমিনিট পড় মেঘলা বেড়িয়ে এলো। রুমটা প্রথম থেকেই আলো বিহীন। শুধু মোম জ্বলছে কিছু। ভেজা পায়ে দরজা খুলতেই কাব্য মেঘলার দিকে তাকাতেই হৃদযন্ত্রটা থেমে গেলো। ঘন কালো টিস্যু জামদানী শাড়ি। হাতে স্বর্নের চিকন বালা। আধভেজা চুল। মেকাপের চিহ্ন মাত্র মুখে নেই। শুভ্রতায় ঘেরা এক নারী। কাব্য সোফায় থেকে ওঠে মেঘলার হাত ধরে আয়নার সামনে নিরবে বসিয়ে আস্তে আস্তে বলে,

– কোনো কথা না বলে চুপচাপ বসে থাকবে। নড়াচড়া একদম বন্ধ।

মেঘলা আয়নায় কাব্যকে দেখে বাকহীন। পুরো কালো পাঞ্জাবি আর পায়জামা। হাতে কালো ঘড়ি। শরীর থেকে চিরচেনা সেই ঘ্রাণ। আর কপাল জুড়ে সেই আর্কষিত চুল। মেঘলা বাধ্য মেয়ের মতো চুপচাপ বসে বসে শুধু কাব্যকে দেখে যাচ্ছে।

কিছুক্ষণপর কাব্যর ঢাকে মেঘলা আয়নার দিকে তাকিয়ে বাকরুদ্ধ। কি সুন্দর সাজিয়েছে তাকে। কখন সাজালো? কিভাবে সাজালো? ভেবেই মেঘলা অবাক। চুলগুলো সুন্দর করে পেছনে মেলিয়ে রেখে নিচ দিয়ে বেলি ফুলে মালা বেধে দেওয়া। কানে একজোড়া কালো ছোট্ট দুল, গলায় সাধারণ একটা হার। একহাতে শ্বাশুড়ি সূত্রে পাওয়া বালা আর আরেক হাতে কালো চুড়ি। সাধারণ কতটা সুন্দর, কতটা শুভ্র হতে পারে তা বিশেষ অভিজ্ঞতা ছাড়া বোঝা যায় না। মেঘলা আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজে নিজেই মুচকি হেসে দিলো।

কাব্য মেঘলাকে ওঠিয়ে সামনে দাঁড় করাতেই মেঘলা কাব্যকে ইশারায় অপেক্ষায় করতে বলে কাজল দিয়ে কানের পেছনে চুলের নিচে লাগিয়ে দিয়ে বলে,

– আমারই না নজর লেগে যায়। খোদা রক্ষা করো। থু থু।

এরপর আয়াতুল কুরছি পড়ে সারা শরীরে ফু দিয়ে আবারো বলে,

– যাক! এখন নিশ্চিন্ত। আর কারো বদ নজর, সু নজর কোনো নজরই লাগবে না।

কাব্য হেসে ওঠতেই মেঘলা জড়িয়ে ধরে। কাব্যও মেঘলাকে জড়িয়ে ধরতেই দরজার কাছে কিছু আওয়াজ পেতেই মেঘলাকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে বলে,

– হুস! একটা শব্দও করবে না। যা যা বলবো শুধু করবে। কেমন?

মেঘলা মাথা দিয়ে হ্যা সূচক উত্তর দিতেই কাব্য ড্রয়ার থেকে এক প্যাকেট বাজি বের করে বারান্দায় গিয়ে তাতে আগুন জ্বালিয়ে বাগানে ছুড়ে দিতেই বেশ জোড়ালো শব্দ হতে থাকে। মেঘলা কানে হাত দিয়ে কাব্যর বুকের সাথে মিশে আছে।
কিছুক্ষণপর দরজার কাছে গিয়ে আস্তে করে দরজা খুলতেই কেউ নেই। কাব্য হেসে মেঘলার দিকে ভ্রু নাচাতেই মেঘলাও কাব্যর বাজি ফুটানোর কারণ বুজতে পেরে হাসতে থাকে।
কাব্য দেরি না করে দরজাটা বন্ধ করে মেঘলার হাত ধরে ধীরে ধীরে বের হয়ে এলো। বাড়ির বাহিরে আসতেই রনি, রৌশান, তনু, অনি, রাহুল, তুলিকে বাগানে দেখে আরো সাবধানে বের হয়ে বাহিরে রাখা গাড়িতে করে বেড়িয়ে পড়ে। এদিকে ওরা বাগানে গুটিবাজি করতে থাকে কে ফাটালো এইটা নিয়ে।

মেঘলা গাড়িতে বসে হেসেই খুন। হাসতে হাসতেই মেঘলা প্রশ্ন করলো,

– আচ্ছা! এখন আমরা যাচ্ছি কোথায়?

– শুধু দেখে যাও। প্রশ্ন না একদম। কিন্তু তার আগে এইটা খুলো।

কাব্য ড্রাইভ করা অবস্থায়ই এক হাত দিয়ে পকেট থেকে একটা গিফট বের করে দিলো। মেঘলা আগ্রহের সাথে সেইটা নিয়ে খুলতেই দেখে অসাধারণ একটা কাপড় ওয়াচ। মেঘলা হাসিমুখে ওয়াচগুলো উঠাতেই কাব্য বলে ওঠে,

– পিছনটা দেখো।

কাব্যর কথামতো দুটো ঘড়ির পেছনে তাকিয়ে দেখে খোদাই করে লেখা ” মেঘাব্য”। মেঘলা বেশ অবাক হয়ে কাব্যর দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকাতেই কাব্য সামনের দিকে তাকিয়েই বলে ওঠে,

– আবির পাঠিয়েছে বিয়ের উপহার হিসেবে।

আবিরের কথা শুনতেই মেঘলা খুশি হয়ে জিজ্ঞাসা করে,

– আবির ভাইয়া? সত্যি? কবে? কিভাবে? আর ওনার সাথে আপনার কথা হয়েছে? ওনি যে সেই যে বিদেশ চলে গেলেন তারপর তো আর যোগাযোগই করলেন না। আপনার সাথে কথা হয়? কথা বলেন আপনারা?

– নাহ্! কথা হয় নি। ও আমার সাথে কথা বলতে দ্বিধাবোধ করছে। দুটো চিঠি পাঠিয়েছে একটা তোমার জন্য আরেকটা আমার। ড্রয়ারে রাখা আছে। পরে পড়ে নিও। আর এই বিয়ের উপহার। নামটাও ও দিয়েছে। বেশ সুন্দর হয়েছে তাই না?

– খুবই।

– আচ্ছা নাও ঘড়িটা পড়িয়ে দাও।

মেঘলা হেসে কাব্যকে ঘড়িটা পড়িয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করে,

– কবে ফিরবেন তা কি কিছু বলেছেন?

– হুম! চার মাস পর দেশে ব্যাক করবে।

– সত্যি!

– হুম।

– আসুক। ধরে বিয়ে করিয়ে দেবো তখন আর দেশ ছাড়তে পারবে না।

– আরেকটা মেঘলা পাবে?

কথাটা বলতেই মেঘলা কাব্যর দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকায়। কাব্য সেদিকে খেয়াল না করেই আবার বলে,

– তোমার প্রতি ওর ভালোবাসাটা মিথ্যা ছিলো না মেঘ সেইটা তখনও মেনেছি আর এখনও মানছি আর সে জন্যই তোমাকে হারানোর ভয়টাও পেয়েছি খুব। আমার সাথে সবসময় মেনে নিতে পারবে না বলেই ও দেশ ছেড়েছে। এখন যদি ওকে দেশে আটকে রাখতে চাও তবে আরেকটা মেঘলা লাগবে। কিন্তু আমার মেঘলার মতো মেঘলা যে একটাই। আর এই মেঘলাকে আমি কারো সাথে ভাগ করবো না, আমার ছায়ার সাথেও না।

মেঘলা ছলছল চোখে কাব্যর দিকে তাকিয়ে শুধু কথাগুলো শুনছিলো। হঠাৎ গাড়ি থামায় সামনের দিকে হেলে পড়তেই মেঘলা সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলো অস্পষ্ট চেনা জায়গা। কাব্য এসে দরজা খুলে হাত বাড়িয়ে দিতেই মেঘলা হাসিমুখে হাত বাড়িয়ে নেমে পড়লো। নামতেই চোখে পড়লো সামনে নদী। কাব্য হাতকে ভরষা করে একটা নৌকার কাছে এসে পৌঁছায়। কাব্য প্রথমে ওঠে মেঘলাকে খুব সাবধানে ওঠিয়ে নিলো। অন্ধকার পুরো। মেঘলা ওঠতেই চোখ ধাঁধানো আলো জ্বলে ওঠলো। সোনালী রঙের ছোট ছোট বাতিতে আলোকিত হয়ে ওঠলো নৌকাটা। ভেতরে ছোট্ট একটা কুঠরির মতো। মেঘলা এতোটাই অবাক যে কোনো প্রতিক্রিয়া দিতে পারছে না। শুধু কাব্যর সাথে সাথে হেটে যাচ্ছে। ভেতরে ঢুকেই দেখে চারদিকে ছোট ছোট হারিকেন ঝোলানো। নিচে একটা লেপের উপর সাদা চাদর বিছানো। পাশেই তিনটা মোম নিচে গোলাপরে পাপড়ি। মেঘলা কাব্যর দিকে তাকাতেই কাব্য মেঘলা দুই হাত নিজের দুই হাত দিয়ে ধরে সামনে বসে এক দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে মেঘলার চোখে চোখ রেখে মৃদু গলায় বলে,

– মেঘ! তুমি কি আমার কাব্য হবে? জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে তোমায় পড়তে চাই, তোমাতে নিখোঁজ হতে চাই, পড়ে মগ্ন হতে চাই। হবে কি?

মেঘলার দুই চোখ নিয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় আনন্দ অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। মাথা নাড়িয়ে হ্যা সূচক উত্তর দিতেই কাব্য ওঠে দাঁড়িয়ে মেঘলার দুই গাল আলতো করে ধরে কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়।

সম্পূর্ণ জ্যোৎস্না রাত। চাঁদটার প্রতিচ্ছবি সরাসরি পানিতে এসে পড়েছে। পানির ঠান্ডা বাতাসে কুঠিরের বাহিরে বসে কাব্য নিজের গায়ে চাদর জড়িয়ে তার ভেতরে মেঘলাকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। মেঘলা কাব্যর বুকে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে আছে। কাব্য মেঘলার এক ধরে নরম ভাবে বলে,

– মেঘ!

– হুম!

– ভালোবাসি!

মেঘলা সাথে সাথে চোখটা খুলে কাব্যর দিকে মাথাটা উচু করে তাকিয়ে পরিতৃপ্তির হাসি দিয়ে আবারো বুকের মাথা দিয়ে গভীর এক নিশ্বাস নিয়ে চোখ বন্ধ করে নিয়ে বলে,

– বড্ড বেশি।

সমাপ্ত….. ❤