#তুমিময়_অসুখ
#পর্ব-১০
#লেখিকা-ইশরাত জাহান ফারিয়া
২১.
—“এই আপনি এটা কি করলেন? ছিহ! আপনি কি অশ্লীল!”
—“তোর যা ভাবতে ভালো লাগে, তাই ভাবতে পারিস! তোর ভাবনাটাকে তো আমি পাল্টাতে পারবো না।”
আমি ঠোঁট মুছতে মুছতে বললাম, ‘আপনাকে বিরক্ত লাগছে আমার। আপনি আমার রুম থেকে বেরিয়ে যান।’
—“তুই বললেই হলো নাকি?”
আমি কিন্তু সবাইকে সবকিছু বলে দেবো। যে আপনি আমাকে দেখতে পারেন না, আমাকে দিয়ে সারাদিন কাজ করান।
অভ্র ভাইয়া অবাক হওয়ার ভঙ্গি করে বললো, ‘লাইক সিরিয়াসলি? তুই দেখি আমাকে কপি করিস! মিথ্যা বলা শিখে গেছিস দেখছি!’
আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। ওনি আমার বিছানায় গা এলিয়ে শুয়ে পড়লেন। আমাকে অর্ডার করার ভঙ্গিতে বললেন, ‘যা তো! এভাবে তাকিয়ে থাকবি না। নাহলে বাচ্চার মা হওয়ার আগেই ট্যারা হয়ে যাবি।’
আমি অগ্নিদৃষ্টিতে ওনার দিকে তাকালাম। বাচ্চা হওয়ার সাথে ট্যারা হওয়ার কি সম্পর্ক আমি বুঝলাম না। হাতের বালিশটা ওনার ওপর মুখের উপর ছুঁড়ে মেরে কটমট করে বসে রইলাম।
সকালে ব্রেকফাস্ট করার সময় টেবিলের নিচ দিয়ে ইলহাম আমাকে পা দিয়ে খোঁচা মারার চেষ্টা করছে বারবার। আমি বিরক্ত হয়ে ওর পায়ে লাত্থি দিতে গিয়ে দিলাম অভ্র ভাইয়ার পায়ে। অভ্র ভাইয়া রেগে আমার দিকে তাকিয়ে ইশারায় বুঝিয়ে দিলেন এর পানিশমেন্ট আমাকে পেতেই হবে। আর ওনার পানিশমেন্ট মানেই আমার গলায় ফাঁস, সেটা আমার থেকে আর কে ভালো জানে? খাওয়া শেষে ওনি রুমে চলে গেলেন আর আমি বসে বসে অভুক্তের মতো খাচ্ছি!
২২.
ব্রেকফাস্ট শেষে আমিও রুমে চলে গেলাম। আর রুমে এসে দেখি ওনি কাপড় পড়ছেন। আমি পাত্তা না দিয়ে অন্যদিক ঘুরে বসে রইলাম। বাইরে হিম বাতাসে দুলছে গাছের পাতা, আকাশ কেমন রঙিন হয়ে আছে। সবকিছু সুন্দর। আমার মন ফুরফুরে।
আড়চোখে ওনাকে দেখতে লাগলাম, খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। কাউকে ভালো লাগলে মনে বোধহয় নতুন নতুন প্রশ্ন জাগে। আমার মনেও উল্টোপাল্টা সব প্রশ্ন উদয় হচ্ছে।
ওনি আমাকে এক নজর দেখে আবার মোবাইলটা হাতে নিয়ে ভাইয়ার রুমে চলে গেলো। ইলহাম আর ভাইয়ার সাথেই আড্ডা, আর আমি নিজের বাসায় এতিমের মতো আম্মুর কাছ থেকে একটু পরপর রাম ধমক খাই। ওনার সেবা করাটা আমার কর্তব্য, আম্মু বলেছে। সেজন্য একটু পরপর আম্মু তাঁ্র ভাইপুত্রের জন্য এটা সেটা বানিয়ে আমাকে দিয়ে পাঠাচ্ছেন। কিসব বিদঘুটে খাবার, তেল নেই, মশলা নেই। কিভাবে খায়? খোদা জানে।
বাসায় আসার পর থেকে ভাইয়া আর ইলহামের সাথেই ওনার গলাগলি ভাব। আর আমি যেন কেউ না, খারাপ লোক একটা। আমার সাথে এরকম করছেন কেনো ওনি? ভাব দেখলে গা জ্বলে যায়। যাইহোক, ওনি যেমনি হোক না কেনো তাতে আমার কি? আমি আমার পড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকি।
এমনি এমনি করে অনেক রাত হয়ে গেলো।আর আমি সারাটা দিন পড়াশোনার পেছনে কাটিয়ে দিলাম? আসলে এতদিনে এতো পড়া জমে গিয়েছে যে কোনটা ছেড়ে কোনটা পড়বো বুঝতেই পারছিলাম । কখন যে বিকেল গড়িয়ে রাত হয়ে গেলো খেয়ালই ছিলো না। যাইহোক, অনেক টায়ার্ড আমি। এখন একটু রিল্যাক্স করা যাক।অবশেষে দরজা খুলে ইলহামের রুমে উঁকি দিয়ে ওকে দেখতে পেলাম না। ভাইয়ার রুমে গিয়ে ওনি আছেন কিনা খোঁজ নিতে গেলাম, কিন্তু দুজনের কেউ-ই নেই। হয়তো ড্রইংরুমে আছে ভেবে গেলাম ওখানে। গিয়ে দেখি ভাইয়া আর ইলহাম বসে টিভি দেখছে। আমার দিকে তাকিয়ে ইলহাম খোটা মেরে বললো, ‘এতক্ষণে আমাদের কথা মনে পরলো বুঝি?’
ভাইয়া জিজ্ঞেস করলো, ‘তুই এতোক্ষণ কি করছিলি বুড়ি?’
আমি ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললাম, ‘তেমন কিছুনা। অনেক পড়া জমেছিলো, পড়া কমপ্লিট করলাম অর্ধেক।’
ভাইয়া বললো, ‘ওহহ আচ্ছা।’
কিন্তু আমার মন পড়ে আছে ওনার দিকে। ওনি কোথায়? এখানে নেই কেন? কতক্ষণ ধরে দেখতে পাচ্ছিনা, ওনার কথা এখন কাকে জিজ্ঞেস করবো? আমার তো কেমন জানি লাগছে জিজ্ঞেস করতে। ভাইয়া আমাকে অস্থির হতে দেখে ধীর গলায় বললো, ‘কি হয়েছে বুড়ি? খাবিনা? আম্মু কখন বলে গিয়েছে!’
আমি বললাম, ‘আমার না খেতে ইচ্ছে করছে না!’
—“কেনো?”
—“ক্ষিধে নেই ভাইয়া!”
—“শরীর খারাপ? নাকি বাইরের কিছু খেতে চাস?”
—“বললাম তো কিছু খাবো না।”
ভাইয়া আমাকে লোভ দেখানোর জন্য বললো, ‘রাতের বেলা ফুচকা খেতে খুব মজা, তুই খাবি?’
—“নাহ!”
—“আরে কিছু তো বল! কি খাবি? তুই না খেয়ে থাকলে আমিও খাবো না!”
আমি ভাইয়াকে বলার আগেই ইলহাম বললো, ‘আরে ভাইয়া তুমি ওকে কি জিজ্ঞেস করছো? আমাকে জিজ্ঞেস করো, যাও ফুচকা নিয়ে আসো। সবাই মিলে যখন খাবো তখন দেখবে ঠিকই বাধ্য মেয়ের মতো খাবারের দিকে চেয়ে থাকবে। তুমি যাও।’
ভাইয়া হাসতে হাসতে বললো, ‘তাই নাকি বুড়ি?’
আমি রেগে ইলহাম আর ভাইয়ার দিকে তাকালাম। দুজনেই হাসছে। আমার গা জ্বলে যাচ্ছে। আমি কি আর সাধে না করছি? আমি তো মনেমনে ওনাকে খুঁজে চলেছি। আর এরা আমাকে নিয়ে মজা করছে।
ভাইয়া ইলহামকে থামিয়ে দিয়ে বললো, ‘ওকে আমি নিয়ে আসছি!’
ভাইয়াটাও না সবসময় সাদাসিধা। দু’বোন তাঁর প্রাণ। আমরা ছোট থেকেই যা চেয়েছি, ভাইয়াও তাই দিয়েছে। আমরা না খেলে ও নিজেই খেতো না। জোর করেও কেউ খাওয়াতে পারতো না। বোন দুটোকে খুব ভালোবাসে তো!
ভাইয়া যাওয়ার পর আমি ইলহামকে বললাম, ‘তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?’
ইলহাম পাত্তা না দেওয়ার ভঙ্গিতে বললো, ‘বলে ফেলো!’
—“ওনি কোথায়?”
ইলহাম ছোট ছোট চোখ করে আমার দিকে তাকালো, যেন কিছু বুঝতে পারছে না। বললো, ‘ওনি? ওনিটা আবার কি?’
আমি থতমত খেয়ে বললাম, ‘আরে ওনি!’
—“আরে ওনিটা কে? তুমি ঠিকঠাক বলো তো।”
—“অভ্র ভাইয়া!”
ইলহাম এক চিৎকার দিয়ে আমার কান ফাটিয়ে ফেললো। মাথা চেপে ধরে আমার দিকে সন্দেহী চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘অভ্র ভাভাইইইয়ায়া?’
—“হুম! অভ্র ভাইয়া।”
—“আপ্পি?”
—“এই! তুই এরকম করছিস কেন?”
—“তুমি এটা কি শুনালে আপ্পি?”
আমার প্রচুর রাগ হলো। রাগী গলায় বললাম, ‘তুই কি আমার হাতে চড় খেতে চাস?’
—“আপ্পি তুমি এখনো ভাইয়াকে ‘ভাইয়া’ বলেই ডাকো?”
আমি গোলগাল চোখ করে বললাম, ‘তাতে কি?’
—“লাইক সিরিয়াসলি? নিজের জামাইকে কেউ ভাই ডাকে?”
—“এই তুই চুপ করে বলবি, ওনি কোথায়?”
—“কেন, মিস করছো?”
আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেলো। চিল্লিয়ে বললাম, ‘তুই তোর ঢং নিয়ে থাক। আমি রুমে যাচ্ছি।’
বলেই ওঠে চলে আসছি এমন সময় ইলহাম বললো, ‘তোমার ভাইটা বাসায় চলে গিয়েছে। আমার মনে হচ্ছে, তোমার ওপর রাগ করে আছে। যাওয়ার সময় চোখমুখ লাল হয়ে ছিলো!”
২৩.
আমি একথা শুনে মন খারাপ করে রুমে চলে এলাম। কেমন মানুষ ওনি? আমাকে একবার বলেও গেলো না। বিয়ের আগে তো আমার জন্য বৈরাগী হয়ে ঘুরঘুর করতো, আর বিয়ের পর আমি ফেলনা হয়ে গেলাম? আমার খুব কান্না পেলো। দরজা লাগিয়ে কাঁদতে লাগলাম।
কিছুক্ষণ পর, ভাইয়া ফুচকা নিয়ে দরজায় অনেকক্ষণ ধাক্কাধাক্কি করলো, আম্মু খাবারের জন্য ডাকলো আমি কারো ডাকেই সাড়া দিলাম না। মরার মতো পড়ে রইলাম। ওনার মুখটাই চোখের সামনে ভাসছে বারবার। এখন বোধহয় আমাকে আর ওনার ভালো লাগে না। লাগবে কিভাবে? আমি নিজে ওনাকে কত কষ্ট দিয়েছি, ওনার অধিকার থেকে বারবার ওনাকে বঞ্চিত করেছি। এমনকি আজ দুপুরে যখন আমি পড়ায় মগ্ন, তখন ওনি আমার রুমের দরজায় অনেক নক করেছিলেন কিন্তু আমি ওনার মুখের ওপর ‘ডিস্টার্ব করবেন না, আমাকে সবসময় বিরক্ত করা আপনার কাজ, হ্যানত্যান বলেছিলাম’ এজন্যই বোধহয় ওনি কষ্ট পেয়ে চলে গিয়েছেন। কিন্তু আমিতো সেসব এমনিই বলেছি, পড়ায় বিজি ছিলাম তাই। এখন নিজের ওপরই রাগ হচ্ছে।
তবে আজ কেন এমন হচ্ছে ওনাকে না দেখে? আমি কি ওনার মতোই তুমিময় অসুখে আক্রান্ত হয়ে পড়েছি? কে জানে? কে দিবে এই প্রশ্নের উত্তর?
কাঁদতে কাঁদতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম বুঝতে পারিনি। মাঝরাতের দিকে মোবাইলের টুংটাং শব্দে ঘুম ছুটে পালালো। ঘুমঘুম চোখে তাকিয়ে দেখি অভ্র ভাইয়ার ম্যাসেজ। ওনি লিখেছেন, ‘ঘুমাচ্ছিস?’
আমি সিন করে ম্যাসেজের দিকে তাকিয়ে রইলাম। রিপ্লাই করলাম না। বেশ খানিকক্ষণ পরে আবারও ম্যাসেজ এলো, ‘তুই খাসনি?’
আমি এবারেও রেসপন্স করলাম না। ওনি আবারও ম্যাসেজ করলেন, ‘আমাকে ছাড়া তোর ঘুম আসছে?’
আমি লিখলাম এবার, ‘হুম!’
ওপাশ থেকে ওনি লিখলেন, ‘মিথ্যা বলছিস কেন? ঘুমালে তুই ম্যাসেজ করতি কিভাবে আমায়? দিনদিন মিথ্যুক হচ্ছিস? থাপড়াইয়া দাঁত ফালাবো মিথ্যে বললে!’
আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। আমার দাঁত থাপড়িয়ে কিভাবে ফেলবে ফোনের ওপার থেকে বুঝলাম না!আমি গম্ভীর হয়ে বসে রইলাম। কিচ্ছু বললাম না। অভ্র ভাইয়া লিখলেন, ‘আমি ফোন দিচ্ছি, ধর!’
আমি আবারও অবাক হলাম। আজ পর্যন্ত ওনার সাথে দু’একবার ম্যাসেজ ছাড়া ফোনে কখনো কথা হয়নি। ওনি ফোন দিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু আমি ধরছি না। এতো রাতে ওনার সাথে ফোনে প্রেমালাপ বা ঝগড়া করার কোনো ইচ্ছা আমার নেই। সবচেয়ে বড় কথা ফোনে কথা বলার সময় আমার নিজের ভয়েস কেমন হয়, সেটা নিয়ে আমার ডাউট আছে। তাই ওনার সাথে কথা বলতে চাচ্ছিনা।
অভ্র ভাইয়া ভয়েস নোট পাঠালেন। গলার স্বর শুনে মনে হচ্ছে ওনি রেগে আছেন। রাগী গলায় বললেন, ‘তুই যদি এক্ষুনি আমার ফোন না ধরিস তাহলে তোর বাসায় এসে তোকে খুন করে যাবো ড্যাম ইট!’
👉”আল্লাহ তা’আলা বলেন”
আমাকে ডাকো, “আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দিবো!”
~ সূরা মুমিন ‘৬০
চলবে….ইনশাআল্লাহ!