তুমিময়_অসুখ পর্ব-১১

0
4557

#তুমিময়_অসুখ
#পর্ব-১১
#লেখিকা-ইশরাত জাহান ফারিয়া

২১.
—“আসসালামু আলাইকুম!”

—“ওয়ালাইকুম সালাম। এভাবে গাধার মতো কাঁপছিস কেন?”

আমি উত্তর না দিয়ে কাঁপাকাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভালো আছেন?’

—“নাহ! খালি বিছানায় থাকলে আমার অসুখ হয়ে যায়, এইতো এখনো আমি সেই ভয়ংকর অসুখ নিয়ে তোর সাথে কথা বলছি।”

আমার কি হলো কে জানে। ওনার এই অসুখের কথা শুনে ঠোঁট উল্টে জোরে কেঁদে দিলাম।

ওপাশ থেকে অভ্র ভাইয়া চুপ করে রইলেন। যেন আমার কান্না শুনছেন ওনি। তারপর প্রশ্ন করলেন, ‘কাঁদছিস কেন?’

আমি যেন মায়ায় জড়িয়ে গেলাম। যেন এই প্রশ্ন এর আগে এতো সুন্দর করে কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করেনি। সম্পর্ক ভেঙ্গে আবার নতুন করে জোড়া লাগলে যে অনুভূতি হয়, আমি ঠিক যেন এই মুহূর্তটা অনুভব কর‍তে পারছি। আমি কাঁদছি। কান্নাভেজা কন্ঠে ওনার ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে বলে বসলাম, ‘আপনি আমাকে না বলে চলে গিয়েছেন কেন?’

ওনি হাসলেন। বললেন, ‘আমি তোকে খুব জ্বালাই তো, তাই আর ডিস্টার্ব করলাম না। তুই তো আমাকে সহ্যই করতে পারিস না।’

আমি কাঁদতে কাঁদতে প্রায় হিঁচকি তুলে ফেললাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কে বলেছে আপনাকে? অলওয়েজ মিথ্যা ধারণা পুষে রাখার মানেটা কি?’

অভ্র ভাইয়া অবাক হয়ে বললেন, ‘তার মানে তুই আমাকে টলারেট করতে পারিস? হাউ দিস পসিবল?’

আমিও বোকার মতো বলে বসলাম, ‘নিজের হাজব্যান্ডকে টলারেট করা প্রতিটি মেয়ের মানবিক দায়িত্ব! তাই আমিও এর ব্যতিক্রম নই।’

কথাটা বলে নিজেই বেকুব বনে গেলাম। হায় হায়, এই লোকটা নিঞ্জা টেকনিক করে আমার মনের কথা জেনে নিলো? এই মুখ আমি কাকে দেখাবো?

অভ্র ভাইয়া হাসতে হাসতে লুটোপুটি খাচ্ছে। আচমকা হাসি থামিয়ে জিজ্ঞেস করে বসলেন, ‘ভালোবাসিস তোর হাজব্যান্ডকে?’

আমি আবারও আবেগে আপ্লুত হয়ে বললাম, ‘হুম!’

—“কতটা ভালোবাসিস?”

—“যতটা ভালোবাসলে আমাকে কোনোদিন ভুলবে না, ততটুকুই।”

—“তাহলে এতদিন বলিসনি কেন?”

–“ভালোবাসা প্রকাশ না করাই আমার কাছে ভালোবাসা। কিছু অনুভূতি, শুধু আমিই অনুভব করবো। কিছু কষ্ট, যা আমিই অনুভব করবো। কিছু ভালোলাগা আর না বলার মাঝেই আমার ভালোবাসা। যে অনুভূতি চোখের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, সেটাই আমার ভালোবাসা!”

—“তুই তো দেখি গভীর জলের মাছ। এই ভালোবাসা নিয়ে ঘুমাস কিভাবে?”

আমার আবেগ কেটে গেলো। এতো ভালো কিছু কথা যখন বলেই ফেললাম, তাহলে লজ্জ্বা পেয়ে আর বসে থাকার কারণই নেই। আমি রেগে বললাম, ‘আপনি আমার সাথে ফাজলামো করছেন?’

ওনি স্মিত হাসি হাসলেন। বললেন, ‘নাহ! কিন্তু তুই যে তোর বরকে এতো ভালোবাসিস, সেটা তো তোর বর জানতো না। তাই হুট করেই তোর বর তোকে একটা সারপ্রাইজ দিতে চাইছে!’

আমি লজ্জ্বায় রাঙা হয়ে বললাম, ‘কি সারপ্রাইজ?’

—“তুই কি সারপ্রাইজ চাস?”

—“আমি বলে দিলে সেটা সারপ্রাইজ হবে কিভাবে?”

—“তাইতো!”

—“হুম।”

—“আচ্ছা, তাহলে তুই আমাকে অন্যকিছু জিজ্ঞেস কর। আমি সেখান থেকে আন্দাজ করে তোর জন্য একটা সারপ্রাইজ রেডি করছি!”

—“এখন? এতো রাতে?”

—“জাস্ট পাঁচ মিনিট!”

আমি ভাবলাম। কি প্রশ্ন করা যেতে পারে ওনাকে? এমন কিছু তো মনে আসছে না। আচ্ছা! ওনি তো এটা বললেন না যে, ওনি আমাকে ভালোবাসেন কি না! তাহলে আমিও এটাই জিজ্ঞেস করি। নিজের প্রতি ওনার অনুভূতি জানার জন্য আমি আকুল হয়ে গেলাম, যদিও ওনি সবসময় আমাকে পেতে চেয়েছেন, কিন্তু আমাকে ভালোবাসে কিনা সেটা কখনো বলেননি। নিজেকে ছ্যাঁছড়া ভাবছি এই মুহূর্তে। তাও কিছুই করার নেই। বললাম, ‘আপনি আপনার বউকে কেমন ভালোবাসেন?’

ওনি কয়েক মুহূর্ত নিরব থেকে অট্টহাসিতে মেতে উঠলেন। আমি রেগে ফোন কেটে দিলাম, লাগবে না আমার প্রশ্নের উত্তর, না লাগবে ওনার মতো নির্দয় মানুষের সারপ্রাইজ!

ওনি আসলেই নির্দয়। ওনার মতো একটা লোক আমার সিরিয়াস কথায় হাসছে? আই কান্ট বিলিভ! ওনি কি বুঝতে পারছে না আমিও তুমিময় অসুখে আক্রান্ত? আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ওনার থেকে দূরে থেকে? আমি খেতে পারছিনা, ঘুমাতে পারছিনা, পড়ায় কন্ট্রিবিউট করতে পারছিনা আর ওনি আমার সঙ্গে রিভেঞ্জ রিভেঞ্জ খেলা খেলছেন!

আমি গাল ফুলিয়ে কাঁদছি। ঘুম চোখে আসবে না আজ রাতে, বুঝতে পারছি। মন খারাপ করে বসে থাকতে হবে সারারাত। কেউ কি পারতো ম্যাজিক করে আমাকে সব ভুলিয়ে দিতে? আমার অসুখটাকে সারিয়ে দিতে? এই ভয়ংকর অসুখ আমাকে দিনদিন গভীর ভালোবাসার জালে আটকে ফেলতে চাইছে, কেউ কি পারতো না এই অন্ধকার রাত্রিতে, আমার অসুস্থ মনটাকে এক নিমিষে সুস্থ করে দিতে?

২২.
অভ্র ভাইয়া আবার ফোন দিলেন। আমি ধরলাম না। বারবার দিচ্ছে, আমি ধরছি না। এরকম করতে করতে ৯ টা কল হলো, কিন্তু আমি ধরলাম না। একটু পর আবার দিলো, এবার না চাইতেও ধরলাম। ওনি ধমকে বলে উঠলো, ‘ফোন না ধরে কি বরের টাকা বাঁচাচ্ছিস ডাফার?’

আমি চুপ।

—“এই তোর কি এই মাঝরাতে আমার সঙ্গে ‘চুপ, চুপ’ খেলা খেলার ইচ্ছে হচ্ছে?”

আমি রেগে শান্ত গলায় বললাম, ‘আমাকে রাগাবেন না বলছি।’

অভ্র ভাইয়া গা জ্বালানো ফিচেল হাসি হাসলেন। আমার এই মুহূর্তে ওনার দাঁত সবক’টা খুলে ফেলতে ইচ্ছা করছে যাতে ভবিষ্যতে চকচকে দাঁত নিয়ে আমার সাথে হাসি-ঠাট্টা করতে না পারে।

ওনি হাসতে হাসতে গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন, ‘আমি না তোকে বাতাসের মতো ভালোবাসি!’

আমি ভালোবাসে তা তো বুঝলাম। কিন্তু ‘বাতাসের’
মতো ভালোবাসে সেটা আবার কি? আমি ভাবনায় মত্ত। ভালোবাসে যে এটাই আমার মনে সুখ সুখ অনুভূতি এনে দিলো।

ওনি আবারও হাসলেন। বললেন, ‘ওগো, বাতাসী বউ! আমার না আব্বা হতে ইচ্ছা করছে গো!’

আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘আপনি এসব কি বলছেন?’

—“বলছি আমি আব্বা হবো! আর তুই আম্মা!”

—“কিসব বলছেন? আপনি কি উল্টোপাল্টা খেয়েছেন আবারও?”

—“উল্টোপাল্টা খাওয়া তো সেদিনই ছেড়ে দিয়েছিলাম, যেদিন তোর সাথে আমার বিয়ে হলো!”

—“আচ্ছা, আপনি এসব আজব আজব কথা বলছেন কেন আজ? আর এতো হাসছেনই বা কেন?”

—“সবসময় এতো প্রশ্ন করলে তোর বর রেগে যায়, তুই জানিস না ইরাম?”

—“হুম জানি!”

—“জানালা খোলা তোর বাতাসী বউ?”

—“এই! আপনি আমাকে এসব নামে ডাকবেন না!”

—“তোর মতো আবালের কথা শুনতে আমি ইচ্ছুক নই! যেটা জিজ্ঞেস করেছি সেটা বল!”

আমি মুখ কালো করে বললাম, ‘হুম খোলা। লাগিয়ে দিচ্ছি!’

—“লাগাবি না!”

—“কেন?”

—“জানালার পাশে আয় বাতাসী বউ!”

আমি বিরক্ত হয়ে জানালার পাশে বসলাম। বাইরে উঁকিঝুঁকি দিতে লাগলাম। ফোনের ওপাশ থেকে অভ্র ভাইয়া কথা বলছেন আর আমি শুনছি। কখনো মুগ্ধ হচ্ছি, কখনো বিরক্ত হচ্ছি, কখনো রাগছি ওনার কথা শুনে। হঠাৎ করে বাইরের আকাশে ঝিলিক মেরে উঠলো কি যেন, আমার চোখ ধাঁধিয়ে গেলো। আগুনের ফুলকি উড়ছে যেন, সাথে শব্দ হচ্ছে। আমি অবাক হয়ে তাকাতেই দেখলাম, আকাশে তারাবাজির মেলা বসেছে। অসংখ্য বাজিতে পুরো আকাশ সোনালি রঙে ছেয়ে গিয়েছে। অনেকগুলো বাজি আকাশে ফেটে গিয়ে ‘আমি তোকে ভালোবাসি’ লিখা! ফোনের ওপাশ থেকে অভ্র ভাইয়া বলছেন, ‘আমার কথা শুনছিস ইরাম?’

—“হুম!”

আমার অস্পষ্ট উওর। অভ্র ভাইয়া বললেন, ‘আমি তোকে ভালোবাসি ইরাম। তুই জানতে চেয়েছিলি না? এটাই তোর জন্য ছোটখাটো সারপ্রাইজ। আর দেখ, তোর ব্যলকনিতে কিছু খাবার রাখা আছে, খেয়ে নিস। নতুন বছরের সাথে সাথে আমার জীবনের অন্যতম একটা অধ্যায় শুরু হলো আজ। তারপর আমাকে রাগানোর জন্য বললেন, ‘তো নতুন বছরে তোর একশো একটা বাচ্চা হোক, দোয়া করি বাতাসী। গুড নাইট। ঘুমিয়ে পড়।

ওনি ঝড়ের মতো কথাগুলো বলে ফোন কেটে দিলেন। ম্যাসেজ করে বললেন, ‘আজ থার্টি ফার্স্ট নাইট ছিলো, তুই দেখি আমার বিরহে এটাও ভুলে গিয়েছিস বাতাসী? নে, জানিয়ে দিলাম। এখন প্যাকেট করে আমার বাচ্চাগুলোকে পাঠিয়ে দিস। ছেলেটার নাম ‘তুতুন’ আর মেয়েটার নাম ‘পুতুন’। বেশি লাগবে না, দুজন হলেই হবে বাতাসী। ঠিক আছে? যাহ! খেয়েদেয়ে চিকন হ, আর ঘুমা।’

ওরে খোদা!!! এটা কি ছিলো? এটা ম্যাসেজে ভালোবাসা জানানো নাকি বাঁশ খাওয়ানো বুঝলাম না। এসব ওনি কি বললেন? ছিহ,, সত্যিই অভদ্র একটা লোক। যাইহোক, ফ্রি’তে কিছু সময় বিনোদন পাওয়া গেলো। বাজিগুলো খুব সুন্দর ছিলো।

এতক্ষণ কেঁদে কেঁদে বিরহ প্রকাশ করছিলাম। এখন খেতে খেতে আনন্দ করবো। ব্যলকুনিতে গিয়ে খাবার নিয়ে আসলাম। কিন্তু কখন আর কিভাবে ব্যলকুনিতে খাবার রেখে গেলেন সেটাই বুঝতে পারছি না। আর এতো ভেবে আমার কাজ নেই। প্যাকেট খুলে বিরিয়ানি দেখতে পাই। গপাগপ করে খেতে লাগলাম। রাত প্রায় তখন সাড়ে তিনটা বাজে।

খাবার খাওয়ার মাঝখানেই ওনার ম্যাসেজ এলো। লিখেছে, ‘জানিস, আমি কাঁদছি? কেন কাঁদছি বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে আমি অনেক বড় একটা চাকরি পেয়েছি, আমার অনেক দায়িত্ব। আমাকে এখন সেই চাকরিটা বাঁচাতে হলে ভালোবাসা প্রয়োজন। আর সেই ভালোবাসাটা হলি তুই। তুই খুব ভালো। অবশেষে তুইও আমার মতো তুমিময় অসুখে আক্রান্ত হয়ে গেলি।’

ওনার ম্যাসেজ পড়তে পড়তে আমার চোখ ভিজে উঠলো। কিন্তু বরাবরের মতো গণ্ডমূর্খ মেয়ের মতো ভাবলাম, ‘ভালোবাসার সাথে চাকরির সম্পর্ক কিভাবে হয় বুঝলাম না। আর এই অদ্ভুত অসুখের অদ্ভুত কোনো ঔষধ নেই কেন? থাকলে সেই ঔষধ খেয়ে তুমিময় অসুখ আক্রান্ত আমি’কে একেবারে সুস্থ করে দিতাম! ভালোবাসার মতো ভয়ংকর অসুখে আক্রান্ত হতাম না। যেখানে প্রতিটা নিঃশ্বাসে মিশে থাকে একজনকে ভালোবাসার মতো কঠিন অনুভূতি!’

‘ আমি তোমার বিরহে রহিবো বিলীন
তোমাতে করিবো বাস,
‘ দীর্ঘ দিবস,দীর্ঘ রজনী,দীর্ঘ বরষও-মাস!’

আমাকে নিরাশ করে দিয়ে আপনারা গঠনমূলক মন্তব্য করেননি এখনো পর্যন্ত। কয়েকজন নিয়মিত মন্তব্য করে, তাঁদের সংখ্যাটা অনেক কম। ভুল ত্রুটি ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ আপনাদের।

👉”আহার কর এবং পান কর- কিন্তু অপচয় করো না! কারণ আল্লাহ্‌ অপচয়কারীকে ভালোবাসেন না”

~ (সূরা আল্‌-আ’রাফ-৩১)

চলবে…ইনশাআল্লাহ!