নীলাঞ্জনা পর্ব-০৩

0
294

#নীলাঞ্জনা
#পর্ব_৩
#লেখনীতে_শুভ্রতা_জাহান

খালামনিকে বাড়ি আনা হয়েছে। সাথে তার কিউট বাচ্চা ছেলে বাবুটা। নীলের চেহারার সাথে মিল না থাকলেও দুজনেই প্রচন্ড সুন্দর। মানে যাকে বলে ভয়ংকর সুন্দর আরকি। নীলের ঠোঁট কান্না করার পরে যেমন লাল হয়ে যায়, ওর ভাইয়ের ঠোঁট দুটোও হয়েছে তেমন। বাড়ির সবাই ব্যাস্ত খালামনি আর তার বাবু নিয়ে। দাদি তো আসার পরে বাচ্চাটা কোলে নিয়েছেন আর ছাড়ছেনই না। এদিকে নীলময়ীকে তুলে দেওয়া হয়েছে আমার ঘাড়ে! আমার ঘাড়ে বসে আছেন গলা জড়িয়ে ধরে। কিন্তু কথা বলছে না কেনো? এ মেয়ে তো চুপ থাকার পাত্রী নয়। হলোটা কি এর! আমি একথা মনে মনে বলতে না বলতেই তার কণ্ঠস্বর কানে এলো।

“নবু নবু..”

“আমি নভ বেদ্দপ, নবু নই।”

“তুমি আমাতে বতে দিলে?”

“না আফা। এত সাহস আছে নাকি আমার যে আপনাকে বকে দেবো! বলুন কি বলছিলেন।”

“বলতিলাম তি আমি আম্মুল তাছে জাবু।”

“আচ্ছা চল।”

নীলকে ঘাড়ে নিয়েই হাঁটা ধরলাম ঘরের দিকে। উদ্দেশ্য এই বিচ্ছুকে খালামনির কাছে দিয়ে আসবো। ঘরে ঢুকতে দেখা মিললো আম্মুর। কোথায় যাচ্ছি জিজ্ঞেস করলে জানালাম নীল খালামনির কাছে যাওয়ার জন্য বায়না করছে। আম্মু আর কিছু বললেন না। চলে গেলেন বাইরে। আমিও ভেতরে ঢুকলাম। গিয়ে নীলকে খালামনির পাশে বসিয়ে দিলে তিনি কেমন করে যেন তাকালেন। কিন্তু কিছু বললেন না। অদ্ভুত ঠেকলো আমার কাছে। এবাড়িতে আসার পর থেকে দেখেছি খালামনি নীলকে অনেক ভালোবাসেন, না একটু বেশিই ভালোবাসেন। সকলের খুব আদরের নীল। এমনকি আমার বাবা মাও তাকে খুব ভালোবাসে কারণ আমার কোনো বোন নেই। আর কখনো নাকি হবেও না। ডাক্তার বলেছেন আম্মুর আর বাবু হবে না। এগুলো আমাকে বাড়ির কেউ বলেনি। আমি কাকিমাদের বলতে শুনেছি। সর্বোপরি নীল সবার কাছেই আদরের দুলালী। সেই আদরের নীলকে পাশে দেখে যেখানে খালামনির জাপটে ধরার কথা সেখানে তিনি মুখ ফিরিয়ে নিলেন! এটা কীভাবে সম্ভব? একটু না অনেকটাই অবাক হলাম আমি।

“আম্মু আম্মু ভাইতে আমাল তোলে দেবে ইত্তু?”

খালামনি চোখমুখ কঠিন করে বললেন,
“না তুমি দূরে থাকবে ওর থেকে। ছোঁবে না আমার ছেলেকে তুমি। বুঝেছো?”

খালামনির কথাগুলো কেমন যেন ঠেকলো। তারপরেও নীলকে মাথা নেড়ে সায় দিতে দেখলাম। আমার সাথে সাথে বোধহয় খালুজানের ফুফুও অবাক হয়েছেন। তিনি বললেন,
“কিরে বউ আমার নাতিনডার লগে এমনে কতা কস ক্যারে?”

খালামনি যেন একটু বেকায়দায় পড়লেন। আবার নিজেকে সামলে বললেন,
“ও তো ছোট মানুষ ফুফু। ওর কাছ থেকে পড়ে যাবে বাচ্চাটা।”

খালামনির ব্যবহার কেমন চোরা চোরা লাগছে। হ্যাঁ এটা ঠিক নীল ছোট কিন্তু এখানে তো সবাই আছে। পড়ে যেতে গেলে ধরতে পারবে। আবার নীল খালামনির কাছে যেতে গেলে তিনি হাত দিয়ে সরিয়ে দিলেন। আর কেউ খেয়াল না করলেও আমার চোখ এড়ালো না। আম্মুকে কি একবার বলবো? পরে যদি বলে তুমি ছোট মানুষ ভুল দেখেছো? না একবার বলেই দেখি গিয়ে।
বাইরে গিয়ে আম্মুকে খুঁজে বললাম সব কথা। বাবাও পাশে দাঁড়ানো ছিলেন। আমার কথা শুনে দুজনেই কেমন চিন্তিত হয়ে গেলেন। আবার বললেন খালুজান বাজার থেকে আসলে নাকি তাকে কিছু বলতে হবে। কি বলতে হবে তা আমার সামনে আর খোলসা করলেন না। অবস্থা সুবিধার লাগছে না। খালামনির চোখমুখ কেমন যেন ছিলো যখন উনি নীলের সাথে কথা বলেন। নীলকে আমার কাছে নিয়ে আসবো ভেবে আবারো গেলাম ঘরের দিকে। দরজার কাছে যেতেই আপনা আপনি থেমে গেলো পা জোড়া। খালামনিকে নীল জড়িয়ে ধরায় তিনি ওকে হাত ধরে উঁচু করে বিসানা থেকে নামিয়ে ধাক্কা মারলেন। বাচ্চা মানুষ ধাক্কা না সামলাতে পেরে নিচে বসে পড়েছে নীল। খালামনির ফুফু শাশুড়িও ততক্ষণে কোথাও চলে গেছেন তাই ঘর ফাঁকা।থেকে থেকে ফুলাচ্ছে ঠোঁট। ভীষণ রকম মায়া লাগলো আমার। দৌড়ে গিয়ে কোলে তুলে নিলাম।

“তুমি ওকে ফেলে কেনো দিলে খালামনি?”

“ও আমার ছেলেকে ফেলে দিতে গেছিলো নভ। তুমি ওকে নিয়ে যাও এখান থেকে। আমার কাছে যেন আর না আসে।”

অথচ আমি স্পষ্ট দেখলাম নীল শুধু খালামনিকে জড়িয়ে ধরেছে, বাবুকে স্পর্শও করেনি। খালামনি কি অবলীলায় মিথ্যা অপবাদ দিয়ে দিলেন এইটুকু একটা বাচ্চাকে। তাও তার নিজের মেয়ে! কথা না বাড়িয়ে নীলকে কোলে নিয়েই বাইরে বেরিয়ে এলাম। সেখানে আম্মুকে দেখতে পেয়ে বললাম সব আবারও। কীভাবে তার বোন মিথ্যা অপবাদ দিলো মেয়েটাকে। এখনো আমার কাঁধে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে চলেছে।
আমার কথা শুনে আম্মু খালামনির কাছে গিয়ে নীলকে ফেলে দেওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বললেন আমি নাকি বানিয়ে বানিয়ে বলেছি। তিনি ধাক্কা দেননি বরং নীল ওনার ছেলেকে ফেলে দিয়ে নিজেই মাটিতে বসে পড়েছে। আম্মু জানেন আমি কখনো মিথ্যা বলি না। তবুও তর্ক করলেন না খালামনির সাথে। কিছুক্ষণ পরে খালুজান বাসায় এলেন। আমার কাছ থেকে নীলকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করলেন কিছুক্ষণ। এরপর বাজারের ব্যাগ তার ফুফুর হাতে দিয়ে ঘরে যাবেন এমন সময় আম্মু আর বাবা তাকে ডাক দিলেন। বললেন পুকুর পাড়ের দিকে যেতে। চলে গেলেন তিনজনই। যাওয়ার আগে আমাকে বলে গেলেন নীলের খেয়াল রাখতে। আমিও আর এত কিছু না ভেবে ঠান্ডা মস্তিষ্কে নীলময়ীর সাথে দুষ্টুমি করতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লাম।

চিন্তিত সুরে বললেন আনোয়ারা বেগম
“ভাইজান সমস্যা তো একটা হয়ে গেছে।”

“কি হইছে আপা? আপনারে অস্থির লাগে ক্যান?”

“আপনার মনে আছে হাসপাতালে জ্ঞান ফেরার আয়রা নীলাঞ্জনা আমার মেয়ে বলে তারপর হঠাৎ চুপচাপ হয়ে গেলো?”

“হ মনে থাকবো না ক্যান। ঐডা তো আয়রা ঘুমের ঘোরে কইছে। ঐডা নিয়া আবার কি হইলো?”

বিষণ্ণ মুখে আনোয়ারা বললেন
“তখন তো আমরাও ভেবেছিলাম অসুস্থ অবস্থায় ঘুমের ঘোরে ভুলভাল বলেছে কিন্তু সেটা ভুল প্রমাণিত হয়েছে।”

অবাক বদনে নওশাদ শেখ জানতে চাইলেন এসবের মানে কি? তার প্রশ্নে এবার মুখ খুললেন নিহাল সওদাগর..

“তোর স্ত্রী তো নীলাঞ্জনাকে সহ্যই করতে পারছে না। প্রথমে তার ছেলের কাছে যেতে, ছেলেকে ছুঁতে বারণ করেছে। আর তারপর নীলাঞ্জনা মামনি তাকে জড়িয়ে ধরতে গেলে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে। মেয়েটার সে কি কান্না ঠোঁট ফুলিয়ে ফুলিয়ে। তুই আসার কিছুক্ষণ আগেই নভ আর ওর আম্মু মিলে থামালো।”

নিহাল সওদাগরের কথা কর্ণকুহরে পৌঁছানো মাত্রই যেন নওশাদ শেখের চোখ অক্ষীকোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। যে আয়রা নীলাঞ্জনার গায়ে ফুলের টোকা অবধি লাগতে দিতো না সে নীলাঞ্জনাকে ধাক্কা দিয়েছে? বিশ্বাস হতে চায় না তার। আমতা আমতা করে বলে,
“তাইলে অহন কি করবো আমি নিহাল? তুই তো জানো নীলের মধ্যে আমি ছোট থেইকা আমার আম্মারে খুঁইজা পাই। অর কিছু হইলে আমি বাঁচবো ক্যামনে?”

নওশাদ শেখের কথা শুনে তার প্রিয় বন্ধু নিহাল সওদাগর ভরসা দিয়ে বললেন চিন্তা না করতে। তিনি আর তার স্ত্রী আনোয়ারা যতদিন আছেন নীলের কিছু হতে দেবেন না। আরো বললেন হাসপাতালে যেন খোঁজ নেন নওশাদ শেখ। কেনো তার স্ত্রী নীলাঞ্জনাকে নিজের মেয়ে মানছেন না? কিছু তো অবশ্যই কারণ আছে এর পেছনে! কি সেই কারণ? জানতেই হবে আমাদের।

এদিকে নীলাঞ্জনা মেতে আছে নভর সাথে খুনসুটিতে। আধো আধো বুলিতে সে কথা বলছে আর তা শুনে অনবরত হেসে চলেছে নভ। তা দেখে আবার রাগে ফুসে উঠছে নীলাঞ্জনা। তার কথায় হাসবে কেনো হুম? কোমরে হাত রেখে গম্ভীর কণ্ঠে সুধালো নীলাঞ্জনা

“তুমি আমাল ততা ছুনে হাচছো তেনো নবু?”

নীলাঞ্জনার কথা শুনে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লাম আমি। ভাই অনেক শখ করে নাকি আমার জন্মের পর আম্মু নামটা রাখছিলো। ১৫ দিন ধরে ভেবে ভেবে ঠিক করেছিলো নামটা। নভ সওদাগর, আহ কত সুন্দর। অথচ এই নীলময়ী বিবি দুদিনে আমার নামটার ইন্নালিল্লাহ করে দিলো! এত অত্যাচার করেও সাধ মিটলো না? খেয়ে দিলো আমার নামটা ! কি লাভ বেঁচে থেকে?

চলবে…?