তুমিময় আসক্তি পর্ব-৪৫

0
1155

#তুমিময়_আসক্তি
#কলমে_আলো_ইসলাম

“৪৫”

–” দোলার দৃষ্টি এসে একজনের উপর আটকে যায়। মোহিত চোখে তাকিয়ে থাকে নীল পাঞ্জাবি পরিহিত সুদর্শন পুরুষ’টার দিকে। রুদ্রও থমকে যাওয়া চোখে তাকিয়ে আছে দোলার দিকে। স্টেজে যেনো একটা নীল পরী বসে আছে রুদ্রর কাছে এমনটা মনে হয়। অনেক সুন্দর লাগছে দোলাকে আজ। দোলার সৌন্দর্য প্রকাশ করার মতো ভাষা রুদ্রর কাছে নেই আপাতত। রুদ্রকে দেখে দোলার মুখে আপনাআপনি মৃদু হাসি ফুটে উঠে। আবার পরোক্ষে সে হাসিটা একটুকরো মেঘে পরিণত হয়ে মিলিয়ে যায়৷ চোখ ফিরিয়ে নেয় রুদ্রর দিক থেকে দোলা৷ দোলার কান্ডে রুদ্র মুচকি হেসে এগিয়ে যায় দোলার দিকে। রুদ্র বাইরে গিয়েছিলো একটা কাজের জন্য। তাই এতখন তার দেখা মিলেনি।

–‘ রুদ্র স্টেজে যেতেই তানিয়াও এসে হাজির হয়। তানিয়া ব্ল্যাক কালারের একটা লং গ্রাউন পড়েছে। সাথে ম্যাচিং করা কানের দুল৷ মুখে হাল্কা মেকাপ। চুল গুলো খোলা। ব্ল্যাক ড্রেসে তানিয়াকে অসম্ভব সুন্দর দেখাচ্ছে৷ তানিয়াকে দেখে দোলা অনেক খুশি হয়। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি উদয় নেয় আবার৷ তানিয়া হাসি মুখে দোলার পাশে দাঁড়ায় গিয়ে।
–” ভাইয়া এতখন কোথায় ছিলেন? আপনার বউ তো আপনাকে চোখে হারাচ্ছিলো এতখন। আশার কথায় রুদ্র মুচকি হেসে দোলার দিকে তাকায় আর দোলা রাগী লুকে আশার দিকে তাকিয়ে থাকে। আশা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে অন্য দিকে ঘুরে দাঁড়ায়।

— সত্যি আমায় খুঁজছিলে? দোলার কানের পাশে মুখ নিয়ে বলে রুদ্র৷ রুদ্রর কথায় দোলা চমকে উঠে লজ্জামিশ্রিত চাহনিতে তাকায় রুদ্রর দিকে। রুদ্রর মুখে ঝুলে থাকা পাগল করা হাসি দোলাকে আরও মুগ্ধ করে তোলে। চোখ অন্য দিকে ফিরিয়ে বলে! বয়ে গেছে আমার কাউকে খুঁজতে। কথাটা বলে একটা ভেংচি কাটে দোলা। রুদ্র ফিক করে হেসে উঠে তাতে।

–‘ ব্রো তুমি এতখন কোথায় ছিলে? আজকের দিনে কোথায় তুমি বউমনির পাশে থাকবে সারাক্ষণ তা নয়! পালিয়ে পালিয়ে বেরাচ্ছো৷ গম্ভীর কন্ঠে বলে তানিয়া।
– পালাবো কেনো? অফিসের একটা জরুরি কাজের জন্য আমাকে বাইরে যেতে হয়েছিলো।
– আজকের দিনেও কাজ? দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে তানিয়া। দোলা মুখটা মলিন করে রাখে।

-‘ সরি! এতটা দেরি হয়ে যাবে ভাবিনি। প্লিজ মুখের হাসিটা হারাতে দিও না অন্তত আজকের দিনটায়। তোমার মুখের হাসিটাই আমার বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা, আমার সামনে এগিয়ে যাওয়া উচ্ছ্বাস। রুদ্রর এমন দম বন্ধকর কথায় দোলার যেনো নিশ্বাস আটকে আসে। মুচকি হেসে উঠে সাথ সাথে।

— হৈ-হুল্লোড়, আনন্দের মধ্য দিয়ে শেষ হয় দোলা আর রুদ্রর রিসিপশন পার্টি। রাজ, সজল, তানিয়া, আশা, রোকন, রুদ্র দোলা সবাই বেশ ইঞ্জয় করেছে প্রতিটি মুহূর্ত। সবাই আজ মন থেকে দিনটাকে উপভোগ করেছে।
— দোলাকে রুদ্রর ঘরে নিয়ে গিয়ে বসানো হয়। রুদ্রর ঘরটা সুন্দর করে সাঁজানো হয়েছে৷ বিয়ের সময় তো কোনো কিছুই করা হয়নি রুদ্রর জন্য। তাই রাজ, সজল, তানিয়া প্ল্যান করে তাদের নতুন করে বাসরঘর সাঁজায়। রুদ্র বা দোলা এইসবের কিছুই জানে না। দোলা তাদের ঘরে ঢুকতেই অবাক হয়। অনেক সুন্দর করে সাঁজানো হয়েছে ঘরটা৷ লাল টকটকে গোলাপ সাথে রজনীগন্ধা ফুল। ঘরের মধ্যে আসতেই দোলার মনটা আরো ভালো হয়ে যায়। দোলা ফুল অনেক ভালবাসে৷ ঘরের মধ্যে যদি এমন ফুল দিয়ে সুন্দর করে সাঁজানো গোছানো থাকে তাহলে মনটা ভালো হবে স্বাভাবিক। দোলারও তার ব্যতিক্রম নয়। দোলাকে বসিয়ে দিয়ে তানিয়া আর আশা দরজা নক করে দেয়। উদ্দেশ্য রুদ্রর থেকে টাকা নিয়ে তবে ভেতরে আসতে দেবে৷

— রাত ১টা প্রায়। তানিয়া আর আশা অনেকখন থেকে দাঁড়িয়ে আছে রুমের সামনে। রুদ্রর আসার নাম নেই। আর না রাজ সজলের দেখা আছে। তানিয়া আর আশা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মশার কামড় খাচ্ছে। ভেতরে দোলা একা একা বসে আছে কখন থেকে। সেও বিরক্ত হয়ে উঠেছে। তানিয়াকে বেশ কয়েকবার ডেকেছিলো দোলা৷ কিন্তু তানিয়া চুপ করে বসে থাকতে বলে দোলাকে।

— ধুর এতখন বসে বউমনির সাথে আড্ডা দিলে ভালো হতো। বেচারি রুমের মধ্যে একা একা বসে বোরিং হচ্ছে৷ আর আমরা এইদিকে মশার কামড় খাচ্ছি। আচ্ছা ব্রো আসছে না কেনো? আর রাজ ভাইয়া বা কোথায়? জানো আশা?
– তানিয়ার কথায় আশা ফোস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে আমি কি করে জানবো। আমি তো তোমার সাথেই আছি সব সময়। ভাইয়ার উপর অনেক রাগ হচ্ছে এবার৷ সাথে উনার উপরও (রাজের কথা বলে) বিরক্ত হয়ে বলে আশা৷

— কিছুখন পর রুদ্র রুমের দিকে আসে। সাথে রাজ আর সজলও আছে। ওদের দেখে ক্লান্ত মনে হচ্ছে অনেক।
– রুদ্র ঘরের সামনে আসতেই থমকে দাঁড়ায়। তানিয়াকে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুচকে বলে, তুই এখানে দারোয়ানের মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? রুদ্রর কথায় তানিয়ার রাগটা আরো চারা দিয়ে উঠে। কোমরে হাত রেখে বলে এতখনে তোমার আসার সময় হলো। সে কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি রুমের সামনে। ওইদিকে বউমনি একা একা কি করছে কে জানে ঠোঁট উল্টিয়ে বলে তানিয়া।
– “” তোকে কি কেউ বলেছে আমার ঘরের সামনে দারোয়ান সেঁজে দাঁড়িয়ে থাকতে? যাই হোক ফ্রিতে সার্ভিস দিয়েছিস বেশ ভালো করেছিস। এখন যা এখান থেকে তোর ছুটি। অনেক ক্লান্ত আমি। রুমে গিয়ে ফ্রেস হতে হবে বলে রুদ্র ঘরের মধ্যে যেতে গেলে তানিয়া পথ আঁটকে দাঁড়ায়।

— এত সহজে ঘরে যেতে দেবো ভাবলে কি করে ব্রো। এমনি এমনি তো আর তোমার ঘরের সামনে দারোয়ান সেঁজে দাঁড়ায়নি। টাকা দাও টাকা। তারপর ভেতরে যাও। তানিয়ার কথা যেনো রুদ্র বুঝতে পারে না। তাই কৌতুহল নিয়ে বলে মানে? কিসের টাকা? আমি যাব আমার ঘরের। তার জন্য আবার ‘টাকা দেওয়া লাগবে কেনো?

— হ্যাঁ তোমার ঘরে যাবা তা ঠিক আছে। কিন্তু আজ তোমার ঘরটা শুধু ঘর নেই ব্রো। বাসরঘর হয়ে গেছে। তাই আমাদের ‘টাকা দিয়ে ভেতরে যেতে হবে। তানিয়ার কথায় রুদ্র বড় বড় চোখ বলে কিহ! এরপর রাজের দিকে তাকায় রুদ্র। রাজ মুখে দুষ্টু হাসি ঝুলিয়ে রেখেছে।
– “” দোস্ত বিয়ের এতদিন পরে এসে আবার বাসরঘর। কি কপাল রে তোর। দে দে খুশি হয়ে ওদের টাকাটা দিয়ে দে। কত ভালো কাজ করেছে একটা বল?
– এই থাম তুই। ওদের আমি বলিনি আমার ঘর সাঁজিয়ে বাসরঘর করতে। সাঁজিয়েছিস যখন ওকে আমি খুশি হয়ে ধন্যবাদ দিতে পারি৷ এর বেশি কিছু করতে পারবো না। তুই তো আমার বোন। ভাইয়ের জন্য এইটুকু করবি না তো আর কি করবি? মুচকি হেসে বলে রুদ্র।

— উঁহু! এইসবে কাজ হবে না ব্রো। টাকা ফালাও তবে ঘরে যাও৷ নাহলে এখানেই দাঁড়িয়ে থাকো আজ। বউমনি ঘরে থাক আর তুমি বাইরে৷ আমরা তো অর্ধেক রাত এখানে কাটিয়ে দিলাম। বাকিটাও নাহয় এখানে থাকবো। কি বলো আশা?
– তানিয়ার কথায় আশা মাথা ঝাকিয়ে বলে অবশ্যই? রুদ্র তো পড়েছে মহা ঝামেলায়।
– রুদ্র তুমি তো বাজে ভাবে ফেসে গেছো। তাছাড়া তানিয়া তো তোমারই বোন। ওর থেকে মুক্তি পাওয়া সোজা নয়। তাই যা চাই দিয়ে তাড়াতাড়ি বউয়ের কাছে যাও৷ ওই বেচারি না আবার ঘুমিয়ে যায় তোমার অপেক্ষা করতে করতে। মুখ চেপে হেসে বলে বলে সজল।

— রুদ্র মুখটা মলিন করে বলে,কত দিতে হবে তোদের?
– বেশি না মাত্র এক লক্ষ টাকা। সাবলীল ভাবে বলে তানিয়া৷ রুদ্র ওর কথায় ওহ বলে আবার চিৎকার করে কিহ বলে উঠে। রুদ্রর চিৎকারে সবাই চমকে তাকায় তার দিকে।

–” এই ফাজলামি হচ্ছে আমার সাথে। এক লক্ষ টাকা মানে কি হুম। রাগী কন্ঠে বলে রুদ্র।
– এক লক্ষ টাকা মানে এক লক্ষ টাকা। গা ছাড়া ভাব নিয়ে বলে আশা।
– দেখো আমার কিন্তু ভালো লাগছে না। আমাকে ভেতরে যেতে দাও৷ ফ্রেশ হতে হবে আমাকে। তোমাদের যা দাবি আছে কাল শুনবো। এখন যে যার রুমে যা।
– একদম না। আমরা নগদে বিশ্বাসী ওকে। তাই টাকা না নিয়ে আমি তো একদম নড়ছি না তানিয়া বলে । আমিও না তানিয়ার কথা শেষ হতেই আশা বলে। রুদ্র অসহায় ফেস করে রাজ আর সজলের দিকে তাকায়। ওরা মুচকি মুচকি হাসে শুধু।

–‘ কি রে রুদ্র৷ বোন এক লক্ষ টাকা চেয়েছে তাই দিতে পারছিস না৷ আজ এমন একটা আনন্দের দিনে খুশি হয়ে টাকাটা দিয়ে দিবি তা-না ঝামেলা করছিস৷ আচ্ছা তোর কাছে কি দোলার থেকে টাকা বড় হয়ে গেলো? মেয়েটা একা একা রুমের মধ্যে বসে আছে কখন থেকে। ওর কথাটা একবার ভাব৷ চিন্তিত হওয়ার ভান করে বলে রাজ

– চুপ থাক শা’লা। তুইও আছিস ওদের সাথে এবার আমি বুঝতে পারছি সবটা। এইটা যে একা ওদের প্ল্যান না৷ এটা একদম ক্লিয়ার আমার কাছে৷ তুই আমার বন্ধু হয়ে আমার বিরুদ্ধে এমন ষড়যন্ত্র করতে পারলি?
– হ্যাঁ পারলাম। আজকের দিনে নো ছাড়াছাড়ি। তানিয়া টাকা না নিয়ে একদম ভেতরে যেতে দেবে না রুদকে ৷ আমরা গেলাম। অনেক ঘুম পাচ্ছে বলে রাজ একটা হাই তুলে রুদ্রকে চোখ মেরে চলে যায়। সাথে সজলও চলে যায়। রুদ্র দাঁতে দাঁত চেপে রাজের গুস্টি উদ্ধার করতে থাকে।

–”তানিয়া বোন আমার টাকার পরিমাণটা কমানো যায়না?
– কাতর স্বরে বলে রুদ্র। রুদ্রর কথায় তানিয়ার অনেক হাসি পায়। কিন্তু এই মুহূর্তে হাসলে চলবে না। তাই মুখটা গম্ভীর করে বলে, ছিহ ব্রো৷ তুমি এত বড় বিজনেসম্যান হয়ে সামান্য এক লক্ষ টাকা দিতে পারছো না৷ এত কিপটে তো তুমি ছিলে না।

– শাট আপ। একদম বাজে বকবি না। তোদের এক লক্ষ টাকা চাই তো ওকে। তাই দেবো। রুদ্রর কথায় তানিয়া আর আশা লাফিয়ে উঠে।
– আমাকে ভেতরে যেতে দে। রুদ্রর কথায় তানিয়া কৌতুহল নিয়ে বলে আমাদের টাকা?
– আমি কি এক লক্ষ টাকা সাথে নিয়ে ঘুরছি ইডিয়ট। ভেতরে আছে। রুদ্রর কথায় তানিয়া ভ্রু কুচকে সন্দেহ চোখে তাকিয়ে বলে, সত্যি দেবে তো ভেতরে গিয়ে। ফাকি দিবে না তো?।
— রুদ্র ছোট ছোট চোখ করে তাকিয়ে থাকে তানিয়ার দিকে। তাই দেখে তানিয়া হাসার চেষ্টা করে বলে ওকে ওকে। তুমি ভেতরে গিয়ে ‘টাকা’টা দাও। আমি জানি তুমি কথা দিয়ে কথা রাখো৷ ওইটা এমনি বললাম আমি। এরপর তানিয়া দরজা খুলে দেয়। দরজা খোলার শব্দে দোলা নড়েচড়ে উঠে। এতখন বসে বসে সবটাই শুনছিলো দোলা৷

— রুদ্র ঘরে এসে ড্রয়ার থেকে টাকা বের করে তানিয়ার দিকে ছুড়ে দেয়। তানিয়া টাকা হাতে নিয়ে বিশ্বজয়ের হাসি মুখে ঝুলিয়ে বলে তুমি সত্যি অনেক ভালো ব্রো।
– এবার মানে মানে কেটে পড় যা৷ বের হো তাড়াতাড়ি।
– রুদ্রর কথায় তানিয়া মুখটা ফ্যাকাসে করে বলে, যাচ্ছি যাচ্ছি৷ তোমার ঘরে থাকার ইচ্ছেও নেই আমার । এরপর দোলার দিকের তাকিয়ে মুচকি একটা হাসি দিয়ে অল দ্যা বেস্ট বলে চলে যায় আশা আর তানিয়া৷ ওরা যেতেই রুদ্র দরজাটা বন্ধ করে দেয়।

–‘ ফ্রেস হয়ে আসো যাও। অস্বস্তি নিয়ে বসার থাকার কোনো মানে নেই। থমথমে গলায় বলে রুদ্র দোলাকে উদ্দেশ্য করে। রুদ্রর কথায় দোলা ছোট ছোট চোখে তাকায়৷ আর মনে মনে ভাবতে থাকে তার মনের কথা রুদ্র কি করে জানলো। সত্যি দোলার অনেক অস্বস্তি লাগছিলো এইসবে। ভারী শাড়ি, গহনা, মেকাপ৷ রুদ্রর কথায় দোলা যেনো মুক্তি পায় এইসব থেকে। উঠে ওয়াসরুমে চলে যায় সোজা একটা পাতলা সুতির শাড়ি নিয়ে।

–” দোলা ফ্রেস হয়ে আসলে রুদ্র যায় ওয়াসরুমে । কিছুখন পর রুদ্রও বেরিয়ে আসে ওয়াসরুম থেকে। বের হতেই পুরো রুমটা একবার চোখ বুলিয়ে নেয়৷ দোলা খাটের একপাশে মাথা নিচু করে বসে আছে৷ মনের মধ্যে অজানা ভয় বাসা বেধেছে তার৷ সাথে অনেকটা লজ্জা ঘিরে ধরেছে। দোলার কাছে আজকের দিনটা সেই প্রথম দিনের মতো অনুভূতি লাগছে। মনে হচ্ছে আজ প্রথম রুদ্রর সামনে আসছে সে বিয়ে করে।
— রুদ্রর হাতে থাকা টাওয়ালটা বিসানার উপর রেখে দোলার কাছে এগিয়ে আসে৷ দোলা অনুভব করতে পারছে রুদ্র তার দিকে এগিয়ে আসছে৷ রুদ্র যত এগিয়ে আসছে দোলা তত শক্ত হয়ে বসে বিসানার চাদর শক্ত করে চেপে ধরে।
– রুদ্র খুব কাছাকাছি আসতেই দোলা চোখ বন্ধ করে ফেলে। দম বন্ধ হয়ে আসবে এখনই দোলার এমন ভাব। রুদ্র কিছুখন দোলার মুখের দিকে অপলক ভাবে চেয়ে থাকে। দোলার ছেলেমানুষী দেখে রুদ্র মুচকি হাসে৷ এরপর হুট করে কোলে তুলে নেয় দোলাকে। হঠাৎ কোলে নেওয়ায় দোলা চমকে উঠে রুদ্রর টি-শার্ট খামচে ধরে। খিচে চোখ বন্ধ করে আছে এখনো দোলা। রুদ্র দোলাকে নিয়ে বারান্দার দিকে এগিয়ে যায়।

–‘ আজ আকাশে চাঁদ নেই৷ কুটকুটে অন্ধকার বিরাজমান। মেঘের আড়ালে থাকা চাঁদটাও আজ উঁকি দেয় না। বারান্দায় মোমবাতি জ্বলছে অনেক রকমের। মোমবাতির আলোয় পরিবেশটা আরো মনোমুগ্ধকর করে তুলেছে। বারান্দায় এসে রুদ্র দেখে দোলা এখনো চোখ বন্ধ করে আছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দোলাকে চোখ খুলতে বলে রুদ্র৷ কিন্তু দোলা যেনো চোখ খুলে তাকানোর সাহস পাচ্ছে না৷ ভীষণ লজ্জা লাগছে তার রুদ্রর দিকে তাকাতে। তার চোখে চোখ রাখতে।
– দোলা চোখ খোলো বলছি। রুদ্রর কথায় এবারও রাজি হয়না দোলা। রুদ্র গম্ভীর স্বরে বলে, আমি কিন্তু এবার ফেলে দেবো তোমায় এখান থেকে নিচে। তাড়াতাড়ি চোখ খোলো। রুদ্রর কথায় দোলার চোখ অটোমেটিক খুলে যায়৷ এরপর চারিপাশে তাকিয়ে দেখে তারা বারান্দার একদম কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে৷ দোলা ভয়ে রুদ্রর গলা দুইহাতে শক্ত করে চেপে ধরে। যাতে পড়ে না যায়।
– এখন তাকালে কেনো? রুদ্রর কথায় দোলা করুণ চাহনি নিয়ে তাকায় রুদ্রর দিকে। রুদ্র মুচকি হেসে দোলাকে নামিয়ে দিয়ে! ওইখানে থাকা একটা বেতের চেয়ারে বসে এরপর দোলাকেও বসিয়ে দেয় তার উপর।
– রুদ্র দোলাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে, আমার প্রতি কি একটু বিশ্বাস নেই তোমার? বললাম আর চোখ খুলে ফেললে। কি ভেবেছিলে সত্যি ফেলে দেবো?। রুদ্রর কথার কোনো জবাব দেয়না দোলা।
– কিছুখন নিরব মেরে বসে থাকে দোলা আর রুদ্র। দুজন দুজনের নিশ্বাসের শব্দ ফিল করতে পারছে যেনো। এমন নিরব পরিবেশ।

— জানো দোলা! তোমাকে প্রথম যেদিন দেখি সেদিন অনেক রাগ হয়েছিলো। বাকি সব মেয়েদের মতো তোমাকেও তাদের কাতারেই রেখেছিলাম। ড্যাডি জোর করে বিয়েটা দেওয়ায় অনেক বিরক্তও ছিলাম। ড্যাডের উপর একটু রাগও হয়েছিলো। কিন্তু সেটা বুঝতে দেয়নি কখনো। কারণ আমি ওই মানুষটাকে অনেক ভালবাসি। একমাত্র ওই মানুষটাই আমার ভরসা ছিলো। যখন মা চলে যায় তখন বাবা আমাকে সামলিয়েছে। আমার জন্য নিজের কথা ভাবিনি কখনো ব৷ আমি কষ্ট পাবো বলে আমার সামনে তার দুঃখটাও কখনো প্রকাশ করতে চাইনি। মা যাওয়ার পর মেয়েদের প্রতি একটা ধারণা হয়েছিলো। একটা অভিমান বা ক্ষোভ বলতে পারো। এরপর যখন রোজা এলো আমার জিবনে। আমি সব কিছু আবার নতুন করে দেখতে শুরু করলাম। মেয়েদের সম্পর্কে ধারণাগুলো বদলাতে লাগলাম। রোজা কিন্তু সব সময় আমাকে সাথ দিয়ে গেছে পাশে থেকে৷ এক মুহূর্তের জন্যও আমার মনে হয়নি ও আমাকে ভালোবাসে না। ওর চলাফেরা, আমার সাথে কাটানো মুহূর্ত সব কিছু বলে দিত রোজাও আমাকে ভালবাসে৷ তাই আমি নিজের মনের কথার উপর ডিপেন্ড করে। নিজের অনুভূতিগুলো তার সামনে তুলে ধরেছিলাম। কিন্তু ও আমার অনুভূতির মূল্য দেয় না। উল্টো আমাকে অপমান করে । কথাটা বলতে রুদ্রর চোখ দিয়ে একফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে। দোলা চুপটি মেরে শুনছে রুদ্রর কথা। তার চোখেও পানি।

–‘ আমি না! রোজাকে সত্যি অনেক ভালবেসেছিলাম। আমার পাশে চাইতাম ওকে৷ আমার মনে হতো রোজা যদি আমার সাথে থাকে তাহলে আমার আর কিছু লাগবে না৷ আমার কোনো শূন্যতা থাকবে না। কিন্তু রোজাও আমাকে ছেড়ে চলে গেলো। আমাকে অপমান করে, আমার ভালবাসাকে উপেক্ষা করে চলে গেলো। সেদিন না অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম। অনেক ভেঙেও পড়েছিলাম৷ তার সাথে মেয়েদের প্রতি রাগ,ক্ষোভ ঘৃণাটাও বেড়ে যায় আমার। একদম সহ্য করতে পারিনা মেয়েদের। জীবনে যে মানুষ গুলোকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাইলাম তারাই ফাকি দিয়ে চলে গেলো। এরপর তুমি আসলে আমার জিবনে। আমার সব কিছু আবার বদলাতে শুরু করলো। নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম। ভালবাসতে শিখলাম। জীবনের নতুন মানে খুঁজে পেলাম। চাইছিলাম আবার প্রথম থেকে সব শুরু করতে। তাই মনে মনে ঠিক করেছিলাম তোমাকে আমার মনের কথা গুলো বলব। এর জন্য আমি সব এরেঞ্জও করি৷ তোমার মনে আছে দোলা আমি তোমাকে সেদিন রেডি হতে বলেছিলাম বাইরে যাব বলে। সেদিন আমি অনেক প্ল্যান করেছিলাম তোমাকে নিয়ে। কিন্তু তোমার সাথে সজলের ছবি গুলো সব এলোমেলো করে দিলো। ওই ছবিগুলো দেখার পর নিজেকে সামলাতে পারিনি আমি৷ আমার মনে হয়েছিলো সবার মতো তুমিও আমাকে ফাঁকি দিয়েছো। আমাকে ঠকিয়েছো। তাই সেদিন তোমার সাথে বাজে বিহেভ করে ফেলি। এর জন্য আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখীত দোলা৷ জানি অনেক কষ্ট দিয়েছি তোমাকে কিন্তু বিশ্বাস করো সেদিন যা কিছু করেছি তোমাকে হারানোর ভয়ে করেছি। তোমাকে হারাতে হবে ভাবতেই আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিলো। মানতে পারছিলাম আমি। দোলা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে ঘুরে রুদ্রকে জড়িয়ে ধরে বাহুডোরে।

*- আর কোনো কথা নয় ছোট সাহেব। আমার কোনো অভিযোগ নেই আপনার প্রতি আর না আছে কোনো রাগ, অভিমান। সব কিছু ঠিক আছে আর থাকবে। কান্নারত কন্ঠে বলে দোলা।
-আমার কথা এখনো শেষ হয়নি দোলা। বিমুঢ় কন্ঠে বলে রুদ্র।
-” আর কোনো কথা নয় বললাম তো। যা কিছু হয়েছে সবটা ভুলে যান। আমি আছি আপনার সাথে আর থাকবো৷ একমাত্র মৃত্যু ছাড়া আমাদের আলাদা করতে পারবে না কেউ।

-‘ দোলার কথায় রুদ্র দোলার দুটি হাত শক্ত করে ধরে বলে কথা দাও আমাকে ছেড়ে যাবে না কখনো ? আমার থেকে দূরে যাওয়ার চিন্তা করবে না কখনো। যদি কখনো কোনো কারণে রেগে গিয়ে তোমার সাথে বাজে বিহেভ করি তখন তুমি আমাকে সামলাবে৷ অভিমান করে দূরে চলে যাবে না৷ আমি অনেক চেষ্টা করি কিন্তু আমার রাগটা একদম কন্ট্রোল করতে পারিনা৷ তাই যদি কখনো এমন পরিস্থিতি আসে তখন তুমি আমাকে সামলাবে তো? একা ফেলে চলে যাবে না? বাচ্চাদের মতো আবদার করে বলে রুদ্র৷ রুদ্রর কথায় দোলা মায়াভরা চোখে তাকিয়ে মুচকি হাসে৷ চোখে পানি মুখে হাসি। রুদ্রর অপেক্ষিকৃত চাহনি।

চলবে…