#নীলাঞ্জনা
#পর্ব_৯
#লেখনীতে_শুভ্রতা
পরের দিন ভোর বেলায় জ্বর শরীরের বাইক নিয়েই নভ রওনা হয় ঢাকার উদ্দেশ্যে। অনেকটা পথ জার্নি করে পৌঁছে দেখে ভার্সিটির টাইম হতে বেশি বাকি নেই। মেসে না গিয়ে সোজা চলে যায় সে ভার্সিটিতে। কিছুটা দেরিই হয় বটে। বাইক পার্ক করে গেট দিয়ে ঢুকতেই দেখে মাঠে কিছুটা জটলা হয়ে আছে। ভিড় দেখে এগিয়ে যায় সেদিকে। একপাশে নিজের বন্ধুদের দেখে তাঁদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে কি ব্যাপার। কিন্তু তখন কেউই কিছু বলার মুড এ নেই। সবাই উত্তেজিত হয়ে আছে সামনে ঘটতে থাকা ঘটনা নিয়ে। কিছু জানতে না পেরে নভও সেদিকে ধ্যান দেয়। এতকিছুর মধ্যে আকাশরা বেমালুম ভুলে যায় যে নভ গত কাল সারাটা দিন উধাও ছিলো।
নভদের ভার্সিটির কিছু ছেলে মেয়ে বেশ কয়েকদিন যাবৎ ড্রাগস্ এ আসক্ত হয়ে পড়েছে। এখানকারই কোনো এক টিচার নাকি এর সাথে জড়িত। গোপন সূত্রে জানতে পেরে প্রিন্সিপাল আইনের শরণাপন্ন হন। প্রিন্সিপাল এর রিপোর্ট পেয়ে গোপনেই এক অফিসারকে দায়িত্ব দেওয়া হয় বিষয়টি তদন্ত করার জন্য। সেই অফিসার নাকি আবার অন্য দেশ থেকে এখানে ট্রান্সফার হয়ে এসেছেন। সেই অফিসারই আজ এসেছেন। তিনি নাকি খোঁজ খবর নিয়ে কয়েকজন স্টুডেন্টকে সনাক্ত করেছেন যারা ওই টিচার এর সাথে জড়িত। তাঁদেরই জিজ্ঞাসাবাদ চলছে এখন। নভ অবাক হয়ে দেখে ছেলে দুটোর মাঝে একজন তার রুমমেট।
অনেকক্ষণ ধরে জিজ্ঞেস করেও ছেলে দুটোর মুখ থেকে কোনো কথা বের করতে পারেনি অভ্র। এই জন্যই বোধহয় এসব প্যাচানো কেসে স্যার তাকে ইনভল্ভ করেছে। হালকা হাসে অভ্র। তর্জনী আঙ্গুল দিয়ে কপালে স্লাইড করতে করতে বলে
“তোমরা তাহলে কিছু জানো না?”
ছেলে দুটো মাথা নেড়ে বলে তারা কিছু জানে না। রেগে গিয়ে অভ্র মারতে শুরু করে তাঁদের। তারপরেও কিছু বলছে না দেখে একজনের নাক বরাবর ঘুসি মারলে সে কিছু বলবে বলে ইশারা করে। অভ্র ছেড়ে দিয়ে বলে
“আগে থেকে বললে আর টনিক খেতে হতো না। যাই হোক বল কি কি জানিস।”
ছেলেটা বলে
“আমাদের কাছে কিছু নেই। সব স্যার নিজের কাছে রাখেন। আমরা শুধু তার থেকে নিয়ে সাপ্লাই দিই।”
অন্য ছেলেটা ভয়ে কাঁপতে থাকে। সেই স্যার কোথায় তা জানতে চায় অভ্র কিন্তু তারা জানে না বলে জানায়। অভ্র এবং বাকিরা চলেই যাচ্ছিলো এমন সময় ভিড়ের মধ্যে থেকে একটা ছেলে বলে
“আমি হয়তো আপনাকে সাহায্য করতে পারবো।”
ভ্রু কুঁচকে তাকায় অভ্র। ছেলেটাকে দেখে মনে হচ্ছে সে নিজেই অসুস্থ। সে আবার কি হেল্প করবে? তবুও জিজ্ঞেস করে
“কীভাবে?”
এগিয়ে আসে নভ।
“আসলে এই ছেলেটা আমার সাথে একই রুমে থাকে মেসে। একে আমি প্রায়ই লুকিয়ে বেশ কিছু ব্যাগ আনতে দেখতাম। জিজ্ঞেস করলে বলতো ইলেক্ট্রনিক জিনিসপত্র। ছেলেটার ছোট ছোট লাইট, ফ্যান তৈরীর শখ থাকায় আমি আর কিছু বলতাম না। কিন্তু আজ বুঝতে পারছি আসল ব্যাপার।”
অভ্র বুঝতে পারে ওই রুমেই সম্ভবত ড্রাগস্ গুলো পাওয়া যাবে। নভকে বলে
“ঠিক আছে। আমাকে নিয়ে চলুন আপনার মেসে।”
“আসুন আমার সাথে।”
নভ নিজের বাইকে করেই অভ্রকে নিয়ে যায়। রুমে গিয়ে চেক করলে দেখা যায় সত্যিই ওই ব্যাগ গুলোতে ড্রাগস্ রাখা। অভ্র ধন্যবাদ জানায় নভকে। অতঃপর নভর সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে চলে যাওয়ার জন্য কিছুটা গিয়েও আবার ফিরে আসে। তা দেখে নভ ইশারায় জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে। কিছু না বলে অভ্র হাত বাড়িয়ে বলে
“ফ্রেন্ডস? আসলে দেখো তুমি আর আমি একই বয়সি। লেখাপড়া শেষ হওয়ার আগেই ফুপ্পি আমাকে এই কাজে ঢুকিয়ে দিয়েছে। ওদেশে লেখাপড়ার পাঠ না চুকিয়েই এখানে চলে এসেছি। ভাবছি তোমাদের ভার্সিটিতেই পড়বো। তো তোমার মতো একটা ফ্রেন্ড হলে খারাপ হতো না আরকি।”
নভও হেসে দিয়ে হাত মিলিয়ে বলে
“ওকে ফ্রেন্ডস।”
তারপর দুইজন আবার একসাথেই বেরিয়ে যায়। নভ ভার্সিটি আর অভ্র অফিসের উদ্দেশ্যে।
দিন গুলো দ্রুতই পার হয়ে যাচ্ছিলো। মহুর পরীক্ষা শেষে অপেক্ষা করছে রেজাল্টের জন্য। অভ্র নভদের ভার্সিটিতেই ভর্তি হয়েছে। নভ আর তার বন্ধুদের সাথে ইতমধ্যেই তার বেশ ভাব। ভাব হয়েছে মহুর সাথেও। বেশি ভালোই যাচ্ছে বন্ধুর মতো সম্পর্কটা। সবাই মহু বলে ডাকলেও অভ্র রওনক আকশার এর মতোই নীলাঞ্জনা বলে ডাকে তাকে। নভর জীবনও গতানুগতিক চলে যাচ্ছিলো। ভার্সিটি, বন্ধুরা আর নীলময়ীর স্মৃতিচারণ। সেই সাথে মাঝে মধ্যে বাবা, মা, খালামনি, খালুজান, নয়ন সবার সাথে কিছু সময় কথা বলা।
সব মিলিয়ে চলে যাচ্ছিলো সময়। কিন্তু হঠাৎই একদিন বাড়ি থেকে ফোন আসে। নভকে তার মা আনোয়ারা জানান তার বাবা নিহাল সওদাগর অনেক অসুস্থ। হাসপাতালে ভর্তি তিনি এবং যত দ্রুত সম্ভব পাঁচ লাখ টাকা জমা করতে হবে। আনোয়ারা আর নওশাদ শেখ মিলে অনেক কষ্টে ৩ লাখ জোগাড় করেছেন। বাকি এক লাখ যেন নভ যত তাড়াতাড়ি পারে জোগাড় করে নিয়ে গ্রামে যায়। নিজের মায়ের কথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে নভর মাথায়। এত টাকা সে কোথায় পাবে। এসব চিন্তা করছিলো তখন পেছনে কেউ এসে কাঁধে হাত রাখে। নভ পেছনের মানুষটাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কান্না করে ফেলে।
কেটে গেছে দুই বছরেরও বেশি সময়। নভ তার বাবাকে বাঁচাতে পারেনি সেদিন। এমন নয় যে সে টাকা জোগাড় করতে পারেনি। টাকা নিয়ে সে ঠিকই গিয়েছিলো আর অপারেশনও হয়েছিলো কিন্তু তার বাবা ফেরেনি। নীলকে বাঁচাতে না পারার আক্ষেপ নিয়েই পারি জমিয়েছেন না ফেরার দেশে। সেদিন অভ্র নভ আর তার মায়ের সব কথা শুনতে পায়। সেই সেদিন নিজের চাচাকে বলেছিলো নভকে টাকাটা দিতে আর একটা কাজের ব্যবস্থা করে দিতে যাতে করে সে টাকা শোধ করতে পারে।
মহু এডমিশন পরীক্ষা দিয়েছে। কয়েক জায়গায় চান্স হলেও সে তার অভ্রদা যেখানে পড়েছিল ওই ভার্সিটিতেই পড়বে বলে জেদ ধরে বসে আছে। অভ্রর সাথে ভার্সিটির টিচার গুলোর সম্পর্ক ভালো হওয়ায় বাড়ির কেউও আর আপত্তি করেনি। আজ ভার্সিটিতে মহুর প্রথম দিন। অভ্র প্রায় আধঘন্টা ধরে বসে বসে দেখে চলেছে মহুর কাজকর্ম। সাধারণত মেয়েরা প্রথম দিন ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য মেকাপ টেকাপ করে, সাজগোজ করে ব্লা ব্লা। অথচ এই মেয়ে শুধু ঘড়ি আর জুতা নিয়ে পড়ে আছে। বেশ কিছু সময় ধরে ঘড়ি একটা পড়েছে তো একটা খুলেছে। এভাবে ঘড়ি পছন্দ করার পর এখন শুরু করেছে জুতা নিয়ে। অথচ গায়ে তার সাধারণ একটা কুর্তি সাথে হিজাব। মহুর কাজ দেখে বিরক্ত হয়ে এক সময় অভ্র বলে
“কিরে নীল তোর জন্য কি আজ আর অফিস যেতে পারবো না নাকি?”
মহু ভ্রু কুঁচকে বলে
“আমি তো কিছু করিনি অভ্রদা।”
“কিছু করিসনি মানে? এইযে আমাকে বসিয়ে রেখে জুতা, ঘড়ি নিয়ে গবেষণা করছিস এগুলো আগে করতে পারিসনি? আমার অফিসে কি বউ বস যে আমি দেরি করে গেলেও আদর করে ছেড়ে দেবে? তোর জন্য তো দেখছি চাকরি যাবে আমার।”
মহুর যেন গায়েই লাগে না তার কথা। এতে আরো বেশি বিরক্ত হয়ে নিজেই একটা কালো কেডস পড়িয়ে দেয় অভ্র। মহু একটু অবাক হলেও কিছু বলে না। খারাপ না কেডসটা। অভ্রদার চয়েস আছে বলতে হয়। এরপরে মহুকে টানতে টানতেই নিয়ে বের হয় অভ্র। ড্রয়িং রুমে এসে সবাইকে বলে বেরিয়ে পড়ে। বাইরে গিয়ে মহুকে বাইকে উঠতে বলতেই সে দৌড়ে ভেতরে চলে যায়। বেজায় বিরক্ত হয় অভ্র। এই মেয়েটার কি কোনো সেন্স আছে!
কিছুক্ষণ পর মহু যাওয়ার সময়কার মতোই দৌড়ে বেরিয়ে আসলে অভ্র রেগে কিছু বলতে যাবে তার আগেই মহু হাতে কিছু একটা দেখিয়ে কান ধরে। অভ্র আর কিছু না বলে বের হয়ে যায় বাইকের পেছনে মহুকে বসিয়ে। উদ্দেশ্য মহুকে ভার্সিটিতে দিয়ে নিজে অফিস যাবে।
মহুকে ভার্সিটিতে নামিয়ে স্যারদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে অফিস যায় অভ্র। সেখানে ঢুকতেই ডাক পড়ে বড় স্যারের কেভিনে। স্যারের সাথে কথাবার্তা বলে বের হয়েই কল করে কাউকে।
“জান তোমার তো সব কন্ফার্ম হয়ে গেছে। বড় স্যার মাত্রই আমাকে ডেকে জানালো।”
ওপাশ থেকে কিছু একটা বললে অভ্র হেসে বলে
“আই ওয়ান্ট ট্রিট।”
চলবে…?