তেরো ফাল্গুন পর্ব-০২

0
108

#তেরো_ফাল্গুন ( ২ )
#মেঘা_সুবাশ্রী (লেখিকা)

মায়ের দিকে এক পলক তাকাল ইমরান। মায়ের বিচলিত মুখখানা ফুটে উঠল তার সামনে। মা’ যে তার মতই মর্মদহনে জর্জরিত। গলার স্বর ভীষণ কাঁপছে তার। দু’চোখে আবারও জল জমল। কথাগুলো কেমন দলা পাকিয়ে আছে। কিভাবে বলবে নিজের ব্যর্থ প্রেমের কথা। কিছু সময় চুপ থাকল। বেশ সময় নিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করল। নিশব্দে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভেজানো গলায় বলল,

“মা’ আমি একজন’রে খুব পছন্দ করতাম। সে’ও আমারে করত। প্রায় তিন বছর ধইরা আমাদের চেনা-জানা। কিন্তু হঠাৎ কইরা গত একমাস ধরে সে বদলে গেল। আগের মত কথা বলে না। আমার কল দেখলেও এড়িয়ে যায়। কেমন যেন আমার থেকে পালাই পালাই ভাব। শেষে অধৈর্য্য হয়ে তার বাড়ি গেলাম। সেখানে গিয়ে আমার চোখ খুলে খেল। যা দেখলাম তাতেই আমার আক্কেলগুড়ুম। দু’তলা পাকা দালান ঘর তাদের। দেখেই বুক ধ্বক করে উঠল। ওর অবস্থান আমার চাইতে শতগুণ উপরে। চার ভাই বোনের মধ্যে সে দ্বিতীয়। তার বড় ভাই জাপান থাকে। স্টুডেন্ট ভিসায় পড়াশোনা করতে গেছে প্রায় তিনবছর। এখন সেখানে পড়াশোনার পাশাপাশি জব করে। বাবা কাতার প্রবাসী। অনেক টাকা ইনকাম করেন। মাসে তার আয় প্রায় এক থেকে দেড় লক্ষ টাকা। মেয়ে’টা আমার থেকে তিন ‘বছরের জুনিয়র। এবার দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ে। সামনে এইস.এস.সি দিব। দশম শ্রেণি থেকে তার সাথে আমার পরিচয়। আগে কোনদিন তার বাড়ি যাই নাই। আমার বন্ধুর ভাইয়ের বিয়াতে যাইয়া তার সাথে পরিচয় হয়ছিল। তখন তার সাথে শুধু কথা হইছিল আর কিছু না। কিন্তু তারে আমাদের কলেজে দেইখা প্রথম অবাক হইছিলাম। আমি তখন স্নাতক ১ম বর্ষে। সে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হইছে। সেদিন সে নিজে এসে আমার সাথে কথা বলে। মাঝে মাঝে কোনো সাহায্যে লাগলে জিজ্ঞেস করত। আমিও সাহায্যে করতাম। কিন্তু কথা বলতে বলতে তার প্রতি কখন দুর্বল হয়ে গেছি টেরই পাইনি। দু’জন মেসেজে কথা বলতাম। আমি উত্তর দিতে দেরি হলে সে কেমন অস্থির হয়ে যেত। আবার উত্তর আসতে দেরি হলে আমিও অস্থির হয়ে যেতাম। একসময় দু’জন দু’জনের প্রতি ভীষণ আসক্ত হয়ে পড়লাম। আমি কিন্তু কখনও তার সাথে মিথ্যে বলি নাই। সব সত্যি কথা বলছি। আমার বাবা নাই। কিন্তু আমার মা’ সব একা হাতে সামলাই। জানো মা’ সেদিন সে তোমার বেশ প্রশংসা করছিল। খুব গর্ব করে বলছিল তোমার মা’ সত্যিকারের একজন যোদ্ধা। রিয়েল হিরো বলে আখ্যায়িত করছিল। কিন্তু আজ,,

এইটুকু বলে সে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। বাচ্চাদের মত দু’ঠোঁট উল্টালো। মায়ের কোলে আঁচলের মাঝে নিজের মুখ ডেকে রাখল। দু’চোখের জল গড়িয়ে পড়ল তার মায়ের শাড়ির আঁচলে।

নূরবানু ছেলের মাথায় হাত বুলালো। চাপা এক কষ্ট অনুভব করলেন। তবুও সান্ত্বনা স্বরূপ বলল,

‘তুমি জানো বাপ, আকাশে মেঘ কালা হয় ক্যান? কালা মেঘ দেখলে কিন্তু মানুষ ভয় পায়, কাঁইপা উঠে। অথচ ঐ কালো মেঘ থেইক্যাই কিন্তু ঝুমঝুমিয়ে বৃষ্টি নামে। আমাদের জন্য রহমতের বর্ষণ নিয়া আসে। ছোটবেলায় একটা ছড়া পড়ছিলাম, এখনো একটু আধটু মনে আছে।

“মেঘ দেখে কেউ করিস নে ভয়,
আড়ালে তার সূর্য হাসে,
হারা শশীর হারা হাসি
অন্ধকারেই ফিরে আসে।”

বাপজান আজ তোমার কষ্ট হইতাছে। কিন্তু আজ থেকে পাঁচবছর পর তোমার কষ্ট হবে না। বরং সেদিন তুমি নিজেই এই দিনের জন্য নিজেরে ধিক্কার দিবা। নিজেরে নিজেই বল’বা, আমি কত বোকা আছিলাম! যে ছাইড়া যাই সে কখনো তোমার ছিল না। যে জিনিস তোমার না তার জন্য তুমি ক্যান কানবা। শুধু শুধু নিজের চোখের জল অন্যের জন্য কেন খরচ করবা। চোখের জল মুছো। শক্ত হইয়া বস। আমি তোমার জন্য গরম গরম ভাত নিয়া আসতেছি। তারপর ওষুধ খাইয়া একটা ঘুম দাও। সকালে দেখবা তোমার আরাম লাগব।’

ইমরানের কান্নার বেগ কমে এসেছে। নিজেকে স্থির রাখার প্রতিজ্ঞা করছে। তবু অসহায় মন তার কথাই ভাবছে। বক্ষস্থলে তীব্র দহনে দগ্ধ হচ্ছে বার বার। মায়ের কোল থেকে একপাশে গিয়ে বসল। নূরবানু উঠে গেল খাবার আনতে।
_

সময়ের পালাবদলে সেদিনের পর পেরিয়েছে মাস’দুয়েক। ইমরান আগে থেকে নিজেকে অনেক’টাই সংযত করেছে। আগের মত মর্মদহনে ব্যথিত না হলেও রাত নামলেই দু’চোখের ঘুম উধাও হয়েছে তার। দু’চোখে জল না জমলেও চোখের নিচে ঠিকই কালসিটে দাগ পড়েছে। খাবারে অরুচি এসেছে আগের থেকে। তবু নিজেকে স্থির রেখেছে। প্রতিনিয়ত নিজেকে নিয়ে লড়াই করছে।

স্নাতক শেষ না হওয়ায় সরকারী চাকরির জন্য কোথাও আবেদন করতে পারছে না। বাইশ বছর বয়সী যুবকের জন্য এই সময়’টা আসলে বেশ কঠিন। একটা ভালো জব, পরিবারের খেয়াল রাখা, তাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব। সবকিছু তাকে তো দেখতে হবে। কিভাবে করবে সব? আজকাল একটা ভালো জব সোনার হরিণের মতই। দু’ তিনটে টিউশন দিয়ে নিজের পড়াশোনার খরচ হলেও পরিবারের খরচ বহন করা যায় না। তার বোন এস এস সি পরীক্ষার্থী। সে বড় হচ্ছে। তার বিয়ের কথাও ভাবতে হবে। মা’ আর কতকাল করবে তাদের জন্য। তার যে বয়স বাড়ছে।

একটা চাকরির জন্য হন্য হয়ে ঘুরছে গত দু’মাস। অনেকে শিক্ষাগত যোগ্যতা কম বললে নিতে চাই না। কেউ অভিজ্ঞতাহীন বলে তাড়িয়ে দেয়। শত ঘুরেও চাকরির ব্যবস্থা হয়নি তার। শেষে না পেরে সেলসম্যান হিসেবে একটা ওষুধ কোম্পানিতে চাকরির ডাক পড়ে। কিন্তু বেতন নিতান্তই কম। মাত্র সাত হাজার। ডিউটি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। এই চাকরি করতে গেলে তার টিউশন, পড়াশোনা সব বাদ দিতে হবে। তাই সে চাকরি আর করা হল না।

হতাশায় মূর্ছিত হয়ে আরও একমাস অতিবাহিত হল ইমরানের। আজও কিছু করার মত খুঁজে পাই না সে। প্রতিদিন নজর বুলায় পত্রিকার পাতায়। একদিন আচমকা চোখ পড়ে একটা এনজিও সংস্থার চাকরির বিজ্ঞপ্তির নোটিশে। কোনো রকম প্রত্যাশা ছাড়াই নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতার ফটোকপি নিয়ে উপস্থিত হয়। তার ইন্টারভিউ নেওয়া হয়। এনজিও সংস্থার প্রতিনিধি বেশ স্বভাব সুলভ তার সাথে কথা বলে। চাকরির আশ্বাস দেয়। আপনি বাড়ি যান জনাব ইমরান মাহমুদ। মনে করুন চাকরি হয়ে গিয়েছে। ইমরানও বেশ খুশি হল তাদের ব্যবহারে। তাই নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরল। দিন গুনতে লাগল জয়েন করার কল আসবে কখন। এভাবে প্রতিক্ষায় সময় কাটল আরও একমাস। তবু অপেক্ষায় আছে তার কবে জয়েন করার কল আসবে।

একদিন কলেজ থেকে ফিরার পথে গ্রামের পরিচিত ছোট এক ভাইয়ের সাথে দেখা হয়। সে হাসিমুখে তার সাথে কুশল বিনিময় করে। শেষে বলল, ভর দুপুরে কোথায় থেকে ফিরলে ছোট ভাই? নিরব তার কথায় হেসে বলল, ইমরান ভাই আমি একটা জব পাইছি এনজিওতে। বেতন মোটামুটি ভালোই। এই তো দশের মত পাই। পরে আরও বাড়বে। নিরবের মুখে এনজিওতে চাকরির কথা শুনে পুরো স্তব্ধ হয়ে গেল। বেশ কৌতুহল জাগল তার মনে। তাই পুনরায় বলল, তোমার চাকরি হয়েছে, শুনে খুশি হলাম। নিরব তার কথা শুনে দাঁত কেলিয়ে হেসে উঠল। বলে উঠল, ইমরান ভাই জব পাওয়া অত সোজা না। হয় মামা নয়ত চাচা লাগে। আমার মামা-চাচা দুইটাই লাগছে। এলাকার একজন প্রতাপশালী লোক আছে। যিনি রাজনীতিতে যুক্ত। তার সুপারিশ আর সম্মানি দিয়েই তবে জব পাইছি ভাই। এমনি এমনি পাই নাই। নিরব তার কথা শেষ করে বাড়ির দিকে পা বাড়াল। ইমরান নিজের উপর বিদ্রুপের হাসি দিল নিরবের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে।

সময় যতই গড়াচ্ছে ততই সব যেনো তার এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। নাহ একটা চাকরি হচ্ছে নাহ কিছু করতে পারছে। শেষে এক বেকারিতে জব নিল। কিছুদিন সেখানে কাজ করল। পরিশ্রমের তুলনায় বেতন ছিল স্বল্প। তাই দু’মাস করে ছেড়ে দিল। তার কিছুদিন পর একটা কম্পিউটার দোকানে কাজ পেল। সেখানে সারাদিন কাজ করতে হত। কাজের তুলনায় বেতন অতি নগন্য। সেটাও শেষে ছেড়ে দিল। তার কিছুদিন পর একটা কাপড়ের দোকানে চাকরি নিল। ভালই বেতন ছিল। তবে দোকানের মালিকের বেচাকেনা ছিল বেশ মন্দা। মার্কেটের বাকি দোকানীদেরও একই অবস্থা। ঠিকমত বেতন পরিশোধ করতে পারত না তার। তাই সেই চাকরি’টাও চলে গেল তার।

এভাবে সময়ের চাকায় দিন গড়াল দু’ বছরে। তার স্নাতক শেষ হল। সরকারী চাকরির আশায় বেশ কয়েক’টায় আবেদন করল। সবকটায় পরিক্ষা দিল। কিন্তু দিনশেষে হতাশা ছাড়া আর কিছুই পেল না। এত কিছুর মাঝে একদিন খবর পেল ফাহিয়ার বিয়ে হয়ে গেছে আরও দু’বছর আগে। তার স্বামীর পরিবার অনেক বিত্তশালী। ফেনী শহরে তাদের বিশাল বড় দু’টো কাপড়ের শো’রুম আছে। ফ্ল্যাটবাসা আছে শহরের মধ্যে। আবার গ্রামেও বিশাল বাড়ি। সব ঘরই পাকা। তার স্বামী’রা দু’ভাই। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায় ফাহিয়া রাজরানী হয়েই আছে। আফসোস হল না তার।

ইমরান নিশব্দে হাসল। সম্পর্কের বাঁধন ছুটে গেছে প্রায় আড়াই বছর। আজ আর কষ্ট হয় না। শুধু মায়ের জন্য বড্ড আফসোস হয়। কবে সে তার মায়ের মুখে হাসি ফুটাবে। বয়স তো তারও কম হয়নি। পঁচিশ বছরের টগবগে যুবক। অথচ এখনো সে মায়ের উপর নির্ভর। লজ্জায় মাথা অবনত হয়ে যায় তার। কবে পারবে কিছু করতে। একজন বেকার যুবক জানে বেকারত্ব কেমন অভিশাপ!

চলবে,,,,