তুই আমার কাব্য পর্ব-৫২

0
1382

#তুই_আমার_কাব্য 🍂

#Writer: Anha Ahmed
#Part: 52
.
🍁
.

সাজানো গোছানো সুন্দর একটা সংসারের লোভ নেই এমন নারীর সন্ধান পাওয়া সত্যিই বিরল ব্যপার। হাসি-খুশি ও প্রেমময় সংসারের আকাঙ্খায় নারী সর্বদায় মগ্ন। আর খেয়াল ও আগলে রাখে এমন জীবন সঙ্গী তো তারা এসব বোধশক্তি অর্জনের পর থেকেই চেয়ে আসে। আর যদি পেয়েও যায় তাহলে কি ছেড়ে দেওয়া চলে? সাধনা করেও পাওয়া যায় না এমন জীবন সঙ্গী। একটা গানের লাইন মনে পড়ে গেলো এইটা ভাবতে গিয়ে।
” একবার ধরতে পেলে মনের মানুষ ছেড়ে যেতে আর দেবো না,
দেখেছি, দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা। ”

আরো একটা আছে,

” তোমায় হৃদকমলে রাখবো ছেড়ে দেবো না,
ছেড়ে গেলে মনে মানুষ আর তো পাবো না,
না না না যেতে দেবো না..
তোমায় হৃদ মাঝারে রাখবো, ছেড়ে দেবো না। ”

সামাজিক প্রতিবন্ধি অথবা মানসিক বিকারগস্ত, যাকে সরাসরি পাগল বলা হয় তারাও কিন্তু এই ব্যাপারে সহমত হবে। সেখানে তো মেঘলা সুস্থ সবল ভালো মানুষ। সে কিরে এর ব্যতিক্রম হয়?

🍁

বিছানায় পা তুলে বসে মনের খুশিতে বসে কাব্যকে দেখে যাচ্ছে। তাকে মূলত শুয়ে থাকার আদেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সব আদেশ তো মানতে নেই। আদেশ অমান্য করার মাঝে বিষাদীয় এক সুখ আছে। মেঘলার চোখের সামনে কালো টি-শার্ট পরিধানকৃত কপাল জুড়ে পড়ে থাকা অগোছালো এক চমৎকার পুরুষ বসে আছে। তার সম্পূর্ণ মনোযোগ এই মূহুর্তে ল্যপটপে। পরীক্ষার কিছু এসাইনমেন্টের কাজে ব্যস্ত। ভাগ্যিস ব্যস্ত। না হলে মেঘলার পক্ষে এভাবে বসে থাকা সম্ভব হতো না। চোখের তৃষ্ণা মেটানোও হতো না।

বালিসটা সামনে রেখে তাতে ভর করে বসে আছে মেঘলা। কাব্যর কাজ শেষে ল্যাপটপটা বন্ধ করতেই মেঘলা বসে থাকতে দেখে বেশ অবাক হলো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো এগারোটা বেজে পনেরো মিনিট। পরক্ষণেই বিচলিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,

– তাকায়ে আসো কেনো? তোমাকে না ঘুমাতে বললাম? এতক্ষণ এভাবেই বসে ছিলে?

– জ্বি না। শুয়েও ছিলাম।

– ঘুমাও নি কেনো? সেই কখন শুয়ে রেখে আসছি আমি? কথা মানতে এতো কষ্ট হলে আমার বাড়িতে থাকা চলবে না। কালকেই তোমার বাড়িতে রেখে আসবো।

– আশ্চর্য! এমন করেন কেনো? ঘুম না আসলে কি করবো আমি? আর আমি কি করছিলাম? ধর্মীয় শাস্ত্র মতে ও আইন অনুসারে বিয়ে করা একমাত্র স্বামীকে দেখছিলাম। আর আমার বাড়ি আপনার বাড়ি কি? এটা আমারো বাড়ি। আমার আইনত শ্বশুর বাড়ি। এতে আমার পুরো অধিকার আছে। আপনি বললেই হলো নাকি যে দিয়ে আসবো। জানেন না বিয়ের পর মেয়েরা শ্বশুর বাড়ি থাকে। আমি কেনো তার বিপরীতে যাবো ?

– আচ্ছা! তাই তো! তোমার তো শ্বশুর বাড়ি। ভুলেই গিয়েছিলাম। তোমারও পুরো অধিকার আছে বাড়ির উপরে।….. তাহলে এক কাজ করো শ্বশুর মশাইকে গিয়ে বলো তোমার জন্য আলাদা ঘর দিতে। আমার ঘরে থাকতে পারবে না। থাকতে হলে আমার কথা মতো চলতে হবে।

মেঘলা কাঁদো কাঁদো মুখ করে কান্না করার ব্যর্থ চেষ্টা করে বলে,

– এমন কেনো করেন সবসময়? আমি কি অন্য কেউ? আমি তো আপনার একমাত্র বউ। আমি থাকবো না তো কে থাকবে? নাকি অন্য কেউ আছে? আপনি কি আমাকে ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবছেন? আপনি আমাকে আর ভালোবাসেন না।

কাব্য মুচকি হেসে ওঠে দাড়িয়ে টেবিল গুছাতে গুছাতে বলে,

– ভালোবাসি? কাকে? তোমাকে! কবে বললাম তোমাকে ভালোবাসি?

মেঘলা এবার সত্যি সত্যি ঠোট উল্টিয়ে ধরা গলায় বলে,

– ভালোবাসেন না আমাকে? হ্যা! কেনোই বা বাসবেন? কে আমি? আমাকে তো এক্সিডেন্টলি বিয়ে করতে হয়েছে। আমি তো বোঝা আপনার। এর জন্যই আমাকে নিজের রাখতে চান না। বুঝেছি সব। থাকবো না আমি আর। আমি নিজ থেকেই চলে যাবো। জোর করে পাঠাতে হবে না। গেলাম আমি। আপনি থাকেন যাকে নিয়ে থাকার ইচ্ছা হয়।

একরাশ অভিমান নিয়ে বালিশটা ছুড়ে ফেলে বিছানা থেকে ওঠে দরজার কাছে যেতেই লাইট বন্ধ হয়ে গেলো। জানালা দিয়ে বাহিরের আবছা আলোয় ঘরটা হালকা আলোকিত। মেঘলা পেছন ফিরতেই অনুভব করলো তাকে কেউ কোলে নিচ্ছে। হঠাৎ এমন হওয়ায় বেশ অনেকটা অবাক হলো মেঘলা। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবারো গাল ফুলিয়ে কোল থেকে নামতে চাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করতে লাগলো।

কাব্য মেঘলার ছটফটানোকে গুরুত্ব না দিয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে দিয়ে ওপরে চাদর টেনে নিজেও বিছানায় ওঠে গেলো। মেঘলা উঠে বসতে গেলে কাব্য পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ে। কাব্যর কিছু কিছু কাজ একদমই অপ্রত্যাশিত হয়। যার জন্য বার বার অপ্রস্তুত হয়ে কি করবে তা ভুলে যায় মেঘলা। আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে কাব্য। মেঘলা চেয়েও একচুল নড়তে পারছে না। ঘাড়ে কাব্যর নিঃশ্বাসের উপস্থিতিতে সারা শরীরে শীতল রক্ত বয়ে যাচ্ছে। নিজের ঠোঁট দাঁত দিয়ে কামড়ে নিরব থাকার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। একটু করে নড়েচড়ে ওঠতেই কাব্যর বাঁধন আরো শক্ত হয়ে এলো। কাব্য আরেকটু নিজের কাছর টেনে ঘুম ঘুম কন্ঠে বলে,

– মেঘ এতো নড়াচড়া করো না। খুবই ক্লান্ত। খুবই ঘুম আসছে। এভাবে নড়াচড়া করলে কিভাবে ঘুমাবো? ঘুমাতে দাও। না হলে যেভাবে নিয়ে এসেছি ওভাবে গেষ্টরুমে রেখে আসবো।

মেঘলার ঘুম হারাম করে নিজে ঘুমানোর প্ল্যান করছে কি সুন্দর! নিজের যখন যা ইচ্ছে মন চায় তাই করবে? ভেবেই মেঘলা কাব্যর হাত পেটের উপর থেকে সরাতেই কাব্যর মৃদু চিৎকারে চমকিয়ে ওঠে। হুড়মুড়িয়ে ওঠে লাইটটা জ্বালিয়ে কাব্যর কাছে গিয়ে কাব্যর হাতের তালুর কাটা ও ছুলে যাওয়া ক্ষতর চিহ্ন চোখে পরে। ক্ষতগুলোতে এমনিতেই রক্ত জমে আছে। মেঘলার বেপরোয়াভাবে ধরার জন্য হালকা রক্ত ভেসে ওঠে। এতো ক্ষত কাব্যর হাতে আর সেইটা ও কেবল দেখলো? ভেবেই চোখ টলমলিয়ে ওঠলো। চুপ করে বসেই রয়েছে হাতের দিকে তাকিয়েই। কাব্য এক হাত দিয়ে ওই হাত শক্ত করে ধরে আছে। আচমকা এমন হওয়ায় সেও সামলাতে পারে নি। মেঘলা যেনো জানতে না পারে তার জন্যই ব্যন্ডেজ খুলেও রেখেছে। মেঘলার অজান্তে ব্যাথা দেওয়াটা বুঝতে পেরেই কাব্য ছোট্ট একটা শ্বাস নিয়ে মৃদু গলায় বলে,

– তোমায় নড়াচড়া করতে না করেছিলাম। কেনো শুধু শুধু এতো…

এতটুকু বলে মেঘলার দিকে তাকাতেই আর কথা বলতে পারে না। কারণ মেঘলা রীতিমতো কান্না শুরু করে দিয়েছে। নিরবে চোখের পানি পরে যাচ্ছে। মুখমন্ডলে অনুতাপের দৃশ্যও ফুটে ওঠেছে। কাব্য মেঘলাকে দেখে বুঝতে পারছে না কিভাবে সামাল দেবে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে তারপর একটা চমকার হাসি দিয়ে মেঘলার কাছে এগিয়ে গিয়ে দু হাত দিয়ে ধরে নরম ভাবে বলে,

– কি হয়েছে সুইটহার্ট? কাঁদছো কেনো? এই সামান্য ক্ষত দেখে? আরে আমি ব্যাথা পাই নি। এমনি তোমাকে ভয় দেখাতে চিৎকার করেছি। দেখো কোনো ব্যথা নেই।

মেঘলা নাক টেনে রাগ দেখিয়ে হাতদুটো নামিয়ে দিরে সরে গিয়ে দাঁড়ায়। কান্না জড়িত কন্ঠেই হালকা উত্তেজিত হয়ে বলে,

– সরুন। ধরবেন না আমাকে। আপনি সত্যি আমাকে নিজের মনে করেন না। করলে নিজের কষ্ট লুকাতেন না এভাবে। কতটুকু ব্যথা পেয়েছেন। কে জানে কত রক্ত বের হয়েছে। আমাকে জানানোর প্রয়োজনই মনে করলেন না।

কাব্য মুচকি এক হাসি দিয়ে মেঘলাকে টেনে আবার নিজের কাছে বসিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। মেঘলা রাগ দেখিয়ে উঠে যেতে চাইলে কাব্য বলে ওঠে,

– এরকম করলে কিন্তু আবার ব্যথা পাবো।

সাথে সাথে মেঘলা থেমে গেলো। কাব্য আলতো করে কাঁধে থুঁতনি ভর করে রেখে বললো,

– পাগলি! তুমি কান্নাকাটি করবে বলেই বলি নি। কান্নাকাটি করলে তোমার শরীর আরো খারাপ করবে তখন এতো কষ্ট করে তোমাকে সুস্থ করার চেষ্টাটা একদম বৃথা হয়ে যাবে আমার। তুমি কি সেইটা চাও?

মেঘলা নাক টেনে টেনেই বলে,

– আপনি কেনো বললেন না আগে? জানলে কি ব্যথাটা পেতেন শুধু শুধু? ব্যথায় আরো ব্যথা দিয়ে দিলাম। আচ্ছা বসেন চুপচাপ। আমি এক্ষুনি পট্টি করিয়ে দিচ্ছি।

মেঘলা তখনি ওঠে চোখ মুছতে মুছতে বক্সটা এনে কাব্যর হাতে মলম লাগিয়ে পট্টি করিয়ে দিলো।
মেঘলা কাব্যর হাতটা আলতো করে ধরে দেখেই আবারো কান্না করা শুরু করে। কেঁদেই বললো,

– খুব ব্যথা পেয়েছেন তাই না? সরি । আমি না জেনেই ব্যথা দিয়ে ফেলেছি।

কাব্য নিঃশব্দে শুধু মেঘলাকে দেখে যাচ্ছে। বাচ্চাদের মতো কেঁদে চলছে। সদ্য দৌড়ানো শেখা বাচ্চা পড়ে যাওয়ার পর কেঁদে কেঁদে যেমন হিচকি তুলে মেঘলারও তেমন অবস্থা। নাকের মাথাটা এইটুকুতেই লাল হয়ে গিয়েছে। মুচকি মুচকি এক তৃপ্তির হাসির ঝলক ফুটে ওঠছে কাব্যর মুখে। প্রশান্তির হাসি।

চলবে….. ❤