নক্ষত্রের রূপালী রাতে পর্ব-০৩ এবং শেষ পর্ব

0
168

#নক্ষত্রের_রূপালী_রাতে (শেষ পর্ব)
নুসরাত জাহান লিজা

কাজী অফিসের সেই দিনটার পর কেমন ম্যাজিকের মতো এক বছর কেটে গেল। আজ ওদের প্রথম বিবাহবার্ষিকী। কতকিছু ঘটেছে এরমধ্যে, তবুও সময়ের আয়নায় তাকালে মনে হয় এই তো সেদিন ওদের দেখা হলো, বিয়ে হলো। এতটা কাছাকাছি আসা, তবুও ইদানিং মনে হয়, কোথায় যেন একটা কিছু নেই৷ সবই আছে, ওই তো মৃন্ময় পাশে বসে, তবুও কীসের যেন একটা অভাব। পরস্পরের নিঃশ্বাস পর্যন্ত চেনা বলেই হয়তো সূক্ষ্ম একটা পরিবর্তনও এতটা স্পষ্ট।

পৃথা সরাসরি এখন অব্দি জিজ্ঞেস করেনি কিছু। ভেবেছে মৃন্ময় নিজে বলুক। ছেলেটা ধীরে ধীরে কেন এভাবে গুটিয়ে যাচ্ছে তার একটা ব্যাখ্যা সে নিজেই দিক।

ঘড়িতে রাত বারোটা সাতাশ। মানুষটা ঘুমিয়ে কাদা। বিবাহবার্ষিকীর প্রথম প্রহরের জন্য পৃথা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল একটা শুভাশিসের জন্য। হয়তো ভীষণ ক্লান্তিতেই ঘুমিয়ে পড়েছে। ইদানিং অফিসে খুব ব্যস্ততা নাকি মৃন্ময়ের।

পৃথাও ভীষণ ব্যস্ত। ঘর সামলে অফিস করা তো কম ঝক্কির নয়। তবুও দিন শেষে যখন দুজনে মুখোমুখি, তখন আর সেসব কিচ্ছু মনে থাকে না। ঝরঝরে সতেজ মনে হয় সব। পৃথা হাতের কাজ শিখেছে বাড়িওয়ালা আন্টির কাছ থেকে। সাত মাস আগে থেকে নিজের হাতে একটা সোয়েটার বুনছিল। দু’দিন আগে কাজ শেষ হয়েছে। প্রথম হিসেবে খারাপ হয়নি। নিজের হাতের ভালোবাসা মাখা স্পর্শ আছে এতে। এরচাইতে ভালো উপহার আজকের দিনের জন্য আর আছে বলে ওর মনে হয়নি।

মৃন্ময়ের কোনো অভিযোগ নেই, পৃথা যা রান্না করে দেয় তাই খেয়ে নেয় তৃপ্তি করে। সে মাঝেমধ্যে জিজ্ঞেস করে, “কেমন হয়েছে?”

“তুমি ভালোবেসে রান্না করেছ। খারাপ কী করে হয়?” মৃন্ময় হেসে সবসময় এভাবেই উত্তর দিয়েছে।

মাঝেমধ্যে ভীষণ পাগলামী করে নিজেই রান্না করত। বেশিরভাগ সময় মৃন্ময়-ই চা করে। ওর বানানো চা পৃথার অভ্যাস হয়ে গেছে। নিজের আর করতে ইচ্ছে করে না।

চানাচুর দিয়ে মুড়ি মাখিয়ে দেয় কোনো কোনোদিন। এটাও বেশ লাগে। আজকের দিনটা কী মনে আছে মৃন্ময়ের! ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আলো নিভিয়ে পৃথাও শুয়ে পড়ল। একটা হাতে আলতো করে জড়িয়ে নিল মানুষটাকে। ঘুমের মধ্যেও সে ঘন হয়ে এলো পৃথার দিকে, নিখাঁদ ভরসা আর অভ্যাসে।

***
মৃন্ময়ের ঘুম ভাঙল ভোরে। পৃথা ঘুমিয়ে আছে পাশে। একপাশে জানালার পর্দা টানা হয়নি। নতুন সূর্যের আবছা আলো জানালা গলে ভেতরে আসছে। পৃথার মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। চুলগুলো ছড়িয়ে আছে, অল্প কিছু চুল ডান দিকের চোখ ঢেকে দিয়েছে। আলতো হাতে মুখ থেকে চুল সরিয়ে সেদিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে রইল মৃন্ময়। ওর মনে হলো এভাবেই তাকিয়ে সে বাকি আয়ুষ্কাল পর্যন্ত কাটিয়ে দিতে পারবে, তবুও কোনো ক্লান্তি স্পর্শ করতে পারবে না ওকে। এই মুহূর্ত একান্তই ওর নিজের।

পাখির কিচিরমিচির ভেসে আসছে। যেকোনো সময় পৃথার ঘুম ভাঙবে। আজকের দিনটা মৃন্ময়ের মনে আছে। ওর জীবনের পরিপূর্ণ প্রাপ্তির দিন। সে কী করে ভুলে যাবে! রাতে অনেক চেষ্টা করেও জেগে থাকতে পারেনি। ইশ! নিশ্চয়ই মন খারাপ করেছে! এখানেই সে বারবার হেরে যায় পৃথার কাছে। স্ত্রী জাগার আগেই সে নিজেকে প্রস্তুত করতে চায়। জানে ওদিক থেকে অভিযোগ আসবে না, কখনো কোনো অনুযোগ নেই তার। কিন্তু মৃন্ময়ের খারাপ লাগছে। মন খারাপটা কাটিয়ে দিতে হবে।

বিছানা থেকে নেমে নিজেই সারপ্রাইজ পেল মৃন্ময়। একটা সুন্দর কাগজের প্যাকেট, তার উপরে লেখা ‘তোমার জন্য, মৃন্ময়। – পৃথা।’

প্যাকেট খুলে হতভম্ব, একদিন দেখেছিল পৃথার হাতে বুনতে। ওকে দেখে ঝটপট লুকিয়ে ফেলেছিল। সে সোয়েটারটা হাতে নিল, গায়ে গলাবার আগে কতক্ষণ মুখ গুঁজে রইল তাতে। সে আবেগপ্রবণ মানুষ। মেয়েটা দায়িত্ব নিয়ে ওকে আরও আবেগী করে দেয় বারবার।

গত তিন মাস মৃন্ময় খুব হিসেব করে টাকা খরচ করেছে। ওর এক কলিগ কিছু টাকা ধার নিয়েছিল, সেটাও ফেরত পেয়েছে। গতকাল একটা ছোট্ট লকেট দেয়া চেইন কিনেছে। বিয়ের সময় ভালো কিছু দেয়া হয়নি মেয়েটাকে। তাই এটা কিনেছে নিজে পছন্দ করে।

তবুও মনে হলো সে এবারও হেরে গেছে। দিনের পর দিন পৃথা কী সুন্দর ভালোবাসা মেখে এটা বুনেছে, আর সে…

এটার পাশে নিজের আনা উপহারটাকে নিতান্তই তুচ্ছ বলে মনে হলো। ভাবছিল এটাকে লুকিয়ে ফেলবে, কিন্তু হলো না। তার আগেই শুনল,

“মৃন্ময়, উঠে পড়েছ?”

মৃন্ময় দেখল পৃথা উঠে এসে ওর পাশে দাঁড়িয়েছে, গায়ে শাল জড়ানো।

“আমাদের যৌথ জীবন বহুকাল ধরে বেঁচে থাকুক।”

মৃন্ময়ের কথায় হাসি ফুটল পৃথার ঠোঁটে।

“সোয়েটার পছন্দ হয়েছে? প্রথম বানিয়েছি।”

“ভীষণ পছন্দ হয়েছে। আমি এটা আজ সারাদিন পরে থাকব। এরপর তুলে রাখব। আমাদের সন্তান হলে তারা দেখবে, তাদের বাবাকে তাদের মা কত ভালোবাসে।” বলতে বলতে লাজুক হাসল মৃন্ময়। আশ্চর্য, সে এখনো লজ্জা পায় গভীর অনুভূতি প্রকাশে!

রাঙা আভা সরে যেতে মৃন্ময়ের মুখে অস্বস্তির ছাপ দেখা গেল। এক আকাশ প্রমাণ দ্বিধা নিয়ে সে বলল, “তোমার মতো এতটা চমৎকার গিফট আমি আনতে পারিনি পৃথা। তবুও এটা তোমার জন্য।”

নিজের আনা উপহারটা বাড়িয়ে দিল পৃথার দিকে। পৃথা হাতে নিয়ে দেখল, এরপর বলল, “তোমার কেন মনে হলো এটা চমৎকার নয়?”

“তুমি নিজের হাতে বানিয়েছ, আর আমি.. ”

ওকে শেষ করতে না দিয়ে পৃথা বলল, “এটা কিনতে তোমার কতটা স্যাক্রিফাইস করতে হয়েছে, আমি জানি না ভেবেছ? গত কয়েকমাসে তোমাকে তোমার অনেক শখকে এড়িয়ে গেছ। এটা কি আমার প্রতি ভালোবাসা নয়?”

এভাবে মৃন্ময় ভেবে দেখেনি আগে। এবার খানিকটা সহজ হলো সে। পৃথা বলল, “এটা পরিয়ে দাও।”

মৃন্ময় গলায় পরিয়ে দিল। সে সত্যিই ভাগ্যবান। নইলে পৃথাকে সে কী করে পেল। মনে মনে শুকরিয়া করল।

“তোমার সাথে কিছু কথা আছে মৃন্ময়।”

“বলো না।”

“এখন না, রাতে বলব। সারাদিন আগে আমাদের দিনটা কাটুক। আমি কিন্তু ছুটি নিয়েছি।”

“আমিও।”

***
সারাদিন দু’জনে ঘুরল, পছন্দের আর স্মৃতির জায়গাগুলোতে। অনেকদিন পর আবারও দুজন খুব কাছাকাছি এলো। যে সূক্ষ্ম দূরত্ব এসেছিল তাও আজ অনুভূত হলো না।

আজ অনেকদিন পর মৃন্ময়কে বেশ প্রাণবন্ত মনে হলো। তবুও পৃথার মনে হলো কোনো গোপন অভিমান যদি থেকে থাকে, সেটা ক্লিয়ার হওয়া ভালো। আজকের এই ভালোবাসায় পরিপূর্ণ দিনে যা মনে হয়নি, দুদিন পরে যে মনে আসবে না তার নিশ্চয়তা কী! ছোট ছোট কাঁটাকে সুযোগ দেয়া উচিত নয়। সময় থাকতেই উপড়ে ফেলা উচিত। বিন্দু বিন্দু বালুকণা সম অভিমান জমতে দেয়া ঠিক হবে না, একদিন অভিমানের সিন্ধু হয়ে প্রতিবন্ধকতা তৈরির সুযোগ পৃথা দিতে চায় না।

দুপুরে বাসায় খেয়েছিল, রান্না দু’জনে মিলেই করেছে। পৃথা একবার না করেছিল, তাতে কিঞ্চিৎ মেঘ জমছিল সাহেবের মুখে!

রাতে বাইরে খেয়ে বাসায় এসেছে। খানিকটা রেস্ট নিয়ে পৃথা বলল, “চলো, ছাদে যাই।”

মৃন্ময় রাজি হলো। ছাদে আজ মস্ত এক চাঁদ উঠেছে। পৃথিবীপ্লাবি জোছনার রূপালী আলোয় ঝলমল করছে।

পৃথা বলল, “আজ কি পূর্ণিমা?”

“জানি না! কী সুন্দর!” উচ্ছ্বাস প্রকাশের সাথে সাথে খানিকটা চিন্তাও হচ্ছিল মৃন্ময়ের। কী বলবে পৃথা!

“মৃন্ময়, তুমি আমার কাছে কিচ্ছু লুকাবে না কিন্তু। যা জিজ্ঞেস করব, উত্তর দিতে হবে।”

এবার চিন্তা বাড়ল, “আমি তোমার কাছে কিচ্ছু লুকাই না।”

“সত্যিই তাই?” পৃথার অন্তর্ভেদী দৃষ্টি। ভেতরটা পড়ে নিচ্ছে যেন।

“আমাকে নিয়ে তুমি কোনো কমপ্লেক্সে ভুগছো?”

মৃন্ময় মুহূর্তে শান্ত হয়ে গেল। মেয়েটা ওকে খোলা বইয়ের মতো পড়তে পারে। আজ বলতেই হবে। মুহূর্ত খানেক তারা ভরা আকাশে উজ্জ্বল চাঁদের দিকে চেয়ে রইল নিষ্পলক। এরপর বড় করে শ্বাস টেনে মৃন্ময় বলল,

“পৃথা, আমি সেই ছেলেবেলা থেকে একাই বড় হয়েছি। আমি কারোর সাথে মিশতে পারতাম না। আমার রেজাল্ট খুব ভালো হতো বলে কয়েকজন বন্ধুত্ব করত যাতে পরীক্ষায় তাদের সাহায্য করি। আমি মন খুলে কথা বলতে পারতাম না। একসময় দেখলাম আমার এই দুর্বলতা অন্যদের চোখে হাসির খোরাক। আমার ভীষণ কষ্ট হতো। সেসব প্রকাশ করতে পারতাম না। কার কাছে বলব! আমার তেমন কেউ ছিল না। না কোনো বন্ধু, না শুভাকাঙ্ক্ষী। একসময় গুটিয়ে গেলাম নিজের মধ্যে। স্কুল শেষ করে কলেজ, ইউনিভার্সিটি শেষ হলো। কেউ হয়তো সহানুভূতি দেখাত। কিন্তু আগলে রাখার মতো কেউ হয়নি। পড়া শেষে মেসে উঠলাম। তখন একটা চাকরির জন্য মরিয়া ছিলাম। একদিন আচমকা তোমার সাথে দেখা হলো। আমার জীবনের সবচাইতে সুন্দর মুহূর্ত সেটা।”

খানিকটা থেমে দম নিল মৃন্ময়। ওর বাবা-মা পালিয়ে বিয়ে করেছিল। কোনো পরিবার থেকে মেনে নেয়নি। একটা সড়ক দুর্ঘটনায় তারা চলে যান। ওর দাদি এরপর ওকে নিয়ে যান। ওর পড়াশোনা করান। ওর ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার পরে তিনিও চলে যান। এরপর সে টিউশনি করে পড়াশোনা শেষ করে।

“তোমার জন্য আমি আবারও বাঁচার অবলম্বন পেলাম। আমি ভীষণ ভয় পাই পৃথা। তোমাকে হারাবার ভয়ে আমি তটস্থ থাকি। আমার মনে হয়, তুমি এত স্যাক্রিফাইস করছ আমার জন্য। আমি কেবল নিয়েই যাচ্ছি। এরজন্য যদি একসময় আমি তোমার বিরক্তির কারণ হই। তাহলে তুমি… আমি জানি এটা ভুল ভাবনা। কিন্তু এতটা ভালোবাসা পেয়ে আমি অভ্যস্ত নই। আমি শেষ হয়ে যাব, বিশ্বাস করো।”

পৃথা এগিয়ে এসে মৃন্ময়ের হাত ধরে বসালো। এরপর নিজেও পাশে বসল। মৃন্ময়ের কাঁধে নিজের মাথাটা রাখল। হাত দুটো এখনো ওর হাতে ধরা। এরপর মৃদু গলায় বলল,

“মৃন্ময়, তুমি কেবল আমি আমি বলে ভাবছ বলেই এসব অযাচিত চিন্তা তোমার মাথায় এসেছে। আমি যা করছি, তা আমাদের জন্য করছি। আমাদের দু’জনের ভালো থাকার জন্য করছি। দাম্পত্যে আমিত্বের জায়গা নেই। কবেই আমি ছেড়ে আমরা হয়েছি, তুমি জানো না? তুমি ভালো না থাকলে আমিও ভালো থাকি না, আমি ভালো না থাকলে তুমিও না। আমরা এক সাথে আছি। বিশ্বাস করো, আমি ভীষণ সুখী তোমার সাথে। আমিও তোমার যত্ন ভালোবাসা অনুভব করি, যতটা তুমি আমারটা করো। কিন্তু তুমি যদি এই ভাবনা থেকে না বেরিয়ে আসতে পারো, তাহলে অবশ্যই আমি বিরক্ত হবো। আমাদের মধ্যে দূরত্ব আসবে। আমরা না চাইলেও আসবে। তুমি কি এটা চাও?”

মৃন্ময় চায় না, তবে উত্তর দিল না। প্রগাঢ় হলো আলিঙ্গন। ভুল চিন্তাগুলো ছাড়াতে সময় লাগবে হয়তো। তবে সে জানে একজন ওর পাশে থাকবে, ওর ভালোয়, ওর মন্দে, ওর সুখে, ওর বিষাদে। সে-ও থাকবে তার পাশে। ওরা তো এখন একা নয়, পরস্পরের!

“আমাদের সন্তানদের শুধু মায়ের ভালোবাসা দেখলে হবে, বাবার ভালোবাসা দেখবে না? প্রথমজন কিন্তু আগমনী বার্তা পাঠিয়েছে!”

মৃন্ময় বিস্মিত হতেও ভুলে গেল যেন। এক অপার্থিব সুখে সে ভেসে গেল। জীবনানন্দের নক্ষত্রের আগুন ভরা রুপালি রাত, এই মৃদু বাতাস, আকাশ ভরা তারার সাক্ষী রইল কেবল।
……….
সমাপ্ত