#নক্ষত্রের_রূপালী_রাতে (পর্ব ২)
নুসরাত জাহান লিজা
“আগামীকাল ওরা বেশ কয়েকজন আসবে। ফুয়াদসহ। আংটি পরিয়ে যাবে, বিয়ের ডেট ফাইনাল হবে।”
গতকাল রাতে পৃথা আর মৃন্ময় যখন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিল, তখন বাবা বাসায় ছিলেন না। তিনি এসে রাতের খাবার খেয়ে পৃথার ঘরে এসে কথাটা বললেন।
পৃথা বলল, “বাবা, আমার একটা ডিসিশন জানানোর ছিল।”
“দেখ, ওদের কথা দিয়েছি। পিছিয়ে আসা সম্ভব নয়।”
“বিয়েটা আমার। তাই শেষ কথাটা আমার হওয়া উচিত। তাই না, বাবা?”
“তুই জীবন কতটা চিনিস?”
“জীবনকে কতটা চিনি সেটা তো জানি না বাবা! আমার মনে হয় কেউ-ই সেটা পুরোপুরি জানে না। তবে যেটুকু জানি, তাতে এটুকু বুঝি, জীবন ব্যাবসা নয়। নিজের ব্যাংকে কতটা প্রফিট যোগ হলো, তার চাইতে বড় বোধহয় মানসিক শান্তি। আর সেই শান্তির জন্য আত্মমর্যাদা ধরে রেখে শিরদাঁড়া সোজা রাখাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
“এই বয়সটায় রঙিন ঠুলি থাকে। আর কিছু শুনতে চাই না। কাল রেডি থাকিস।”
“আমি পালিয়ে যেতে চাই না বাবা। তাই নিজের সিদ্ধান্ত জানিয়ে যাচ্ছি। আমি আগামীকাল মৃন্ময়কে বিয়ে করছি। কাজী অফিসে। পারলে দোয়া কোরো।”
গর্জে উঠে পৃথার বাবা বললেন, “তুই কী করে যাস, আমি দেখব।”
“আমি প্রাপ্তবয়ষ্ক মানুষ। স্ব-ইচ্ছায় যাচ্ছি। তুমি চাইলেও আটকাতে পারবে না।”
“যদি যাস, একেবারে যাবি। আর কোনোদিন আমার চোখের সামনে আসবি না।”
“বাবা, তুমি যদি শুধুমাত্র আমার ভালো চিন্তা করে বিয়েটা ঠিক করতে, তোমার জন্য আমার শ্রদ্ধার জায়গাটা অটুট থাকত। এখন আর সেটা থাকল না।” এই প্রথম পৃথার গলা খানিকটা ভাঙা শোনালো যেন।
তবে এটা ভেঙে পড়ার সময় নয়। নতুন জীবন হাতছানি দিয়ে ওকে ডাকছিল। একটা ভীষণ শিশুর সারল্যে ভরা মুখ ওর জন্য নিজের সর্বস্ব নিয়ে অপেক্ষায় আছে।
***
সময় মতো বের হওয়াটা সম্ভব হলো না পৃথার। বাবা বিভিন্নভাবে বাঁধা দেবার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন। ওর ফোন খুঁজে পাওয়া গেল না।
এরমধ্যে মা নিজে এলেন ওর রুমে। তিনি বাবার কথাই শেষ কথা হিসেবে মানেন সবসময়। এই প্রথম তিনি নিজের মতামত প্রকাশ করলেন। একটা শাড়ি হাতে করে এনেছেন।
“ধুমধাম করে তোর বিয়ে দেবার ইচ্ছে ছিল আমার। সেই ভাগ্য তো হলো না। তোকে বউ সাজে দেখাও হলো না। তবুও বিয়ে করবি, সবার জন্য এটা একটা স্বরণীয় দিন। তুই এই শাড়িটা পর।”
একটা লাল জামদানী। পৃথা মা’কে জড়িয়ে ধরল প্রগাঢ় মমতায়। দু’জনের চোখেই অশ্রু।
“আমি পরিয়ে দিই?”
“দাও।”
তিনি একটা কানের দুল পরিয়ে দিচ্ছিলেন। পৃথা আপত্তি করল, “এসব কিছু নেব না, মা।”
“এটা আমার নিজের। তোর বাবা দেয়নি। তোর বিয়েতে মা হিসেবে একটা উপহার দেবার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করিস না মা।”
মেয়েকে সাজিয়ে দিলেন। সাজ শেষে পৃথার পুরো মুখে হাত বুলিয়ে নিজের হাতে চুমু খেলেন। মাথায় হাত দিয়ে প্রাণভরে আশীর্বাদ করলেন। এরপর একটা ছবি তুললেন নিজের মুঠোফোনে।
পৃথা সমস্ত পিছুটান কেটে বেরিয়ে এলো। বাবা বসার ঘরেই ছিলেন, কিন্তু একবারও তাকিয়ে দেখেননি।
***
কাজী অফিসের সামনে এসে বুকে কেমন ধুকপুকানি হচ্ছিল! সেটা অবশ্য বেশিক্ষণ রইল না। মৃন্ময় রাস্তায় বমি করছিল, সেদিকে ছুটে যেতে হলো। ও ঘাড়ে হাত রাখতেই, পেছনে তাকালো ছেলেটা। ওর এক কলিগ পানির বোতল হাতে দাঁড়িয়ে ছিল। কোনোরকমে মুখটা ধুয়ে পৃথাকে জড়িয়ে ধরল মৃন্ময়, স্থান কাল ভুলে।
মুহুর্তেই সম্বিত ফিরল, অপ্রস্তুত হয়ে পিছিয়েও এলো।
“শরীর বেশি খারাপ লাগছে?” উউৎকণ্ঠিত গলা পৃথার।
“এখন ঠিক আছি। চলো ভেতরে যাই। আমি ভয় পাচ্ছিলাম।”
হাসল মৃন্ময়, ছেলেটার হাসি এত চমৎকার! মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে পৃথার। ফুলগুলো পৃথার খোঁপায় গুঁজে দিল সে।
বিয়েটা অবশেষে সম্পন্ন হলো। পৃথার দুজন বান্ধবী এসেছে, আর মৃন্ময়ের একজন কলিগ সস্ত্রীক এসেছে।
“তোমার হাতটা একবার ধরি?”
পাশ থেকে পৃথার বন্ধু সৌমি বলল, “ভাইয়া, এখন পুরো মানুষটাই আপনার।” আরও কিছু দুষ্টুমি করতে চাইছিল, কিন্তু পৃথার মুখের দিকে তাকিয়ে থেমে গেল।
মৃন্ময় ভীষণ লজ্জা পেল, মুহুর্তের জন্য ঘোরের মধ্যে ভুলেই গিয়েছিল যে ওরা দু’জন এখানে একা নেই।
“লজ্জাবতী বউ দেখা যায়, লাজুক বরও দেখলাম এবার।” নওরীন বলল এবার।
পৃথা এবার আর কিছু বলল না। একবার মৃদু হেসে আলতো করে মৃন্ময়ের হাতটা ধরল। ছেলেটা ভরসা পেয়ে স্বাভাবিক হলো দ্রুত।
সবাই রেস্টুরেন্টে খাওয়াদাওয়া করল। এরপর মৃন্ময়ের বাসায় এলো।
মৃন্ময় যে চিলেকোঠার ঘরে থাকত, সেই বাড়িওয়ালা আর তার স্ত্রী থাকেন। এক মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলে দেশের বাইরে। সেখানেই পরিবার নিয়ে স্থায়ী হয়েছে। বুড়ো-বুড়ি একেবারেই নিঃসঙ্গ। তাই তারা তাদের অ্যাপার্টমেন্টের একটা ঘর ছেড়ে দিলেন। হয়তো একটা পরিবারের আশায় কিংবা একটু সঙ্গের।
ভাড়াটাও বেশ কম, রান্নাঘর শেয়ার করতে হয়। তবে খারাপ লাগে না। অল্প কিছুদিনেই দারুণ সখ্যতা গড়ে উঠেছে। টোনাটুনির সংসার চমৎকার কাটছিল। পৃথার চাকরি হলো বিয়ের চার মাসের মাথায়৷ মা মাঝেমধ্যে খোঁজখবর নেন।
মৃন্ময় কখনো ভাবতে পারেনি একটা মানুষের উপস্থিতি জীবনকে এতটা বদলে দিতে পারে, কেমন সুখ সুখ আবেশে সময় কাটছিল।
পৃথা ওকে সব দিক থেকে আগলে রাখছিল। জীবনের নতুন মানে আবিষ্কার করছিল প্রতিনিয়ত।
তবুও ধীরে ধীরে কোথাও যেন একটা সুর কেটে যাচ্ছিল। পৃথা উপলব্ধি করছিল, কিন্তু সমস্যাটা ঠিক কোথায়, তাই বুঝে উঠতে পারছিল না। মৃন্ময় যেন নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছিল।
***
মৃন্ময় ভীষণ সুখী ছিল পৃথাকে পেয়ে। পৃথার সর্বস্ব উজাড় করা ভালোবাসা সে প্রাণভরে গ্রহণ করছে, যত্নে করা রান্না খাচ্ছে, ঘর গুছিয়ে দিচ্ছে, ওকেও গুছিয়ে দিচ্ছে। এটাই একসময় মৃন্ময়ের হীনমন্যতার কারণ হলো।
মেয়েটা নিজের বাড়ি, আয়েসি জীবন ওর জন্য ত্যাগ করেছে। মুখ ফুটে না বললেও এটা নিয়ে মনে নিশ্চয়ই আক্ষেপ আছে। স্বার্থপরের মতো মৃন্ময় যেন কেবল নিজেরটাই ভেবে এসেছে। এই ভাবনা নিজের কাছেই যেন নিজেকে ছোট করে দিচ্ছিল।
এত স্বার্থপর তো সে কখনো ছিল না! সারাক্ষণ মনে হতো সে-ও পৃথার জন্য কিছু করে, চেষ্টাও করে। তবুও মনে হয় পৃথা ওর জন্য যা করছে, তার তুলনায় এটা বড়ই ঠুনকো, নগন্য। এই হীনমন্যতা ওকে ভেতরে ভেতরে শেষ করে দিচ্ছিল।
………
(ক্রমশ)