দুই দুয়ারী
শেষ পর্ব (প্রথম অংশ)
মিলিদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমি। বিয়ের কোন আমেজ নেই এখানে, আত্মীয় স্বজনের ভিড় নেই, বাড়তি কোন সাজসজ্জার বালাই নেই। থাকার মধ্যে অল্প একটু সুগন্ধের আভাস আছে, প্রতিদিনকার চেয়ে ভালো রান্না হয়েছে সেটুকু বোঝা যাচ্ছে। সেই ঘ্রানে আমার ভেতরে ক্ষুধা চনমন করে উঠলো, কিন্তু খাবার কথা ভাবার সময় নেই এখন ।
কিছুখন দাঁড়িয়ে থেকে যখন কারো সাড়া পেলাম না, দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে গলা তুললাম, ” মিলি, এই মিলি, একটু বাইরে আসবে? ”
মিলি না, ওর মা বের হয়ে এলেন, আর পেছনে তার বাবাও।
” আপনি এত তাড়াতাড়ি এখানে কেন? ” বাবা বললেন। আমি খেয়াল করলাম, উনি আমাকে আপনি করে বলছেন আজ, মেয়ের জামাইকে আপনি করে বলার চল আছে, আমি আমার ভবিষ্যতের জীবনেও সেটা দেখেছি। আমার একটু শিহরণ হলো, আমি মেয়ের জামাই, ভেবে।
আমি বললাম, ” ইমাম সাহেবকে কি খবর দেয়া যায়? আমি ভাবছিলাম যদি এখনই… ”
তিনি হাতের ইশারায় আমাকে বসতে বললেন, ” কোন সমস্যা হইছে? নাকি ভাবতেসেন দেরি করলে আপনার মন পাল্টায় যাবে? ”
” আমার মন এই জীবনে পাল্টাবেনা ” লজ্জার মাথা খেয়ে বলে বসি, ” আমার খুব মন খারাপ। মিলি আমার কাছে… মানে যদি মিলির কাছে বসি… আমার মন ভালো হবে”।
মা দ্রুত ঘরে ঢুকে গেলেন, লজ্জা পেয়েছেন। বাবা হাসতে গিয়েও মুখ গম্ভীর করে ফেলে বললেন, ” দেখি জালালরে পাঠাই মসজিদে ”
জালাল দ্রুতগতিতে ছুটে গেল, আমি বসে রইলাম। আমার ভীষণ তৃষ্ণা পেয়েছে, রীতিমতো বুক ফেটে যাচ্ছে তৃষ্ণায়, কিন্তু সেটা পানির জন্য নয়। দুই একবার উঁকি ঝুকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম, কাউকে দেখতে পেলাম না, কেউ বের হয়েও এলোনা।
জালাল যেভাবে গিয়েছিলো, সেভাবে দৌড়ে ফিরেও এলো, জানা গেল ইমাম সাহেব মসজিদে বা বাড়িতে কোথাও নেই। আমার ইচ্ছে হলো বলি, আপনি বিয়ে করাতে পারেন না? তিনবার কবুল বলতে হয় শুনেছি, আমি না হয় দশবার বললাম, চলবে না?
মা আবার বের হয়ে এসেছেন, ” বাবার মনে হয় খাওয়া হয়নাই সারাদিন, একটু সেমাই খান, ইমাম সাহেব চলে আসবে ”
উনি খুব সুন্দর করে বাবা বলেন, অনেকটা আমার মায়ের মত করে, আমার মন দ্রবীভূত হয়ে যায়। আমি ফিসফিস করে বললাম, ” আমি এখানে বসে থাকলে আপনাদের সমস্যা হবে? আমার কোথাও যেতে ইচ্ছে করছেনা। ”
” সমস্যা আর কি? যেই না বিয়ার আয়োজন। কিন্তু বাবা ঘরে আসতে বলতে পারবোনা এখনই। এইটুক তো করতে দেন মাইয়াটার জন্য “।
রোদ উঠেছে আজকে, বেশ গরম। এর মধ্যে মাথার উপর কোনরকম ছাউনি ছাড়া বসে থাকা একটু কষ্টই, তবু রাজি হয়ে গেলাম। হতচ্ছাড়া মিলিটা ঘরের ভেতর ঘাপটি মেরে বসে কি করছে জানিনা, একটাবার বাইরে আসলে কি হয়?
***
আমি বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, অথবা ঝিমুনি এসেছিলো, ইমাম সাহেবের উপস্থিতি ঘুম ভাঙালো আমার।
” খবর তো শুনছো মনে হয়, সেইজন্যই ছুঁইটা আসছো, তাই না? ” উনি বললেন।
আমি মাথা নিচু করে রইলাম। যদিও আমি জানি, এনারা কেউ আমার পরিচয় জানেন না, তারা জানেন না, আমি ওই ঘৃনিত নিষ্ঠুর চরিত্রহীন নজরুলের খুব আপন, রক্তের সম্পর্কের লোক, তবু লজ্জায় মাথা হেট্ হয়ে থাকে, তুলতে পারিনা।
” মেয়েটা খুব অসুস্থ হয়া গেসে” বলে উনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ” বাঁচবো কিনা সন্দেহ “।
আমি চমকে উঠলাম, প্রচন্ডভাবে।
” কলিমের বাড়ির সামনে ফালায় রাইখা গেসে। হুশ ছিলোনা। ”
আমি দাঁড়িয়ে গেলাম এবার, চিৎকার করে বললাম, ” পুলিশ? পুলিশ নাই এখানে? আপনারা নজরুলকে ধরিয়ে দিচ্ছেন না কেন? ”
” সেইটা নিয়াই কথা হইতেছিলো এতক্ষন। নিজামুদ্দিন সাহেবের ওইখেন থেকে আসলাম। কলিম পুলিশে জানাইতে চায়না ”
আমি অবাক হয়ে গেলাম। সোবহান , তার মেয়ে শেফালী আর তার স্বামীর কথা মনে পড়লো। কলিম ভাই ও কি তাদের মত জমিজমা আর দুটো গরুর বদলে এই অপমান ভুলে যাবে? এ কোথায় এসে পড়লাম আমি? আবার গলা চড়ালাম, ” মিলি, এই মিলি, বাইরে আসো। আমরা এখুনি চলে যাবো। ”
” যাইও ” ইমাম সাহেব বললেন, ” তাড়াতাড়িই যাইও। আজকে ঝামেলা হবে। এইখানে না থাকাই ভালো। বসো। বিয়াটা পড়ায় দেই, বেশি সময় লাগবেনা… ”
বসতে গিয়েও হঠাৎ বলি, ” ঝামেলা মানে? কেমন ঝামেলা? ”
” কলিম” উনি বললেন, ” নিজামুদ্দিন সাহেবের ওইখানে বসা এখনো। মানুষ মারার অস্ত্র খুজতাসে। সে বলছে, চেয়ারম্যান সাহেবের বংশ শেষ হইবো আজকে। নজরুল, হের পোয়াতি বৌ, নাইমুল কেউরে ছাড়বেনা। এই বংশ বাড়লেই আরো মাইয়াদের ক্ষতি, এই পরিবারে আর কোন পুরুষ মানুষ সে রাখবোনা “।
আমার মাথা ঝিমঝিম করতে লাগলো। কলিম ভাই কেন একথা বলতে বা ভাবতে পারে, আমি সেটা সমস্ত মন দিয়ে অনুধাবন করতে পারি। আর মনে হচ্ছে, খুব একটা অন্যায় ভাবনাও না সেটা… কিন্তু, তাহলে আমার বাবা? উনি জন্মাবেন না? আর যদি উনি না থাকেন তাহলে আমি? আমি যদি না থাকি তাহলে মিলিকে পাবো কি করে? আমার মাথা ঘুরতে লাগলো।
” আর আপনারা সেটা মেনে নিলেন? ”
” আমি মানা না মানার কে? তবে নিজামুদ্দিন সাহেব না করেন নাই। বলসেন, কাজ শেষ হোক, তারপরে পুলিশের ব্যাপার উনি দেখবেন”।
আমি আবার ডাকলাম, ” মিলি, এই মিলি, একটু বাইরে এসো। একবার। ”
এবার ভেতর থেকে মার গলা শুনি, ” নামাজে দাড়াইসে বাবা। একটুখানি সহ্য নাই, এইটা কেমন কথা? ”
আমার মাথার ভেতর প্রতিটা শিরা উপশিরা নিজেদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে, আমাকে কলিম ভাইয়ের আগে সেখানে পৌঁছুতে হবে। নজরুল যত খারাপই হোক না কেন, ওকে আমার, আমার বাবার, আমাদের প্রয়োজন। সেই সাথে আমার দাদি, উফ, বাচ্চা একটা মেয়ে, যার গর্ভে পালিত আমার বাবা, পৃথিবীর আলো দেখার জন্য মুখিয়ে আছেন।
” আমি আসছি মিলি ” জোরে বললাম, ” একটু অপেক্ষা করো। আমি আসছি ”
ইচ্ছে ছিল, বিয়ে করে মিলিকে নিয়ে গরুর গাড়িতে উঠবো। আমার তো ওকে নিয়ে যাবার জায়গা নেই, অন্তত বিদায়ের নাটক করবো দুজন মিলে। তারপর চালকের চোখ এড়িয়ে অথবা চালক দেখে ফেললে নির্লজ্জের মতোই ওকে একটু ভালোবাসবো। সেইজন্য গাড়িটাকে আসতে বলা। ভাগ্য ভালো, আমার মতোই আমার গরুর গাড়িও সময়ের আগেই এসে উপস্থিত। অবশ্যই আমি কলিম ভাইয়ের আগে পৌঁছে যাবো।
***
যখন পৌঁছালাম, তখন প্রায় বিকেল হয়ে এসেছে, অন্তত মাথার উপরের তীব্র সুর্যটা আর নেই। কোন কিছুর পরোয়া না করে ঘরে ঢুকে গিয়েছি, অবাক হয়ে দেখলাম, নজরুল কাঁথা গায়ে ঘুমুচ্ছে। কি সাহস! কত বড় আস্পর্ধা! কি পরিমান আত্মবিশ্বাস!
আমার ওকে হাত দিয়ে স্পর্শ করতে ঘৃণা করে, আজন্ম যাকে সম্মান করে এসেছি, সেই দাদা নজরুল, তাকে আমি আমার বহুল ব্যবহৃত স্যান্ডেলের আগা দিয়ে লাথি মেরে ঘুম থেকে তুলি, ” এই শুওরের বাচ্চা। ওঠ। এখুনি ওঠ”।
চেয়ারম্যান সাহেবের স্ত্রী আর আমার দাদি দুজন এসে উপস্থিত হয়েছে তখন, আমি বললাম, ” আপনার ছেলেকে দেখতে বলেছিলেন না? এই দেখেন দেখতে এসেছি “।
দাদি চূড়ান্ত বিস্ময় নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন, নজরুল নিজেও তাই। অদ্ভূতভাবে সে আজকে কিছুই বললোনা, বরং উঠে দাঁড়াতেই আমি আমার সব শক্তি একত্রিত করে ওকে চড় মারলাম।
” কি হইতেসে এসব? ” চেয়ারম্যান সাহেবের কণ্ঠ। আজ আমি স্নেহ বোধ করিনা, যে বাবা এতকিছুর পরে ছেলেকে ঘরে প্রবেশ করতে দিয়েছেন, আবার হয়তো রাতের ক্লান্তি দুর করার জন্য তাকে দিনের বেলায় ঘুমাতে দিচ্ছেন, তাকে ধিক্কার করতে ইচ্ছে করে।
অবশ্য আমিও কম কিছু নই, রক্তের টানে এখানে ছুটে এসেছি এই নরপিশাচকে উদ্ধার করতে, ওনার সাথে আমার খুব একটা পার্থক্য নেই বোধহয়।
” এখুনি পালাতে হবে তোদের ” তুই ছাড়া কিছু বের হলোনা মুখ দিয়ে, ” যেমনে আছিস সেভাবে, এক মুহূর্ত সময় নেই ”
” কি হইসে? ” চেয়ারম্যান সাহেব বললেন।
” আপনি জানেন না কি হইসে? কলিম আসছে ওকে মারতে। হয়তো চলেও এসেছে। এখুনি বের হন আপনারা। দাদি, লুৎফর, নাইমুল সব সহ। আমার সাথে গরুর গাড়িটা আছে। পিছনের জঙ্গলের পথ দিয়ে বের হতে হবে। আর একবারও না থামিয়ে যতদূর যাওয়া যায় চলে যেতে হবে। ”
আমি ইমাম সাহেবের কাছে শোনা কথাটা ওদের জানালাম। চেয়ারম্যান সাহেব বোকার মত হাসছেন, ” কলিম? ও মারবে আমাদের? হাহাহাহা। ওর রক্ত পর্যন্ত আমার কিনা। তারপরেও যাইতে হইলে এরা যাক, কলিমের সামনে আজকে না পড়ুক। আমি থাকি। গাড়িতেও ধরবোনা এত লোক।”
নজরুল একটা শব্দও বললোনা মুখ দিয়ে, শুধু লুঙ্গি বদলে পাজামা পরে নিলো নীরবে। দাদি খুন খুন করে কাঁদছেন বিরামহীন, চেয়ারম্যান সাহেব আর তার স্ত্রী নিস্তব্ধ। নাইমুল বাবার জামা ধরে দাঁড়িয়ে রইলো, সে কিছুতেই যাবেনা। তার তো কোন দোষ নেই, তাই।
তাদের বাড়ির পেছনে জঙ্গলটা, সেদিক দিয়ে বের হয়ে গেলো গরুর গাড়িটা। এক কাপড়ে আর সামান্য কিছু অর্থ নিয়ে ওরা যাচ্ছে।
আমি বড় করে নিঃশ্বাস ফেলে তাকিয়ে রইলাম সেই কুয়াটার দিকে, এই পর্যন্ত তিনবার বাবাকে বাঁচিয়ে দিলাম। অথচ সেই কবে আমি দুষ্টুমি করতে গিয়ে বিদ্যুতের তারে আটকে গেছিলাম আর বাবা বুদ্ধি করে আমাকে স্পর্শ না করে রাবারের সেন্ডেল দিয়ে লাথি মেরে আমাকে সরিয়ে এনেছিলেন, এই কথা যেকোন সুযোগে শুনিয়ে দিতে ভুলেননা।
আমার একটু হাসিও পেলো। বাবার কাছে থেকে পুরোটা সুদে আসলে উসুল করব এবার বাড়ি গেলে। কিন্তু না, সেই সম্ভাবনা তো নেই আর, আমি আর সেখানে যাচ্ছিনা। আমি এখন মিলির কাছে যাবো। আর সেখানেই থাকবো।
আমি ঘুরে বাড়ির সামনে এলাম, বাদ আসর আমার বিয়ের কথা ছিল, অথচ ঝুপ করে আধার নেমে গেছে। মিলি হয়তো রাগ করছে, অসুবিধা নেই, আমি ওর সব রাগ শুষে খেয়ে ফেলবো।
চমকে উঠলাম। উঠোনে একজন কেউ দাঁড়িয়ে আছে। এই গরমে তার পরনে কালো রঙের শাল। কলিম ভাই।
দুই দুয়ারী
শেষ পর্ব (শেষ অংশ )
” চেয়ারম্যান চাচা ” অদ্ভুত গলায় ডাকলো সে, ” একটু বাইরে আসেন। কথা ছিল।”
আমি ওর কাছে যেতে চাইলাম, ভাবলাম, বন্ধু সদৃশ কাউকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে পারলে হয়তো ওর ভালো লাগবে। কিন্তু সে তাকাচ্ছেনা আমার দিকে, নির্লিপ্ত পাথরের মত ওর চোখ।
হারিকেন হাতে বয়স্ক লোকটা বের হয়ে এসেছেন, বললেন, ” কলিম নাকি? ” তার পেছনে তখনো নাইমুল, এখনো বাবার জামা খামচে ধরে রেখেছে।
” নজরুলরে বাইর করেন। ওর জন্য জিনিস আনছি ”
সে একটা রাম দা বের করলো। আমার পা জমে গেছে, খুব করে চাইছি কোনোভাবে আরেকটু সময় যাক, ওদেরকে নিয়ে দুর থেকে দূরে চলে যাক গাড়িটা।
” এইটা দিয়া কি করবা কলিম? ”
” হাহাহাহা” ভয়ঙ্কর শীতল গলায় হাসছে কলিম, ” আপনার জন্য কি না করছি। মনে আছে, যুদ্ধের পরে নিয়ম জারি হইল, সব অস্ত্র জমা দিতে হবে। সবাই জমা দিল শুধু আপনের বড় পোলায় ছাড়া.. আপনে কইলেন কাউরে বলতেনা, বললাম না আমিও।…. তয় কিনা আমরা গরিব মানুষ। আমার কপালে জুটলোনা। অসুবিধা নাই। আমাদের দা ই চলে। রাইফেল লাগেনা ”
” আমার ছেলে ভুল করসে। তার বিনিময়ে যা চাও নিয়া নাও। বাড়ির মধ্যে যা আছে সব তোমার। আর একটা কেন, তোমারে দশটা সুন্দরী বৌ আইনা দেয়ার ক্ষমতা আমার আছে “।
” নজরুল কই? ” কলিমের গলা আরো শীতল।
চেয়ারম্যান সাহেব এগিয়ে এসে তার কাঁধে হাত রাখলেন, ” তুমি আমার জন্য করসো, আমি কি তোমার জন্য করিনাই? আপোষে মিটায় ফেলি চলো “।
কলিম ভাই ধাক্কা মেরে তাকে সরিয়ে দিলো, তারপর এক দলা থুথু মাটিতে ফেলে বললো, ” সেই ছোটবেলা থিকা আপোষে মিটায়া আসতেসি। আর না। নজরুল কি বাসায় নাই? ”
” ভাইজান পালায় গেছে ” নাইমের চিকন কণ্ঠ।
” কলিম ভাই ” আমি মাঝখানে থেকে বললাম, ” আমার সাথে চলেন, ভাবীকে ডাক্তার দেখানো দরকার ”
” কিসের ভাবি? নজরুলে যারে … ছে, তারে আমি রাখমু নাকি? তবে তার আগে….
আমি কিছু বলার বা বুঝার আগে সে নাইমুলের গর্দান লক্ষ করে দা চালালো, একটি আঘাতেই ছেলেটা মাটিতে পরে গেছে, অন্ধকারেও আমি ফিনকি দিয়ে ছোটা রক্তের স্রোত দেখতে পেলাম।
” কলিম ” চেয়ারম্যান সাহেব চিৎকার করে উঠলেন, ” কি করলা? কি করলা এটা তুমি? ”
কলিম ভাই তাকালো তার দিকে, ” এইবার তর পালা। বলা তো যায়না, বুড়া বয়সে আরেকটা হারামি জন্ম দিয়া বসস যদি? ”
নিজের ছেলের মৃতদেহ সামনে, তবু লোকটার চোখে ভয় নেই, অনড় কণ্ঠ, বললেন, ” আমাকে মারতে পারবাইনা তুমি। আমি না তোমার বাপের মত? ”
আমি প্রচন্ড ভয়ে, বিস্ময়ে, ঘটনার আকস্মিকতায় থরথর করে কাঁপছি তখন , বিশ্বাস করতে পারছিনা বাচ্চা ছেলেটা সত্যিই মরে গেছে কিনা। কোন কিছু করার ক্ষমতা নেই আমার, তবু কলিম ভাইকে ধরে রাখবার জন্য এগিয়ে গেলাম। মানসিক অসুস্থতা মানুষকে অসুরের শক্তি দেয় হয়তো, সে আমাকে পিপিলিকার মত ঝেড়ে মাটিতে ফেলে দিলো।
চেয়ারম্যান সাহেবের স্ত্রী এখন বের হয়ে এসেছেন, চিৎকার করে তিনি বসে পড়েছেন নাইমুলের পাশে। কলিম দা হাতে এগিয়ে গেল সেদিকে, ” দেখেন কেমন লাগে… আমারে দশটা বৌ আইনা দিবেন, আপনে করবেন দশটা বিয়া? ” এই বলে মহিলার মাথায় প্রচন্ড শব্দে আঘাত করলেন। আবারো রক্ত।
আমি নিজেকে যতই পরিণত মনে করিনা কেন, আজ বুঝতে পারলাম, আমি একজন দুর্বল তরুন ছাড়া আর কিছু নই, প্রেমে পড়া আর ভালোবাসা ছাড়া আমার আর কোন যোগ্যতা নেই। আমি হরহর করে বমি করছি শুধু, অনেক চেষ্টা করেও জায়গা থেকে নড়তে পারছিনা।
চেয়ারম্যান সাহেব শেষ চেষ্টা করেন, ” তুমি আমারে মাফ কইরা দাও। আল্লাহর ওয়াস্তে….
আমি বাকিটা দেখতে পারলাম না, চোখ বন্ধ করে ফেলি। কলিম ভাইয়ের কান্নার শব্দে চোখ খুললাম, বৃদ্ধ লোকটার মাটিতে পরে থাকা দেহের পাশে বসে সে চিৎকার করে কাঁদছে। লোকটা পরে আছে ভাঙা হারিকেনের পাশে, মুখ থেকে পানের পিক গড়িয়ে পড়ছে, আর সেটা মিশে যাচ্ছে রক্তের সাথে।
জীবিত অবস্থায় সে শুধু বলেছিলো, লোকটা তার বাবার মত, আজকে নিজ হাতে খুন করে মৃতদেহর পাশে বসে বিলাপ করছে, ” আব্বা। আব্বা গো। কি করলাম এইটা? ” হঠাৎ করেই বুঝতে পারলাম আমি, নজরুল আর তার ছেলেরা শেষ হয়ে গেলেও এই বংশ শেষ হতোনা, কলিম ভাই নিজেও সেটা জানে।
ঠিক তখন আমার টনক নড়লো, মিলি! হ্যাঁ মিলি অপেক্ষা করে আছে। তারচেয়েও বড় কথা আমি, আমি অপেক্ষা করে আছি। আমি এখন মিলিকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদতে চাচ্ছি। আমার খুব ভয় করছে, মিলির কাছে আশ্রয় চাচ্ছি।
কোথা থেকে এতক্ষনে শক্তি পেলাম, জানিনা, কিন্তু আমি উঠলাম। এবং দৌঁড়াতে শুরু করলাম। এই ছোটার কোন নিয়ম নেই, সীমা নেই। শুধু ছুট। ছুট। ছুট।
আমি ছুটছি মেঠো পথ ধরে। রক্ত। গাছ গাছালি পার হয়ে। রক্ত। আমার শরীরে কোথাও রক্ত লাগেনি, তবু রক্ত। মনে হচ্ছে চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে রক্তের প্রবাহে। উফ। কি ভয়ংকর। কি নিষ্ঠুর!
কিন্তু একসময় আমাকে থামতে হয়। কোনোভাবেই পা চলছেনা, এত ক্লান্ত হয়ে গেছি আমি! অবাক হয়ে লক্ষ করলাম দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে কখন স্কুলঘরের সামনে চলে এসেছি। আরেকটুখানি দূরত্ব, তারপরই মিলিদের বাড়ি, অথচ আমার পা চলছেনা। প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে। মনে হচ্ছে এক্ষুনি না ঘুমালে মরেই যাব আমি।
খুব কষ্টে নিজেকে টেনে নিয়ে বটগাছটার নিচে বসলাম। একটু ঘুমিয়ে নেই, তারপর আমি আসছি। একটু অপেক্ষা করো মিলি, আমি আসছি।
ঘুমিয়ে যাবার ঠিক আগে আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো গত রাতের কথা, ছোট মাটির পাত্রে করে মিলি আমার জন্য কি একটা খাবার এনেছে, আমি বুভুক্ষের মত খাচ্ছি। এরপর পরই আমার মনে পড়লো ছয় মাস আগের একটি দৃশ্য। আমি, রায়হান আর রনি হাটছি, আমি থমকে দাঁড়িয়ে বলছি, আমরা কি আগেও এখানে এসেছি? মনে হচ্ছে এই দইটা আমি গতকাল খেয়ে গেছি!
***
অনন্তকালের ঘুম ভেঙে জেগে উঠলাম আমি। প্রথমেই আরামের বিছানাটা খেয়াল করলাম, মোটা নরম তোষক, শরীরের উপর নকশা কাঁটা দামি কাঁথা।চোখ পড়লো সামনের দেয়ালে, আপাদমস্তক কালো পোশাকে মোড়া আমি আর আমার চার বন্ধুর ছবি, নিচে বড় করে লেখা ” ড্রিমিং রক”। গলাটা শুকিয়ে আছে, ” পানি খাবো ” বললাম।
” বাবা ” অনেকদিন পরে আমার মায়ের হাহাকার ভরা কণ্ঠ শুনতে পেলাম, ” বাবা আমার। কি হয়েছে তোমার? কে এই অবস্থা করলো তোমার বলো একবার… তার গলা ভেঙে এলো।
আমি আনন্দিত হতে পারলাম না হুট্ করে, বরং প্রচন্ড হতাশা আর মন খারাপ করা অনুভূতি আমাকে গ্রাস করলো। আমি বুঝতে পারছি আমি আমার আগের জীবনে ফিরে এসেছি! আগে কখনো বলা হয়নি, কিন্তু ঠিক এইরকম একটা আশংকা সব সময় আমাকে ঘিরে থাকতো। তাই খুব বেশি অবাক হলাম না, একটা অনিয়ন্ত্রিত আবেগের স্রোত আমাকে ভাসিয়ে দিল সহসা, আমি কেঁদে ফেললাম। মা আমার মুখে পানি তুলে দিতেই জড়িয়ে ধরলাম তাকে, সেটা যতো না তাকে অনেকদিন পরে দেখতে পাবার আনন্দে, , তার চেয়ে বেশি কষ্টে, মিলির কথা ভেবে।
” মা। তোমার কথা অনেক ভেবেছি মা। প্রতিদিন ভেবেছি।”
আমাকে জড়িয়ে ধরা মায়ের শরীর যেন একটু শক্ত হয়ে এলো এই কথায়, জোর করে ছাড়িয়ে নিয়ে আমার মুখের দিকে তাকালেন, ” সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত প্রতিদিন মনে করেছ…. ” তিনি কথা হারিয়ে ফেললেন, বিভ্রান্ত দেখালো তাকে।
আমিও বিভ্রান্ত হয়ে গেলাম, সকাল থেকে বিকেল মানে কি? গত ছয়মাস তো আমার তার সাথে দেখা হয়নি! ততক্ষনে মা চিৎকার করে বাবাকে ডাকছেন, ” তাড়াতাড়ি আসো। দেখো কি বলে আমার ছেলেটা। কি হয়েছে ওর…. ” তিনি শব্দ করে কাঁদতে লাগলেন।
মায়ের কান্নায় আপ্লুত হতে আমার সময় লাগলোনা, আবারো পাগলের মত জড়িয়ে ধরে রাখলাম অনেকক্ষন। উনি জানেন না, ওনাকে আমি দেখছি প্রায় ছয় মাস পর , এই কদিনে তার ছেলে অনেক বড় হয়ে গেছে।
বাবার সাথে আমার সম্পর্ক বেশ ভাসা ভাসাই ছিল, প্রচন্ড ভালোবাসলেও কখনো বলা হয়নি সেকথা। আজ লজ্জার মাথা খেয়ে ওনাকেও আমি জড়িয়ে ধরি আর অনেকবার বাবা বাবা বলে ডেকে মনের সাধ মিটিয়ে নেই। সেই সাথে আমি চাতক পাখির মত অপেক্ষায় থাকি আমার দাদিকে দেখবার জন্য, কিছু প্রহর আগে যাকে দেখে এসেছি একজন দুঃখী তরুণী হিসেবে।
উনি এসে বসলেন আমার পাশে, মাথায় হাত রেখে বললেন, ” তোমার দাদা খুব রাইগা আছে। অসুস্থ মানুষ, রাগ সইতে পারেনা। ঘুমায় গেছে। যে তোমার এমন অবস্থা করলো, তার রক্ষা নাই বুঝছো?”
” কেউ করেনি কিছু। ওনাকে চিন্তা করতে মানা করো। আর উনার কথা জানতে চেয়েছি আমি?” শক্ত গলায় বললাম, ” তুমি চিন্তা করনাই আমার জন্য? তুমি কেমন আছ? ”
” আমি ” উনি শূন্য দৃষ্টিতে তাকালেন, ” আমি আর কেমন থাকবো… হঠাৎ কথা থামিয়ে আমার চোখের দিকে তাকালেন।
” কি দেখো বুড়ি? ” হাসার চেষ্টা করলাম।
” আমার এক ভাই ছিল, তোমার সঙ্গে তার খুব মিল। অনেক আগের কথা তো, ভুইলাই গেসিলাম। আজকে হঠাৎ মনে পইড়া গেল “।
আজকের আগে তো আমি সেখানে যাইনি, মনে পড়বে কি করে? ভেবে আমি নিজেই খুব দ্বিধায় পরে গেলাম। আমি রীতিমতো তাদের জীবন বাঁচিয়েছিলাম, কিন্তু সেটা করেছি যখন আমার বয়স বাইশ। তাই গত বাইশ বছর উনি আমার কথা ভুলে ছিলেন। কি ভীষণ গোলোকধাঁধা।
একটু পরে রায়হান আর রনির কাছে জানলাম কি হয়েছিল। ঈদের নামাজ শেষে বাড়ি ফেরার সময় ওরা আমাকে খুঁজে পায়নি। ওরা ভেবেছে কোথাও গিয়েছি হয়তো, ফিরে আসবো একটু পরেই। বিকেল পর্যন্ত না আসায় সবাই খুব চিন্তায় পরে যায়, খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে স্কুলের মাঠে বট গাছের নিচে আমাকে অচেতন অবস্থায় পেয়ে যায়। আমার পোশাক নোংরা কাদা মাখা, পায়ে জুতো নেই। সেই থেকে এই রাত পর্যন্ত আমি ঘুমিয়ে কাটিয়েছি। ডাক্তার এসে দেখে গেছে, আমি অবশ্য টের পাইনি।
সবাই এখন চিন্তামুক্ত, একজন যুবকের এক বেলা বাড়িতে না ফেরাটা খুব বিশাল কোন ব্যাপার না সত্যিই। এদিকে আমি মনে মনে অস্থির হয়ে উঠেছি, একটুখানি একা থাকবার জন্য।
” আমি ঠিক আছি মা ” বললাম, ” ঘুমালে আরো ভালো বোধ করবো। তুমি যাও। ঘুমিয়ে পর”।
” জামাটা বদলে নাও ” বলে মা চুমু খেলেন আমার কপালে। জামার কথায় আমি চমকে উঠে পকেট হাতড়াই, আছে, ছোট একটা কাগজ এখনো আছে।
একটু পরে টের পেলাম বাড়ির সব বাতি নিভে গেছে। আমি চোখের সামনে আমার জীবনের প্রথম এবং পঞ্চাশ বছরের পুরোনো প্রেমপত্রটি মেলে ধরি।
” বিয়ে করতে হলে দাঁড়ি গোঁফ কামাইবেন….
আমি আর পড়তে পারিনা, চোখের পানি সবটা ঝাঁপসা করে দেয়, আমি কাঁদতে শুরু করি। মিলি, আমার মিলি। ওকে একবার চোখের দেখাও দেখে আসিনি আমি। ও কি খুব মন খারাপ করেছিল? নাকি সবসময়ের মত কাঠিন্যের মুখোশ পরে হেসে ফেলেছিলো? ওর কি খুব জানতে ইচ্ছে করেছিল, কেন সেদিন আমি আর ফিরে যাইনি?
আমি ভীষণ ক্লান্তি অনুভব করি, এত অবসাদ! মনে হলো, আমার হাত পা দশ মন ভারী হয়ে গেছে, আমি হাঁটতে পারবোনা। তবু নিজেকে টেনে টেনে বের হয়ে এলাম। এইটুকু পথে আমার যানবাহনের দরকার হয়না আর , আমি হাঁটতে শুরু করি।
এখন আর অন্ধকার নয় পথটা, দুই একটা লাইট আছে রাস্তায়, সেই আলোয় খুব পরিচিত সেই পথে আমি হাঁটতে থাকি। যখন স্কুলের মাঠটা পেরোই, দেখি , হতচ্ছাড়া বটগাছটা তেমনি দাঁড়িয়ে আছে, অনড়। আমার মন খারাপে ওর কখনো কিছু আসে যায়নি, আজও ওর কোন বিকার নেই। আমি থামিনা। আমি জানি আমাকে কোথায় যেতে হবে।
জগদদল ভারী পাথরের মত পা দুটিকে বয়ে নিয়ে জালাল সাহেবের বাড়ির সামনে এসে দাড়াই আবার।জালাল সাহেব এত রাতেও বাড়ির বাইরে উঠোনেই বসেছিলেন, আমাকে দেখে পরিচিত ভঙ্গিতে হাসলেন,
কথা বললেন না, একটা দিকে আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে দিলেন।
***
সেই আঙ্গুল অনুসরণ করে আমি বন্ধ একটা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছি, ভেতরে যাবার সাহস হচ্ছেনা। একবার ভাবলাম চলে যাই এখান থেকে, কি হবে শুধু শুধু কষ্ট বাড়িয়ে? কিন্তু তীব্র আকাঙ্খার কাছে পরাজিত হয়ে আমি ভিতরে ঢুকলাম।
সেই নীল রঙের শাড়িতে জংলী ফুলের ছবি, কিন্তু যে বসে আছে সে একজন বৃদ্ধা রমণী, হিসেব মতে তার বয়স সত্তুরের কাছাকাছি। কিন্তু আমার সমগ্র চেতনা দিয়ে আমি জানি, ওই মিলি, আমার মিলি। ওর গাল কুঁচকে ঝুলে পরেছে, হাতগুলি শীর্ন, বয়সের ভারে সামান্য পিঠ সোজা করে রাখতে পারছেনা। তবু আমি ওর পাশে বসলাম।
” আপনি…. তুমি ভালো আছ মিলি? ”
সত্তুর বছরের বৃদ্ধাকে তুমি করে বলতে আমার বাঁধলোনা, ঠিক তেমন বাইশ তেইশ বছরের যুবককে সে বললো, ” জ্বী। আপনি ভালো আছেন? ”
এই পর্যায়ে আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না, আবার কাঁদতে শুরু করলাম, বৃদ্ধা আমার মাথায় হাত রাখলেন, ” কাঁদবেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে”
আমি ফোঁপাতে থাকি। ওকে আমার দেখতে ইচ্ছে করে কিন্তু চোখে চোখ রাখতে সংকোচ হয়, মাথা নিচু করে রাখি, ” কি ঠিক হবে মিলি? আমি তো তোমাকে রেখে চলে আসতে চাইনি? আমি তো শুধু তোমাকে চেয়েছিলাম!”
বয়স ওর কণ্ঠকে ভারী করেছে, কিন্তু হাসির সেই রিনিঝিনি শব্দকে কেড়ে নিতে পারেনি, খিলখিল করে হেসে বললো, ” আস্তে বলেন, কেউ শুনলে কি ভাববে? আমি বুড়া মানুষ না?”
” তুমি সব জানো, তাই না? ”
” এখন জানি” সে ছোট করে বললো।
” আমাকে খুব ঘৃণা করেছিলে? ভেবেছ পালিয়ে গেছি?” আমি মরিয়া হয়ে প্রশ্ন করি।
” হ্যাঁ। অনেক বছর ঘিন্না করছি। এরপর ওই মরণের ঘূর্ণিঝড় হইলো। একদিকে সব মইরা সাফ, অথচ আমি দুঃখের বদলে খুশি হইলাম সেইদিন, অনেকবছর পরে”।
নীরবতা।
“তুমি ভালো ছিলে? ” জিজ্ঞাসা করলাম। আমি খুব বুঝতে পারছি, আমার ভালো থাকাকে আমি পঞ্চাশ বছর আগে রেখে এসেছি, ওর কথা জানতে খুব ইচ্ছে করে।
” ছিলাম ” ও হাসলো একটু, ” আপনি উধাও হবার পর পরই আমার বিয়া হইলো,, ইমাম সাহেবের সাথে, ওই দেখেন জালাইল্যা কি সুন্দর করে মা ডাকে….
” আমাকে মনে পড়েনি? ”
জবাব দিলোনা, ” আমরা ওখানে থাকিনাই বেশিদিন, খুলনা চলে গেলাম, উনি আমাকে কলেজেও ভর্তি করলেন জানেন? জালালের পড়াশোনার দিকে মন ছিলোনা কোনোদিন, অথচ আমার দিকেই তার সমস্ত খেয়াল ছিল। উনি মারা গেছেন দশ বছর হয় “।
” আমার কথা তাই ভুলেই গিয়েছিলে? ”
” কলেজের পরে আর পড়িনাই, কিন্তু আমার জন্য বইয়ের কমতি রাখেন নাই উনি। নানান ধরণের বই। ওগুলা পইড়া পইড়া আস্তে আস্তে আপনার কথা বিশ্বাস করছি। ”
” মিলি, আমার কথা মনে পড়েনি? ”
মিলি হঠাৎ আমার চোখের দিকে তাকালো, ” পঞ্চাশ বছর ধইরা আজকে দিনের জন্য অপেক্ষা করসি। আপনেই বলেন মনে পড়সে কিনা?”
আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম।
” আপনি বলছিলেন ২০২৩ এর ২১ এপ্রিল। কতকিছু ভুইলা গেছি, এইটা ভুলিনাই। কত মজার ব্যাপার না? আপনি লিখছিলেন এক মুহূর্তে বট গাছের নিচে ছিলেন, পরের মুহূর্তে আমার কাছে চইলা গেলেন। সেই কথামতো জালালরে আজকে সকালে বললাম, ওনারে বট গাছের নিচে দিয়া আয়। এক হিসাবে আমিই কিন্তু আপনারে আমার কাছে নিয়া গেসিলাম “।
আজকে মিলি পরিপক্ক, আমি অবুঝ কিশোর। সময় পরিভ্রমনের জটিল সমীকরণ আমার মাথায় ঢুকছেনা। আবার কাঁদতে শুরু করলাম।
” এখন কাজের কথা শোনেন, আমি এত বছর কাটায় আসছি, আমি জানি যেই ঘটনা একবার ঘটসে তা আর ঘটেনাই। আপনার সাথে আমার আর দেখা হয়নাই। বুঝতে পারতেসেন কি বলি? এর পিছে আর সময় নস্ট করবেন না, লাভ হবেনা। বুঝছেন? বলেন আমার এই কথাটা রাখবেন? ”
আমার বুকের ভেতর সেই বাঁশ বাগান আর পুকুর পাড় দগদগে ঘায়ের মত জীবন্ত, পঞ্চাশ বছর কেটে থাকবে ওর, তাই সে এত কঠিন। আমি পারছিনা, আমার পৃথিবী অন্ধকার হয়ে আসছে। আমি শুধু বলেছিলাম, একটু অপেক্ষা করো আমি আসছি। তখন ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারিনি, ওই দুরুত্ব অতিক্রম করে আমার আর কখনো মিলির কাছে পৌঁছানো হবেনা। অথচ পঞ্চাশ বছরের দূরত্ব অনায়াসে অতিক্রম করে এইখানে ফিরে এসেছি!
আমি আজও বুঝিনা কি বলবো, তাই ফিসফিস করে শুধু বলি, ” মিলি। মিলি। ”
ও নির্লিপ্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে চুক চুক শব্দ করে আফসোস প্রকাশ করলো, ” আহারে, বাচ্চাটা এখন কি কষ্ট পাইবো আমি জানি। আমি হাড়ে হাড়ে জানি। ”
আমার চোখ পড়ে তার হাতের দিকে, মেহেদী দিয়েছে। তরল গলায় হেসে উঠলো সে, ” কালকে আপনারে দেইখা নাতিনরে বললাম, আমারেও দে একটুখানি। শোনেন আমার খুব কান্না আসতেসে। কানলে রাগ করবেন?”
আমি ওর কুঁচকে যাওয়া হাত নিজের হাতে নিয়ে অনেকক্ষন বসে রইলাম। লোকে জানলে বলবে, কি অরুচিকর একটা ব্যাপার! অথচ আমি জানি কি তীব্রভাবেই না আমি একে ভালোবাসি! আর এই মুহূর্তে বৃদ্ধা রমণীর প্রতি শারীরিক আকর্ষণ বোধ, কই, করছিনা তো!
” আমার খুব কষ্ট হচ্ছে মিলি। আমি কি করবো বলে দাও”।
” আমি বেশিদিন আর নাই, বুঝছেন? শরীর খুব খারাপ। গিটে গিটে ব্যাথা। বইসা আছি, বুঝতে পারতেসেন না, কুজা হইয়া হাঁটি। আমার অপেক্ষা শেষ, আমার রান্নাবান্না ও আজকে থেকে শেষ। এখন খালি বিশ্রাম”।
অসুস্থতার কথায় আমি উচ্চ ভোল্টের বিদ্যুতের শক খাবার মত চমকে উঠে হাত ছেড়ে দিলাম। কি করছি আমি? এই বৃদ্ধার হাত ধরে আছি কেন? এ আমার মিলি নয়, হতেই পারেনা। একসাথে বুড়ো যখন হতে পারিনি, তখন আর মিলিকে আমি এই রূপে এখন দেখতে চাইনা, আমার মনে ওর তরুণী ছবিটাই বেঁচে থাক।
” যান। আর আসবেন না। ”
” আসবো না মিলি ”
আমি দেখলাম বৃদ্ধা রমণীর চোখে তরুণী মেয়ের মত পানি চকচক করছে। সত্যিই ওকে এভাবে দেখতে আমি আর আসবোনা। কিন্তু সে যে আমাকে অর্ধ শতাব্দী মনে রেখেছে, তার বিনিময়ে আমিও আগামী অর্ধ শতাব্দী ওকে ভালোবাসবো।
সে আমাকে এগিয়ে দেয় উঠান পর্যন্ত, জালাল আমাকে দেখে শিশুদের মত হেসে হাত নাড়ে। আমি হাঁটতে শুরু করি এক বুক স্মৃতি বুকে নিয়ে , ছয় মাস আগের অথবা পঞ্চাশ বছর পরের জীবনে ফিরে যাবার জন্য।
সমাপ্ত।