নীড় পর্ব-৩৪ এবং শেষ পর্ব

0
727

নীড়
রেশমী রফিক
৩৪।।
শারারের খুব ক্লান্ত লাগছে। কপালের ব্যাথাটা খানিক কমেছিল। এখন আবার বাড়ছে। চোখে অন্ধকার দেখছে। একটা ভুল হয়ে গেল। বাসে চড়ার আগে ফার্মাসি থেকে পেইনকিলার কেনা উচিত ছিল। আর কিছু ঔষধপত্র। রেস্টুরেন্টের ভেতর এক ডাক্তারকে ডেকে আনা হয়েছিল। তিনি প্রাথমিকভাবে কিছু ঔষধের নাম লিখে দিয়েছিলেন। ওগুলো তখনই ফার্মাসি থেকে কিনে আনা হয়েছিল। এরপর কোথায় গেছে, কে জানে। কক্সবাজারে নেমেই কোনো ক্লিনিক বা ফার্মাসির খোঁজ করতে হবে। এদিকে তুবার কথা বলার নেশা চেপেছে। একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছে সে। কথার পিঠে কথা প্যাঁচিয়ে ফেলছে। শুনে শারারের খুব রাগ হচ্ছে। কষে দুইটা থাপ্পড় মারতে ইচ্ছে করছে। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে রেখেছে সে। বউয়ের গায়ে হাত তোলা কোনো ভালো কাজ না। ওর আব্বু যখন ওর আম্মুর গায়ে হাত তোলে, ওর খুব খারাপ লাগে। আব্বুর হাত ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করে। ছোটবেলায় এই ব্যাপারটা সে নিতেই পারত না কোনোভাবে। প্রচুর রেগে যেত। আব্বুকে অনেকগুলো কথা শোনাতে ইচ্ছে করত। কিন্তু আম্মু নিরস্ত করত। আম্মুকে সে বরাবরই শান্ত থাকতে দেখেছে। কীভাবে এত মারধোর সহ্য করে স্বামীর বাড়িতে পড়ে আছে আম্মু, সে ভেবেই পায় না। এমন নয় যে, নানুবাড়ির অবস্থা ভালো না, কিংবা আম্মু বাড়ি থেকে বের হয়ে আসলে বাবার বাড়িতে জায়গা পাবে না। বরং সবসময়ই দেখেছে আম্মুর প্রতি মামাদের বাড়তি আদর, আগলে রাখার প্রচেষ্টা। কিন্তু আম্মু অন্য ধাতুতে গড়া। শত মার খেয়েও স্বামীর ভিটে ছাড়বে না।
শারার ছোটবেলা থেকে এগুলো দেখেই বড় হয়েছে। আম্মুকে সবসময় আব্বুর ধমক দেয়া, গায়ে হাত তোলা, আব্বু বাসায় ফিরলে আম্মুর নিজেকে গুটিয়ে রাখা, বাসা জুড়ে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করা ইত্যাদি। তার কাছে একটা সময় পর্যন্ত এসব স্বাভাবিক ছিল। পরবর্তীতে বুঝতে পেরেছে, কতখানি অস্বাভাবিকতার ভেতর বেড়ে উঠেছে সে। তাই বলে কখনো নিজেকে শুধরে নেয়ার তাগিদ হয়নি। আজ, বিশেষ করে এই মুহূর্তে ওর মন বারবার তাগিদ দিচ্ছে, তুবা আজেবাজে যাই বলুক। মনের মধ্যে যত ক্ষোভ আছে, বলেকয়ে বের করে ফেলুক। ওকে সে কিছুই বলবে না। ধমকও দেবে না। আজ ওকে বলতে না দিলে আজীবন বলার সুযোগ খুঁজতেই থাকবে। খেদ সবটুকু ঝেড়ে ফেলুক এই বাসের মধ্যে! তাছাড়া, তুবা এখন যে কেউ নয়, ওর জীবনসঙ্গিনী। তাকে তার মুল্যায়নটুকু করতেই হবে। আজীবন একসাথে চলতে পারুক আর না পারুক, তুবার গায়ে আর কখনোই হাত তুলবে না সে। কখনো তুবার সাথে ধমকের সুরে কথা বলবে না। তুবার জীবনে দমবন্ধ করা, নিঃশ্বাস আটকে রাখার মতো অনুভূতি নয়, এক টুকরো আনন্দ হতে চায় সে। কিংবা একটু সুখের নীড়। আজ সারাদিনে তুবা বাসা-বাসা করে পাগল হয়েছে। বাসায় যেতে উদগ্রীব সে, যেখানে গিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারবে। অথবা আরাম করে হাত-পা ছড়িয়ে বসে থাকবে। না হোক অনেক বড়, না থাকুক রাজকীয় বিলাসিতা, একটুখানি নীড় যেন বেলাশেষে তুবাকে ফিরে আসতে অস্থির করে, এই নীড়টুকু হতে চায় সে। ওর বুকে মাথা রাখতেই যেন তুবার মন জুড়ে শান্তির পরশ ছড়িয়ে যায়।
শারারের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে তুবা চুপচাপ বসে রইল। ওর মন খারাপ হচ্ছে খুব। আবার ভালোও লাগছে। এই বাসটা একটু-একটু করে ‘ঢাকা’ থেকে সরে যাচ্ছে দূরে, বহু দূরে। এর সাথে তাল দিয়ে ওর মনে হচ্ছে, সমস্ত ভয়-আতংক আর টেনশন উবে যাচ্ছে। বহুদিন ধরে আম্মার কড়া শাসনে জীবন অতিষ্ঠ মনে হচ্ছিল। জানে, আম্মা ওর ভালোর জন্যই শাসন করে। ছোট মেয়ে, তাই আম্মা ওকেই সবথেকে বেশি আদর করে। তবু কেন যেন নিতে পারছিল না আর ধরাবাঁধা বন্দি জীবন। একটুখানি নিয়মের বাইরে পা ফেললেই আম্মার বকা আর মারধোরের আতঙ্ক, যেন সারাক্ষণ ওকে টেনশনের চুড়ান্তে দাবিয়ে রাখে। এর থেকে একটু বিরতি দরকার ছিল। এই দূরযাত্রাটাই বিরতির কাজ করে দিচ্ছে। ‘বিয়ে’ সম্পর্কে কমবেশি জানা থাকলেও পাশের মানুষটা একদমই স্বল্প পরিচিত। দুই-তিনদিনে যতটুকু কথা হয়েছে, চেনাজানার জন্য তা যথেষ্ট ছিল না। এই মানুষটা ওকে হুটহাট কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, জানে না। তবু দুশ্চিন্তা ভর করতে পারছে না মাথার ভেতর। হাজারও ক্লান্তির ভীড়ে একটুখানি স্বস্তি ওকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে লাগল। শারারের কাঁধে মাথা রেখে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমাল সে। ঘুমের মধ্যেই টের পেল একটা হাত পরম ভরসা দিয়ে ওকে আগলে নিয়েছে বুকের মধ্যে।
তুবা ঘুমিয়ে গেছে, নিশ্চিত হবার পর পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করল শারার। ফেসবুক মেসেঞ্জারে একটা চ্যাট গ্রুপ আছে। নাম ‘বাজি ধরছি’। কয়েকজন কাজিন আছে সেখানে। মূলত চ্যাটগ্রুপটা খোলা হয়েছে সাইফুলের বিয়ের সময়। গায়ে হলুদের দিন থেকেই সাইফুলের অবিবাহিত কাজিনরা তুবার পেছনে লেগেছে। এদের মধ্যে একজনের খুব পছন্দ হয়েছে তুবাকে। কিন্তু প্রেম নিবেদন করার সাহস পাচ্ছে না। প্রথমত, তুবার চলাফেরা আর আচরণে কিছুটা অহংবোধ ফুটে উঠে। যার ফলে তাকে দেখলে মনে হয়, মুডি। এই ধরনের মেয়েরা সাধারণত প্রেম নিবেদন করাটা পছন্দ করে না। কোনো ছেলে প্রেম নিবেদন করলে তাকে প্রত্যাখান থেকে মনে-মনে এক ধরনের সুখ কামনা করে। দ্বিতীয়ত, তুবার আম্মা অর্থাৎ সাইফুলের শাশুড়ি কীরকম দজ্জাল মহিলা, তা সাইফুলদের পরিবারে ইতোমধ্যে সবারই জানা হয়েছে। অবিবাহিত কাজিনদের সাইফুল নিজেই গল্পাচ্ছলে শুনিয়েছে, দিবার বাসায় প্রথমবার গিয়ে কীরকম রোষাণলে পড়েছিল সে। একারণে, তুবাকে প্রেম নিবেদন করতে চাওয়া বেচারা এক পা এগোচ্ছে তো দুই পা পিছিয়ে যাচ্ছে এই ভেবে, তুবা যদি কোনো কারণে প্রত্যাখান করে, অতি অবশ্যই চুপ থাকবে না। বরং মায়ের কাছে গিয়ে নালিশ করবে। তারপর শেফালি বিয়েবাড়িতেই কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়ে ফেলবেন কি না, তার নিশ্চয়তা কী?
বিয়ের ঠিক আগের রাতে, সাইফুলের ব্যাচেলর পার্টিতে এই নিয়ে বলাবলি হচ্ছিল। শারার তাদের দলে যোগ দেয়নি। তার নিজের প্রেমিকা আছে, বহু বছরের প্রেম। নাম সিমি। সেই প্রেমিকা খুবই অধিকারপরায়ণ। এতটাই, শারার কোনো মেয়ের সাথে হেসে কথা বললে, বা ফেসবুকে কোনো মেয়ের পোস্টে লাইক/লাভ রিঅ্যাক্ট দিলেই তার মুখ কালো হয়ে যায়। যথারীতি ক্ষণিকের সম্পর্ক ছেদ হয় এবং অনেকগুলো দিন কথাবার্তা বন্ধ থাকে। আবার কখনো শারারের মোবাইল বিজি দেখালে তার একের পর এক প্রশ্নবাণ চলতে থাকে। রাতের বেলায় মোবাইলে কল করে ‘ওয়েটিং’ পেলে সেই প্রশ্নবাণ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠে। এমনকি আমেরিকা প্রবাসী চাচাত বোন, দশ বছরের রিমির সাথে কথা বললেও সমস্যা তৈরি হয়ে যায়। এছাড়া, সিমির ইচ্ছেমতো যখন খুশি তখনই তাকে সময় দিতে হয়। না পারলে প্রেমিক হিসেবে কী যোগ্যতা, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠে আসে। শারার নিজে প্রগতিশীল মননের ছেলে। সিমির এই অধিকারবোধ সে উপভোগ করে ঠিকই। কিন্তু অতিরিক্ত অধিকারবোধ মাঝেমধ্যে বিরক্তির উদ্রেক করে। নেহাতই প্রেমিকা সে, পছন্দের মানুষ। তাকে ভালো লাগে। মনের সমস্ত ভালোবাসা তাকে ঘিরে। এজন্য মুখ বুজে সহ্য করে। করেছে এতকাল। সিমিকে কয়েকবার বাসায় নিয়ে গেছে। আম্মুর সাথে দেখা করিয়েছে, পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। স্পষ্ট করে কিছু না বললেও আম্মু অনেকটাই বুঝে নিয়েছে। কেবল আব্বুকে বলা হয়নি। আব্বু থাকাকালীন সময়ে ঘুণাক্ষরেও সিমিকে বাসায় নিয়ে আসেনি। একটাই ভয়, সিমিকে যদি আব্বুর কোনো কারণে পছন্দ না হয়, তাহলে তিনি সরাসরি কিছুই বলবেন না। কিন্তু তল দিয়ে ঠিকই কলকাঠি নাড়বেন, যাতে সিমি আর ওর আজীবন একসাথে চলার পথ আলাদা হয়ে যায়। আব্বুকে হাড়ে-হাড়ে চেনে সে।
সাইফুলের বিয়ের সময় সিমি হঠাৎ আবদার করল, বিয়েতে সে উপস্থিত থাকবে। বিয়েবাড়ির আনন্দ উপভোগ করবে ষোলআনা। শারার রাজি হয়নি প্রথমে। সিমিকে আব্বুর শকুনি দৃষ্টির সামনে দাঁড় করানোর কথা ভাবতেই পেটের ভেতর গুড়-গুড় করছিল। পরবর্তীতে সাইফুলের পরামর্শে মনস্থির করল, সিমি কেবল দিবার গায়ে হলুদ আর বিয়ে এই দুইদিন উপস্থিত থাকবে। তাতে করে ওকে অনায়াসে মেয়েপক্ষ হিসেবে চালিয়ে দেয়া যাবে। কিন্তু সিমি বেঁকে বসল। সে প্রতিটা অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে চায়। দিবাকে সে এও বলেছে, বিয়েবাড়ির হৈ-হল্লার মধ্যে কোনো মেয়ে যাতে শারারের দিকে কুদৃষ্টি না দেয়, সেজন্যই তার উপস্থিত থাকা দরকার। এটা শুনেই শারার বুঝে গেছে, সারাক্ষণ সিমি ওর আশপাশে ঘুরঘুর করবে, কখনোবা গায়ের সাথে সুপার গ্লু মেরে লেগে থাকবে, কথিত কোনো মেয়েকে দেখানো উদ্দেশ্যে। কিন্তু তাতে যে হবু শ্বশুরের নজরে পড়ে যাবার সম্ভাবনা আছে, তা নিয়ে তার কোনো মাথাব্যাথা নেই। শারার বিষয়টা নিয়ে আম্মুর সাথে কথা বলেছে। আম্মু নিষেধ করেছে। ওদের বংশের ধারা অনুসারে বিয়ের আগেই ছেলেমেয়ের মেলামেশা কেউ ভালো চোখে দেখবে না। বিশেষ করে শফিকুল চৌধুরী কোনো অবস্থাতেই হজম করবেন না। কিন্তু সিমিকে কিছুতেই বুঝানো গেল না। ফলশ্রুতিতে ক’দিনের সম্পর্ক ছেদ এবং কথাবার্তা বন্ধ। প্রতিবারের মতো শারার আর ওকে মানানোর চেষ্টা করেনি। ভেবেছিল, বিয়েবাড়ির ঝামেলা শেষ হোক। এরপর সিমিকে কল করবে। কিন্তু যতই দিন গড়াচ্ছিল, এক ধরনের স্বস্তি অনুভব করছিল। সিমির অনুপস্থিতি ওকে কখনো পীড়া দেয়নি। বরং মনে হচ্ছিল, কয়েকটা দিন ভালোই কাটবে। এই অনুভূতির সাথে পাখা মেলছিল তিক্ত বোধ।
সাইফুলের ব্যাচেলর পার্টিতে তুবার পাণিপ্রার্থীর দলে শারারের নাম না থাকলেও কথোপকথনে অংশ নিয়েছিল। তুবাকে প্রথম দেখে তার কাছে অসাধারণ কিছুই মনে হয়নি। বরং খুবই সরল আর আলাভোলা টাইপের মেয়ে মনে হয়েছে। যৌবনে পা দিলেও মননের দিক থেকে এখনো কিশোরী। এই মেয়ে প্রেম নিবেদন কী, সেটাই ভালোভাবে জানে নাকি সন্দেহ। প্রত্যাখান করা তো দূরে থাক। তবে বুঝে না উঠলে মায়ের কাছে বলে দেয়ার ব্যাপারটা একদমই উড়িয়ে দেয়া যায় না। আলোচনার আসরে শারার আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল,
– এই মেয়েটাকে শুধু তুই না, যে কোনো ছেলে এসে যদি বলে আই লাভ ইউ, সে গলে মাখন হয়ে যাবে।
– হ্যাঁ। তোরে বলছে না?
– বেট ধর।
– ধরলাম বেট। তুই গিয়ে প্রপোজ কর।
– আজব! আমি কেন প্রপোজ করতে যাব? আমি তো অলরেডি এনগেজড।
– তাতে কী? তুই তো সত্যিকার প্রেম করতে যাচ্ছিস না।
শারার মাথা নেড়ে বলল,
– সত্যি আর মিথ্যা যাই হোক। আমি এসবের মধ্যে নেই। মাফ কর।
সাইফুল ফিক করে হেসে ফেলল। বলল,
– তোরে আসলেই মাফ করা উচিত। নাইলে সিমি যদি জানতে পারে, জবাই দিবে একদম।
আসরে উপস্থিত সবাই হা-হা করে হেসে উঠল। শারার বিরক্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল শুধু। সিমিকে সে ভালোবাসে। মনের মধ্যে আস্ত ভালোবাসার পাহাড় জমা হয়ে আছে। কিন্তু আজকাল ওর নাম শুনলেই তিক্ততা অনুভূত হয়। বলল,
– আমি ওইসব প্রপোজ-টপোজের মধ্যে নেই। বড়জোর যেটা করতে পারি, ওর সাথে একদিন ডেট করে দেখাতে পারি।
কাজিনরা সবাই বুড়া আঙুল দেখিয়ে বলল,
– কচু করবা তুমি! তুবা তোমারে বেইল দিলে তো! মেয়ের যেই মুড! আশপাশ দিয়ে হাঁটা যায় না।
– বেট। আমি ওর সাথে ডেট করব। তবে হ্যাঁ, আগেই বলে রাখি। ডেট মানে শুধুই ডেট। একদিন দেখা করব। খাওয়া-দাওয়া করব। এতটুকুই। এর বেশি কিছু পসিবল না। আর হ্যাঁ, সিমি যেন না জানে।
– আরে, তুই এটুকুই করে দেখা আগে! হ্যাহ! না পারলে সিমিরে বলে দিব। দেখিস।
অতঃপর মেয়েপক্ষের কোনো একজনকে খুঁজে পাবার বাহানায় তুবার সাথে দেখা-সাক্ষাৎ আর কথোপকথন হলো। শারারের অনুমানকে সত্যি প্রমাণ করে তুবা এক বাক্যে রাজি হয়ে গেল বাইরে দেখা করতে। প্রথম দিনেই বাজি জিতে গিয়েছে শারার। পরের কয়েকদিন কাজিনদের উৎসাহে কেবল নাটক মঞ্চস্থ করে গেছে। সবার কৌতুহল ছিল জানতে, শেষ অবধি কী হয়। আজ বোধহয় শেষটা হলো। সাথে আরেকটা শুরু!
তুবার সাথে ডেট করার বিস্তারিত পরিকল্পনা আর বৃত্তান্ত শেয়ার করতে মুলত চ্যাটগ্রুপটা খোলা হয়েছিল। শারার দেখল, আজ সেখানে মেসেজের ঝড় বয়ে গেছে। সাইফুল ইতোমধ্যে ঘটনা জানিয়ে দিয়েছে। ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই রীতিমতো হতভম্ব। খুব সাধারণ একটা বাজি থেকে এতদূর গড়িয়ে যাবে পরিস্থিতি, ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি কেউ। গত কয়েকদিন কর্ণফুলী সিটিতে দেখা করলেও আজ সবাই জোর করেছিল, কোনো একটা রেস্টুরেন্টে যাওয়া হোক। নয়তো ‘ডেট’ ব্যাপারটা ঠিক জমবে না। একই সাথে, এই খবরটা সিমিকে জানিয়ে দেবার পরিকল্পনা ছিল। সিমি যেমন মেয়ে, এই ডেটের কথা শুনলে রাগ-টাগ সব ফেলে হুড়মুড় করে ছুটে আসবে। তারপর শারারের কপালে শনি ঝুলবে। প্রেমিকার সাথে বিচ্ছেদ হয়েছে এই সুযোগে আরেক মেয়ের সাথে ডেটিং! শনি যারপরনাই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে, তা আর বলতে! বলা বাহুল্য, প্রতিবারের সম্পর্ক ছেদের বিরতির অবসান ঘটায় এই কাজিনরাই। কখনো তাতে শারারের সমর্থন থাকে, কখনো জানেও না। কিন্তু আজ সে বাজিমাত করে ফেলেছে। হোক ইচ্ছেয় কী অনিচ্ছেয়।
শারার-তুবা পালিয়ে গেছে, এই খবরটা বোধহয় এখনো কেউ টের পায়নি। নয়তো সাইফুল এটাও চ্যাটগ্রুপে জানিয়ে দিত। আবার হতে পারে, টের পেয়ে চারদিকে খোঁজাখুঁজি চলছে। সাইফুল এখনো সময় করে উঠতে পারেনি চ্যাটগ্রুপে মেসেজ দেবার জন্য। শারার মুচকি হেসে লিখল,
– ভাইগণ, বিবাহ সেরে ফেলেছি। এখন তোরা সবাই মিলে আমাদের জন্য দোয়া করবি।
সবাই উন্মুখ হয়ে আছে ঘটনার বৃত্তান্ত জানাতে। শেষ মেসেজ সাইফুলের, ‘দেখি, আপডেট জানাব নে।’ এর মধ্যে শারারের মেসেজ পেয়ে হুড়োহুড়ি পড়ল। একজন লিখল,
– কীরে? কাহিনি কী ঘটাইলি তুই? কী করছিলি রেস্টুরেন্টে গিয়ে?
শারার লিখল,
– কেন শুনিস নাই কী করছি?
– সাইফুল তো বলল, আকাম করতে গিয়ে ধরা খাইছিস।
– তাহলে তো জানছিসই। আবার জিজ্ঞেস করিস কেন?
– আরে শালা, আসল কথা বল। তুবার সাথে তুই আকাম করবি কেমনে? তুবা তোরে চান্স দিলে তো!
– ভাইসকল, ডেটের চান্স দিয়ে ফেলছে। বাকিটা বুঝে নাও।
– যা ব্যাটা, ওইরকম সব মেয়েই একটু-আধটু চান্স দেয়। তার মানে এই না, আকাম করার লাইসেন্স পেয়ে যাবি।
– লাইসেন্সের ব্যবস্থা তো আব্বুই করে দিল। এখন হানিমুনে যাচ্ছি।
– ফুপাজান তোরে হানিমুন কাকে বলে, কত প্রকার, কী কী ভালোমতো শিখায় দিবে। তুই চিনিস না তোর বাপকে?
– চিনি। এজন্যই তো হানিমুন সারতে যাই।
– মানে?
– মানে লাইসেন্স পাইছি। এখন একটু আকাম না করলে হয়?
– কী বলিস? তুই অলরেডি কাহিনি শুরু করে দিছিস?
– এখনো না। কাল থেকে শুরু হবে।
– অহ। কাল পর্যন্ত তোর লাইসেন্স ভ্যালিড থাকে নাকি, তাই দেখ। শুনলাম, ডিভোর্সের কাগজ রেডি করবে।
– তাই নাকি?
– সাইফুল তো এটাই বলল। তুবার বাপ-মাকে ডেকে আনতেছে ভাবি। ফুপাজান তো ভাবিরে সামনে রেখে কাহিনি খালাস করতে চাইছিল। কিন্তু ভাবি কঠিন চিজ। উনি উনার বাবা-মাকে খবর দিছে।
– আহারে! শ্বশুর-শাশুড়িতে সালাম করাটা মিস হয়ে গেল।
– তোর ঘটনা কী করে? তুই এত চিল মুডে আছিস কেমনে? সিমি কল দিছে নাকি?
– সিমি কে?
– আরে সিমি! তোর গার্লফ্রেন্ড।
– অসভ্য বদমাইশ পোলাপান কোথাকার। একটা বিবাহিত ছেলেকে তোরা বিপথে নেবার পাঁয়তারা করিস! আমার বউ জানলে তোদেরকে কেটে কুটি-কুটি করবে।
– বুঝেশুনে কথা বল, হারামজাদা। তুবা আমার গার্লফ্রেন্ড, ঠিক আছে? তোর ভাবি লাগে। খবরদার, ওরে বউ ডাকবি না। এইসব কাগজের বিয়েশাদি ভ্যালিড না। ফুপা কালকেই তোর লাইসেন্স ইনভ্যালিড করে দিবে।
– তুই শুনে রাখ। এখন থেকে তুবা তোর ভাবি। আমার বউ। ওকে? ওর দিকে কু-নজর দিলে তোর চোখ আমি কাঁটাচামচ দিয়ে তুলব।
অন্যরা এতক্ষণ মেসেজ পড়ছিল। এবার একজন লিখল,
– শারারের কাহিনি কী? হালায় এত চিল মুডে থাকে কেমনে?
শারার লিখল,
– কাহিনি একটাই। বাজিতে আমি জিতছি। শুধু জিতি নাই, তুবাকে পেয়েও গেছি। ইয়েসসসস…
সাইফুল এতক্ষণ বাদে মেসেজ দেখেছে। লিখল,
– শালার আনন্দ দেখো! ইয়েস লেখছে। এদিকে আমার উপর দিয়ে তুফান যাইতেছে। আমি টেনশনে শেষ। দিবা যদি কোনোভাবে জানতে পারে, এই কাহিনিতে আমিও ইনভলভড ছিলাম, আমার ম্যারিড লাইফের এখানেই দি এন্ড। দিবা আজকেই আমাকে ডিভোর্স দিয়ে চলে যাবে বাপের বাড়ি। অই তুই দরজা খোল। তুবার সাথে কথা আছে, আর্জেন্ট।
শারার উত্তর দিল,
– কী কথা, এখানে বল। আমি এখন বউ নিয়ে হানিমুন যাচ্ছি।
– মানে কী?
– মানে আমি এখন রাস্তায়। ঘরে না, বলদ।
– রাস্তায় কী করিস?
– পালাচ্ছি তুবাকে নিয়ে। কবে ফিরব, জানি না। হাতে টাকাপয়সা কম। কাল সকাল হবার সাথে সাথেই ব্যাংকে দৌড়াবি। বাজির পুরো দশ হাজার টাকা আমার অ্যাকাউন্টে জমা দিবি। তোরা সবাই দশ হাজার করে জমা দিবি।
– অ্যাহ! সবাই দশ হাজার করে জমা দিব মানে কী? বাজিতে জিতলে মোট দশ হাজারই পাওয়ার কথা ছিল তোর।
– আগের কথা বাদ। এখন জনপ্রতি দশ হাজার দিবি। কারণ তোদের জন্যই আজ আমি আর তুবা খুব বাজেভাবে ফ্যাসাদে পড়ছিলাম। তুবার গায়ে হাত দিয়েছে ওই লোকগুলো। ওর মোবাইল ফোন, ব্যাগ সবকিছু নিয়ে গেছে। আমার গাড়ি ভেঙ্গেছে। এগুলোর ক্ষতিপূরণ তোদেরই দেয়া উচিত। সেই হিসেবে দশ হাজার টাকা জনপ্রতি কমই চাইছি। ওই সাইফুল। তোর দায়িত্ব এটা। সবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে তুই জমা দিব আগামীকাল সকালেই। ফার্স্ট আওয়ারে। আমার টাকা লাগবে ইমিডিয়েটলি। বুঝতে পারছিস? টাকা না পেলে আমি দিবার কাছে সবকিছু ফাঁস করে দিব। গুড নাইট।
লিখেই মোবাইলটা অফ করে দিল শারার। চার্জ একদমই কম। এটুকু দিয়ে আজকের রাতটা চালাতে হবে। সকালে কক্সবাজারে নেমেই ফোনটা চার্জে দেবার ব্যবস্থা করতে হবে। এরপর ছোট্ট একটা ফার্নিশড বাসা খুঁজতে হবে। আপাতত সমস্ত চিন্তা-ভাবনা আর টেনশন মাথা থেকে দূর করে তুবার দিকে মনোযোগ দিল শারার। ওকে বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছে সে। ঘুমন্ত চোখমুখে খেলা করছে অনাবিল আনন্দ, যেন আপন নীড়টুকু পেয়েই গেছে। শারার নিজেও কি তার নীড় খুঁজে পায়নি? তুবার সাথে দেখা করার উদ্দেশ্য যেটাই থাকুক, গত কয়েকদিনে তুবার উচ্ছ্বলতা ওকে ছুঁয়ে গেছে পুরোপুরি। ক্ষণে-ক্ষণে মন জানান দিয়েছে, প্রেমিকা তো এমনই হতে হয়! উচ্ছ্বল আর চঞ্চল। একটানা অনেকক্ষণ কথা বলে যায়। অবুঝের মতো আবদার করে। চেহারায় খেলা করে ছেলেমানুষী ভঙ্গি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, প্রেমিকা নয়। জীবনটাকে পরিপূর্ণ করতে ঠিক এমন একটা বউ সত্যিই দরকার ছিল। ওর কপালে আলতো চুমু দিল শারার। ফিসফিস করে বলল,
– ভালোবাসব, তুবা। অনেক বেশি ভালোবাসব। আই প্রমিজ।
(সমাপ্ত)