নীড় পর্ব-১৯+২০

0
330

নীড়
রেশমী রফিক
১৯।।
১৯।।
এমপি মাসুদুল করিম র সাথে দেখা করতে তার কার্যালয়ে এসেছেন শফিকুল চৌধুরী। সাথে ওসি আছেন। এমপি সাহেব ব্যস্ত মানুষ। সচরাচর তার দেখা মিলে না। কোনো জরুরী দরকার থাকলে তার পিএসের সাথে কথা বলতে হয়। ওসি সাহেব খবর পাঠাতে চেয়েছিলেন, পুলিশ এসেছে। কিন্তু শফিকুল চৌধুরী তার নামটাই বলে পাঠালেন। ওসিকে ইশারায় বললেন,
– আপনি চুপচাপ তামাশা দেখেন। এই এমপির খেল আমি বের করব আজ।
কথা ফলতে সময় লাগবে। কিন্তু তার লক্ষণ দ্রুতই দেখা দিল। মিনিটখানেক আগেও এমপির পিএস বলেছিল, স্যার জরুরী মিটিংয়ে আছে। দেখা হবে না। অথচ এখন বলছে, এমপি নাকি তাদেরকে বসতে বলেছেন। এর পেছনের কারণটা অবশ্যই শফিকুল চৌধুরী নন। এমপি আসলে কল পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে। সচিবের সেক্রেটারি নিজে কথা বলেছেন তার সাথে। মাসুদ অবশ্য তাতে ভড়কে যাননি। তবে বুঝে-সমঝে কথা বলেছেন। সেক্রেটারি হলেও ফোনের ওপাশের লোকটার ক্ষমতা নেহাতই কম নয়। সচিব তো নাম-মাত্র। তার মূল কাজকর্ম ছাড়াও যত রকমের দৌড়াদৌড়ি আছে, সবকিছু সেক্রেটারি সম্পন্ন করে। সচিব শুধু নির্দেশ দিয়েই ক্ষান্ত হন। একারণে বিভিন্ন জায়গায় সচিবের নিজের যতটা না পরিচিতি আছে, সেক্রেটারির গন্ডি তার চেয়েও বড়।
এমপি মাসুদ ব্যস্ত মানুষ। কিন্তু এই লোক তার চেয়েও বেশি ব্যস্ত। তবু কী কারণে এরকম সাধারণ একটা খুচরো ঘটনায় তিনি নাক গলাচ্ছেন, তা বোধগম্য নয়। মাঠ-পর্যায়ের বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলোতে তার মতো উচ্চস্তরের কাউকে সচরাচর জড়িত হতে দেখা যায় না। কিন্তু স্বর্ণপাতার থালা প্রসঙ্গে সেক্রেটারি নিজে কল করেছেন, তার মানেই বুঝতে হবে ব্যাপারটা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেবার মতো নয়। ব্যস্ত মানুষ, তাই সংক্ষেপে কথা শেষ করেছেন। কেবল এতটুকুই বলেছেন,
– আপনার এলাকায় কি কাজকর্ম কিছু নাই? দেশের উন্নয়ন কি সব প্রথম বছরেই করে ফেলছেন যে, গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন? যতসব ফালতু ঘটনায় পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ছেন। ব্যাপারটা আসলে কী, বলুন তো। স্বর্ণপাতার থালা নিয়ে আপনার অবজেকশন কোথায়? কেন ওই মেয়েটাকে বারবার হ্যারাস করছে আপনার লোকজনরা?
এই এতটুকু কথাতেই মাসুদ বুঝে নিয়েছেন, স্বর্ণকে সহজভাবে নেয়াটা ভুল হয়েছে। শিল্পপতির মেয়ে হলেও রাজনৈতিক মহলে যথেষ্ট ভালো সংযোগ আছে তার। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে কল এসেছে মানে বাপের থেকেও মেয়ে বেশি ক্ষমতাধর। এতদিন শামুকের মতো গুটিয়ে রেখেছিল নিজেকে। সাধারণ মানুষের ভূমিকায় অভিনয় করছিল। অসহায় সেজে আমজনতার দৃষ্টি আকর্ষণ করছিল। এবার ভোল পাল্টে ফেলেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, আজ কী এমন ঘটনা ঘটেছে ওই রেস্টুরেন্টে?
সেক্রেটারি ফোন রাখার আগে কাট-কাট করে বললেন,
– যত দ্রুত সম্ভব, ঝামেলা শেষ করেন। এই রেস্টুরেন্ট নিয়ে আমি যেন আর কোনো ফোনকল না পাই। আপনার কাজকর্ম না থাকলেও আমার আছে। একটু বেশিই আছে। সচিব স্যারের পুরো রেস্পন্সিবিলিটি আমার ঘাড়ে। সো, এতসব নখরামো দেখার সময় আমার নাই।
মাসুদুল করিমের তখন বলতে ইচ্ছে হয়েছিল,
– আপনি যখন এতই ব্যস্ত, তাহলে ইগনোর করলেন না কেন? এই স্বর্ণপাতার থালা নামের দুই আনা রেস্টুরেন্ট নিয়ে আপনাকেইবা কেন মাথা ঘামাতে হচ্ছে। যেভাবে আমাকে বললেন, সেভাবে অপর পক্ষকেও বলতে পারতেন, এই সব খুচরো ঝামেলায় নাক গলানোর সময় নেই।
বললেন না। যতই ক্ষমতাধর হন না কেন, মাথার উপরেও আরেক মাথা থাকে। তাকে সহসা কিছু বলা যায় না। কেবল মাথা নিচু করে শুনতে হয়। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না। মাসুদ কিছুক্ষণ ‘জি স্যার-জি স্যার’ করে ফোন রাখলেন। ঠিক তখন পিএস এসে খবর দিল, শফিকুল চৌধুরী নামে এক ব্যবসায়ী এসেছেন তার সাথে দেখা করতে। কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা ছিল না। জরুরী ভিত্তিতে এসেছেন। সাথে ওসি আছেন। পিএস নিজেও ঘটনার বিস্তারিত জানে না। তবে শফিকুল চৌধুরী যে স্বর্ণপাতার থালা সম্পর্কিত কথাবার্তা বলতে এসেছেন, তা বলতে বাকি রাখেনি। এমপি মাসুদ তাকে নির্দেশ দিয়েছেন, তাদেরকে সসম্মানে আপ্যায়ন করতে। তবে একবার যেহেতু বলা হয়েছে, তিনি গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে আছেন। চট করে দেখা করবেন না। তার আগে আজকের ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হবে। সবটা জেনে, কথাবার্তা গুছিয়ে তবেই শফিকুল চৌধুরীর সাথে দেখা করবেন। নয়তো হিতে-বিপরীত হয়ে যেতে পারে। আর বল একবার কোর্টের বাইরে চলে গেলে তাকে ফিরিয়ে আনা কঠিন। এলাকার এমপি তিনি। এলাকার পার্টি অফিসের ছেলেপেলেদের একমাত্র ভরসা। ওদেরকে ধসিয়ে দেয়া চলবে না। তবে পরবর্তীতে হুঁশিয়ারি জারি করতে হবে যেন কারও সাথে পাল্লা দেবার আগে তার গতিবিধি আর পরিচিত গন্ডি দেখে নেয়।
পার্টি অফিসের নেতা নাইম সবসময় এই বিষয়গুলো সামাল দেয়। স্বর্ণপাতার থালাকে ঘিরে যা কিছু হয়েছে বা হচ্ছে, তার মূল হোতা নাইম। তিনিই ওকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, যেন কায়দা করে রেস্টুরেন্ট বন্ধ করার ব্যবস্থা করে। একে তো অল্পবয়সী মেয়ে, তার উপর এলাকায় এসে আরামসে ব্যবসায় শুরু করেছে। কোনোরকম চাঁদা দেয়নি। কয়েকজন ছেলেছোকরা গিয়েছিল চাঁদা চাইতে। তাদের সাথে কঠিন আচরণ করেছে। উলটো হুমকি দিয়েছে, আরেকবার চাঁদাবাজি করতে আসলে পুলিশকে জানাবে। মামলা করবে ওদের নামে। এছাড়াও ক্ষমতাধর প্রভাবশালী বাবার ভয় দেখিয়েছে। নাইম তখন থেকে বেদম ক্ষেপে আছে। তার ভাষ্যমতে, মেয়েটা এক নম্বরের বেয়াদব। নাইমকে নাকি সে গোণায় ধরে না। এই বিষয়টা নিয়েই কথা বলতে এসেছিল। তখনই মাসুদকে জানিয়েছে, স্বর্ণর বাবা বিরোধী দলের সমর্থক। তাও এমন একজনের সাথে স্বর্ণদের লতায়-পাতায় আত্মীয়তা, যার সাথে মাসুদুল করিমের সাক্ষাৎ শত্রুতা। রাজনীতিতে বিপক্ষ দলের নেতাকর্মীদের সাথে দেখা হলে মুখে হাসি ঝুলিয়ে রাখাটা, আন্তরিক হবার ভান করাটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু ওই লোক সামনে পড়লে মাসুদ সেই হাসিটুকু দেবার দরকার মনে করেন না। না দেখার ভান করে এড়িয়ে যান। স্বভাবতই তিনি আশ্বাস দিয়েছেন নাইমকে। যা কিছু হোক, ওর পক্ষে থাকবেন। বিষয়টা বেগতিক পর্যায়ে গেলে সামাল দেবেন। এতকাল ঝামেলা যতটুকুই হয়েছে, তাকে এর মধ্যে নাক গলাতে হয়নি। স্বর্ণপাতার থালা নিয়ে কী হয়েছে, ঠিকঠাক জানেনও না। নাইম তাকে অল্পসল্প আপডেট দিয়েছে শুধু। অথচ আজ কিনা সরাসরি ফোনকল চলে এসেছে তার কাছে। বিষয়টা অবশ্যই বেগতিক।
নাইমের কাছে সবটা শোনার পর এমপি মাসুদের ভ্রু কুঁচকে গেল। নাইমও শুনল তার কথা। অস্থির সুরে বলল,
– ভাই, আপনার কাছে রিকুয়েস্ট। কোনোভাবে সচিবের সেক্রেটারি স্যারকে ম্যানেজ করেন। নাইলে বিষয়টা পাকা ধানে মই দেয়ার মতো হয়ে যাবে। এতদিন যাওবা ধুনফুন চলছে। আজকে একদম হাতেনাতে ধরছি টাইট কইরা। ফান্দে পইড়া ওই মাইয়ার এখন আর ডাইনে-বায়ে কোনোদিকে যাওয়ার উপায় নাই। এইজন্য এরে-ওরে দিয়া কল করাইতেছে। কিছুক্ষণ আগে এলাকার এক বড় ভাইকে ডাকাইছিল। তাকে পুলিশ ভয় দেখাইছে। উনি ভদ্রলোক। পিছিয়ে গেছেন। এখন আমরা ফিল্ড দখল করছি। একেবারে প্রাইম টাইম। এখন যদি বলেন পিছানো লাগবে, তাইলে তো ভালো রকমের সমস্যা। বিষয়টা এখন হারজিতের দিকে আগাইছে। একটু ভাবেন, ভাই। এই মেয়ে একবার আমাদের অ্যাগেইন্সটে জিতে গেলে তার আস্পর্ধা কতদূর যাইব। আর দলের মধ্যে আপনার পজিশনটাও জুত থাকল না। আমাগো দল ক্ষমতায় থাকতে আমাগো এলাকায় বিজনেস করতে আইসা জিত্তা যাইব বিরোধী পার্টি। ইজ্জতের তো পুরাই দফারফা। একটু দেখেন ভাই।
নাইমের কথা একদমই ফেলে দেবার মতো নয়। খানিকক্ষণ ভাবলেন মাসুদ। তারপর বললেন,
– তুমি এক কাজ করো। আমার অফিসে চলে আসো। ওই ছেলের বাবা এসেছে আমার সাথে কথা বলতে। ওসি আছেন। ঘটনার সময় তুমি যেহেতু ওখানে ছিলে, এই আলোচনায় তোমার প্রেজেন্ট থাকাটা জরুরী। সবথেকে ভালো হয় যদি তুমি ওদেরকে হ্যান্ডেল করো। বাট ইন অ্যা প্রপার ওয়ে। টাইট যেহেতু দিয়েছ, অল্পসময়ের মধ্যে গুটি চেলে দাও। কাহিনি ঝটপট গুছিয়ে ফেল। বুঝতে পারছ তো, কোন জায়গা থেকে কল এসেছে। এবং আরও একবার সেখানে কল করার উপায় রাখা যাবে না। অলরেডি ওদেরকে বলা হয়েছে, আমি মিটিংয়ে আছি। তাছাড়া আমার ছেলের বাচ্চা হবে আজ। অ্যাপোলোতে যেতে হবে। আমার সময় হবে না। আমি জাস্ট তোমাকে ইন্ট্রুডিউস করিয়ে দেব।
– জি ভাই। আমি এখনই আসতেছি। আপনি একদম চিন্তা কইরেন না।
– হ্যাঁ চলে আসো। আর ব্যাপারটা আজকেই শেষ করবা।
– আচ্ছা ভাই। (চলবে)

নীড়
রেশমী রফিক
২০।।
ঘটনাস্থল থেকে এমপির অফিস পর্যন্ত আসতে নাইমের মিনিট বিশেক লাগল। আসার আগে দলের উঠতি এক কর্মীকে ওখানের অবস্থান ভালোভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে। সবাইকে জানিয়েছে এমপির কলের কথা। এও বলেছে, তার অনুপস্থিতিতে যেন কোনোরকম নড়চড় না হয়। এমপির সাথে কথা বলেই সে ফিরবে। তারপর যা ব্যবস্থা নেবার, নেবে।
কার্যালয় খুব বেশি দূরে না। চট করে রিকশায় চড়ে চলে আসা যায়। তাতে বড়জোর পাঁচ-সাত মিনিট লাগে। কিন্তু সে হেঁটে এসেছে। কারণ এমপির মুখোমুখি হবার আগে বা শফিকুল চৌধুরীকে মোকাবিলা করার আগে তার একটু সময় দরকার। মাসুদ ভাই বরাবরের মতো আজও ওর উপর দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন। তার কেবল একটাই কথা, আজই সবরকমের ঝামেলা শেষ করতে হবে। সেক্রেটারির কাছে আর ফোনকল যাওয়া চলবে না। অতএব, আজই স্বর্ণকে একহাত দেখে নিতে না পারলে কোনোকালেই তা সম্ভব না। অথচ পরিকল্পনা কিছুই করা হয়নি। আজকের এই ঘটনাও অপরিকল্পিত। তিনটা ছেলেকে ভিন্ন-ভিন্ন অবস্থান থেকে রেস্টুরেন্টের উপর নজর রাখতে বলা হয়েছিল। যাতে কোনোরকম সুযোগ ফস্কে না যায়। ওরা ওদের দায়িত্ব সুন্দরমতোই পালন করেছে। সারাক্ষণই তক্কে-তক্কে ছিল। তাই স্বর্ণর বন্ধু আর তার প্রেমিকাকে হাতেনাতে ধরতে সময় লাগেনি। কথা হচ্ছে, পরের পদক্ষেপ কী হবে? অসামাজিক কার্যকলাপের অভিযোগ তুলে রেস্টুরেন্ট ঘেরাও করে বেশিদূর যাওয়া যাবে না, এই বুদ্ধিটুকু তার ঘটে আছে। তাছাড়া, এই অসামাজিক কার্যকলাপের শক্তপোক্ত প্রমাণ নেই। সে কেবল সময়ক্ষেপণ করছিল, যাতে চিন্তাভাবনা করে পরের ধাপে পা আগানো যায়। তার আগেই এমপি কল এসেছে। অতএব যে সময়টুকু দরকার ছিল, তা একেবারেই নেই। যা চিন্তাভাবনা আর পরিকল্পনা করার, হাঁটাপথে এমপির অফিসে যেতে-যেতেই করে ফেলতে হবে।
অফিসের দারোয়ানকে বোধহয় আগেই বলা ছিল। নাইম পৌঁছুবার পরই তাকে সরাসরি গেট থেকে এমপির বাসভবনের দিকে যেতে বলা হলো। নাইম অবাক হলো একটু। এর আগে কখনো ওখানে যায়নি। সবসময় অফিসে দেখা করেছে। একজন কর্মচারী পথ দেখিয়ে নিয়ে নিল ওকে। মাসুদুল করিমের বাসভবনটা অফিসের ঠিক পেছনে। ওদিকে আরেকটা সদর গেট আছে। ওটা ব্যক্তিগত কাজে বা পরিবারের সদস্যদের জন্য ব্যবহৃত হয়। তাছাড়া দুটো ভবনের মধ্যিখানে বেশ খানিকটা খোলামেলা জায়গা আর ঘন গাছ-গাছালি থাকায় সচরাচর এপাশ থেকে ওই ভবনটা চোখে পড়ে না। এতকাল নাইমও সেভাবে লক্ষ করেনি। আজ অফিস ভবন পার হতেই পেছন দিকে এগিয়ে যাওয়া সরু হাঁটাপথ অনুসরণ করে নজরে এলো বিশাল দোতলা বাড়ি। আকারে অফিস ভবনের দ্বিগুণ হবে।
পুরো জায়গাটা বা দুটো ভবনই মাসুদুল করিমের পৈত্রিক সম্পত্তি। আশপাশে আরও কিছু সয়সম্পত্তি আছে। সেসব তার ভাইবোনদের দখলে। এই বাড়ি দুটো তিনি পেয়েছেন। তাই একই সীমানার মধ্যে রেখেছেন। একজন এমপির পারিবারিক বাসভবন জনসাধারণের চাইতে কিঞ্চিৎ বিলাসবহুল হবে, এমনটা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে খুব স্বাভাবিক। নাইমের চিন্তাধারাও ছিল এমন। কিন্তু বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে বুঝল, আদতে তার কল্পনাকেও হার মানিয়েছে বাস্তব। হাঁ করে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল সে। ঢাকা শহরের মধ্যে এরকম রাজকীয় বাড়ি সম্ভবত এই প্রথম দেখল। বাড়িটা এতদিনে দুদকের নজরে পড়ে যাবার কথা ছিল। পড়েনি, কারণ স্থানীয় এলাকাবাসী থেকে শুরু করে আশপাশের প্রায় সবাই জানে বাড়িটার বয়স অনেক। অর্থাৎ বাড়িটা মাসুদুল করিম কোনো অবৈধ উপার্জন থেকে নির্মাণ করেননি। রাজনীতিতে পা দেবার সুবাদে তিনি চিরাচরিত কালো পথে একটু-আধটু পা রাখলেও এই বাড়িটার মধ্যে কোনোরকম দুর্নীতি প্রবেশ করতে পারেনি।
মাসুদুল করিমের দাদা ছিলেন ব্রিটিশ সরকারের একজন নামিদামি কর্মচারী। সেই আমলে এখানে জায়গা কিনে বাড়ি করেছিলেন তিনি। সৌখিন রুচির মানুষ বিধায় বিলেত থেকে বাড়ি বানানোর নানারকম কাঁচামাল কিনে আনা হয়েছিল। সম্পূর্ণ নির্মাণের পর আশপাশের সবার তাক লেগে গিয়েছিল। শোনা যায়, স্বয়ং ক্লাইভ নাকি বাড়িটা নিজ চোখে দেখতে এসেছিলেন। কালের বিবর্তনে বাড়িটার জৌলুস এখন আর আগের মতো নেই। বংশের ভেতরেই হাতবদল হয়েছে কয়েকবার। ঘষামাজা আর সংস্কার চলেছে। শেষমেশ মাসুদুল করিম অন্য সম্পত্তিতে নিজের ভাগ ছেড়ে এই বাড়ি পুরোটাই নিজের নামে লিখে নিয়েছেন। এখন নিজেই থাকেন পরিবার নিয়ে। সঙ্গত কারণে তিনিও বেশ ভালোই পয়সাওয়ালা। সব ভাইবোনরা মিলে পারিবারিক ব্যবসায়ের যশ এখনো ধরে রেখেছেন শক্ত হাতে। তাই বাড়িটার আগের মতো চোখ-ধাঁধানো রুপ না থাকলেও এর পেছনে টাকাপয়সা খরচ হয় বছরান্তে।
মাসুদুল করিম বারান্দায় দাঁড়িয়ে নাইমের হতভম্ব চেহারা দেখছেন। এই বাড়িটাকে ঘিরে তার এক ধরনের চাপা গর্ব আছে। কমবেশি প্রত্যেকেই বাড়িটা দেখলে অবাক হয়। এটুকু তার জানা। অনেকের হতবাক চেহারাও দেখা হয়েছে। কিন্তু নাইমের হাঁ করে তাকিয়ে থাকাটায় কেন জানি অন্যরকমের আনন্দ লাগল তার। খানিকবাদে ওকে ডাকলেন,
– অ্যাই গাধা ছেলে, তুমি নিচে দাঁড়িয়ে আছ কেন? উপরে আসো।
নাইম চটজলদি বিস্ময় লুকিয়ে ফেলল। দ্রুত পা বাড়াল বাড়ির ভেতর। ততক্ষণে মাসুদ সাহেব নিচতলায় নেমেছেন। একবারে পরিপাটি হয়ে এসেছেন। ওর সাথে কথা বলেই বের হবেন। সাথে পরিবারের আরও অনেকে যাবে। বাড়ির ভেতর উৎসবের আমেজ টের পাওয়া যাচ্ছে। মাসুদ বসার ঘরে ঢুকেই হাঁক ছাড়লেন,
– অ্যাই নয়ন, কোথায় গেলি? দুই কাপ মালাই চা আর মিষ্টি দিয়ে যা এখানে।
বলেই নাইমের দিকে ফিরলেন। তার মুখে হাসি। বললেন,
– নাতি হয়েছে, বুঝলে। এইমাত্র শুনলাম। অবশ্য খবর আগেই জানা ছিল। স্ক্যানে দেখিয়েছে ডাক্তার। আজকে সিজার হলো। সেজন্যই একটু টেনশন হচ্ছিল।
মাসুদুল করিম সচরাচর পরিবারের আলাপ করেন না বাইরের কারও সাথে। তার কাছে রাজনীতি পরিবার দুটো সম্পূর্ণ আলাদা অধ্যায়, যা সমান্তরালে পথ চলছে পাশাপাশি। কখনো মধ্যেকার দুরত্বের হেরফের হয় না। কিন্তু আজকের দিনটা অন্যরকম আনন্দের। বেশ অনেকগুলো বছরের হাহাকার আর চাপা কষ্ট একপাশে সরিয়ে প্রথমবারের মতো পরিবারে নতুন প্রজন্মের ছেলেসন্তান এসেছে। এর আগে সবগুলোই কন্যা। তাদের কেউই কারও চেয়ে কোনো অংশে কম নয় মাসুদুল করিমের দৃষ্টিতে। নাতনীদের সবাইকে তিনি দিনরাত চোখে হারান। তবু মনের গহীণে কোথাও একটু খচ-খচ করত। একটা ছেলেসন্তান না থাকলে তার সমূহ সয়সম্পত্তির ভাগীদার তৈরি হয়ে যাবে আশপাশ থেকে। আজ থেকে মনের কাঁটাও দূর হয়েছে। আনন্দে ঝলমল করছেন মাসুদ।
নাইম হেসে অভিনন্দন জানাল তাকে। তিনি বললেন,
– অনেকদিন ধরে মনে হচ্ছিল মাথার উপর কালো আকাশ। চারপাশ অন্ধকার হয়ে আছে। আজ সুর্য উঠেছে। আলোয় ঝলমল করছে সব। আমি চাই, এই আলো বহুদূর যাক। আমার চারপাশে কোনোরকম অন্ধকার আমি সহ্য করব না। হোক তা ফ্যামিলিতে, অথবা পলিটিক্সে। বুঝতে পেরেছ, কী বলেছি?
নাইম উপর-নিচে মাথা ঝাঁকাল। মাসুদ আবার বললেন,
– তুমি জানো, আমি ভাগ্যে বিশ্বাস করি না। তবে কিছু কিছু ব্যাপার খুব মেনে চলি। আজ সকালে ঘুম ভেঙ্গেই দুটো ভালো খবর পেয়েছি। এখন সবথেকে ভালো খবর পেলাম। কিন্তু কী জানো, এত ভালোর মধ্যেও কাঁটার মতো বিঁধে আছে সচিব স্যারের সেক্রেটারির ফোনকল। আমি আমার দলকে, আমার সিনিয়রদের সাথে সবসময় ভালো সম্পর্ক রাখি। কেউ আমাকে পেছন থেকে আঁতকা বাঁশ দিলেও কিছু বলি না। আলগোছে সরে যাই। কেন, জানো? কারণ, দলের সবাইকে আমি ফ্যামিলি ভাবি। এই তোমরা থেকে শুরু করে পিএম পর্যন্ত আমার আপনজন। অথচ সেই আপনদের মধ্য থেকে একজন আমাকে কল করেছে ওই রেস্টুরেন্টের পক্ষে কথা বলতে। ব্যাপারটা আমার জন্য কতখানি ইনসাল্টিং, ভাবো! আমাকে হটাতে ওই মেয়ে বা ওর বাপ হোয়্যাটএভার আমারই দলের একজন সিনিয়রকে দিয়ে কল করিয়েছে। হাউ ডেয়ার দে আর! আমার এতগুলো ভালোর মধ্যে যেন এক পিঞ্চ কালি ঢেলে দিল। আমার দিনটাই বরবাদ জাস্ট!
নাইম নিচু সুরে বলল,
– ভাই, ওই মেয়েরে এমন শিক্ষা দিব। এই জন্মে তো দূরে থাক, পরের কয়েক জন্মেও সে আর আসবে না আপনার সাথে টেক্কা দিতে। ওর চৌদ্দগুষ্টিও আসবে না আপনের ছায়া মাড়াইতে। এই আমি বলে রাখলাম। আমাকে জাস্ট একটু সময় দেন। কাহিনি গুছায় আনছি। এখন যদি পিছাই…
– পেছানো লাগবে না। তবে আজকের দিনই আছে তোমার হাতে। আমি এর একটা বিহিত চাই। অ্যাট এনি কস্ট।
– আজকেই কাজ হইয়া যাবে, ভাই। এক্কেরে হাতেনাতে। স্বর্ণ তো যাইব, লগে সেক্রেটারি স্যারেও শরম পাইয়া যাইব অর পক্ষে কথা বলছে বইলা।
– গো অ্যাহেড দ্যান। আমি তোমাকে ভরসা করি, নাইম। তুমি সবসময় আমার পক্ষে কাজ করেছ। আমি তোমাকে দলের অন্য কারও থেকে মাচ-মোর এপ্রিশিয়েট করি। আর রেকমেন্ডেশনেও তোমার নামটাই আগে থাকবে।
– ভাই, কে জানি আসছিল, বললেন?
– শফিকুল চৌধুরী না কে জানি। রেস্টুরেন্টের ব্যাপারে কী যেন বলবে। সাথে ওসিকেও এনেছে। আমি যাইনি দেখা করতে। ওসির সামনে আই ডোন্ট ফিল কমফোরটেবল উইথ দিজ কাইন্ড অফ টপিক। লোকটা সুবিধার না।
– বুঝতে পারছি, ভাই। আপনি টেনশন নিয়েন না। আমি এখন গিয়ে দেখা করতেছি শফিকুল সাহেবের সাথে। যা ব্যবস্থা করার, আমিই করব। ওসিকেও খানিকটা টাইট দেয়া লাগবে। আপনি শুধু খবর পাঠান, আজকে আপনার সাথে দেখা হবে না। যা কথাবার্তা যেন আমার সাথেই বলে।
– ওসিকে এখন কিছু বলার দরকার নাই। তার সাথে আমার আলাদা কিছু ডিল আছে। তাছাড়া, লোকটা ভীষণ কাজেরও। তাকে চটানো যাবে না। তবে আমি বলে দিচ্ছি যেন তোমার ফেভারে থাকে। বাট প্ল্যান কী তোমার? ইন শর্ট বলো তো!
– প্ল্যান তেমন আহামরি কিছু না। কিন্তু রেজাল্ট হবে একদম কমপ্লিকেটেড। স্বর্ণর হালুয়া টাইট হয়ে যাবে।
– কীরকম?
– যেই দুইজনকে হাতেনাতে ধরছি, তাদের বিয়ে পড়ানোর ব্যবস্থা করব। একদম পাবলিকের সামনে কাজি ডেকে এনে বিয়ে। না পারবে ডিক্লাইন করতে, কারণ এরা বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ড। ডিক্লাইন করলে নিজেদের মধ্যেই ক্যাচাল লাগবে, আবার বিষয়টা সহজে অ্যাকসেপ্ট করার মতো না। বিয়ে তো মুখে-মুখে হয় না। বিয়ে প্রসঙ্গে অনেক ব্যাপার-স্যাপার আছে। তাছাড়া, শফিকুল সাহেবের মতো মাননীয় একজন ব্যক্তির ছেলের বিয়ে এরকম সিচুয়েশনে হবে না। অন্তত উনি এইটা মানবেন না। আবার আমরাও জোর দাবি তুলব, অসামাজিক কাজকর্ম করতেছিল তারা। এখন বিয়ে না করাইয়া ছাড়া যাবে না। এই বিয়েটা ওইসব কাপলদের জন্য জলজ্যান্ত এক্সাম্পল্ম যারা এইখানে-সেইখানে নানান কুকাজ করে বেড়ায়। আর স্বর্ণর জন্য সাক্ষাৎ গালের উপর জুতার বাড়ি। ও এইসব কুকাজকে প্যাম্পার করে। ওর মদদে হয় সবকিছু। যেহেতু শফিকুল সাহেব রাজি হবে না। উনি অবশ্যই এইটা নিয়ে ঝামেলা করবে। আমরাও নামমাত্র ঘ্যানঘ্যান করতে থাকব। ঘটনা অনেকদূর জানাজানি হবে। এই চান্সে আমরা কতগুলা পত্রিকায় খবর দিব যেন তারা সাংবাদিক পাঠায় কভার করতে। চিন্তা করেন ভাই, শিল্পপতির মেয়ে রেস্টুরেন্ট বিজনেসের আড়ালে অসামাজিক কাজকর্ম চালায় আর শফিকুল সাহেবও মোটামুটি ফেমাস বলা যায়। উনার আলাদা একটা লেভেল আছে। উনার ছেলেই কি না গার্লফ্রেন্ডের সাথে কুকাজ করতে গিয়ে ধরা পড়ছে। এই জিনিস যদি দেশের প্রথম সারির কয়েকটা পেপারে ছাপা হয়, একদম ছবিটবি সহ। তারপর ধরেন যদি টিভি চ্যানেলের লোকজন আনতে পারি, তাইলে তো আজকেই কেল্লাফতে। শিল্পপতি আর তার মেয়ের তো যাইবই, শফিকুল সাহেবেরও ইজ্জত শেষ। আমাদের কাজ এটাই। ঘটনা রাষ্ট্র করে দেয়া। বাকিসব করবে সাংবাদিকরা। আমরা শুধু খবর পাস করব এলাকাবাসীর নাম দিয়ে।
মাসুদুল করিমের চোখমুখ চকচক করে উঠল। তিনি সহাস্যে জড়িয়ে ধরলেন নাইমকে। বুকে চেপে ধরে বললেন,
– ইউ আর অ্যা জিনিয়াস, মাই বয়!
(চলবে)