নীলাঞ্জনা পর্ব-০৬

0
246

#নীলাঞ্জনা
#পর্ব_৬
#লেখনীতে_শুভ্রতা

১১ বছর পর

ভার্সিটির মাঠে গোল হয়ে একসাথে বসে ট্রুথ ডেয়ার খেলছে কিছু ছেলে মেয়ে। তাঁদের মধ্যে একটা মেয়ে বোতল ঘুরাচ্ছে। ঘুরতে ঘুরতে একজনের দিকে মুখ করে থেমে গেলো বোতলটা। তার দিকে পড়তে দেখে বাকিরা উচ্ছাসে ফেটে পড়লো যেন। সকলেই একসঙ্গে চিৎকার করে উঠলো হুররে বলে। তাঁদের চিৎকার করতে দেখে ভ্রু কুচকালো সেই মানব। এগুলো তার মোটেই পছন্দ হচ্ছে না।

তাঁদের মধ্যে থেকে এক ছেলে বলে উঠলো
“ব্রো বলো কি নেবে? ট্রুথ নাকি ডেয়ার?”

তাকে উত্তর দিতে না দিয়েই একটা মেয়ে বলে উঠলো
“আরে এটা আর নতুন কি? ও তো সেই ডেয়ারই নেবে।”

এবার মুখ খুললো ছেলেটি
“তাহলে কি তোদের ইচ্ছে মতো ট্রুথ নিয়ে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারবো?”

কাঁদো কাঁদো মুখে এক মেয়ে বললো
“জাস্ট একবারই তো দোস্ত। নিয়ে নে না ট্রুথ। প্রমিস মাত্র একটাই প্রশ্ন করবো!”

সন্দেহের চোখে তাকিয়ে অতঃপর ছেলেটি মাথা নাড়লো। অর্থাৎ সে রাজি। তাকে রাজি হতে দেখে বাকিদের মধ্যে থেকে হুট্ করেই একজন বলে উঠলো
“ভাই তুই এত প্রপোজ পাওয়ার পরেও প্রেম কেন করিস না? তুই কি কাউকে লাভ করিস?”

“এটা কি হলো? কথা ছিলো তোরা একটা প্রশ্ন করবি। এখানে দুইটা কেন হলো।”

ছেলেটার কথায় তার বন্ধু গুলো যেন ভীষণ বিরক্ত হয়। প্রথম কথা বলা ছেলেটা বলে
“আরে ভাই সেইম প্রশ্ন তো। তুই দ্বিতীয়টার উত্তর দিয়ে দে না এত না পেঁচিয়ে।”

এরপর কিছুক্ষণ চুপ থাকে ছেলেটা। তারপর আস্তে করে বলে
“হুম লাভ করি। ভীষণ লাভ করি একজনকে। গত ১১ বছর যাবৎ তার জন্য অন্য কোনো মেয়ের সৌন্দর্য চোখে পড়েনি আমার। তার সেই হরিণী চোখের চাহুনি আজও শান্তিতে ঘুমাতে দেয় না আমায়। গালে হাত রেখে অদ্ভুত ভঙ্গি আর ভেঙে ভেঙে বলা কথা গুলো এখনো কানে বাজে আমার। সে আমারে আমার হইতে দেয় না।”

ছেলেটার কথা শুনে তার বন্ধুদের একজন বলে ওঠে
“বাহ্ বস বাহ্। তলে তলে কবি হয়ে বসে আছো আর আমরা বললে হরতাল হ্যাঁ। নট ফেয়ার ব্রো।”

একথা শুনে ছেলেটার পিঠে চাপর মেরে এক মেয়ে বলে
“থামবি তুই। তোর বকবকানি পরে শুনবো। এখন সেই হৃদয় হরণীর নাম শুনতে দে অসভ্য। এই বল নাম বল সেই লাড়কির যে কিনা আমাদের হিরোর ঘুম কেড়ে নিয়েছে। তাও ১১ বছর! ভাভাগো ভাভা।”

বন্ধুদের খুনসুটিতে হেসে ফেলে ছেলেটা। অতঃপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে
“সে প্রথম প্রেম আমার #নীলাঞ্জনা!”

সব গুলো বন্ধু নাম শুনে একসাথে বলে ওঠে
“ওয়াও! নীলাঞ্জনা। নামটাই এত সুন্দর। না জানি সেই হৃদয় হরণী নিজে কত সুন্দর।”

ছেলেটা বলে
“হ্যাঁ সে সুন্দর। প্রচুর সুন্দর। ভয়ংকর সুন্দর আমার নীলময়ী।”

হ্যাঁ। আপনাদের ধারণাই সত্য। এটা আমাদের সেই ছোট্ট নভ। যে সারাক্ষণ নীলাঞ্জনার সাথে খুনসুটিতে মেতে থাকতো। এখন সে আর ছোট নেই। অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্র সে। যদিও চতুর্থ বর্ষে থাকার কথা। কিন্তু নীলাঞ্জনার শোক কাটাতে সময় লেগেছে নভর।
সেদিন সেই নৌকা ভ্রমণেই তাঁদের জীবন থেকে হারিয়ে গেছে তাঁদের সবার চোখের মনি নীলাঞ্জনা। অনেক খুঁজেও পাওয়া যায়নি তাকে। সবার ধারণা নীল আর নেই কিন্তু নভর বিশ্বাস তার নীলময়ী ফিরে আসবেই। অবশ্যই আসবে, তাকে আসতেই হবে। নভর হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসার জন্য তাকে আসতে হবে, নওশাদ শেখের চোখের জলের প্রতিটা কণার মূল্য দিতে তাকে আসতে হবে, তার দাদির নাতনির জন্য কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারানোর গল্প জানতে তাকে ফিরতে হবে, ফিরতে হবে আনোয়ারা বেগম এর মনি ডাক শোনার ইচ্ছে পূরণ করতে।

নভর চোখ ভিজে ওঠে পুরোনো কথা ভাবতে গিয়ে। উঠে চলে যায় সে বন্ধুদের মাঝ থেকে। কিছুটা দূরে গিয়ে একটা গাছে হাত রেখে অন্য হাতে চোখের পানি মুছে বলে
“কেন হারিয়ে গেলি তুই নীল? আমরা সবাই তো তোকে কত ভালোবাসতাম, আদর করতাম! তোর কোনো আবদার অপূর্ন রাখিনি কখনো। শুধুমাত্র কি খালামনি তোকে ভালোবাসেনি বলে চলে গেলি? জানিস খালামনিও নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। কত কান্না করে তোর জন্য। তুই যাওয়ার পর থেকে খালুজান আর আম্মু খালামনির সাথে কথা বলে না। বাবাও অনেক চুপচাপ হয়ে গেছে। বাবা বলেন তিনি আরেকটু আগে দেখলে হয়তো তুই আমাদের সাথে থাকতি। সবাইকে কষ্ট দিয়ে খুব মজা পাচ্ছিস তাই না? একবার ফিরে আয় শুধু দেখবি কেমন বকে দিই তোকে। তখন আম্মুর কাছে নালিশ করেও লাভ হবে না।”

কথা গুলো বলতে বলতে আবারো কেঁদে ফেলে নভ। ঠিক সেই সময়ে নিজের কাঁধে কারো হাতের ছোঁয়া পেয়ে চোখ মুছে ঘুরে দাঁড়ায়। দেখতে পায় তার বন্ধু সাথী দাঁড়িয়ে।
নভর চোখ মুছে দিয়ে সাথী বলে

“কাঁদছিস কেনো? নীলাঞ্জনা বুঝি অন্য কাউকে ভালোবাসে?”

“আমার নীল হারিয়ে গেছে রে সাথী। ওই নদী নিয়ে গেছে আমার নীলকে।”

নভর কথা সম্পূর্ণ বুঝতে পারে না সাথী। তারপর জিজ্ঞেস করলে সবটা বলে নভ। তা শুনে সাথীর চোখেও পানি চলে আসে।

“আমরা জানতাম না রে তোর আর নীলের সাথে এমন কিছু হয়েছে। জানলে কখনোই মনে করাতাম না, বিশ্বাস কর নভ।”

সাথীর কথা শুনে চোখ মুছে হালকা হাসে নভ।
“আরে না। আসলে নীলের কথা কখনোই ভুলতে পারিনি আমি। আজ শুধু সবার সামনে বলতে গিয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম। আচ্ছা চল ওরা অপেক্ষা করছে হয়তো।”

সাথীকে আর কিছু বলতে না দিয়ে তাকে টেনে নিয়ে বাকিদের কাছে যায় নভ। তখন রিহান বলে ওঠে
“কিরে ভাই। হারায় যাস কেন? চল খিদা লাগছে ক্যান্টিনে চল।”

অতঃপর নভ, সাথী, রিমু, আকাশ সবাইকে ঠেলতে ঠেলতে ক্যান্টিন এর দিকে নিয়ে যায় রিহান।

আকশার বাড়ির সিঁড়ি বেয়ে বাবাই বাবাই বলে চিৎকার করতে করতে নামছে এ বাড়ির একমাত্র মেয়ে মহুয়া। বাবাই এর সাড়া শব্দ না পেয়ে ড্রয়িং রুমের ছোফায় বসে পেপার পড়তে থাকা লোকটাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে
“পাপাই পাপাই তুমি কি আমার বাবাইকে দেখেছো?”

ভাতিজির কণ্ঠ, স্পষ্ট একসাথে পেয়ে তার দিকে চোখ তুলে তাকান রেহমান আকশার। ভাতিজিকে নিজের পাশে বসিয়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলেন
“সারাদিন বাবাই বাবাই করলে হবে মহু? কাল থেকে না তোর এসএসসি পরীক্ষা! পড়তে হবে না?”

পড়ার কথা শুনে মুখ অন্ধকার করে ফেলে মহুয়া। তা দেখে হেসে ওঠেন রেহমান। তারপর কিচেন এর দিকে ইশারা দিয়ে বলেন
“ঐখানে আছে বাবাই যা।”

পাপাই এর গালে আঙ্গুল দিয়ে খোঁচা মেরে তুমি কত ভালো বলেই কিচেন এর দিকে দৌড় লাগায় মহুয়া। রেহমান জোরে জোরে হাসতে শুরু করেন মেয়ের কাজে। কিচেনে গিয়ে নিজের বাবাইকে কিছু করতে দেখে কথা না বলে উঁকি মারে মহুয়া।

“উঁকি মারতে হবে না। তোমার জন্যই করা হচ্ছে।”

“কি করছো বাবাই বলো না।”

“রাতে জানতে পারবে। সিক্রেট।”

“প্লিজ বাবাই বলো না।”

“রুমে গিয়ে পড়তে বসো। আমি রহিমা খালাকে বলছি তোমার খাবার দিতে।”

বাবাই এর কাছে প্রশ্রয় না পেয়ে মুখ ভেংচি দিয়ে চলে যায় মহুয়া। নিজের রুমে গিয়ে বইখাতা নাড়াচাড়া করতে শুরু করে। কাল থেকে তার এসএসসি পরীক্ষা কিন্তু তার যেন কোনো আগ্রহই নেই। বাবাইও বললো না তাকে কি করছে। ধুর ভাল্লাগেনা। এরমধ্যে রহিমা খাবার নিয়ে এলে তার হাতে খাওয়ার বায়না ধরে মহুয়া। রহিমাও খাইয়ে দেন। এ বাড়িতে তিনি কাজ করলেও কেউ তাকে কখনো অসম্মান তো করেই না বরং পরিবারের একজন ভাবে। খেয়ে দেয়ে আবার পড়তে বসে যায় মহুয়া। এদিকে বাড়িতে তাকে না জানিয়েই চলতে থাকে বিরাট আয়োজন।

চলবে…?