#নীলাঞ্জনা
#পর্ব_১০
#লেখনীতে_শুভ্রতা
নিজের বন্ধুর বোনের এনগেজমেন্টে এসে একটা মেয়েকে দেখে অবাক হয় নভ। মেয়েটার হাতে প্যাচানো সেই নাম লেখা চেইন যা নভ তার নীলময়ীকে দিয়েছিলো নীলময়ীর পঞ্চম জন্মদিনে। এই মেয়েটা নীলময়ীর চেইন কোথায় পেলো? সেই চেইন তো নীলের সাথে সাথে হারিয়ে যাওয়ার কথা। তাহলে কি এই মেয়েটা নীল? চোখ ভিজে আসে নভর। না, তাকে জানতেই হবে কে এই মেয়ে! অভ্রর কাছে জিজ্ঞেস করতে হবে আগে। নাকি আগে মেয়েটার সাথে কথা বললে ভালো হয়? কথা বলার জন্য এগিয়ে যায় নভ।
আজ রেহানা আপুই এর বয়ফ্রেন্ড তাকে আংটি পড়াতে আসবে। বাড়ির সবাই সবার পরিচিতদের ইনভাইট করেছে। শুধু মহুই কাউকে বলেনি। আর বলতোই বা কাকে? ওর তো কোনো ফ্রেন্ডই নেই। গাড়িতে করে স্কুলে, কলেজে গেছে আবার গাড়িতেই ফিরেছে। ক্লাসে তেমন কারো সাথে মেশা হয়নি। যাও টুকটাক কথা ওই পড়াশোনা নিয়ে। তাই মহু একাই বসে আছে। নভ এসেছে রওনক সাহেব আর অভ্র দুজনের ইনভাইট এ। অভ্র বন্ধু আর রওনক বস হওয়ায় কারো কথাই ফেলতে পারেনি সে। তার বাবা অসুস্থ থাকাকালীন রওনক সাহেবই টাকা দিয়ে সাহায্য করেছিলেন। তাই আরো বেশি ফেলতে পারেনি নভ তার কথা। সেখানে এসেই এক মেয়ের হাতে দেখে লকেট সহ নীলের চেইন। অদ্ভুত ব্যাপার, সবাই চেইন রাখে গলায় আর এই মেয়ে হাতে রেখেছে। যদিও এতে নভর জন্য ভালোই হলো কারণ গলায় থাকলে তো আর সে দেখতে পেতো না।
মহু একটা টেবিলে বসে বসে গোলাপের পাঁপড়ি ছিড়তে ছিড়তে পা নাচাচ্ছিলো। তখন কেউ এসে তার সামনে দাঁড়ায়।
“আচ্ছা তুমি বলতে পারবে অভ্র কোথায়?”
অচেনা একটা ছেলের কণ্ঠে মাথা তুলে তাকায় মহু। মেয়েটার চোখ দেখে বুক কেঁপে ওঠে নভর। এ তো হুবহু তার নীলময়ীর চোখ। মাথা নেড়ে না বলে মেয়েটা। কথা বলার ইচ্ছে নেই একটুও। সবার ফ্রেন্ড আছে শুধু তারই নেই। এই শোকেই কাতর সে। নভ আশেপাশে কাউকে না দেখে বলে
“এত মানুষের মধ্যে তুমি একা বসে আছো যে? তোমার সাথে কেউ আসেনি?”
কিছুটা ঠোঁট ফুলিয়ে মহু বলে
“আমার সাথে আসবে কি করে? আমি এই বাড়ির ছোট মেয়ে। একা বসে আছি কারণ আমার কোনো ফ্রেন্ড নেই।”
অবাক হয় নভ। মেয়েটা তাহলে অভ্রর চাচাতো বোন? একটু ভাব জমাতে বলে
“আচ্ছা তাহলে ফ্রেন্ডস?”
কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে মহুও বলে
“ঠিকাছে ফ্রেন্ডস।”
একটা চেয়ার টেনে মহুর মুখোমুখি বসে পড়ে নভ। এই চেইন এর ব্যাপারে তাকে যেকোনো ভাবে জানতে হবে।
“তোমার চেইনটা তো খুব সুন্দর, সাথে লকেটটাও। কে দিয়েছে এটা?”
এক পলক নিজের হাতে থাকা চেইনটা দেখে মহু। তারপর বলে
“আমার বাবাই। গত জন্মদিনে।”
আবারও নভ জিজ্ঞেস করে
“সবাই গলায় পড়ে তুমি কেনো হাতে পেঁচিয়ে রেখেছো?”
“এটা আমার খুব পছন্দের। গলায় পড়লে তো হিজাব এর জন্য দেখতে পারবো না তাই হাতে রাখি।”
বেশ অবাক হয় নভ। কৌতূহল দমাতে না পেরে বলে ওঠে
“আচ্ছা তোমার এই লোকেটটা আমি একটু খুলে দেখি?”
আশ্চর্য হয় মহু। তারপরেও মাথা নেড়ে বোঝায় নভ খুলে দেখতে পারে। মহুর অনুমতি পেতেই নভ একপ্রকার তাড়াহুড়ো করে খুলে ফেলে লকেটটা আর তখনই তার চক্ষু চড়ক গাছ। এ তো তার আর নীলময়ীর ছবি। ছবিটা মহুকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে
“এখানে কে কে?”
মহু অবাক হয় তার লোকতের মধ্যে থাকা ছবি দেখে। ছবিটাতে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে। দুইজনই ছোট। মেয়েটা সে নিজেই তা বুঝতে পেরেছে কারণ বাবাই তার রুমে এরকম একটা ছবি বাঁধাই করিয়ে দিয়েছে কিন্তু ছেলেটা কে? প্রায় বছর খানেক ধরে লোকেট তার কাছে আছে বটে তবে খুলে দেখার মতো কৌতূহল কখনো জাগেনি। ফল স্বরূপ এর মধ্যে থাকার ছবির ব্যাপারে সে অজ্ঞাত। নিজের প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে নভ আবারও জিজ্ঞেস করে। এবার মহু বলে
“আসলে জানিনা আমি। বাবাই এর কাছে শুনে আপনাকে বলবো কেমন?”
একটু ধাতস্ত হয় নভু। তাড়াহুড়ো করলে মেয়েটা তাকে সন্দেহ করবে। আগে তাকে নিশ্চিত হতে হবে এই নীল। তারপর সব কিছু। চেইন দিতে দিতে নভ বলে
“তোমার নাম নীলাঞ্জনা?”
একটু হেসে জবাব দেয় মহু
“হ্যাঁ। মহুয়া আকশার নীলাঞ্জনা।”
অবাক হয় নভ। আকশার? কিন্তু এটা তো নীলাঞ্জনা শেখ হবে। তাহলে কি সেদিন নদী থেকে অভ্রর চাচা নীলকে বাঁচিয়েছেন? নভর চিন্তার মাঝে অভ্র এসে নীল বলে ডাক দেয়। চমকে তাকায় নভ। অভ্রও মহুর পাশে নভকে দেখে অবাক হয় কিন্তু তা প্রকাশ করে না।
“কিরে নভ তুই এখানে যে? আমার হাতে হাতে একটু কাজ করলেও তো পারিস! আজ নিজের ভাই না বলে পর করে দিলি?”
ভ্রু কুঁচকে তাকায় নভ। এই ছেলে কখনো ভালো হওয়ার নয়। এত ব্যাস্ততার মাঝেও মজা করছে তার সাথে।
“সে তো তবেই করবো যখন তুই আমার সাথে কথা বলে আমাকে নিয়ে যাবি। তা তুই তো কখনো আমাকে আগে বলিসনি তোর এত সুন্দরী একটা বোন আছে?”
চোখ মেরে বলা নভর কথা শুনে অভ্র চোখ রাঙিয়ে তাকায়।
“খবরদার নজর দিবি না।”
নভ হেসে ফেলে। এই দুজনের কান্ড দেখে মহু ভ্রু কুঁচকে ফেলে। এরা ফ্রেন্ড? তাকে বললো না তো ছেলেটা।
“অভ্রদা আমার লোকতে এটা কার ছবি চেনো তুমি?”
দুই হাতে দুইজনকে টেনে নিতে নিতে অভ্র বলে
“এখন সময় নেই এগুলো বলার। ফুপ্পি এসে গেছে। আর ছেলের বাড়ির লোকজনও। এখন ওরা আংটি পড়াবে সবাইকে থাকতে বলেছে তোর বাবাই। আর ফুপ্পিও তোকে দেখতে চেয়েছে।”
অভ্রর কথার পরে আর মহু বা নভ কেউই কিছু বলে না। পরে জানা যাবে সব। তারা তিনজন উপস্থিত হয় সবার মাঝে। মহুকে নিজের ফুপ্পির পাশে দাঁড় করিয়ে দিয়ে নভকে নিয়ে অভ্র চলে যায় একটা ফাঁকা জায়গায়। সাথে নেয় ফুপ্পির একমাত্র পুত্র পিয়ালকেও। লোকজনের মধ্যে অসম্ভব গরম লাগছে তার। এদিকে নভ অবাক হয়ে দেখছে পিয়ালকে। এত চেনা লাগছে কেনো এই ছেলেকে। কে এই ছেলে? পাশে গিয়ে অভ্র নিজের কাজিন বলে পরিচয় দিলেও নভর সন্দেহ যায় না। এতটা মিল কেনো পাচ্ছে কারো সাথে? কোথায় কি কোনো রহস্য আছে?
রেহানার আংটি বদল অনুষ্ঠান শেষে সকলে খাওয়া দাওয়া করে যার যার মতো চলে গেছে। নভও চলে গেছে কিন্তু যাওয়ার আগে মহু বা নীলের কাছ থেকে তার ফেসবুক আইডি নিতে ভোলেনি। সে নিশ্চিত এটাই তার নীলময়ী এবার শুধু আর একটু অপেক্ষা। আকশার বাড়ি এখন ফাঁকা হয়ে গেছে। গেস্টরা যেতেই রওনক আকশার বোনের পরিবার সহ সবাইকে বলে খাবার টেবিলে আসতে। রাত কম হয়নি। খেয়ে ঘুমাতে হবে সবার। তার বোনটাও আমেরিকা থেকে জার্নি করে এসেছে। এখন রেস্ট দরকার। সবাই টেবিলে এসে খাওয়া শুরু করলে হঠাৎ মহু বলে ওঠে
“বাবাই আমাকে যে তুমি লোকেট আর চেইন দিয়েছিলে না? ওতে মেয়েটা তো আমি আর ছেলেটা কে?”
মেয়ের প্রশ্নে যেন একটু থতমত খেয়ে যান রওনক সাহেব। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলে
“ওটা তোমার অভ্রদা।”
বাবাই এর কথা শুনে মহু ভ্রু কুঁচকে অভ্রর দিকে তাকায় কিন্তু খাচ্ছে বিধায় আর কিছু বলে না। তবে ঠিক করে নেয় খাওয়া শেষে তাকে চেপে ধরবে বলে। তখন জিজ্ঞেস করলো মহু বলে দিলেই হতো। মহু তাকিয়ে থাকাকালীন অভ্রও তাকালে চোখাচোখি হয়ে যায়। ভাবে তাকে এভাবে ফাঁসিয়ে দেওয়ায় একটু রাগও হয় বাবাই এর ওপর। পিয়াল এর কথা বলতে পারতো! পিয়ালকে মহু কিছু বলতো না কিন্তু তার তো পিন্ডি চটকে দেবে। পরোক্ষণে নিজেই নিজেকে গালি দেয়। পিয়াল আর মহু তো একই বয়সি তাহলে ছবিতে বড় ছোট কীভাবে হলো এই প্রশ্নের কি উত্তর দিতো তখন? আর কিছু না ভেবে খাওয়ায় মনোযোগ দেয় সবাই।
সবার মনোযোগ খাবারে থাকলেও এক জোড়া চোখ প্রচন্ড অবাক হয়ে চেয়ে আছে মহুর দিকে। এটা কীভাবে হতে পারে? মাথা ঘুরে ওঠে পলাশ সাহেবের। নিজের স্ত্রীকে রুমে আসতে বলে নিজেও খাওয়া শেষ না করেই উঠে যান। টেবিলের সবাই প্রথমে অবাক হলেও পরে ভাবে হয়তো জার্নি করার জন্য ক্লান্ত।
নয়না আকশার স্বামীও ওভাবে উঠে চলে যাওয়া দেখে কিছুটা চিন্তিত হয়ে নিজেও উঠে চলে যান। ঘরে গিয়ে দেখেন তার স্বামী নেই। অতঃপর চোখ যায় বেলকনিতে। সেখানে গিয়ে পলাশ সাহেবকে বিরস মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কাঁধে হাত রাখেন। পলাশ চৌধুরী সামনে না ঘুরেই জিজ্ঞেস করেন স্ত্রীর কাছে
“মেয়েটা কে নয়না?”
অবাক হননা নয়না। তিনিও খেয়াল করেছেন মহুকে যে কিনা হুবহু তার ননদের মতো দেখতে। কিন্তু স্বামীকে কি বলবেন ভেবে পাননা। তার সন্দেহ যদি সত্যি হয় তাহলে তো সব শেষ হয়ে যাবে? কি হবে তার?
স্ত্রীর কাছ থেকে জবাব না পেয়ে এবার ঘুরে দাঁড়ান পলাশ চৌধুরী।
“আমার বোনের ওভাবে চলে যাওয়ার জন্যই আমার মেয়ে অপছন্দ জানো তুমি। ওই মেয়েটা কীভাবে সম্পূর্ণ আমার বোনের মতো দেখতে নয়না? উত্তর দাও! আই নিড অ্যান সার।”
কিছুটা চিৎকার করেই বলেন পলাশ চৌধুরী। কেঁপে ওঠেন নয়না আকশার। তাহলে কি সব শেষ?
এদিকে নভ শুয়ে শুয়ে ভাবছে ওই ছেলেটা কীভাবে পুরোপুরি নয়ন এর মতো দেখতে? কই নীল তো নয়ন এর মতো দেখতে না। তাহলে কি তার খালামনির কথাই সত্যি? কেউ নিয়ে গেছিলো তার ছেলেকে? তাহলে নীল কে? হাজার ভেবেও উত্তর পায় না নভ।
চলবে…?