নীড় পর্ব-১৫+১৬

0
302

নীড়
রেশমী রফিক
১৫।।
স্বর্ণপাতার থালার চারপাশে অনেক মানুষজন জড়ো হয়েছে। বেশিরভাগই উত্তেজিত এলাকাবাসী। শারার-তুবাকে গাড়ি থেকে উদ্ধার করে আনার পর রেস্টুরেন্ট ঘেরাও করেছে তারা। বাকিরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে। একে-ওকে জিজ্ঞেস করছে ঘটনা কী। যাদের জিজ্ঞেস করা হচ্ছে, তারা তিল থেকে তাল বানানোর মজাদার রসদ পেয়ে গেছে। আসল ঘটনাকে অতিরঞ্জিত করে রঙচঙ মেখে, সত্যির সাথে খানিকটা মিথ্যে মিশিয়ে বর্ণনা করছে। যার সংক্ষিপ্ত রুপ হচ্ছে, শারার-তুবাকে প্রায় নগ্ন অবস্থায় গাড়ির ভেতর পাকড়াও করা হয়েছে। অসামাজিক কাজকর্মে লিপ্ত ছিল ওরা। দু’জনের কারওই পরনের জামাকাপড় ঠিক ছিল না। বিশেষ করে মেয়েটার উর্ধ্বাংশ বলতে গেলে অনাবৃতই ছিল। ছেলেটার দুই হাত পায়চারি করছিল সেখানে। দু’জনের মুখ দিয়ে কামধ্বনি বের হচ্ছিল। বাঙালী বরাবরই চটকদার গল্প শুনতে এক পা বাড়িয়ে রাখে। এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আগ্রহী শ্রোতারা খুটিয়ে-খুটিয়ে জানতে চাইছে আদ্যোপান্ত। তাদের চেহারায় ঝিলমিল করছে এক ধরনের উচ্ছ্বলতা, যেন এই ঘটনার সাক্ষী হতে না পেরে জীবন প্রায় বৃথা হয়ে গেছে। তবু পুরোপুরি ব্যর্থ হয়নি। অল্পের জন্য হাতছাড়া হয়ে গেছে আর কী। এ যাত্রায় জীবনকে স্বার্থক করে তুলতে প্রত্যক্ষদর্শীদের থেকে খুঁটিনাটি জানার প্রয়াস চলছে। বলা বাহুল্য, প্রত্যক্ষদর্শীর সংখ্যা তুলনায় এই মুহূর্তে ধাই-ধাই করে বাড়ছে। যারা ওই সময়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল না, তারাও পরে এর-ওর থেকে শুনে এখন নিজেরাই সাক্ষাৎ প্রত্যক্ষদর্শী বনে গেছে। এখানেই শেষ নয়। উপস্থিত জনতা রসালো গল্প শোনার পরও অপেক্ষা করছে দু’জনের চাঁদবদন দেখার জন্য। জানে, সেই সুযোগ মেলার সম্ভাবনা নেই। এখান থেকে বের হবার সময় ওরা নিশ্চয়ই আর দশজনের মতো মুখ তুলে হাসতে-খেলতে থাকবে না। মাথা নিচু করে রাখবে যতটা সম্ভব, যাতে চেহারা কেউ চিনতে না পারে। তবু বলা যায় না, একটু সুযোগ মিলেও যেতে পারে। অন্তত চেহারা না দেখলেও দুজনের শারীরিক গড়ন দেখাতেও যথেষ্ট শান্তি আছে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, রাতের অন্ধকারে এ ধরনের অপকর্ম ঘটলে ব্যাপারটা একটু হলেও মানা যায়। অন্ধকারের মধ্যে যা-তা করা যায়। কেউ টেরও পায় না। দিনে-দুপুরে এই কাজ করতে পারে কেউ, তাদের ধারণার বাইরে। অতএব, যারা দিনের ঝকমকে আলোয় রাতের কার্যকলাপে মগ্ন হতে পারে, তাও আবার খোলা জায়গায়। তাদের চেহারা এক ঝলক দেখতে পারলেও জীবন উৎরে যাবে। নাহ, এই জিনিস কিছুতেই মিস করা যাবে না।
পুরো এলাকায় চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে। সবার চোখমুখে এক ধরনের উদ্বিগ্নতা। কী হয়, কী চলছে ভেতরে, কৌতুহলে পেট ফেটে যাবার উপক্রম। পুলিশ এসেছে অনেকক্ষণ হয়। শুরুতেই তারা সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। এরপর বিপক্ষ দলের নেতাগোছার একজনকে ডেকে নেয়া হয়েছে ভেতরে। পরের খবরটুকু আর জানা যাচ্ছে না। কিন্তু খবর পাওয়া যাচ্ছে না। রেস্টুরেন্টের সবগুলো জানালা ভেতর থেকে আটকে দেয়া হয়েছে। ডাইনিংয়ে যেসব কাস্টমার ছিল, তারা যথারীতি খাওয়া-দাওয়া সেরে এক-এক করে বাইরে আসছে। উৎসুক জনতা তাদেরকে ঘিরে ধরছে ভেতরের কাহিনি জানতে। প্রতিবারই নিরাশ হচ্ছে। কারণ ডাইনিংয়ে যারা বসে খাচ্ছিল, তারা অত কিছু বুঝে উঠতে পারেনি। রেস্টুরেন্টের বাইরে কী হয়েছে, তাদের জানার কথা নয়। তারা কেবল সদর দরজা দিয়ে একদল ছেলেপেলেকে হন্তদন্ত হয়ে ঢুকতে দেখেছে। ডাইনিং পার হয়ে সোজা রেস্টুরেন্টের ভেতর দিকে গেছে তারা। এরপর আর কিছুর আভাস মেলেনি। যেসব ওয়েটার তাদের সেবায় নিয়োজিত ছিল, তারা খানিক হতবিহ্বল হলেও পরক্ষণে নিজেদের সামলে নিয়েছে। আগের মতোই কাজ করছে, যেন কিছু হয়নি। কাস্টমাররা বরং বাইরে এসে এত মানুষজন দেখে হতবাক। আশপাশ থেকে ঘটনা শুনে আরও হতভম্ব!
স্বর্ণ রেস্টুরেন্টের ভেতর চলে আসার পর তার অনুগত বাহিনিকে নির্দেশ দিয়েছিল শারার-তুবাকে উদ্ধার করতে। এরপর থানায় কল করে পুলিশের সাহায্য চেয়েছে। ফোনে বলা হয়েছিল, একদল মাস্তান এসে হাঙ্গামা শুরু করেছে রেস্টুরেন্টে। কিন্তু এখানে আসার পর পরিস্থিতি বুঝা গেল অন্যরকম। যদিও স্বর্ণ ওসব স্বীকার করছে না। তার ভাষ্যমতে, আজ এই হাঙ্গামা করাটা বিপক্ষ দলের পুর্বপরিকল্পনা। তারা আগেভাগেই ওঁত পেতে ছিল কোনো একটা ইস্যু তৈরি করতে। যথারীতি শারারের গাড়ি রেস্টুরেন্টের পেছনে থেমেছে এবং তারা তাদের নাটক শুরু করেছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, শারার-তুবাকেই কেন নিশানা করা হলো। রেস্টুরেন্টে তো আরও অনেকেই খেতে এসেছে। তাদের মধ্যে শারার-তুবার মতো ছেলেমেয়েরাও আছে। সত্যিকারের প্রেমিক-প্রেমিকা থাকলেও অবাক হবার কিছু নেই। এই উত্তরও স্বর্ণ দিয়েছে সোজাসাপটা। এই লোকগুলো বহুদিন ধরেই ঝামেলা পাকানোর উদ্দেশ্যে ওকে আর ওর রেস্টুরেন্টের আশপাশে নজরদারি করছিল। কিছুদিন আগে ওর বন্ধুরা এসেছিল কয়েকজন। তাদের মধ্যে শারারও ছিল। ওইদিন বন্ধুদেরকে সে পুরো রেস্টুরেন্ট ঘুরিয়ে দেখিয়েছে। রেস্টুরেন্টের সামনে এবং পেছনে সবটাই। স্বভাবতই ওর বন্ধুদেরকে অন্যসব কাস্টমারদের থেকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা কোনো ব্যাপার ছিল না। সেদিনই শারারকে ওরা চিনে রেখেছিল। আজ যখন সে এসেছে এই রেস্টুরেন্টে এবং তার সাথে একটা মেয়ে আছে, প্রতিপক্ষ তাৎক্ষণিকভাবে ওদেরকেই নিশানা করেছে।
পুলিশ কেবল স্বর্ণর বক্তব্য নয়, বিপক্ষ দলের বক্তব্যও শুনেছে। এলাকার একজন প্রভাবশালী বড় ভাইকে রেস্টুরেন্টের ভেতর ডেকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তিনি ঘটনাস্থলে উপস্থিত না থাকলেও প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে ইতোমধ্যে সবটা জেনে নিয়েছেন। তার ভাষায়,
– স্যার, আপনি একটা জিনিস ভেবে দেখেন। এইখানে তো অনেকেই ব্যবসা করতেছে। আশপাশে ভালোই দোকানপাট আছে। খাওয়ার দোকান থেকে শুরু করে মোটামুটি মিনি মার্কেট বলা যায়। তাই না? কোনো দোকানদার বা ব্যবসায়ীকে নিয়ে আমাদের আপত্তি নাই। শুনছেন কোনোদিন? আমরা কি কোনোকালে থানায় গেছিলাম এখানের কোনো দোকানের বিরুদ্ধে মামলা করতে? যাই নাই। কারণ, কারও মধ্যে ভেজাল নাই। শুধু এই মহিলা ছাড়া। এই মহিলা এইখানে রেস্টুরেন্ট দেয়ার পর থেকে এলাকার পরিবেশ নষ্ট হয়ে গেছে। এলাকার উঠতি সব ছেলেমেয়েরা তো আছেই, অন্য এলাকা থেকেও আসে এইখানে যত রকমের নষ্টামি করতে। আমরা এখানকার স্থানীয়। এখানে আমাদের জন্ম, এখানেই বড় হইছি। এই এলাকাটা আমাদের কাছে অনেকটা ফ্যামিলির মতো। আমরা এখানে যত বাড়িওয়ালা বা স্থানীয় আছি, নিজেদের আপন ভাবি। মিলেমিশে থাকি। এই এলাকার জন্য আমি নিজে অনেক ছোট বয়স থেকে কাজ করতেছি। যত রকমের সোশ্যাল ওয়ার্ক আছে। খোঁজ নিয়ে দেখেন, সবখানে আমার নাম পাবেনই। আমাদের একটা যুব সমাজ সংস্থা আছে। এলাকার শান্তি রক্ষার জন্য, পরিবেশ ভালো রাখার জন্য সবরকমের চেষ্টা আমরা করি। আজ পর্যন্ত কেউ বলতে পারবে না এলাকায় কোনোদিন দুই নাম্বারি কিছু হইছে। অথচ আজকে বাইরের একটা মহিলা আইসা এইখানে জুড়ে বসছে। যা খুশি তাই করতেছে। আরে দুত্তোরি, মহিলা বলতেছি কেন? পুচকি একটা মেয়ে। ওর বয়স কত? খুব বেশি হইলে পঁচিশ কি ছাব্বিশ? এই মেয়ের কি রেস্টুরেন্টের ব্যবসা করার বয়স হইছে? ব্যবসায়ের সে বুঝে কী? এইখানে আইসা স্রেফ নষ্টামি করতেছে। এইসব রেস্টুরেন্ট বিজনেস আসলে সবার চোখে ধোঁকা দেয়ার জন্য। আড়ালে দেখেন গিয়ে, সব দুই নাম্বারি চালাইতেছে। আর আজকে যে ছেলেটাকে আমরা আপত্তিকর অবস্থায় ধরছি। এই ছেলে ওর ফ্রেন্ড লাগে। মেয়েটারে দেখেন। স্কুলের ড্রেস পরা। তার মানে একদমই অল্পবয়স। এই ছেলে ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিয়ে আসছে ওইসব কাহিনি করতে। স্যার, আপনি আমার কথা শুনেন। আমাকে তো আজকে নতুন চিনতেছেন না। আপনি যতদিন ধরে এই থানায় আছেন, আমাকে এই এলাকায় দেখে আসছেন। কি, দেখেন নাই? এলাকার যে কোনো সমস্যায় পুলিশের হেল্প লাগলে আমি সবার আগে আগাইয়া গেছি। আপনি প্লিজ রেস্টুরেন্ট সার্চ দেন। আমি শিউর, এইখানে যে অনৈতিক কাজকর্ম চলে, তার প্রমাণ পেয়ে পাবেন।
এসআই মশিউর রীতিমতো বেকায়দায় পড়েছেন। এলাকাবাসী জোর প্রতিবাদের মুখে রেস্টুরেন্টে তল্লাশি চালানো অবশ্যম্ভাবী হয়ে গেছে। একবার তল্লাশি চালিয়ে দেখলে তো সমস্যা নেই। বরং কিছু পাওয়া না গেলে এলাকাবাসীদেরকে সে সতর্ক করতে পারত। আর যদি সেরকম কিছুর প্রমাণ মিলে, তাহলে রেস্টুরেন্টের মালিকের বিরুদ্ধে মামলা হতো। ব্যাপারটা তখন আরেকদিকে গড়াত। মোদ্দা কথা, একটা এস্পার নয়তো ওস্পার হতো। কিন্তু স্বর্ণপাতার থালায় সেটি হবার জো নেই। মালিকের বাবা বিশাল শিল্পপতি। ঢাকার প্রভাবশালীদের মধ্যে অন্যতম। উপরমহল থেকে নির্দেশ এসেছে মালিকের পক্ষে অবস্থান নিতে। এখানে আসার আগে ওসি নিজে তার রুমে ডেকে নিয়ে বলেছেন, এলাকাবাসীদেরকে যেন উপযুক্ত ভয় দেখানো হয় যাতে আবার কোনোরকম হাঙ্গামা করার আগে দ্বিতীয়বার ভাবে। সম্মানিত লোকজনদের হয়রানি করার অভিযোগ এনে মামলা করার দরকার মনে করলে যেন তাই করা হয়। তাছাড়া, এলাকাবাসীদের মুখের কথায় তো আর অ্যাকশন নেয়া যায় না। যাদেরকে পাকড়াও করা হয়েছে, তাদের সাথেও কথা বলা দরকার। আদৌ কি তারা আপত্তিকর অবস্থায় ধরা পড়েছে কি না, জানতে হবে। দরকার পড়লে তাদের অভিভাবকদের সাথেও কথা বলতে হবে। তাই বিরস মুখে বললেন,
– আচ্ছা, আপনি বাইরে যান। আমি দেখছি কী করা যায়। তল্লাশি মুখের কথাতেই চালানো সম্ভব না। এর আগে কিছু রুলস অ্যান্ড রেগুলেশনস আছে। কিছু প্রসিডিউর আছে। সেসব ফলো করতে হবে। আমি ওই ছেলেমেয়ে দুটোর সাথে কথা বলব এখন। তাদের মুখ থেকেও শোনা দরকার কাহিনি আসলে কী। তারপর যাচাই-বাছাই করে…
নেতা গোছের বড় ভাইয় খানিক ঝুঁকে এলেন সামনের দিকে। গলার সুর যতটা সম্ভব নিচু করে বললেন,
– স্যার, এমনে তো অনেক টাইম ওয়েস্ট হবে। ততক্ষণে সমস্ত প্রমাণ লোপাট করে ফেলা হবে। আপনি বুঝতেছেন না কেন?
– আমি সবই বুঝতেছি। কিন্তু আপনিই একটা ব্যাপার ধরতে পারতেছেন না। এটা হাই প্রফাইল কেস। যে মেয়ের নামে এত কমপ্লেইন আপনাদের, সে কিন্তু সাধারণ কেউ না। তার রেস্টুরেন্টে হুটহাট তল্লাশি চালানো সহজ কথা না। উপযুক্ত প্রমাণ লাগবে।
– এত্তগুলা মানুষ তার অ্যাগেইনস্টে বয়ান দিতেছে, এরপরেও উপযুক্ত প্রমাণ মনে হইতেছে না আপনার?
– না। হইতেছে না। মানুষের মুখের কথা পাল্টাইতে দুই সেকেন্ডও লাগে না। এই কথা আপনি না জানলেও আমার জানতে বাকি নাই। পুলিশের চাকরি তো আজকে নতুন করতেছি না। ঘটনার সময় দুনিয়ার মানুষ দুনিয়ার কথা বলতে পারে। কিন্তু যখন কোর্টে হাজির হয়, তখন উকিলের জেরার চাপে সব অস্বীকার করতেও পারে।
– কী বলেন? কথা পাল্টে ফেলবে কেন?
– শুনেন, পুলিশের কাছে অফিশিয়াল স্টেটমেন্ট দেয়ার পরেও কোর্টে গিয়ে কথা ঘুরানোর মতো কেসও লাইফে অনেক দেখছি। আজকে যারা আপনার পক্ষে বা রেস্টুরেন্টের মালিকের বিপক্ষে চিল্লাচিল্লি করতেছে, আপনি এখন বাইরে গিয়ে যদি বলেন স্বর্ণপাতার থালার মালিকের বাবা অমুক। উনি আর উনার মেয়ে এলাকাবাসীর নামে মানহানি মামলা করার প্রিপারেশন নিতেছে, দেখবেন চারপাশে খালি হয় কেমনে? মাঝখান থেকে ফেঁসে যাবেন আপনি। এই যে, এদের প্রতিনিধি হয়ে আসছেন আমার সাথে কথা বলতে, এরা কয়জনে আপনার পেছনে থাকবে শেষ পর্যন্ত সেটা নিশ্চিত করেন আগে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, তল্লাশি করে যদি আসলেই কিছু না পাই, আপনার ঘাড়েই কিন্তু ঝামেলা চেপে বসবে। আপনি তখন ঝামেলা বয়ে বেড়ানোর অ্যাবিলিটি রাখবেন তো?
বড় ভাই ঢোক গিলল। এসআই মশিউরের কথা শুনে ঘাবড়ে গেছেন তিনি। আসল ঘটনা যাই ঘটুক, তিনি সামনে ছিলেন না। নিজ চোখে কিছু দেখেননি। যা কিছু শুনেছেন, সবই কান কথা। এখানে আসার আগে অনেকেই তাকে বলেছে, দরকার হলে থানায় গিয়ে অফিশিয়াল স্টেটমেন্ট দেবে রেস্টুরেন্টের মালিকের বিপক্ষে, তিনি যেন বড় ভাই হিসেবে ব্যাপারটা তদারকি করেন। কিন্তু এই মুহূর্তে এসআইয়ের কথা শুনে মনে হচ্ছে, এরা ইচ্ছেকৃতভাবে তাকে সামনে এগিয়ে দিয়েছে যুদ্ধ করতে। বিপদ দেখলে পেছন থেকে যে কোনো মুহূর্তে হটে যেতে এদের একটুও সময় লাগবে না। তাই বলে এখন পিছিয়ে আসার উপায়ও নেই। আজ যদি মাথা নিচু করে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে আসেন, মানইজ্জত আর থাকবে না এলাকায়। এতকাল যাবত এলাকার বড় ভাই হিসেবে যে সম্মান পেয়ে এসেছেন, তাতে ঢিলে পড়বে।
এলাকার যে কোনো সামাজিক কাজকর্মে বা থানা-পুলিশে দৌড়াদৌড়ি করতে তার জুড়ি নেই। এসআই মশিউরের সাথে তার পরিচয় আজকের নয়। তাই এসআই যত না শান্ত সুরে তাকে সম্ভাব্য ভবিতব্য ব্যাখ্যা করলেন, অন্য কোনো পুলিশ অফিসার হলে এতটা করত না।
এসআই মশিউরের মুখে কিঞ্চিৎ হাসি স্পষ্ট হলো। তিনি বললেন,
– শুনেন ভাই, আপনি এলাকার সেবায় নিয়োজিত। ব্যাপারটা ঠিক আছে। কিন্তু এর মধ্যে জড়াবেন না। এই রেস্টুরেন্ট নিয়ে এলাকার মানুষের আপত্তি আজকে নতুন না। আগেও বিভিন্ন অভিযোগ এসেছে। আমি নিজে দুইবার এসেছি পরিস্থিতি সামাল দিতে। অতএব, আজকের ব্যাপারটা একটু হলেও বুঝতে পারছি। এখানে একটা ব্যাপার স্পষ্ট। এক হাতে তালি বাজে না। অর্থাৎ রেস্টুরেন্টের মালিক এখানে অসামাজিক কাজকর্ম করুক বা না করুক, এলাকাবাসীর দোষও কম না। তারা মালিককে হয়রানি করার চেষ্টা করেছে অনেকভাবে। রেস্টুরেন্টে হামলা করেছে। ভাঙচুর করেছে। ইভেন একটা মামলাও হয়েছিল। এখন ঝামেলা নতুন করে মাথাচাড়া দিলে বা কোর্ট পর্যন্ত গেলে কিন্তু আগের এইসব রেকর্ডও আসবে সামনে। তখন আপনাদের পক্ষে কেস অনেকটাই উইক হয়ে যাবে। অতএব, বুঝেশুনে যা করার করেন…
– কিন্তু স্যার। যা রটে, তার কিছুটা তো ঘটে।
– তা ঘটে। কিন্তু প্রমাণ কই? আপনারা কি হাতেনাতে কাউকে ধরতে পারছেন এখনো? আজকে যে ধরছে দুইটা ছেলেমেয়েকে গাড়ির ভেতর। কোনো ফুটেজ আছে?
বড় ভাই চুপ রইলেন। বিষয়টা তিনি জানেন না। হয়তো কেউ ভিডিও করেছে। কিন্তু সেই ভিডিও কতটা নিজেদের পক্ষে যাবে, সেটাও দেখার বিষয়। কারণ হামলাকারীদের চেনেন তিনি। তারা আইন নিজের হাতে তুলে নিতে ওস্তাদ। এসআই যেন তার মনের কথা পড়তে পেরেই বললেন,
– উলটা আমি রেস্টুরেন্টের মালিকের কাছ থেকে শুনলাম যাদেরকে অ্যাটাক করা হয়েছে, আপনার লোকজন মানে এলাকাবাসী নাকি তাদের জামাকাপড় ছিঁড়ে ফেলছে। মেয়েটার উপর বেশি অ্যাটাক হয়েছে। স্কুলের ড্রেস পরা ছিল। একটু আগে এক ঝলক দেখেছি। তার অবস্থা পুরো খারাপ। মেয়েটা ট্রমাটাইজড হয়ে গেছে। আর ছেলেটার মাথায় শক্ত কিছু দিয়ে বাড়ি মারা হইছে। ব্লিডিং হচ্ছে। আপনাদের ঘেরাও কর্মসূচীর কারণে তাকে হাসপাতালে নেয়া যাচ্ছে না। এই ছেলে যদি ব্লিডিংয়ের কারণে মারা যায়, আর মেয়েটা যদি এনিহাউ সুইসাইড করে, তখন কিন্তু ব্যাপারটা আরও খারাপের দিকে যাবে। ছেলের বাপেরও কিন্তু ক্ষমতা কম না, যতদূর শুনলাম। মেয়ের ফ্যামিলির ব্যাপারে অবশ্য এখনো তেমন ইনফো পাইনি। তবে শুনেছি, ছেলেটারই দূর সম্পর্কের আত্মীয়। কী যেন বলল কাজিন বা এরকম কিছু।
বড় ভাই হতবিহ্বল ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছেন। এখানে আসার আগে মনোবল ছিল শতভাগ। এখন তার পরিমাণ কমতে শুরু করেছে। বুক ধুকপুক করছে। এসআইয়ের কথা যত শুনছেন, মনে হচ্ছে অন্ধকার চোরাবালিতে তলিয়ে যাচ্ছেন। তবু গলায় জোর এসে বলার চেষ্টা করলেন,
– কিন্তু স্যার…
– আমার কথা শুনুন। আপনি আমার পরিচিত। এলাকার একজন মান্যগণ্য মানুষ। আপনাকে আপনি এই জঞ্জালের মধ্যে আশা করিনি। এসবের মধ্যে আপনি না থাকলেই পারতেন। কেননা, সামনের দিকে ব্যাপারটা আরও ঘোলা হবে। আপনি এর মধ্যে আটকে যাবেন। এজন্যই এত কথা বলছি। আরেকটা কথা হচ্ছে, যেখানে যত যাই ঘটুক, আইন নিজের হাতে তুলে নেয়াটা কিন্তু কোনোভাবেই সাপোর্ট করার মতো না। অথচ লোকজন ওদের গায়ে হাত তুলেছে। মেয়েটার শরীরে হাত দেয়া হয়েছে। কাইন্ড অফ অ্যাবিউজ বলা যায়। মেয়েটার মেডিকেল রিপোর্ট লাগবে। কারণ ওকে কতটা অ্যাবিউজ করা হয়েছে…
– স্যার, সত্যি বলতে আজকের ঘটনা আমি নিজে কিছু দেখি নাই। শুধু আজকের না, এই রেস্টুরেন্ট নিয়ে যত কমপ্লেইন, কোনোটাই আমার নিজের দেখা না। কিন্তু তাই বলে এতগুলো মানুষের স্টেটমেন্ট ফেলে দেবার মতো না। আমার ধারণা, অনেকেই আসবে অফিশিয়াল স্টেটমেন্ট দিতে। কোর্টেও যেতে পারে। কারণ অলরেডি এলাকায় একটা ঠান্ডা যুদ্ধ আছে। আগেরবার মিথ্যে মামলায় কয়েকটা ছেলেকে জেল-জরিমানা করা হয়েছিল। সেটার জের ধরে যদি সবাই এক হয়…
এসআই মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। যাক, লোকটাকে একটু হলেও ভড়কে দেয়া গেছে। এই লোক পিছু হটলেই সবটা ক্ষান্ত হবে, তা নয়। বরং তার কথাগুলো আমলে নেবার মতোই। এলাকাবাসী ক্ষেপে গেলে শিল্পপতির মেয়ে যতই মামলা-মোকাদ্দমায় টাকাপয়সা ঢালুক, ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করুক, মানসিক শান্তি বলতে যা বুঝায়, তা আর পাবে না কোনোদিন। এখানে ব্যবসায় করতে হলে এদের সাথে তাল দিয়ে চলাটা জরুরী। এতক্ষণ এই লোকটাকে বুঝ দিয়েছেন। আর শিল্পপতির কন্যাকে সবক দিতে হবে। তাকে বুঝতে হবে, জলে নেমে কুমিরের সাথে যুদ্ধ করাটা মানায় না। হাতে যতই অস্ত্রশস্ত্র থাকুক, কুমিরের একটা কামড় খেলে সব অস্ত্র বেগার পড়ে থাকবে। জান হাতে নিয়ে পালানো ছাড়া আর উপায় থাকবে না। দেখা যাক কী হয়। আপাতত তাকে বলা হয়েছে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে। অর্থাৎ উপরমহলের নির্দেশানুযায়ী স্বর্ণর গায়ে যেন এতটুকু আঁচ না লাগে, আবার এলাকাবাসীও যেন না ভাবে পুলিশ একপাক্ষিক।
(চলবে)

নীড়
রেশমী রফিক
১৬।।
শফিকুল চৌধুরী যখন স্বর্ণপাতার থালায় পৌঁছুলেন, রেস্টুরেন্টের সামনে তখন বিশাল ঝামেলা চলছে। এলাকাবাসী এতক্ষণ কেবল রেস্টুরেন্ট ঘেরাও করে রেখেছিল। যখন এলাকার বড় ভাই বাইরে এসে তাদেরকে বললেন, এভাবে ঘেরাও করে লাভ হবে না কোনো। পুলিশ কিছু করতে পারবে না। কারণ তাদের হাত-পা আইনের কাছে বাঁধা। পরিস্থিতি কতটা বেগতিক, বুঝলেও যা কিছু করার, নিয়মের মধ্যে করতে হবে। এরপর এলাকাবাসীর ক্ষোভের আগুনে ঘি পড়েছে। পুলিশ না হয় আইনের কাছে বন্দি। তারা তো নয়! দরকার পড়লে জেল খাটবে। চাঁদা তুলে স্বনামধন্য কোনো উকিল নিয়োগ করবে, তবু এই অনাচার সহ্য করবে না। এই বড়লোকের কন্যা টাকাপয়সা ঢেলে কতদূর কী করতে পারে, করুক! এলাকাবাসীর ক্ষমতাও তার দেখার দরকার আছে। জানার দরকার আছে, জীবনে অর্থই সবকিছু নয়। ইতোমধ্যে কয়েকজন সাংবাদিককে খবর দিয়ে ডেকে আনা হয়েছে। তারা এলাকাবাসীর পক্ষে নিউজ কভার করবে। শারার-তুবাকে রেস্টুরেন্টের ভেতর লুকিয়ে রেখেছে স্বর্ণ। পুলিশও তার পক্ষে কথা বলছে। জিজ্ঞাসাবাদের নামে কালক্ষেপণ করছে, যাতে সমস্ত প্রমাণাদি লোপাট করতে সুবিধা হয়। এলাকাবাসীর প্রতিনিধিকে আইনের ভয় দেখানো হচ্ছে। অথচ পুলিশ নিজে কতদূর আইন মানে, সেটাও কারও অজানা নেই। যা হোক, এতক্ষণে এলাকাবাসীর বুঝা হয়েছে পুলিশ ডেকে আনার ব্যাপারটা আসলে নাটক মাত্র।
এসআই মশিউর ফোনে সমস্ত আপডেট জানালেন ওসিকে। উপরমহল থেকে বারবার ফোনকল আসছে। কিন্তু পরিস্থিতি সামাল দেয়া যাচ্ছে না সহজে। স্বর্ণকে তার রেস্টুরেন্টসমেত উচ্ছেদ না করে তারা রাজপথ ছাড়বে না। প্রকৃতপক্ষে এলাকাবাসীর নামে কতিপয় ছোকরা এই অভিযানে নেমেছে। এসআই মশিউর রেস্টুরেন্টের ভেতর জিজ্ঞাসাবাদ চালালেও ওসি চুপচাপ বসেছিলেন না। সাদা পোশাকে পুলিশ পাঠিয়ে এলাকার বেশ কয়েকটি বাসার মালিকের সাথে কথা বলেছেন। প্রত্যেকের কাছ থেকে একটা লিখিত চিঠি আদায় করা হয়েছে এই মর্মে, স্বর্ণপাতার থালা নিয়ে তাদের কারওই কোনো আপত্তি নেই। বরং কয়েকজন জানালেন, এলাকার এমন একটি রেস্টুরেন্ট চালু হবার পর সপ্তাহে অন্তত একদিন সপরিবারে সেখানে খেতে যাওয়ার রেওয়াজ চালু হয়েছে বাসায়। ছেলেমেয়েরা তো বটে, স্ত্রীও অপেক্ষায় থাকেন ছুটির দিনের। প্রতি শুক্র-শনিবার যে কোনো একদিন ওখানে খাওয়া হয়। তাছাড়া, রেস্টুরেন্টের সার্ভিস ভালো। তাদের ডেলিভারি সার্ভিস না থাকলেও অনেক সময় দেখা যায়, এলাকার মধ্যে কেউ ফোনে অর্ডার করলেও স্টাফদের কাউকে দিয়ে খাবার পাঠিয়ে দেয়া হয়। বিশেষ করে, এলাকার পরিচিত মুখ যারা।
স্বর্ণর নামেও ইতিবাচক কথা শোনা গেল। রেস্টুরেন্টের মালিক হলেও তার ব্যবহার খুবই আন্তরিক। স্টাফদের সাথে নিজেও কাজ করে। রান্না তো তারই করা, এর বাইরেও প্রায়ই তাকে রেস্টুরেন্টের ডাইনে ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়। কখনো সদর দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে কাস্টমারের। কেউ ভেতরে এলে সাদর সম্ভাষণ জানায়। এছাড়াও, প্রতিটি টেবিলে গিয়ে হাসিমুখে কথা বলা, কিছু লাগবে কি না জানতে চাওয়া এগুলো তার অবসর সময়ের রুটিন। এক ভদ্রলোক জানালেন, গত সপ্তাহে স্বর্ণপাতার থালায় খেতে গিয়ে মালিকের সাথে কথোপকথনের সুযোগ হয়েছিল। সেসময়ই তিনি জানতে পেরেছেন স্বর্ণর পরিবার সম্পর্কে। স্বর্ণর বাবা একজন শিল্পপতি হলেও তার মধ্যে নাক-উঁচু স্বভাব নেই। ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সবার সাথে সমানভাবে মিশেন। ভদ্রলোকের চাচা একসময় চাকুরি করেছেন স্বর্ণর বাবার অফিসে। সে সুত্র ধরেই স্বর্ণর বাবার সম্পর্কে খানিক জানাশোনা আছে। চাচা এখন আর বেঁচে নেই। ফ্যাকটরিতে কর্মরত অবস্থায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছেন। তার অসহায় পরিবারের পাশে আত্মীয়স্বজন কমবেশি থাকলেও শক্ত ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন স্বর্ণর বাবা নিজে। তারই অফিসে চাকুরি দেয়া হয়েছে ভদ্রলোকের চাচাত ভাইকে। ছেলেটা তখন অনার্সে পড়ছিল। প্রতিদিন ক্লাস শেষ করে ফ্যাকটরিতে যেত। সুপারভাইজার হাতে ধরিয়ে কাজ শেখাত। এখন সেই ছেলে ফ্যাকটরির ম্যানেজার পদে চাকরি করছে। এছাড়াও চাচিকে বেশ বড়সড় অঙ্কের টাকা দেয়া হয়েছিল যাতে ভরণপোষণে কোনোরকম সমস্যা না হয়। স্বর্ণর বাবার কোম্পানিতে প্রতিটি কর্মচারীকে বাধ্যতামুলক লাইফ ইন্স্যুরেন্স করতে হয়, যেহেতু ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করতে হবে। প্রতি মাসের বেতন থেকে সেই কিস্তি পরিশোধ করে কোম্পানী নিজে। যদি কেউ মারা যায়, তাহলে সেই টাকা তুলে দেয়া হয় পরিবারের হাতে। আর যদি মারা যাবার আগেই চাকুরি থেকে অবসর নেয়, তখন ইন্স্যুরেন্সের টাকাটা প্রফিডেন্ট ফান্ডের সাথে বাড়তি হিসেবে পাওয়া হয়। স্বর্ণর বাবার অফিসে কর্মরত প্রতিটি মানুষ তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। স্বর্ণ নিজেও বাবার এই ধাত পেয়েছে। তাকে দেখে কেউ বলবে না এই রেস্টুরেন্টের মালিক। তেমনি কর্মচারীদের সাথে ব্যবহার খুবই আন্তরিক। তাদের সুযোগ-সুবিধার প্রতি তার কড়া নজর।
আরও তদন্ত করে জানা গেল, স্বর্ণপাতার থালার উপর ক্ষোভটা আসলে রাজনৈতিক স্বার্থ মেশানো। এই এলাকার এমপি হচ্ছেন সরকারি দলের। আর স্বর্ণর বাবার উঠাবসা বিরোধী দলের সাথে। বিরোধী দলের চেয়ারপারসনের ভাতিজার সাথে স্বর্ণর এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়া বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। স্বভাবতই স্বর্ণর বাবার উপর রাজনৈতিক আক্রোশ থাকবে। তারই মেয়ে যখন সরকারি দলের এমপির এলাকায় রেস্টুরেন্টের ব্যবসা করতে এসেছে, তাকে তো একটু হলেও যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে। কিন্তু স্বর্ণ শুরু থেকে শক্ত অবস্থান নিয়েছে। তার অনুগত বাহিনীর সাথে এমপির ছেলেপেলেদের বারকয়েক মারামারিও হয়েছে। ব্যাপারটা তাই এখন আর সহজ পর্যায়ে নেই।
সাদা পোশাকের পুলিশি তদন্তে যখন সরকারি এমপির নাম বের হয়ে এলো, ওসি কিংকর্তব্যবিমুঢ় ভঙ্গিতে বসে রইলেন কিছুক্ষণ। রাজনৈতিক বিবাদের এই পর্বটা তার অজানা ছিল এতকাল। স্বর্ণর বাবার সাথে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকবার আলাপ হলেও রাজনৈতিক চালটা সামনে আসেনি ভুল করেও। স্বর্ণর বাবা কখনো হামবড়া কিছু জাহির করেননি নিজেকে। খুবই সদালাপী মানুষ। দামি গাড়িতে চলাফেরা করলেও কদাচিৎ দরজা খুলে পথভিক্ষুকদের কাতারে দাঁড়াতেও তার সময় লাগে না। এক সুত্রে শোনা যাচ্ছে, সামনের নির্বাচনে বিরোধী দলের মনোনয়ন তাকে দেবার চিন্তাভাবনা করা হয়েছে। এখনো দলের পক্ষ থেকে তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব দেয়া হয়নি। তবে প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন। ঘটনা হচ্ছে, আজ উপরমহল থেকে যে ফোনকল এসেছে তা স্বর্ণর বাবার পক্ষ থেকে নয়। ফোন করেছেন প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিবের সেক্রেটারি। স্বর্ণর সাথে তার ছেলের কোনোভাবে জানাশোনা আছে। সেই পরিচিতির সুত্র ধরে সে কল করে এখানের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানিয়েছিল। তারপর ছেলে তার বাবাকে বলেছে। সেক্রেটারির নির্দেশ, যতদ্রুত সম্ভব এলাকাবাসীকে হটানো হোক। এবং ভবিষ্যতেও যেন এ ধরনের ঘটনা আর না ঘটে, সেই হুঁশিয়ারিও দেয়া হয়েছে।
ওসি এবার নিজে রেস্টুরেন্টে পা দিলেন। উত্তেজিত জনতা খানিক ঝিমিয়ে পড়েছিল, অপরপক্ষ থেকে কোনোরকম সাড়া না পেয়ে। পুলিশের গাড়ি দেখামাত্র তাদের হৈ-চৈ বেড়ে গেল। ওদিকে শফিকুল চৌধুরীও এসেছেন। তার পরিচয় সেভাবে কেউ জানল না। পুলিশের গাড়ির পেছনে তার গাড়িটা থেমেছে। তিনি সরাসরি ওসির সাথে কথা বললেন। নিজের পরিচয় দিলেন শুরুতে। এরপর ব্যাখ্যা করলেন আসার কারণ।
ওসি প্রথমে বিস্মিত হলেন। কারণ একের পর এক ক্ষমতাশালী লোক কেন্দ্রীভূত হচ্ছে এই রেস্টুরেন্টকে ঘিরে। প্রথমে স্বর্ণর বাবা, এরপর স্বর্ণর বন্ধুর বাবা, এখন আবার আরেকজন! শারারকে তিনি চেনেন না। তাই নির্দিষ্ট করে কিছু বলতে পারলেন না। তবে শফিকুল চৌধুরীকে সাথে নিয়ে গেলেন ভেতরে। এসআই মশিউর তাকে দেখে বলল,
– স্যার, চলে এসেছেন! ভালো হয়েছে খুব। এখানে তো ভেজাল আরও বেশি প্যাঁচ খেয়ে গেছে। বুঝতে পারছি না কী করব।
– কীরকম?
– এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে একজন রিপ্রেজেন্টেটিভ এসেছিলেন। তাকে আমি ঠিকমতোই কনভিন্স করেছিলাম। উনি এখান থেকে বের হবার সময় বলে গেছেন, বাইরের লোকজনদের শান্ত করবেন। কিন্তু তারা এখন উনাকেও মানছে না। উনি বিষয়টা বুঝিয়ে বলার পর আরও ক্ষেপে গেছে। ওদের দাবি, এই রেস্টুরেন্ট উচ্ছেদ করতে হবে। আমি বুঝলাম না…
– আমি বুঝতে পেরেছি মশিউর। তোমাকে এখানে পাঠিয়ে আমি আরও কিছু কাজ সেরে নিয়েছি। কারণ ফোনকল এসেছে অনেক উপর থেকে। সচরাচর তারা ফোন করেন না খুচরো ঝামেলায়। কিন্তু এই রেস্টুরেন্টের বেলায় করেছেন। এবং এই ঝামেলার পেছনে কে বা কারা আছে, সেটাও ফাইন্ড আউট করা গেছে। সমস্যা কী জানো? দুই পক্ষই একই দলের।
– মানে?
– মানেটা পরে বুঝিয়ে বলছি। এখন অত কথা বলার সময় নেই। ভিকটিমরা মানে যাদের আটকে রাখা হয়েছে, তাদের কী অবস্থা?
– মেয়েটা মেন্টাল শকে আছে, স্যার। ঠিকমতো কথা বলছে না। পুলিশ দেখলেই ভয় পেয়ে শারারের পেছনে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে।
– শারার কে?
শফিকুল চৌধুরী নিজেই উত্তর দিলেন,
– আমার ছেলে। ওকে খুঁজতেই এসেছি।
এসআই মশিউর বললেন,
– শারারের সাথে কথা হয়েছে, স্যার। ও বলল, তুবা মানে ওই মেয়েটাকে নিয়ে এখানে লাঞ্চ করতে এসেছিল। গাড়িটা পেছনদিকে পার্ক করার পর পরই লোকজন ওদের অ্যাটাক করেছে। মেয়েটাকে অ্যাবিউজ করার চেষ্টা করেছিল। গাড়ি লকড ছিল বলে অতটা সুবিধা করতে পারেনি। যা গেছে, গাড়ির উপর দিয়েই। পুরা ভেঙ্গেচুরে শেষ।
– এখন এদের বক্তব্য কী? এরা ঝামেলা করছে কেন? সমস্যা রেস্টুরেন্ট নিয়ে। ওদেরকে আটকে রেখেছে কেন?
– ওদের কমপ্লেইন, মিস স্বর্ণ মানে রেস্টুরেন্টের মালিক অসামাজিক কাজকর্মের ইন্ধন দেয়। শারার আর তুবা এর সাথে জড়িত। ওদেরকে নাকি আপত্তিকর অবস্থায় পাকড়াও করেছে।
– আপত্তিকর? কীরকম?
– মানে স্যার, জামাকাপড়ের ঠিক ছিল না। আর বুঝতেই পারছেন একটা ছেলে আর একটা মেয়ে গাড়ির ভেতর… এখন তারা বলতে শুরু করেছে, শারার নাকি একেকদিন একেকটা মেয়ে নিয়ে আসে। এর সাথে মিস স্বর্ণ জড়িত। এই মেয়েগুলোকে নানান কথায় ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিয়ে আসা হয়। এরপর কাস্টমার মানে নানা ধরনের নানা বয়সের ছেলেরা আসা-যাওয়া করে খেতে আসার নামে। শারার আর মিস স্বর্ণ মিলে রেস্টুরেন্ট বিজনেসের আড়ালে অল্পবয়সী মেয়েদের…
শফিকুল চৌধুরী গর্জে উঠলেন,
– অসম্ভব। আমার ছেলে এমন কাজ করবে না কখনো।
– স্যার সেটা তো পাবলিক বুঝতে চাইছে না। এদের মুল ইস্যু অন্যকিছু। এরা মিস স্বর্ণর পেছনে লেগেছে। আপনার ছেলে আর ওই মেয়েটা জাস্ট ভিকটিম।
ওসি বললেন,
– ওদের মধ্য থেকে রেস্পন্সিবল কাউকে নিয়ে আসো। স্পেসিফিক করে বলো, এমপির লোকের সাথে কথা বলতে চাই আমি। আর মিস স্বর্ণ কোথায়?
(চলবে)