নীড় পর্ব-২৯+৩০

0
374

নীড়
রেশমী রফিক
২৯।।
দিবা এসেছে। সাথে সাইফুল। শফিকুল চৌধুরীর গাড়িতেই এসেছে সে। তবে বাসার ভেতর ঢোকেনি। শফিকুল চৌধুরী ওকে বলেছেন, যেন দিবাকে নিয়ে তার বাসায় চলে আসে। আগেভাগে কিছু বলার দরকার নেই। কেবল বলবে, ফুপাসাহেব ডেকেছেন জরুরী দরকারে। সাইফুল এরপর দিবাকে কল করেছে। দিবা মায়ের বাসায় গিয়েছিল। তুবাকে পাওয়া যাচ্ছে না এই খবরটা নিশ্চিত হবার পর থেকেই শেফালি হূলুস্থুল বাঁধিয়ে ফেলেছেন। চিৎকার-চেঁচামেচি করছেন। একে-ওকে কল করছেন পাগলের মতো। কারও কাছেই তুবার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। স্কুলের পর কোনো এক ছেলের সাথে দেখা করতে গেছে। কোচিংয়ের সময় ফিরে আসার কথা ছিল। কিন্তু এরপর আর তার টিকিটি পাওয়া যায়নি।
দিদারুল সাহেব বেশ কয়েকবার কল করেছেন তুবার মোবাইলে। ফোনটা বন্ধ। দুশ্চিন্তায় কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম জমেছে। মাথার ভেতর তালগোল পাকিয়ে গেছে। মেয়েকে তিনি ভালোই চেনেন। উল্টাপাল্টা কোনো কাজ করার ধাতে নেই সে। এমনিতেও মেয়ের সাথে মোটামুটি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আছে তার। শেফালির মতো কড়া শাসন করেন না। তবে বন্ধুত্বের ছলে, কথাপ্রসঙ্গে মেয়েকে ঠিক-বেঠিক শেখান। তার মনে হয় না, তুবা কোনো ছেলের সাথে প্রেম করতে পারে। বান্ধবীদের কাছ থেকে যতটুকু জানতে পেরেছেন, অল্প কিছুদিন হলো এক ছেলের সাথে দেখাসাক্ষাৎ করছে সে। বড়জোর তিন-চারবার হবে। এর আগে কখনো এমন কিছু করেনি। নিয়মিত কলেজে যাওয়া-আসা করেছে। কোচিংয়ে গেছে। এরপর সময়মতো বাসায়ও ফিরেছে। খুব ভালো ছাত্রী না হলেও পড়াশুনায় বেশ মনোযোগী সে। সেই মেয়ের আজ কী হলো, কোথায় গেল, মোবাইলটা কেন বন্ধ করে রেখেছে, ভাবতে গেলে আউলে যাচ্ছে সবকিছু।
তুবার এখন যে বয়স, তাতে কোনো ছেলের সাথে পরিচয় হওয়াটা খুব স্বাভাবিক। প্রেম হলেও অবাক হবার কিছু নেই। কিন্তু তুবার ক্ষেত্রে এসব ভাবা যাচ্ছে না। তুবা ওরকম মেয়ে নয়। প্রেমে পড়লে সবার আগে দিবাকে বলবে সে। দিবার সাথে তার বয়সের পার্থক্য বেশ খানিকটা থাকলেও দিনার ওই ঘটনার পর দুই বোন মানসিকভাবে অনেকটাই কাছাকাছি হয়ে গেছে। বিয়ের আগে দুই বোন এক ঘরে ঘুমুত। বিছানায় শুয়ে গুটুর-গুটুর গল্প করত। দিবা তার নিজের অনেক কথাই শেয়ার করেছে। সাইফুলের সম্পর্কে এই বাসায় তুবাই সবার আগে জেনেছে। তারপর বাবাকে বলেছে। দিদারুল সাহেব অবাক হলেও দিবাকে কিছু জিজ্ঞেস করেননি। মেয়ে বিব্রত হতো। তুবার কাছ থেকে যতটুকু শুনেছিলেন, তাতে মনে হয়নি সাইফুলের সাথে দিবার প্রেম চলছে। ব্যাপারটা সাইফুলের দিক থেকে একতরফা। অর্থাৎ দিবা হয় দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছে। নয়তো সাইফুলকে তার পছন্দ নয়। দিবার সাথেও দিদারুল সাহেবের খুব গভীর সম্পর্ক। এজন্য তিনি ধরেই নিয়েছিলেন, সময় হলে দিবা নিজেই ব্যাপারটা জানাবে। হয়েছিলও তাই। সাইফুল যেদিন হুট করে বাসায় চলে এসেছে, ওকে দেখামাত্র দিবা আঁতকে উঠেছিল। তারপর দৌড়ে গিয়ে তাকে জানিয়েছে। সংক্ষেপে যতটা খুলে বলা যায়, বলেছে। তুবার জীবনে এরকম কিছু ঘটলেও সেও বলত। বলেনি, তার মানেই এখানে অন্য ব্যাপার আছে।
ছেলেটা কে আসলে? হয়তো তুবাকে পছন্দ করে। কোনো এক বাহানায় দেখা করেছে। তারপর? তুবা সম্ভবত তাকে পছন্দ করেনি। হয়তো প্রত্যাখান করেছে। হতে পারে, আজই। তারপর কী হয়েছে? তুবা কেন বাড়ি ফেরেনি? নানান প্রশ্ন জট পাকিয়ে যাচ্ছে। শান্ত ভঙ্গিতে কিছুই ভাবতে পারছেন না দিদারুল সাহেব। তার মন বলছে, তুবার সাথে খারাপ কিছু ঘটেছে। বিপদে পড়েছে সে। ওই ছেলেটা কি ওর কোনো ক্ষতি করেছে?
অজানা আশঙ্কায় বুকের ভেতরটা দুরু-দুরু কাঁপছিল। শেফালি কোনোদিকে খোঁজ না পেয়ে কাঁদতে বসে গেছেন। বিলাপের সুরে তুবাকে ডাকছেন। মেয়ের ক্ষতি হবার আশঙ্কা তার ভেতরেও জেঁকে বসেছে। এর মধ্যে আদৃতা বলার চেষ্টা করেছিল, তুবা হয়তো পালিয়ে গেছে ছেলেটার সাথে। হয়তো বিয়ে করেছে ওরা। দুই-একদিন পর ঠিকই পরিবারের সাথে যোগাযোগ করবে। দিনারেরও একই মত। কিন্তু শেফালির মন মানছে না। তিনি আদৃতার কথা বিশ্বাস না করার চেষ্টা করছেন প্রাণপনে। এইটুকু মেয়ের কেন এখনই মাথায় বিয়ের চিন্তা আসবে? অভিভাবকদের ভাষ্যমতে, সে এখনো নাদান বাচ্চা। কিন্তু বয়সের দিক থেকে হিসেব করলে এখন তার কাউকে ভালোলাগার বয়স। সেই ভালোলাগায় ডালপালা ছড়াতে তো সময় লাগবে। এরপর প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হবে। এখনই কেন পালিয়ে বিয়ে করার প্রসঙ্গ আসবে?
তুবার নিখোঁজ হওয়া উপলক্ষ্যে ওর বড় খালা, এক মামা আর দুই চাচা চলে এসেছেন। দিবাকেও খবর জানানো হয়েছে। পথিমধ্যে সে কিছু বলেনি। কিন্তু বাসায় পৌঁছে বলল, তুবার সঙ্গের ছেলেটা আসলে সাইফুল। তুবার ঘুরাঘুরি করার অনেক শখ। এটা জানার পর বেশ কিছুদিন ধরেই শ্যালিকাকে সাথে নিয়ে ঘুরতে যাবার পরিকল্পনা করছিল সে। তুবার সাথে যোগাযোগ করে আজ হঠাৎই কলেজ ছুটির সময়ে ওকে তুলে নিয়েছে গাড়িতে। এরপর ওরা পুরান ঢাকার ওদিকে ঘুরতে গিয়েছিল। বিষয়টা দিবা নিজেও জানত না। তুবার ফেরার সময় হতেই ওরা বুঝতে পারল, রাস্তাঘাটের যানজটের কারণে ফিরতে বেশ দেরি হয়ে যাবে। তুবা খুব ভয় পাচ্ছিল ভেবে, বাসায় জানলে বকাবকি করবে। এজন্য দিবাকে কল করে জানিয়েছে।
স্বভাবতই দিবার কথা বিশ্বাস হয়নি কারও। কথা বলার সময় তার গলা কাঁপছিল। নার্ভাস ফিল করছিল সে। যদিও এটার পেছনে হাঁপিয়ে যাবার অজুহাত দিয়েছে। তুবার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না শুনে এক কাপড়ে, কোনোরকম প্রস্তুতি ছাড়াই বাসা থেকে বের হয়ে গেছে সে। যত দ্রুত সম্ভব, এখানে আসার চেষ্টা করছিল। এর মধ্যেই সাইফুল কল করেছিল। শেফালির জেরার মুখে, মোবাইলের স্ক্রিণে সাইফুলের কল লগটাও বের করে দেখাল। তবু সবার মন বলল, এখানে ঘাপলা আছে কোনো। খটকা তো অবশ্যই আছে। সাইফুল কেন এভাবে হুট করে তুবাকে নিয়ে ঘুরতে যাবে। দিবা বলল, আগে থেকেই পরিকল্পনা করছিল। তাহলে আজ কেন যাবার আগে দিবাকে কল করে জানাল না?
শেফালি নির্বোধ নন। তার উপর ছেলেমেয়েদের মুখের ভাষা পড়ে ফেলতে তার খুব একটা সময় লাগে না। খানিক চুপ করে ছিলেন তিনি। ভাবখানা এমন যেন, দিবার কথা বিশ্বাস করেছেন। তুবা সাইফুলের সাথে আছে শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন। এরপর কথাচ্ছলে দিবাকে শোবার ঘরে ডেকে নিলেন। দরজা আটকে আসল কথা জিজ্ঞেস করলেন। দিবা মিথ্যে বলতে পারেনি। সাইফুলের সাথে তার যা যা কথা হয়েছে, সবটাই মাকে বলেছে। এরপর শেফালি আর হৈ-চৈ করেননি। আগের মতোই স্বাভাবিক রয়েছেন। দিবা বলেছিল, সাইফুল নিজেই বাসায় এসে তুবাকে পৌঁছে দিয়ে যাবে। তখন ওর সাথে বাসায় ফিরবে দিবা। মেয়ের জামাই আসবে, এই উপলক্ষে তিনি রান্নাবান্নার আয়োজন করতে লাগলেন। এমন নয়, দুশ্চিন্তা হচ্ছে না। তবে সাইফুলকে ভরসা করেন। সাইফুল নিশ্চয়ই তুবাকে সহিসালামতে বাড়ি পৌঁছে দেবে। দিবা এরপর অন্য ঘরে গিয়ে দিদারুল সাহেবকে বলেছে। শুনে তার কপালে ভাঁজ পড়লেও তিনি আর রা কাড়েননি। বিষয়টা আদৃতাসহ অন্যদের মনেও খটকা লাগানোর মতো। তবে কেউ আর কথা বাড়ায়নি। যে-যার বাসায় চলে গেছে। দিনার-আদৃতা শোবার ঘরের দরজা আটকে নিজেদের ভেতর আলোচনা করছিল। দিনার বিশ্বাস করেনি দিবার কথা। তবে বাবা-মাকে নিশ্চিন্ত দেখে তার মনে হচ্ছে, এর মধ্যে কিছু কথাবার্তা হয়েছে, যার কারণে পরিস্থিতি হুট করে স্বাভাবিক হয়ে গেছে। আদৃতা খোঁচা দিল স্বামীকে,
– তোমার বাবা-মা নিশ্চয়ই তোমাকে রাস্তা থেকে টুকিয়ে এনেছে।
– এই কথা বলছ কেন?
– কেন বলব না? উনারা দিবার সাথে কীসব ঘুটুর-ঘুটুর করলেন। কই, তোমাকে তো একবার ডাকলেন না।
– কী আশ্চর্য! আমাকে কেন ডাকবে?
– কেন ডাকবে না? তুমি এই বাড়ির একমাত্র ছেলে। দিবা-তুবার বড় ভাই। তোমার কি কোনো অধিকার নেই ওদের উপর? ওরা কী করছে, কোথায় যাচ্ছে, কী চলছে, এসব জানতে মানা?
– মানা হবে না? আমি কোন কথাটা জানি না আমার বোনদের?
– তাহলে আজ কেন আম্মা দরজা আটকে দিবার সাথে ফুসুর-ফাসুর করল? বাবাকেও দেখলাম দিবার সাথে কথা বলতে নিচু গলায়। আমাকে দেখেই চুপ হয়ে গেল। আচ্ছা, আমাকে কিছু বলতে না চায়। না বলুক। কিন্তু তোমাকে কেন বলল না?
– সেটা আমি কী করে জানব? আর সব কথা আমাকেই কেন বলতে হবে? আমি কি সবকিছু দায়িত্ব মাথায় তুলে নিয়েছি?
– তুমি…
– শোন আদৃতা, আমি এই বাড়ির বড় এবং একমাত্র ছেলে। শুনে অনেকেরই মনে হতে পারে, আমার বোনদের, আমার বাবা-মায়ের সমস্ত দায়িত্ব আমার ঘাড়ে। বিষয়টা সেরকম না। আমার বাবা বুড়া হলেও এখনো অনেক শক্ত-সামর্থ। সেলফ ডিপেন্ডেন্ট। এখনো আর্ন করেন। আমার মাও এখন পর্যন্ত এই সংসারটাকে শক্ত হাতে ধরে রেখেছেন। আমার দায়িত্ব, আমার বোনদের দায়িত্বও নিজেরা পালন করেছেন। এখন আমি বিয়ে করেছি। জব করছি। এজন্য আমাকে আমার মতো ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু আমার বোনদের দায়িত্ব এখনো পালন করে যাচ্ছেন। একারণেই তুবার সব ব্যাপারে তারাই মাথা ঘামান। এখানে আমার কিছু বলার নেই। আমি বলতেও চাই না।
আদৃতা আর কথা বাড়াল না। দিনার এমনিতে রাগারাগি করে না। কিন্তু একবার ক্ষেপে গেলে তাকে সহজে মানানো যায় না। খানিকটা একগুঁয়ে স্বভাবেরও। আর প্রচন্ড পরিবার ন্যাওটা। তার জীবনে বাবা-মা আর বোনদের প্রায়োরিটি সবথেকে বেশি। বিয়ের পর থেকে আদৃতার সাথে এই নিয়ে অনেক বাদানুবাদ হয়েছে। কিন্তু দিনারকে তার মনোভাব থেকে টলানো যায়নি। তার একটাই কথা, আমি মানুষটা এমনই। এটা মেনে নিয়েই তোমাকে আমার সাথে আজীবন থাকতে হবে। আদৃতা এরপর বুঝে গেছে, তার স্বামীকে এমনিতে যেমন-তেমন করে চালানো গেলেও পরিবার নিয়ে কোনো বিরুপ কথা বলা যাবে না। আজও বলতে চায়নি। দিবার সাথে বাবা-মায়ের ফিসফাঁস কথাবার্তা দেখে ব্যাপারটা চোখে পড়ল। বিশেষ করে, মা-মেয়েরা দিনারকে পাত্তাই দেয় না যেন।
খানিকবাদে সাইফুল আবার কল করে দিবাকে জানাল, সে তুবাকে নিয়ে সরাসরি নিজ বাসায় যাচ্ছে। কেন, এত বৃত্তান্ত বলল না। দিবাকে তাড়াতাড়ি বাসায় চলে যেতে বলল। বাসায় পৌঁছেই কথা বলবে। তবে এটুকু বলেই পার পায়নি সে। এই যাত্রায় শেফালির সাথেও কথা বলতে হয়েছে। তিনি নানান প্রশ্ন করছিলেন। উত্তরে সে কেবল এতটুকু বলেছে,
– আম্মা, তুবা ভালো আছে। ওর কোনো বিপদ হয়নি। কোনো সমস্যা নেই। আমি ওকে নিয়ে আমাদের বাসায় যাচ্ছি। কারণ সঙ্গে আমার ফুপা আছেন। উনার গাড়িতে যাওয়া হচ্ছে। ফুপা আপনাদের ওদিকে যাবেন না মনে হয়। উনাকে বাসায় ফিরতে হবে।
– কী হয়েছে, সাইফুল? আমাকে একটু খুলে বলো তো। তোমার ফুপাত ভাই কেন তুবাকে নিয়ে যাবে রেস্টুরেন্টে?
– আম্মা, প্লিজ। সারাদিনে অনেক ধৈর্য ধরেছেন জানি। আপনি চিন্তায় অস্থির হয়ে আছেন এটাও বুঝতে পারছি। কিন্তু আমার হাতে সময় নেই। এখনই গাড়িতে উঠব। ফুপার সামনে কথা বলতে চাচ্ছি না। ফুপা আগেই আমাকে মানা করেছেন কাউকে কিছু না বলতে। তবু আমি দিবাকে জানিয়েছি, নয়তো আপনারা টেনশন করতেন। প্লিজ আন্টি। আমি ফ্রি হয়েই আপনাকে কল দিব। সবটা জানাব তখন। দরকার পড়লে যত রাতই হোক, বাসায় এসে সামনাসামনি কথা বলব। আপনি জাস্ট রিল্যাক্সড থাকেন। তুবা আমার সাথেই আছে। ভালো আছে।
– তুমি একটু তুবাকে ফোনটা দাও। আমি কথা বলতে চাই ওর সাথে।
– আম্মা, তুবা এখন আমার সাথে নাই। মানে আমি ফোনে কথা বলার জন্য একটু দূরে সরে এসেছি। তুবা ফুপার গাড়িতে উঠে বসেছে। ফুপাও এখন গাড়িতে উঠবেন। এই মুহূর্তে ওকে ফোনটা দিতে পারব না।
– তাহলে ওকে বলো মোবাইল অন করতে। মোবাইল অফ করে রাখছে কেন?
– আম্মা, চার্জ নাই। আপনি প্লিজ একটু শান্ত হন। আর দিবাকে বাসায় পাঠিয়ে দেন। তুবা বাসায় পৌঁছে সবার আগে দিবাকেই খুঁজবে। না পেলে নার্ভাস ফিল করতে পারে।
এরপর দিবা শ্বশুরবাড়িতে ফিরে এসেছে। এরপর অপেক্ষা করছিল সাইফুলের জন্য। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। মিনিট কয়েক পরেই গাড়িসমেত সাইফুল চলে এসেছে। সে যখন দোতলায় উঠে এলো, দিবা ভেবেছিল, সঙ্গে তুবাকেও দেখবে। কিন্তু তুবা আসেনি। প্রশ্ন করতে হলো না। সাইফুল আগেই ইশারা করল, এখন কোনো কথা বলা যাবে না। শোবার ঘরে গিয়ে যা বলার বলবে।
দিবার ধৈর্য শেষ প্রায়। তবু মন শক্ত করে ঘরে গেল। এরপর সাইফুলকে জিজ্ঞেস করল,
– কী হয়েছে বলো?
সাইফুল ধীরেসুস্থে দিবাকে সবটুকু বলল। দিবা কোনো প্রশ্ন করল না। একটানে সবটা শুনে গেল। তারপর জিজ্ঞেস করল,
– তুবা এখন কোথায়?
– ফুপির বাসায়।
– ওখানে নিয়ে গেছে কেন ওকে?
– ওই বাড়ির বউ তুবা। ওকে তো ওখানেই নিয়ে যাবে।
– তা নেবে। কিন্তু এখনই কেন? এভাবে এত বড় কাহিনি ঘটানোর পর বিয়েটাই ছিল একমাত্র সলিউশন, মানলাম। শারারের সাথে বিয়ে হওয়াতে আমার আপত্তি নেই। বরং ভালো হয়েছে। আমার বোন আমার চোখের সামনে থাকবে। কিন্তু সাইফুল, ফ্যামিলির দিকটাও দেখতে হবে। আমার বাসায় এখনো কেউ কিছু জানে না। তাদের জানাতে হবে। এরপর দুই ফ্যামিলি মিলে কথাবার্তা বলার পর…
– সেজন্যই ফুপা তোমাকে ডেকেছেন। আমাকে বলেছেন, তোমাকে নিয়ে যেন উনার বাসায় যাই। সম্ভবত তুবার গার্ডিয়ান হিসেবে তোমার সাথে উনি ডিসকাস করতে চান।
– আমার সাথে কেন? আমার বাবা-মা আছে। তাদেরকে খবর দেই…
– এখন না। এখন আমার সাথে চলো। আগে ফুপাজানের সাথে আমরা কথা বলি। এরপর নাহয় আব্বা-আম্মাকে জানাব।
(চলবে)

নীড়
রেশমী রফিক
৩০।।
বসার ঘরে জড়োসড়ো ভঙ্গিতে বসে আছে দিবা। পাশে সাইফুল বসা। সে সোফায় হেলান দিয়ে আরাম করে বসেছে। পায়ের উপর পা তুলে। তবে তা বেশিক্ষণ টিকবে না। শফিকুল চৌধুরী বসার ঘরে পা দেবার আগমুহূর্তে সুরুত করে তার পা নেমে যাবে। একদম ভদ্রলোকের মতো শিরদাঁড়া খাঁড়া করে সোজা হয়ে বসবে।
বিয়ের পর থেকেই দিবা লক্ষ করেছে, তার এই ফুপাশ্বশুরকে পুরো শ্বশুরবাড়ির মানুষজন সমীহ করে চলে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সমীহ নয়, রীতিমতো ভক্তি চলে। কেউবা ভয় পায়। সাইফুলদের বংশে তিনি মোটামুটি শ্রদ্ধেয় একজন মানুষ, যাকে পারিবারিক আলোচনায় সবাই ডাকে। যার কথায় সবাই উঠবস করে। দিবার বিয়ের আলোচনাতেও তিনি উপস্থিত ছিলেন। দিবাদের বাসায় গেছেন সাইফুলের বাবা-মা আর অন্যদের সাথে। তবে দিবার পক্ষের মুরব্বিদের সাথে মূলত তিনিই কথা বলেছেন। বাকিরা তার কথায় সায় দিয়েছে শুধু। হু-হা করেছে। দিবার ধারণা, তিনি মত না দিলে ওদের বিয়েটা হতো না। সাইফুল যতই গো ধরুক। সাইফুলদের বাড়িতে কেউ ওকে পছন্দ করেনি খুব একটা। বিয়ের আগে অত বুঝা না গেলেও এখন দিনে-রাতে প্রায়ই উপলব্ধি হয়। সংসারের ঠোকাঠুকির ফাঁকে অনেক কথা কানে চলে আসে। প্রথম কয়েকদিন তার খারাপ লেগেছে অনেক। ঘরের দরজা আটকে রীতিমতো কান্নাকাটি করে ভাসিয়েছে। সাইফুলকে বকা দিয়েছে, কেন পরিবারের অমতে গিয়ে ওকে বিয়ে করল সে।
সাইফুল ওকে বারবার নিরস্ত করেছে। না পারলে বোনকে ডেকে এনেছে। সায়রা হচ্ছে দিবার কলিজা বান্ধবী। সে ওদের ঘরে ঢুকেই বান্ধবীকে জড়িয়ে ধরেছে। তারপর দুই ভাইবোন মিলে বুঝ দিয়েছে, সংসার জীবনে এরকম হাজার কথা কানে আসবেই। যুগ-যুগ ধরে এটাই চলে আসছে। নতুন বউ বাড়িতে পা দেয়ামাত্র একটা দলের ফিসফাঁস শুরু হয়ে যায়। এগুলোকে ঠেকানো সম্ভব না। তাই পাত্তা না দিয়ে সংসার ধর্মে মন দিতে হবে। পাত্তা দিলেই বরং সর্বনাশ। এরা নতুন বউয়ের দোষ খুঁজে পেতে হয়রান হবে।
দিবা শেষমেশ সায়রার কথা মেনেছে। এমনিতেও ওর দৃষ্টিতে সাইফুলের পরিবার মানেই ওর বাবা-মা আর সায়রা। এরাই যখন অমত করেনি, তাহলে বাকিরা কে কী বলল, তাতে কান দেয়াটা আসলেই বোকামি। যৌথ পরিবার বলেই একটু-আধটু সয়ে নিতে হবে। পরবর্তীতে যতই দিন গেছে, দিবা খুব ভালো করেই বুঝে গেছে সাইফুল আর সায়রা ছাড়া আর কেউ ওকে পছন্দ করে না। সাইফুলের বাবা-মা নিরীহ ধরনের মানুষ। তারা কখনোই ছেলেমেয়েদের ইচ্ছেয় বাঁধা দেননি। তবে মনের মধ্যে চাপা ক্ষোভ আছে। তাদের পছন্দ ছিল বংশের ভেতরই কোনো এক মেয়েকে। সম্ভবত সাইফুলের দূর সম্পর্কের কোনো কাজিন হবে। মেয়েটা দেশের বাইরে থাকে। ওখানেই জন্ম আর বেড়ে উঠা। তবে পারিবারিক অনুশাসন আর বাঙালী সংস্কৃতি তার জীবনে এতই প্রভাব ফেলেছে, তাকে দেখে বুঝার উপায় নেই সে বাংলাদেশে থাকে না। কানাঘুষো থেকে জানা গেছে, এই মেয়েকে খুব ছোটবেলা থেকেই পছন্দ করে রেখেছেন সাইফুলের বাবা-মা। মেয়ের বাবা-মায়ের সাথেও মৌখিক কথাবার্তা হয়েছে। খুব সম্ভব মেয়েটাও ছোটবেলা থেকেই জেনেশুনে বড় হয়েছে যে, বাংলাদেশে ওর হবু বর আর হবু শ্বশুরবাড়ি ঠিক করা আছে। সাইফুল নিজেও জানত। তবে মেয়েটা কখনোই তার মনে সেরকম প্রভাব ফেলতে পারেনি। বিয়ের প্রসঙ্গও খুব একটা আঁচড় কাটেনি। ফলাফলে, তার মনে অনায়াসে স্থান গেড়ে নিতে পেরেছে দিবা। সাথে সায়রার সমর্থন থাকায় এই ভালোলাগা-ভালোবাসা বিয়ে পর্যন্ত এগোনোর সুযোগ পেয়েছে।
সাইফুলের বাবা-মা খুব খুব ভদ্র। মনের মধ্যে যাই থাকুক, দিবার সাথে এখন অবধি তার বিরুপ আচরণ করেননি। মন থেকে মেনে না নিলেও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। দিবাও তাদের মন জয় করার প্রচেষ্টায় নেমেছে। কী করলে তারা খুশি হবেন, কীভাবে করলে তাদের মুখে হাসি ফুটবে, এই নিয়ে সারাক্ষণ তার ধ্যানজ্ঞান চলে। ইতোমধ্যে খানিকটা সফলও হয়েছে। এতকিছুর মধ্যে বাবার বাড়ি অনেকটাই বিস্মৃত হয়ে গেছে। মাঝেমধ্যে মায়ের সাথে ফোনে কথা হয়। শেফালি মেয়েকে সাংসারিক জীবনের ছোটখাট কৌশল শিখিয়ে দেন। সেগুলো প্রয়োগ করে সে। ভাইবোনদের কথা মাথায় ঢোকানোর ফুসরত হয়নি। তাছাড়া বেশিদিনও তো পেরোয়নি। মাত্র একমাস। এর মধ্যে তুবা কী করে ফেলল, তার মাথায় আসছে না।
আগেই বিয়েটা পাকাপোক্ত হয়ে যাওয়ায় কয়েক বছর সাইফুলের সাথে, ওর পরিবারের সাথে পরিচিত হয়েছে দিবা। সাইফুলদের বাসায় প্রায়ই যাওয়া হতো। আর সায়রার বান্ধবী হিসেবে এমনিতেও যাওয়া-আসা ছিল। তখন কোনো এক সময়ে শারারের সাথে পরিচয় হয়েছে। এরপর কালেভদ্রে দেখা হয়েছে। একবার ওর ফোন নম্বর নিল শারার। তখন থেকে প্রায়ই কল করত। বিশেষ করে যখন সাইফুলকে তার দরকার হতো এবং বাসায় ওকে পাওয়া যেত না। আবার ফেসবুকেও বন্ধুতালিকায় যুক্ত হবার সুবাদে অল্পসল্প কথা হতো। তাই বলে তুবার সাথে তার সম্পৃক্ত হবার প্রশ্নই আসে না। নয়তো তুবা ঠিকই ওর কথা বলত বোনকে। তাছাড়া তুবাকে সে কোনোদিন দেখেছে বলেও মনে হয় না। বিয়েবাড়ির ভীড়ে আলাদা করে চোখে পড়ার মতো মেয়েও নয় তুবা। তাহলে?
দিবার মাথায় চিন্তাভাবনার ঝড় বইছে। কিন্তু কিছুই ঠিকঠাক ভাবতে পারছে না। এসির ভেতর বসেও কুলকুল করে ঘামছে সে। ঘেমেনেয়ে একাকার হবার আরেকটা কারণ হচ্ছে, সামনের সোফায় বসা শারার আর তুবা। বসার ঘরে ঢুকতেই তুবা দৌড়ে আসতে চাইছিল ওর দিকে। সেও তুবাকে জড়িয়ে ধরার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু শারার আটকে দিল। তুবার হাত শক্ত করে ধরে রাখল সে। দিবাকে শান্ত সুরে বলল,
– বসো ভাবি।
দিবা হতভম্ব। তুবা তখনো হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছিল। বিরক্তির ভঙ্গিতে বলল,
– কী ব্যাপার? হাত ধরে রাখছেন কেন? হাত ছাড়েন।
শারার খুব স্বাভাবিক সুরে বলল,
– তুমি এখানে বসো।
– এখানে বসব কেন? আপু আসছে। আমি আপুর কাছে যাব।
– তোমার আপু পালিয়ে যাচ্ছে না, তুবা। সে এখানেই বসবে। এই সামনের সোফায়।
– তো? আমি আপুর কাছে গেলে কী সমস্যা?
– সমস্যা আছে। তুমি এখানে বসো।
তুবা উদ্ধত সুরে বলল,
– বসব না। আপনি আমার হাত ছাড়েন।
এই পর্যায়ে শারার কিছু বলল না। তবে তার চোখমুখ দেখে মনে হলো, এখনই বুঝি তুবাকে কষে থাপ্পড় মারবে। হয়তো হাতও তুলেছিল। দিবার কথা ভেবে সামলে নিল বুঝি। কয়েক মুহূর্তে দিবা চট করে ধরতে পারেনি। তবে শারারকে অনুরোধ করেছিল, তুবার হাত ছাড়তে। শারার তাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
– তুমি বসো।
দিবা এক পা বাড়িয়েছিল। সাইফুল আটকাল এবার। ইশারায় বসতে বলল ওকে। বসার ঘরের থমথমে পরিস্থিতি দিবাকে কিছু একটা উপলব্ধি করাল, যার কারণে সে কথা বাড়ায়নি। চুপচাপ বসে পড়েছে। তুবাকে প্রায় জোর করে সোফায় বসিয়েছে শারার। হাত তখনো ছাড়েনি। সাইফুল তখন বলল,
– তুবা, তুমি ভয় পাচ্ছ কেন? বসো। আমরা তো চলে আসছি।
তুবা হাত ছাড়ানোর চেষ্টা বন্ধ করল। সাইফুলকে উদ্দেশ্য করে প্রায় কাঁদো-কাঁদো সুরে বলল,
– আমি বাসায় যাব। প্লিজ সাইফুল ভাই। আমাকে বাসায় নিয়ে যান।
দিবাকেও বলল,
– আপু প্লিজ। আমি বাসায় যাব।
দিবা কিছু বলতে যাচ্ছিল। ওই মুহূর্তে শারার বলল,
– তুবা শোন। তুমি অবশ্যই বাসায় যাবা। তোমার আপু তোমাকে নিতেই এসেছে। কিন্তু তার আগে কিছু ডিসকাশন আছে। আব্বু ফ্রেশ হতে গেছে। আসলে কথাবার্তা বলবে ভাবির সাথে। ততক্ষণ তুমি চুপ করে বসে থাক। নড়বা না একদম।
তুবা প্রায় কাঁদতে কাঁদতে বলল,
– আমি আর কোনোদিন ক্লাস বাদ দিয়ে অন্য কোথাও যাব না। কোনোদিন কোচিং ফাঁকি দিব না।
দিবা হতবাক। বলার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছে না। শারার বলল,
– আর কোনোদিন ক্লাস-কোচিং বাদ দেয়ার সুযোগও পাবা না।
– ঠিক বলছেন। আম্মা আমাকে আজকে মেরেই ফেলবে। কুঁচি কুঁচি করে কাটবে। তারপর নদিতে ভাসিয়ে দিবে।
– রিল্যাক্স। ওসব কিছুই হবে না। ভাবি কথা বলবে আন্টির সাথে। তুমি কান্না বন্ধ করো।
দিবা শুন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মাকে সে কী বলবে, জানে না। এখানে আসার আগে তার মনে হয়নি ঘটনা এত গুরুতর। আপনমনে ধরে নিয়েছিল, কোনোভাবে হয়তো শারারের সাথে পরিচয় হয়েছে তুবার। এরপর দেখা করতে গিয়েছিল রেস্টুরেন্টে। সেখানে অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো ঘটনায় ওরা বাজেভাবে ফেঁসে গেছে, যার কারণে ফুপাজানকে ছুটতে হয়েছে। এখন ওকে ডেকেছেন, তুবার নামে অভিযোগ দিতে। অথবা তুবাকে সতর্ক করতে। কিন্তু বিয়ে পর্যন্ত ঘটনা এগিয়েছে, ঘুণাক্ষরেও মাথায় আসেনি। সাইফুল অবশ্য বিয়ের কথা বলেছিল। তখনও মনে হয়নি কিছু। হয়তোবা সাইফুলের কথা সেভাবে মাথায়ই ঢুকেনি। কিন্তু এখন তুবার পরনে বেনারসি শাড়ি দেখার পর মাথা বনবন করে ঘুরছে। কেন যেন আতঙ্ক জেঁকে বসছে মনে।
শফিকুল চৌধুরী বসার ঘরে ঢুকার আগে গলা খাঁকারি দিলেন। সেই শব্দ শুনে ঘরের ভেতর এক প্রকার ত্রাস সৃষ্টি হলো। তুবা মাথা নিচু করে রাখলেও শরীর ছেড়ে দিয়েছিল। এবারে সোজা হয়ে বসল। দিবা আর সাইফুল বরাবরের মতোই তটস্থ। কেবল শারার নির্বিকার। আপনমনে মোবাইল টিপাটিপি করছে সে। শফিকুল চৌধুরীর সাথে লুৎফুন্নেসাও এসেছেন। এখন আর আগের মতো ঔদ্ধতা দেখা যাচ্ছে না তার চেহারায়। বরং স্বচ্ছ পানির মতো টলমলে পরিস্কার। খানিকটা মায়াময় আর ধীরস্থির। সচরাচর তাকে যেমনটা দেখা যায়। তুবা একবার মাথা তুলে তাকিয়েই আবার নিচু করে ফেলল। শফিকুল চৌধুরী বাদিকের সোফায় বসলেন। পাশে লুৎফুন্নেসা।
শুরুতেই শফিকুল চৌধুরী দিবার সাথে সালাম বিনিময় করলেন। ওর কুশল জিজ্ঞেস করলেন। পরিবারের খোঁজ নিলেন। আজকের ঘটনা ওর বাসায় জানাজানি হয়েছে কি না, কতদূর জেনেছে তাও জিজ্ঞেস করলেন। উত্তর দেবার আগে চকিতে সাইফুলের দিকে তাকাল দিবা। স্বামী-স্ত্রীর চোখাচোখি হলো। ইশারা বিনিময় হলো। সাইফুল আগেই সতর্ক করে রেখেছে ওকে। সেভাবেই উত্তর দিল,
– বাসায় আম্মা খুব কান্নাকাটি করছে। তুবার কোনো খোঁজ পাচ্ছে না, তাই। আব্বাও খুব টেনশনে আছে। সবাই এদিক-সেদিক খোঁজাখুঁজি করছে। এর মধ্যেই কিছুক্ষণ আগে সাইফুল আমাকে জানাল, তুবার খোঁজ মিলেছে। ও নাকি দুপুরে কোনো একটা রেস্টুরেন্টে গিয়েছিল শারারের সাথে। তারপর কী একটা ঝামেলা হয়েছে…
শফিকুল চৌধুরী ওর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললেন,
– শুধু ঝামেলা না। খুব বড় ধরনের কিছু। এবং এখানে আমার ফ্যামিলির সম্মানটাও জড়িত।
দিবা ঢোঁক গিলল। বলল,
– জি?
– তোমার বোন আর আমার ছেলে এদের মধ্যে কতদিনের সম্পর্ক, কী ধরনের সম্পর্ক, তুমি কি জানো কিছু?
দিবা সতর্ক ভঙ্গিতে শারারের দিকে তাকাল। তা দেখে শফিকুল চৌধুরী আবার বললেন,
– ওর দিকে তাকিয়ে লাভ নেই। সত্যিটা জানা যাবে না। শারার এই পর্যন্ত আমাকে একেকবার একেক কথা বলেছে। একবার বলল, তোমার বোনের সাথে ওর কোনো সম্পর্ক নেই। তোমাদের বিয়ের সময় পরিচয় হয়েছে। তারপর অল্প যোগাযোগ ছিল। তোমার বোন নাকি খেতে খুব ভালোবাসে। তার কাছে আবদার করেছে। তাই সে আজ তোমার বোনকে নিয়ে গিয়েছিল স্বর্ণপাতার থালায়।
তুবা বিড়বিড় করে বলল,
– মিথ্যা কথা। আমি তো কর্ণফুলী সিটিতে…
শারার চট করে ওর পা মাড়িয়ে দিল জুতো দিয়ে। তুবা আঁতকে উঠে নিজেকে সামলে নিল। আড়চোখে লুৎফুন্নেসার দিকে তাকাল। ওর দিকেই একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তিনি। খুব শান্ত কিন্তু ভয়ঙ্কর একটা দৃষ্টি। ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল সে। শফিকুল চৌধুরী বলতে লাগলেন,
– এরপর শুনলাম, তারা একজন আরেকজনকে পছন্দ করে। এজন্য ডেটিং করতে গিয়েছিল। কিন্তু সম্পর্ক বলতে কিছু নেই। জাস্ট ভালোলাগা তৈরি হয়েছে। আমি যখন ডিসাইড করলাম ওদের বিয়ে দেব। শারার তখন খুব অবজেকশন জানিয়েছে। বিয়ে সে করবেই না কোনো অবস্থাতে। আমি ঘাড় ধরে ওকে বিয়ে করিয়েছি। কিন্তু বাসায় আসার পর তার মত পাল্টে গেছে। তুবা তার স্ত্রী, এই ব্যাপারটা তার মগজে এতই পাকাপোক্ত হয়ে গেড়ে বসেছে, তুবাকে ছেড়ে এক পাও নড়তে চাচ্ছে না। দেখতেই পাচ্ছ তার অবস্থা।
একটু বিরতি নিলেন শফিকুল চৌধুরী। হয়তো দিবা বা সাইফুলের কিছু বলার অপেক্ষা করলেন। কিন্তু ওরা কিছু বলল না। এই আলোচনায় একমাত্র বক্তা হিসেবে তাকেই মেনে নিয়েছে যেন সবাই। তবে শারার প্রায় অস্ফুট সুরে বলল,
– আব্বু, তোমার কী বলার আছে, তাড়াতাড়ি বলো। অ্যাম টায়ার্ড।
– তোমাকে বলা হয়েছিল রুমে গিয়ে ফ্রেশ হতে।
– তুবা কেন যাবে না রুমে?
– তুমি কি নির্বোধের মতো প্রশ্ন করলে না? নাকি কমনসেন্স পুরোটাই গুলিয়ে খেয়েছ? হতে পারে তুবা তোমার ওয়াইফ, লিগ্যালি। কিন্তু যে সিচুয়েশনে বিয়েটা হয়েছে, ওটা মেনে নেবার মতো নয়।
– তাহলে তুমি কী করতে চাচ্ছ?
– আমি চাই, তুবা ওর বাসায় চলে যাবে। দিবা আর সাইফুলকে এজন্যই ডেকে আনা হয়েছে। ওরা তুবার বোন-দুলাভাই। ওরা ওর অভিভাবক। ওদের হাতে আমি তুবাকে দিয়ে দিব।
– তারপর?
– তারপর মানে?
– তারপর কী হবে? তুবা নিশ্চয়ই আজীবন ওদের বাসায় থাকবে না। কোনো একদিন ওকে আবার এই বাসায় নিয়ে আসা হবে। সেই একদিনটা কবে?
শফিকুল চৌধুরী কোনো কথা বললেন না। এই পর্যায়ে সাইফুল বলতে চেষ্টা করল,
– দেখ, ভাই। তুই যা বলতেছিস, কথাটা আমি বুঝছি। আমরা সবাই বুঝতে পারছি। কিন্তু এভাবে তো হুট করে কেউ বিয়েটা মেনে নিবে না। সামাজিকতার ব্যাপার আছে। কিছু ফরমালিটিস আছে। তুই কি বুঝতেছিস না, তুবার বাসায় ওর বাবা-মা কীরকম টেনশন করতেছে? মানে আমি নিজেও ঠিক বুঝতেছি না। মানে ফুপাজান, ঘটনা আসলে কী? শারার কি চাচ্ছে না তুবাকে ওর বাসায় যাক? নাকি…
শফিকুল চৌধুরী গম্ভীর সুরে বললেন,
– শারার, তোমাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে, কতটা অসুস্থ। এজন্য উল্টাপাল্টা কী বলে যাচ্ছ, নিজেও বুঝতে পারছ না। ইউ নিড রেস্ট। মাথার আঘাতটা কিন্তু হেলাফেলা করার মতো না। তুমি যাও। তোমার রুমে গিয়ে ফ্রেশ হও। সারাদিনে কিছু খাওনি। খাওয়া-দাওয়া করো। আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি তুবাকে নিয়েই ভেতরে যাও।
শোনামাত্রই শারার সোফা ছেড়ে উঠল। তুবাকে বলল,
– চলো আমার সাথে।
তুবা কথা বাড়াল না। চুপচাপ ওর পিছু নিল। লুৎফুন্নেসার চেহারায় উৎকন্ঠা দেখা যাচ্ছে। স্বামীর মনোযোগ আকর্ষণের নীরব চেষ্টা চালাচ্ছেন। শফিকুল চৌধুরী ইশারায় তাকে শান্ত থাকতে বললেন। শারার-তুবা ঘর থেকে বের হয়ে যাবার পর দিবা আর সাইফুলের দিকে ঘুরলেন তিনি। বললেন,
– শারার কী চাচ্ছে সেটা আমার দেখার বিষয় না। আমি চাচ্ছি না, এই বিয়েটা টিকে থাকুক। একটা খারাপ সিচুয়েশনে পড়ে বিয়ে হয়েছে। তার মানে এই নয়, সেটা আজীবন টানতে হবে। অ্যাডজাস্টমেন্ট বলেও একটা ব্যাপার আছে।
বসার ঘরে বোধহয় নীরব বোমা ফাটল। দিবা আর সাইফুল বাকরুদ্ধ, কিছুটা হতবাক। দিবা বিস্ময়ের চুড়ান্তে পৌঁছে গেছে। কেবল লুৎফুন্নেসার মুখে স্বস্তির চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। এতক্ষণ দম বন্ধ করে বসেছিলেন তিনি। এবারে খানিক নড়েচড়ে উঠলেন।
শফিকুল চৌধুরী দিবার উদ্দেশ্যে বললেন,
– তোমাকে আমি আমার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলাম। তুমি তুবাকে নিয়ে যাও। তোমার বাবা-মাকে যেভাবে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললে সুবিধা হয়, সেভাবেই বলো। এই বিয়েটা কয়েকদিনের মাত্র। আমি খুব দ্রুতই উকিলের মাধ্যমে ডিভোর্স পেপার রেডি করে ফেলব। শারারও সাইন করে দেবে। এরপর তোমাদের বাসায় পাঠিয়ে দেব।
দিবা ক্ষীণ সুরে বলল,
– কিন্তু ফুপা…
– কিছু বলবে তুমি?
– জি মানে, এখানে তো তুবার কোনো দোষ ছিল না। ও কেন সাফার করবে?
– সাফার করার প্রসঙ্গ আসছে কেন?
– কারণ একটা মেয়ের লাইফে বিয়ে কেবল কাজির সামনে বসে সাইন করা নয়। এর সাথে ওর সারাটা জীবন জড়িত। এই বিয়েটা যদি না টিকে, মানে আপনারা যদি ছেলের বউ হিসেবে মেনে না নেন তুবাকে, তাহলে বিয়েটা করালেন কেন?
– আজকে ওই রেস্টুরেন্টে যা ঘটেছে, তাতে এটাই ছিল একমাত্র সলিউশন। এই বিয়েটা না হলে কাল মিডিয়াতে আমার ফ্যামিলির সম্মান নিয়ে টানাটানি শুরু হতো। তাতে তোমাদের খুব একটা প্রবলেম না হলেও আমার হতো। আমি সোসাইটিতে অনেক মানুষের সাথে উঠবস করি। আমাকে সোসাইটির সাথে তাল দিয়েই চলতে হয়। আমি এই ব্যাপারটা সাইফুলকে আগেই বুঝিয়ে বলেছি। বিয়ের আগেই। এরপর সাইফুলের মতামত নিয়েই বিয়ে পড়ানো হয়েছে।
দিবা এবারে সাইফুলের দিকে তাকাল। সাইফুল মিনমিন করে বলল,
– ফুপা, আমি বিয়েতে মত দিয়েছিলাম শারারের জন্যই। ও আমার কাজিন। ছোটবেলা থেকে ওকে চিনি। আমার মনে হয়েছে, তুবা ওর সাথে ভালো থাকবে।
– তোমার কি এটা মনে হলো না, এখানে তোমার ফুপুর দ্বিমত থাকতে পারে? কিংবা আমার সোশ্যাল স্ট্যাটাস ভলনারেবল হয়ে যেতে পারে? দিবা না জানে, তোমার তো জানা উচিত আমার সম্পর্কে। তোমার কীভাবে ধারণা হলো, তুবাকে আমি ছেলের বউ হিসেবে অ্যাকসেপ্ট করে নেব?
দিবা প্রায় কাঁদো-কাঁদো সুরে বলল,
– ফুপা, প্লিজ। বিয়েটা যেহেতু হয়ে গেছে। আপনি আর ফুপি মেনে নিন। দরকার পড়লে তুবা কয়েক বছর আমাদের বাড়িতে থাকুক। পরে একসময় অনুষ্ঠান করে ওকে তুলে আনবেন। প্লিজ বিয়েটা ভেঙ্গে দিবেন না। তুবার লাইফে অনেক বড় একটা আঁচ পড়বে।
এই পর্যায়ে লুৎফুন্নেসা মুখ খুললেন,
– ন্যাকা কান্না বন্ধ করো। তোমার কি মনে হয় আমরা বোকা? আমাদের যা খুশি তাই বুঝিয়ে দিতে পারবে? তুবার লাইফে আঁচ পড়ার প্রসঙ্গ তখনই আসবে, যখন বাইরের মানুষ ঘটনা জানবে। কেউ তো জানেইনি এখনো। তোমার শ্বশুরবাড়িতেও খবর পৌঁছায়নি। কোথাও যাতে এই খবর না যায়, সেজন্যই তোমাকে ডেকে আনা হয়েছে। এবং আজকের পর এই বিয়ের খবর চার দেয়ালের বাইরে কখনোই যাবে না। বিয়েটা যেমন লোকচক্ষুর আড়ালে হয়েছে, তেমন করে ডিভোর্সও হয়ে যাবে। নাইবা শারারের সাথে তুবার কোনো সম্পর্ক হবে। তবে তোমরা যদি ঢালঢোল পেটাও, মানে তোমার মা, উনার তো বড় গলা। কথা বলার সময় মনে হয় যেন ঝগড়া করছেন। উনি যদি গলাবাজি করে সবাইকে জানান দেয় এই বিয়ের কথা, সেটার দায় সম্পূর্ণই উনার একার। আমাদের না। যদি মনে করো, চারদিকে জানাজানি করে আমাদেরকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করবে, সম্মানহানির ভয় দেখাবে, তাহলে শুনে রাখো ওসব করলে আমাদের কিছুই আসবে যাবে না। শারার ছেলে। ওর উপর আঁচ আসলেও যা, না আসলেও তা। আমাদের আত্মীয়মহলে যারা আছে, তারা কখনোই তোমাদের কথা বিশ্বাস করবে না। উলটো তোমাদেরকে, মানে তোমাকে দুষবে। বুঝতে পারছ তো, দিবা? শ্বশুরবাড়িতে এসেছ বেশিদিন হয়নি। এর মধ্যে নেগেটিভ ইমপ্যাক্ট পড়ে গেলে তোমারই লস। আজীবন ভুগতে হবে। কারণ, কিছু কিছু ব্যাপার আছে, যা মানুষ কখনোই ভুলে না। আর তোমার বোনের কথা কী বলব? জানি না, তোমাদের ফ্যামিলিতে আদব-কায়দা কীরকম শেখানো হয়। এই বয়সের একটা মেয়ে কলেজ ফাঁকি দিয়ে এক ছেলের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে। রেস্টুরেন্টে গিয়ে সময় কাটাচ্ছে। শুনতেই তো কেমন লাগে! আর আজকের ঘটনা নিশ্চয়ই শুনেছ। তোমার বোন কতটা ধোঁয়া তুলসীপাতা, তার উপর যেমন কোশ্চেন মার্ক চলে আসে, তেমনি তোমাদের ফ্যামিলির উপরও। বাকিটা তোমাদের ব্যাপার।
দিবা হতভম্ব ভঙ্গিতে কথাগুলো শুনে যাচ্ছে। তার চোখ বিস্ফারিত প্রায়। বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটার শব্দ হচ্ছে। মাথা আগেই বনবন করে ঘুরছিল। এখন গতি বেড়েছে। আরেকটু বাদে বোধহয় জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে। কারণ হাত-পায়ে কোনোরকম জোর পাচ্ছে না। খপ করে সাইফুলের হাত চেপে ধরল সে।
(চলবে)