#নীলাঞ্জনা
#পর্ব_১৫
#লেখনীতে_শুভ্রতা(প্রাণ)
সবার সামনে মাথা নিচু করে কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অভ্র। বাড়ির সবাই হতবাক হয়ে চেয়ে আছে তার পানে। চোখে মুখে তাঁদের হাজারো প্রশ্ন। অভ্র তো নিউইয়র্ক গেছিলো তবে এখানে কি করে? আর তাছাড়া সে লুকিয়ে বিয়ে দেখছিলো কেনো? রওনক সাহেব ও রেহমাম সাহেব প্রচন্ড রেগে আছেন অভ্রর ওপর। শুধু বিয়ে বাড়ি বলে কিছু বলছেন না। ঠিক করেছেন নীল আর নভর বিয়েটা হয়ে যাওয়ার পর সব মিটমাট করবেন। এদিকে নিহা তো প্রচন্ড অবাক। এই লোকটা আকশার বাড়ির ছেলে? তাহলে লুকিয়ে ছিলো কেন? যাই হোক দেখতে কিন্তু কিউট আছে!
অতঃপর নীল-নভর বিয়ে পড়ানো হয়ে গেলো। রেহানাকে শশুর বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিদায় বেলায় বাবা, মা, ভাইবোন, ফুপ্পি, বাবাই সবাইকে জড়িয়ে ধরে অনেক কান্না করেছে রেহানা। ছোট থেকে যেই মানুষ গুলোর সাথে বেড়ে উঠেছে, সুখে-দুঃখে সাথে থেকেছে আজ তাঁদের থেকে দূরে চলে যেতে হচ্ছে। এ কেমন নিয়ম প্রকৃতির? মেয়েদেরই কেন পরিচিত পরিবেশ, আপন মানুষ গুলোকে ছেড়ে অপরিচিতকে আপন করে নিতে হয়? তাঁদেরই কেনো সব ত্যাগ করতে হয় সবসময়? এগুলো ভেবে লাভ কি? সেই তো যেতেই হবে!
রেহানার বিদায়ের পরও নভ, নীল, নিহা, নয়ন থেকে গেছে। বাকিরা রেহানার বিদায়ের পরপরই বিদায় নিলেও নীল তার অভ্রদার কাহিনী না শুনে যেতে নারাজ। নভও দ্বিমত করেনি। আর নিহার তো দ্বিমত করার প্রশ্নই আসে না। জামাই খুঁজে পেয়েছে কি না!
সব ঝামেলা মিটিয়ে অভ্রকে চেপে ধরলেন রওনক আকশার।
“কি ব্যাপার অভ্র! তুমি না নিউইয়র্ক গেলে? সেখানে নাকি তোমার ভীষণ জরুরি কাজ পড়েছিল যার কারণে তুমি আমার মেয়েদের বিয়েতে থাকতে পারলে না!”
ভাইয়ের কথায় তাল মিলান রেহমান সাহেবও।
“হ্যাঁ আর তুমি তো বলেছিলে কাজ শেষ হতে নাকি অনেকটা সময় লাগবে। আর যদিও বা আগে আগে শেষ হয়েও যায়! তুমি লুকিয়ে কেনো ছিলে?”
বাড়ির বাকিরাও জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে আছে অভ্র কি বলে তা জানতে। এদিকে অভ্র তো না পারে নিহাকে খেয়ে ফেলতে। কি দরকার ছিলো মেয়েটার পাকামো করার? বেশ তো সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বোনদের বিয়ে দেখছিলো। এই মেয়ে না টেনে আনলে কেউই জানতে পারতো না তার আসার ব্যাপারে। মহা বিচ্ছু মেয়ে তো। আবার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসছে!
“অ্যাকচুয়ালি বাবাই কাজ শেষ হয়ে গেছে।”
ছেলের কথা শুনে ভ্রু কুঁচকান আয়শা বেগম।
“বেশ তো কাজ শেষ হয়েছে বাড়ি ফিরেছিস। তাহলে লুকিয়ে কেন?”
অভ্র একটু থতমত খেয়ে গেছে যেন।
“আমি আসলে ইয়ে মানে সারপ্রাইস মা সারপ্রাইস।”
রেহমান সাহেব, রওনক সাহেব দুজনই তেতে ওঠেন। তোমার সারপ্রাইস এর নিকুচি করেছি। মানুষকে এভাবে কেনো টেনশন দেবে হ্যাঁ? এগুলোর মানে কি! সবার চোখ রাঙানিতে ভড়কে যায় অভ্র।
“আরে বলছি তো সারপ্রাইস। ট্রাস্ট মি বাবাই।”
এত কিছুর মাঝেও এতক্ষণ নির্বিকার ছিলো নীল। বাকিরাও অভ্রকে আবারও চেপে ধরবে তার আগেই নীল থামিয়ে দেয়।
নিজের ঘরে যেতে যেতে বলে
“অভ্রদা আমার রুমে এসো একটু। তোমার থেকে গিফট নেওয়া বাকি এখনো। বাকিরা এখানে থাকো, আমি আসছি।”
সবাই ভাবে ভাইবোন যেহেতু বলছে তাই আর কিছু না বলাই ভালো। সকলে থেকে যায় ড্রয়িং রুমে। অভ্রকে নিয়ে নিজের ঘরে চলে যায় নীল।
নিজের ঘরে ঢুকেই টেবিলের ড্রয়ার থেকে কিছু বের করতে থাকে নীল। সেই মুহূর্তে অভ্র ঘরে ঢোকে। পিছে না ফিরেই নীল বলে
“তুমি যে নিউইয়র্ক যাওনি তা কিন্তু আমি জানি অভ্রদা।”
নীলের কথায় চমকে ওঠে অভ্র। এ কথা তো সে ছাড়া দ্বিতীয় কেউ জানে না। জানার কথাও না। তাহলে নীল কীভাবে জানলো?
“মানে কি বলছিস কি তুই? নিউইয়র্ক যাইনি তো কোথায় ছিলাম এত দিন?”
এবার সামনে ফেরে নীল।
“সেটা তো বলতে পারবো না অভ্রদা কিন্তু যাওনি এটা শিওর।”
কিছুটা ধমকে ওঠে অভ্র
“বাজে কথা বলিস না মহু।”
এই প্রথম অভ্র নীলকে মহু বলে ডাকলো। অবাক হয় নীল।
“এতটা পর করে দিলে আমাকে? এমন স্বার্থপর কীভাবে হলে অভ্রদা?”
আড়চোখে একবার নীলকে দেখে অভ্র। সাদা বেনারসিতে চমৎকার লাগছে মেয়েটাকে। এসব কি ভাবছে অভ্র! নভর স্ত্রী এখন নীলাঞ্জনা।
অভ্রকে চুপ থাকতে দেখে নীল হাতে কিছু একটা দেখিয়ে বলে
“এটা তোমার তরফ থেকে গিফট হিসেবে নিয়ে গেলাম আমি। পারলে মাফ করে দিও। আর হ্যাঁ নিজেকে সুযোগ দাও, তোমার এভাবে পালিয়ে বেড়ানো মানায় না। আমি আমার আগের অভ্রদাকে দেখতে চাই। যে কিনা সব রকম পরিস্থিতিতেই নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে জানে।”
কথা গুলো বলে বেরিয়ে যায় নীল। অভ্র সেখানেই দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকে। আসলেই তো! অভ্র আকশার তো এভাবে পালিয়ে বেড়ানোর মানুষ নয়। নাহ সে পালাবে না। নিজেকে সুযোগ দেবে নতুন করে অভ্র। মনে মনে নীলের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানায় অভ্র। নীল এভাবে না বললে হয়তো অভ্র সারাজীবন নিজের কাছে ছোট হয়ে থেকে যেত।
নীল ঘর থেকে বেরিয়েই দেখা পায় নভর। হয়তো তাকেই ডাকতে এসেছিলো। নভ মুচকি হাসি দেয় নীলকে দেখে। তারপর একসাথে এগিয়ে যায় সবার উদ্দেশ্যে। বাড়ির লোকদের থেকে বিদায় নিয়ে রওনা হয় গ্রামের দিকে। আকশার বাড়ি থেকে নীলের সাথে অভ্র আর পিয়ালকে পাঠানো হয়। যদিও অভ্র রাজি ছিলো না কিন্তু নীল বলার পর আর না করতে পারেনি। এদিকে অভ্র যাচ্ছে দেখে নিহার মনে যেন লাড্ডু ফুটতে শুরু করেছে। গাড়িতে পাশাপাশি বসে ব্যাপক জ্বালিয়েছে নিহা অভ্রকে। বেচারা অভ্র না পারছে সহ্য করতে আর না পারছে কিছু বলতে। হুদাই রাগে ফুসছে।
গ্রামে পৌঁছাতে বেশ কিছুটা রাত হয় নভদের। সবাই প্রচন্ড ক্লান্ত। বাকি সব ঝামেলা মিটিয়ে যখন নভ ঘরে ঢুকতে যাবে অমনি দেখে তার রুমের সামনে চাঁদের হাঁট বসেছে। পিয়াল, নয়ন, নিহা, অভ্র সহ নভর বাকি কাজিন গুলো সব দাঁত কেলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আল্লাহ আল্লাহ করতে করতে তাঁদের সামনে গিয়ে নভ নিজেও একটা ভোলাভালা হাসি দেয়। তা দেখে পিয়াল খোঁচা মেরে বলে
“হাসলে কাজ হবে না ব্রো।”
নভ বেশ নার্ভাস হয়েই বলে
“তো কি করবো? আর এভাবে রুমের সামনে কেন দাঁড়িয়ে আছিস? সর আমি টায়ার্ড অনেক।”
নিহা নিজের চুল নিয়ে খেলতে খেলতে বলে
“ফেলো কড়ি মাখো তেল।”
ভ্রু কুঁচকায় নভ।
“মানে কি?”
সবাই একসাথে বলে ওঠে
“টাকা ছাড় ভাই।”
“কিসের টাকা? আমার কাছে কোনো টাকা পয়সা নেই। আর অভ্র তোর লজ্জা লাগছে না বোন জামাই এর কাছে টাকা চাইতে? তাও ছোট বোন!”
ঠোঁট বাকিয়ে হাসে অভ্র।
“বোন ততক্ষণ ছিলো যতক্ষণ সে আকশার বাড়িতে ছিলো। এখন বন্ধু সে সওদাগর বাড়িতে আছে। বন্ধুর বাসরে তো টাকা চাইবোই। এতে লজ্জার কি আছে?”
চোখ মুখ বিকৃত করে ফেলে নভ। ভালো মতোই ফেঁসে গেছে বুঝতে পেরে পকেটে থেকে ওয়ালেট বের করে দিয়ে দেয়। তারাও দরজা ছেড়ে দেয়।
“সব এক একটা মহা ছ্যাচড়া।”
কথাটা বলেই মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেয় নভ। দরজা লাগানোর শব্দে কিছুটা কেঁপে ওঠে নীল। নভ এগিয়ে গিয়ে তার ঘোমটা তুলে বলে
“মাশাআল্লাহ। হামারে ঘার পে তো চান্দ উতার গায়ে। লাগতা হ্যায় গালতি সে চান্দ আসমা কি বাদলে মে ইহাপে চালি আয়া।”
নভর কথায় ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে নীল
“মানে?”
মুচকি হাসে নভ।
“বলছি যে আমার ঘরে তো আজ চাঁদ উঠেছে। মনে হচ্ছে আকাশে যাওয়ার বদলে সে ভুলে আমার ঘরে এসে গেছে।”
নভর এমন কথাতে লজ্জা পায় নীল। তা দেখে নভ হেসে বলে
“যাও শাড়ি বলদে নিয়ে ওযু করে এসো। নামাজ পড়তে হবে।”
হঠাৎ তুমি বলায় অবাক হয় নীল। আগে যতবার কথা হয়েছে প্রত্যেকবারই নভ তুই করে বলেছে তাহলে আজ তুমি কেনো? নীলের দৃষ্টিতে বোধহয় বুঝতে পারে নভ তার মনের কথা।
“আরে আগে তো বউ ছিলে না তাই তুই বলতাম। এখন বউকে কি তুই বললে চলে বলো?”
মাথা নাড়ে নীল। অর্থাৎ না।
“হ্যাঁ এবার যাও তাড়াতাড়ি।”
বেড থেকে নেমে শাড়ি বদলে ওযু করে আসে নীল। অতঃপর এক সাথে নামাজ পড়ে দেয় দুইজন। তারপর নীলকে অবাক করে দিয়ে তাকে কোলে তুলে নেয় নভ। নীল কিছু বলতে গেলে ইশারায় চুপ থাকতে বলে নভ। তাকে কোলে নিয়েই সোজা চলে যায় ছাদে। নীলকে বসিয়ে দিয়ে নভ নিজেও পাশে বসে পড়ে। অতঃপর নীলের মাথাত নিজের কাঁধে রেখে বলতে শুরু করে।
“গল্প শুনবে নীলাঞ্জনা?”
নভর কথায় নীল একটু অবাকই হয় বটে। যেখানে সব ছেলেরা বাসর রাতে অস্থির হয়ে থাকে তখন স্ত্রীর ওপর নিজের পুরুষত্ব ফলাবে তার জন্য সেখানে এই ছেলে কিনা তাকে কোলে করে ছাদে নিয়ে এলো। এখন আবার বলছে গল্প শুনতে চাই কি না! অদ্ভুত তো!
তবু মুখে হ্যাঁ বলে সে।
“খালামনির মেয়ে হওয়ার তিন বছর পর যখন আমি তাঁদের বাড়িতে আসি তখন মেয়েটা ঠিক করে কথা বলতে পারতো না। মানে একটু তোতলা ছিলো আরকি। কিছু বাচ্চা হয় না ছোটবেলায় একটু আধো আধো কথা বলে? তেমন। প্রথম তার কথা শুনে তো অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছিলাম আমি আর বাবা। তারপর সেই পিচ্চির কি রাগ! আমাকে বলে আমি নাকি অসভ্য। হাহাহা। তারপর বাবার কাছে পুতুল চাইলে আমি যখন বললাম বাবা দেবেন না তখন ঠোঁট ফুলিয়ে সে কি কান্না। তাই নিয়ে বকা খেলাম আমি। এরপরে আস্তে আস্তে তার সাথে যখন ভাব হলো তখন সে প্রতিশোধ স্বরূপ আমার সুন্দর নামটা খেয়ে দিলো।”
এটুকু শুনেই প্রশ্ন করে বসে নীল।
“খেয়ে দিলো মানে?”
প্রশ্নটা শুনে বেশ জোরেই হেসে ফেলে নভ। তা দেখে গাল ফুলায় নীল।
নভ আবার শুরু করে।
“নভ সওদাগর থেকে বানিয়ে দিলো নবু ছদাগল! বারবার করে বলতাম আমি নবু নই নভ। সে বলে সে নাকি নভই বলছে! আরে বইন তাহলে নবু কে বলছে?”
এবার বুঝতে পারে নীল। নভ তার গল্পই তাকে শুনাচ্ছে।
“এই এই আপনি কি আমাকে অপমান করছেন ছোটবেলায় একটু তোতলা ছিলাম বলে?”
“আরে নাহ শুনবে তো আগে।”
ঠোঁট ফুলিয়ে রেখেই বসে থাকে নীল। নভ বলতে থাকে তার মতো।
“খালামনি ছাড়া বাকি সবাই প্রচন্ড ভালোবাসতো আমার নীলময়ী পিচ্চিটাকে। এমন কোনো আবদার ছিলো না যা আমরা পূরণ করিনি। আমাকে স্কুল থেকে নৌকা ভ্রমণে যেতে দেখে সেও বায়না ধরে যাওয়ার জন্য। তখন খালুজান ঠিক করেন তার পঞ্চম জন্মদিনে সবাই যাবো আমরা। গিয়েছিলামও। কিন্তু কে জানতো সেদিনই আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে যাবে আমাদের পরিটা? সে যাওয়ার পর থেকে বাবা আর খালুজান দুজনেই চুপচাপ হয়ে যান। সাথে আমি নিজেও। তারপর আস্তে আস্তে ধাতস্ত হই। তখন থেকে প্রতিটা রাতে সে স্বপ্নে এসে তার আধো বুলি ছড়িয়ে জ্বালিয়ে মারতো আমাকে। ঘুমোতে দিতো না। তার সেই বড় বড় চোখের মায়ায় পড়ে আর কাউকে ভালো লাগেনি পরবর্তীতে। স্কুল, কলেজ এমনকি ভার্সিটি জীবন শেষ হলেও প্রেম করা হয়ে ওঠেনি। হবে কীভাবে? আমি তো আটকে ছিলাম সেই নীলময়ীতে। এরপরে হঠাৎ কীভাবে যেন তার সাথেই বিয়ে ঠিক হয়ে যায় আমার। আর এখন এখানে তার সাথে!”
কথা শেষে নভ থামলে নীল তাকিয়ে দেখে পানি চিকচিক করছে নভর চোখে। তার নিজেরও কেন জানি হঠাৎ খারাপ লাগতে শুরু করে। এত গুলো মানুষ তাকে মনে করে কষ্ট পেয়েছে।
নীলের ভাবনার মাঝেই নভ বলে ওঠে
“আর কখনো ছেড়ে যাবে না তো নীলময়ী? এবার কিন্তু সত্যি আর সামলাতে পারবো না নিজেকে।”
চলবে…?