তেরো ফাল্গুন পর্ব-০১

0
379

#তেরো_ফাল্গুন
#সূচনা_পর্ব
#মেঘা_সুবাশ্রী (লেখিকা)

“তুমি প্রেমিক হিসেবে পরিপূর্ণ হলেও স্বামী হিসেবে ঠিক ততটাই বিকল। তাই আমাদের তিন বছরের সম্পর্কের এখানেই সমাপ্তি টানা উচিৎ ইমরান।”

টেবিলের অপর প্রান্তে বসা ইমরান তড়িৎ বজ্রপাত পড়ার মতই চমকে উঠল। কথাগুলো কেমন যেন অদ্ভুত শোনাল তার কাছে। কানের কাছে ধোঁয়া উঠা উষ্ণ হাওয়ার মতই। তবে নিছক মজা ভেবে দু’ঠোঁট ফাঁক করে হেসে উঠল সে। ভ্রু’দ্বয় কিঞ্চিৎ কুঁচকানো। মুখশ্রী জুড়েও বিস্ময়ের ছাপ। নিজের এক ভ্রু উঁচিয়ে জবাবে বলল,

“মজা করছো, তাই না ফাহিয়া। এমন মজা আমার একদম পছন্দ নয় কিন্তু।”

সামনে বসা রমণীর ভাষার কোনো পরিবর্তন হল না। তার মুখশ্রী আগের মতই কঠিন। গলার স্বরও বেশ তেজী,

“তোমার আমার ব্যবধান দেখছো। তুমি এতিম, বাবা নেই। তোমার মা’ কিসব করে বেড়ায়। বাঁশ, পাটিপাতা, হাঁস মুরগীর ডিম বিক্রি করে সংসার চালায়। তোমাদের নিজেদের কোনো পারিবারিক স্ট্যান্ডার্ড নেই। গ্রামের সবাই তোমার মা’কে ডিমওয়ালি, কামের বেডি, মুরগীওয়ালী ডাকে। আমার পরিবার তোমাদের এমন পরিবারে কখনো বিয়ে দিবে না। আমার ভাইয়া আমাকে মে’রেই দিবে, যদি তোমার কথা বলি। আর বাবা তো জীবনেও মানবে না।”

মুখশ্রী তার মূহুর্তে হতবাক আর বাকরুদ্ধ। অপলক দৃষ্টি জোড়া সামনে বসা রমণীর দিকে। চিবুকে একহাত ঠেকানো। ক্ষানিকটা সময় পেরুতেই ফোৎ করে নিশ্বাস ছাড়ল। নড়েচড়ে বসল আবার। অধরকোণে তাচ্ছিল্যের হাসি ইমরানের। কিন্তু গলার স্বর নরম আর ভীষণ গম্ভীর।

“ছেড়ে যাওয়ার কারণ কি তাহলে আমার মা’ না’কি আমার মায়ের পেশা? কোনটা ফাহিয়া?”

অবরুদ্ধ বসে থাকা ফাহিয়া এবার নড়েচড়ে উঠল। নিজের দৃষ্টি জোড়া আগে থেকে নত রাখা। উত্তর দিতে কিছুটা সময় নিল। নিশব্দে দ্রুতই নিশ্বাস ছাড়ল। গলার স্বর ভীষণ রুক্ষ। জবাবে বলল,

“বাবা-মায়ের অবাধ্য হয়ে তোমাকে বিয়ে করে সংসার করা কখনো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাছাড়া তুমি এখনো বেকার। কবে জব পাবে তার কোনো ঠিক নেই। আমার ভাইয়া আসবে সামনের মাসে। আমার বিয়ের কথা চলছে। তাই তোমাকে আগেই জানিয়ে দিলাম। আমার অপেক্ষা আর করো না। আজ থেকে তোমার আমার সম্পর্কের ইতি এখানেই। আমাকে ভুলে নতুন জীবন শুরু কর। ভালো থেকো, আসছি।”

হাজারও প্রশ্ন মনের মাঝে উঁকি দিল। কিন্তু ইমরান জবাব দেওয়ার মত দ্বিতীয় বাক্যে খুঁজে পেল না। না আটকালো ফাহিয়া’কে। নিষ্পলক ফাহিয়ার যাওয়াই দেখল শুধু। বক্ষস্থল থেকে লম্বা এক দীর্ঘশ্বাস বের হল বরং। ঠোঁটের কোণে শুকনো হাসি।

কথাগুলো ব’লে আর বসল না, উঠে দাঁড়াল ফাহিয়া। পিছন ফিরে তাকানোর প্রয়োজনও মনে করল না। তাকালে হয়ত দেখতে পেত প্রেয়সীর আঘাতে দগ্ধ হওয়া এক ভগ্ন হৃদয়ের নিষ্প্রাণ আঁখি জোড়া। নিজের মতই রিকশা ডেকে নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে যাত্রা করল। আজ থেকে সে মুক্ত। সব সম্পর্কের নাম হয় না। কিছু সম্পর্ক অগোচরেই থাকায় ভালো। প্রেমিক হিসেবে ইমরান আর্দশিক বটে কিন্তু বিয়ে, সংসার একদমই তার সাথে যায় না। যাই হোক এমন ছেলেকে বিয়ে করে তার জীবন বরবাদ করার মানে নেই। যার কোনো ভবিষ্যৎ নেই।

খোলা রেষ্টুরেন্টের এককোণে স্তব্ধ নিথর শরীর নিয়ে বসে আছে ইমরান। আজকের দিনটা তার এভাবে শুরু হবে কস্মিনকালেও ভাবেনি হয়ত। ভারী অদ্ভুত লাগছে তার কাছে! যে তাকে রোজ অনুপ্রাণিত করত। তার মা’কে নিয়ে স্ব গর্বে গুণগান করত। আজ সেই তাকে নিয়ে উপহাস করল। তার দুর্বল জায়গায় গিয়ে আঘা’ত করল। আসলে যতই ভালবাসি ভালবাসি বলে বুলি আওড়াই না কেনো? দিনশেষে একটাই শব্দ কানে ভেসে আসে। টাকা নেই তোমার কিছুই নেই। তুমি অর্থহীন পদার্থ মাত্র এই দুনিয়ার বুকে। নিস্তেজ হওয়া শরীর নিয়ে রেষ্টুরেন্ট থেকে বেরুল। গন্তব্য তার অজানা।

বসন্তকাল চলছে। আজ তেরোই ফাল্গুন। লাল রঙা ফুলে ফুলে চেয়ে আছে পাশের কৃষ্ণচূড়া গাছটি। হরেক রকম পাখির ডাক ভেসে আসছে গাছ-গাছালি থেকে। কিন্তু অদূরে গাছের ডালে আড়ালে থাকা কোকিলের কুহু কুহু মিষ্টি ডাক শোনা যাচ্ছে বেশ। কিছু গাছের পাতা ঝরে পড়ছে। আবার সেই ডালে নতুন মুকুল আর পাতা গজিয়েছে। সময়ের সাথে সাথে তারাও একসময় পুরাতন হবে। ঝড়ে পড়বে মৃত্তিকার উপরে। গাছ-গাছালি ঘেরা সিংহ দীঘি। যেনো এক টুকরো সবুজের বুকে স্বচ্ছ জলরাশির কুন্ডলী।

ইমরান নিজের কষ্ট ভুলতে আনমনে দীঘির লম্বা পাশের সিঁড়িতে বসল। চোখের কোণে জল নেই। কিন্তু কোথাও যেনো দুঃস্বপ্নের ঘোরে আছে। কিছু সময় পেরুলেই হয়ত এই স্বপ্ন ভেঙে যাবে। আবার সবকিছু আগের মত হয়ে যাবে। ফাহিয়া বলবে আমি তোমার সাথে মজা করেছি। শুধু দেখতে চেয়েছি তুমি কেমন রিয়্যাকশন দাও। ভয় পেয়ো না, আমি আছি তো। কোথাও যায়নি। কিন্তু ঘন্টা দুই পেরুলেও কোনো মেসেজ, কল কিছুই আসেনি। সেও নিজ থেকে কল দেয়নি। একবারের জন্য ফেরানোর চেষ্টাও করেনি। শুধু ভাবছে সে ফিরে আসবে হয়ত তার ভালবাসার টানে। এত সহজে তাকে ভুলে যাবে? একদমই নয়।

বসন্তের এই দুপুরেই আচমকাই গগন বক্ষে ঘন আঁধারের মেঘে ঢেকে গেছে। হঠাৎই কোনো রকম পূর্ব সর্তক ছাড়াই ঝুম ঝুমিয়ে বৃষ্টি নামল। দীঘির পাশের মানুষজন ছোটাছুটি করছে। নিরাপদ জায়গায় গিয়ে অনেকেই আশ্রয় নিচ্ছে। এতসবের মাঝে ইমরানের নিজের কোনো হেলদোল নেই। এখনো আগের মতই সিঁড়িতে ঠাঁই বসে আছে। শ্রাবণের অঝোর ধারার মত বসন্তের মাঝে বৃষ্টি হচ্ছে। অদ্ভুত হলেও আজকাল প্রকৃতির রূপ বোঝা বেশ মুশকিল। বৃষ্টির পানিতে ভিজে চুপসে গেছে সে। তবুও নড়ল না। প্রায় দশ মিনিট অঝোর ধারার বৃষ্টি পড়ার পর তার বেগ কমে এল। শুধু গাছের পাতা থেকে টুপটাপ পানির ফোঁটা পড়ার শব্দ কানে ভেসে আসছে।

ভিজে শরীর নিয়ে কত সময় পেরিয়েছে তার জানা নেই। সম্বিৎ ফিরল ফোনকলের কর্কশ ধ্বনিতে। মুঠোফোন কভার মোড়ানো। তবুও একটু আধটু পানি মুঠোফোনে প্রবেশ করেছে। হাতের মাঝে মুঠোফোন ধরতেই স্ক্রিনে স্পষ্ট অক্ষরে জ্বলজ্বল করল মা’ শব্দটি। নিজের ধ্যান থেকে বেরিয়ে মায়ের কল’টা দ্রুতই রিসিভ করল। ওপাশ থেকে সবার আগেই একটাই শব্দই ভেসে এল।

“কই আছো বাপজান? দুপুরের ভাত খাইতে আইলা না ক্যান? খিদা লাগে নাই। দুপুর গড়াইয়া বিকেল হইয়া গেল। এত সময় বাইরে কেউ পইড়া থাকে বাপ? জলদি আহো। মা’ এখনো খাই নাই, তোমার লাইগা বইয়্যা আছি।”

ইমরানের দু’চোখ ছলছল করে উঠল। এত সময়ের চাপিয়ে রাখা কান্নার নোনা জল গড়িয়ে পড়ল তার চিবুক বেয়ে। বক্ষস্থল থেকে একটা করুণ দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। আমার মা’ এখনো খাই নাই। আর আমি এখানে বসে অন্যের জন্য দুঃখ বিলাশ করছি। অথচ যে আমার নয়। কত বোকা আমি! নিজের দুঃখের স্মৃতিকে মাটি চাপা দিয়ে উঠে দাঁড়াল বাড়ির উদ্দেশ্য।
__

সন্ধ্যায় হাড় কাঁপুনি দিয়ে জ্বর উঠল। তীব্র জ্বরের ঘোরে ঠকঠক করে কাঁপছিল ইমরান। অর্ধপুরানো কাঁথায় কোনোভাবে শরীর’টা ঢেকে দিয়েছে নূরবানু। ছেলের কপালে নিজের হাত ঠেকিয়ে বলে উঠল, ‘কি হয়ছে বাপ তোমার? এমন জ্বর কেমনে বাঁধাইলা?”

ইমরানের নির্জীব শরীর আর দু’চোখ মুদিত। মুখ জুড়ে ফুটে উঠছে তার নিরব অসহায়ত্ব। আচমকাই মায়ের দু’হাত আঁকড়ে ধরল। করুণ স্বরের কিঞ্চিৎ গোঙ্গানির শব্দ হল গলায়। ঝরঝর করে দু’চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে বালিশের মাঝে। কান্নামিশ্রিত নরম ভেজা গলার স্বর,

‘মা’ ও ‘মা আমার জন্য জায়নামাজে বেশি করে দোয়া করবা। আমি যেনো একটা ভালো চাকরি পাই। ও ‘মা আল্লাহর কাছে বেশি বেশি করে দোয়া করবা তো আমার জন্য। আল্লাহ যেন তাড়াতাড়ি আমারে ভালো একটা চাকরি দিয়া দেই। বলবা তো মা’।

ছেলের হতাশার কথা শুনে নূরবানুর বুকটা ধ্বক করে উঠল। খিদায় কত কষ্ট করে। ভালো জামা পরতে পারে না। তাও মুখ ফুটে কখনো নিজের কষ্ট জাহির করে নাই। আজ কেনো তার ছেলের এত কষ্ট। কেন এত অসহায়ে কাতর? সে তো আল্লাহকে রোজ বলে তার ছেলের কথা। তারে তুমি দেইখো। সে তোমার আমানত। ভেতর থেকে তীব্র হাহাকারে ফোৎ ফোৎ করে নিশ্বাস ছাড়ল। ছেলের মাথায় আলতো করে হাত বুলালো। নরম সুরে বলল,

‘বাপজান, ধৈর্য্য ধর। দেখবা আল্লাহ তোমার জন্য অনেক বড় নিয়ামত রাখছে। যা, এখনো দেয় নাই। আল্লাহর উপর ভরসা কর বাপ।’

ইমরান নিভৃতে শুনে যাচ্ছে। নিজমনে হাসল নিজের উপর। অল্প বয়সেই তার মা’ বিধবা হয়ে গেল। দু’সন্তান ছেলে-মেয়ে নিয়ে রয়ে গেল জামাইর ভিটের উপর। বাঁশ আর পাটিপাতার তৈরি জিনিস বানিয়ে বাজারে আর মানুষের দ্বারে গিয়ে বিক্রি করে। আবার কখনো হাঁস-মুরগির ডিম বিক্রি করে। কত কষ্টের সংসার তাদের। একখান জমি আছে। সেখানে হেমন্তে ধান করে। অন্তত চুলার হাঁড়িতে ভাতটুকু যেনো ঘরের হয় এই আশায়। আবার কিছু জমি বর্গা নিয়া চাষ করে। কোনোরকম তাদের দিনাতিপাত। তাও মায়ের মুখে কত সুন্দর হাসি। কিন্তু এমন একটা সরল মনের পরিশ্রমী মানুষ’রে নিয়ে কত বাজেভাবে কটুক্তি করে কথা বলে গ্রাম্য পোলাপান। তার মায়ের মজা উড়ায় রাস্তার মানুষও। কেউ বলে ‘ডিমওয়ালীর পোলা’, ‘মোরগওয়ালীর পোলা’। আর কেউ তো আরও অবজ্ঞাস্বরূপ বলে, ‘কামওয়ালীর পোলা’। এতে তার কখনো মন খারাপ হয়নি। নাহ কখনো সে তা মস্তিষ্কে ধারণ করেছে। কিন্তু আজ যখন তার প্রিয় একজন মানুষের মুখ থেকে শুনল, সত্যিই তাজ্জব বনে গিয়েছিল। সেই কথা ভাবতেই আনমনে বক্ষস্থল থেকে ভারী নিশ্বাস উঠানামা করল। এখনো তার দু’চোখ মুদিত। নূরবানু হাত বুলানো থামিয়ে ছেলের মুখের দিকে তাকাল। দু’চোখ সরু করে ব্যগ্রকন্ঠে বলল,

‘ও বাপজান কি হয়েছে তোমার? কোনো সমস্যা হয়ছে কলেজে? না কেউ কিছু বলছে তোমারে।’

অধরকোণে শুকনো হাসি। ইমরান হা’ হয়ে নিশ্বাস ছাড়ল। ধরা গলায় বলল,

‘আমার মাথায় ভালো কইরা হাত বুলাও মা’। আমি ঘুমাতেই চাই। গভীর একখান ঘুম। যাতে ঘুম ভাঙ্গলে মনে অয়, আমি খুব বাজে একখান দুঃস্বপ্ন দেখছিলাম।’

নূরবানু প্রচন্ড হতাশ হল। শৈশবে সে অল্পস্বল্প হলেও পড়ালেখা করছে। পঞ্চম শ্রেণির গন্ডি পেরিয়ে আর পড়া হয়নি তার। তবে কিছুটা হলেও তিনি বোঝেন। ছেলের হেয়ালি পূর্ণ কথায় এবার বেশ বিরক্ত হলেন। রুক্ষভাষী কন্ঠস্বর ভেসে এল তার মুখ থেকে। বেশ বজ্রদৃঢ় কন্ঠে বললেন,

‘সত্য করে কইবা কি হইছে? না আমি কলেজ যামু। তোমার ক্লাসের পোলা ম্যাইয়া গো জিগামু। কিচ্ছু লুকাবা না কিন্তু কইয়্যা দিলাম। খবরদার, আমার অল্পজ্ঞান হইতে পারে তয় বোকা না। মিছা কতা কইবা তো, আমারে আর মা’ ডাকবা না।’

চলবে,,,