পরাণ দিয়ে ছুঁই পর্ব-০১

0
424

#পরাণ_দিয়ে_ছুঁই
#সূচনা_পর্ব

চলন্ত বাস হঠাৎ করে ব্রেক করায় নিজেকে সামলাতে না পেরে স্যারের মুখেই ভুলবশত খা’বলে ধরে ইয়ানূর।

কিছু সময়ের জন্য যেনো সব স্তব্ধ হয়ে গেছে। বাসের সকলে অবাক দৃষ্টিতে সামনে হয়ে যাওয়া দৃশ্য দেখে চলেছে। ইয়ানূর এখনো একই ভাবে আছে। ইয়ানূরের একটা হাত বাসের সিটে বসে থাকা ব্যক্তির মুখে আরেকটা ঘাড়ে।শুধু ধরে নেই একপ্রকার খা’মচে ধরে আছে। ইয়ানূরের ধারলো নখ গুলো যেনো গেঁথে গেছে। কিছু সময় লোকটার দিকে তাকিয়ে এক ঝটকায় সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। তারপর কিছু না বলে একপ্রকার দৌড়ে নিজের জন্য বরাদ্দকৃত আসনে এসে বসে পরে। খুব হাঁপাচ্ছে সে। জীবনে কোনোদিন এমন বিবৃতিকর পরিস্থিতি তে সে পরে নি। ইচ্ছে করছে মাটি ফাঁক হয়ে যাক আর ইয়ানূর ঢুকে পরে সেখানে লুকিয়ে পরুক।

এরমধ্যে একজন স্যার এসে জিজ্ঞেস করে গেছে ইয়ানূর ঠিক আছে কিনা।কি যে লজ্জা লাগছিল তার তবুও মুখে জোরপূর্বক হাসি এনে মাথা নাড়িয়ে জানিয়েছিল সে ঠিক আছে।

ইয়ানূরের কয়েকজন বান্ধবী ইয়ানূরের চোখের দিকে তাকিয়ে ইশারা করে মিটমিটিয়ে হাসছে। আর কয়েকজন ইয়ানূর আর তাদের ন’জর কারা স্যার নামক অতিথির দিকে তাকিয়ে কি যেনো গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর করে চলেছে। ইয়ানূরের হুট করেই খুব কান্না পেলো খুব নরম মনের সে তাকে নিয়ে কোনো বা’জে কথা হলে সহ্য করতে পারে না। তার উপর সে ইন্ট্রুভার্ট।

ইয়ানূরের পাশে বসে তার কাঁধে হাত রেখে স্বান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করে চলেছে তার বান্ধবী ইসরাত। যদিও বা তাতে কোনো লাভ হচ্ছে না। ইয়ানূরের চোখের পানি টলমল করছে, যেনো একটু ছোঁয়া লাগলেই অঝোর ধারায় ঝড়ে পরবে।

এইবারই ইয়ানূরদের কলেজ লাইফ শেষ। কিছুদিন পর এইচএসসি পরীক্ষা। তাই ছাত্র ছাত্রীদের মন ফ্রেশ করার জন্য ওদের অনুরোধেই শিক্ষা সফরের আয়োজন করেছে কলেজ কতৃপক্ষ। যদিও বা ইয়ানূর আসতে চায় নি তার অনেক পড়া বাকি।পড়া ছাড়া মেয়ে টা কিছু বোঝে না। ইসরাত জোর করে নিয়ে এসেছে। ইয়ানূরের বাবা মা কে ইসরাত ই বুঝিয়েছে যেনো তাকে আসতে দেয়।ইয়ানূর অবশ্য এ বিষয় নিয়ে বাবা মায়ের সাথে একটা কথা ও বলেনি। উনারা অনেক ভেবে চিন্তেই ইয়ানূর কে আসতে দিয়েছে। এভাবে ঘরে বসে সারাদিন বইয়ের ভিতর মুখ ডুবিয়ে রাখলে মেয়েটা না পাগল ই হয়ে যায়। কিছু দিন পর ভার্সিটিতে ভর্তি হবে বাইরের সম্পর্কে তার ধারণা খুব কম। এজন্য উনারাই বলে পাঠিয়েছে।

ইয়ানূরের স্যার তালহা ইয়ানূরের বাবার পরিচিত। তালহা কে দেখে রাখতে বলেছে।মূলত তালহা আর ইসরাতের ভরসাতেই ইয়ানূর কে পাঠিয়েছে তার বাবা।এজন্য তালহা এসে জিজ্ঞেস করে গেছে সে ঠিক আছে কিনা।

কিছুক্ষন আগে বাসে বক্সে গান ছেড়ে সকলেই নাচছিলো।এটাই ওদের কলেজ লাইফের শেষ ভ্রমন। পরে কে কোথায় চলে যায় দেখা হবে কিনা কোনোদিন কেউই জানে না। তাই সকলে মিলে আনন্দ করছে। গান শুনে ইসরাতের খুব নাচতে ইচ্ছে করছে কিন্তু সে ইয়ানূরের জন্য যাচ্ছে না।

সবাই এতো মজা করছে অথচ মেয়ে টা কানে হেডফোন লাগিয়ে বই নিয়ে এখানেও পড়া লাগিয়ে রেখেছে। বইয়ের দিকে মুখ রেখেই ইয়ানূর বলল,তুই গিয়ে নাচতে পারিস ইশু।

“কিন্তু,,, ”

“কোনো কিন্তু না।আমার কোনো সমস্যা হবে না। আর আমাকে নিয়ে এতো চিন্তা করতে হবে না এখানেইতো।”

ইসরাত খুশি হয়ে ইয়ানূর কে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে গিয়ে ও ফিরে এলো কারণ ইয়ানূর ব্রু কোচকে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আর সে যে এসব পছন্দ করে না তা মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলো ইসরাতের। ইসরাত নাচার জন্য উঠতে উঠতে বলল, ঠিক আছে দোস্ত তুই পড়াশোনা কর আমি একটু নেচে আসি।

ইয়ানূর মাথা নাড়িয়ে আবার বইয়ের ভিতর ডুব দেয়।যদিও খুব অসুবিধা হচ্ছে এতো হৈ হল্লোড়ে পরতে।তবুও কিছু করার নেই তার।

এরমধ্যে হুট করে কেউ এসে ইয়ানূর কে টেনে নাচের মধ্যে নিয়ে যায়। ইয়ানূর কিছু বুঝতেই পারলো না কি হচ্ছে তার সাথে। সকলেই তাকে নিয়ে প্রায় টানা হেচড়া শুরু করে দিয়েছে নাচার জন্য। ইয়ানূর বলে চলেছে তাকে ছাড়ার জন্য কেউ কানেই নিচ্ছে না। তার হাত ধরে নাচানাচি শুরু করে দিয়েছে। ভাগ্যিস এই বাসে সব ছাত্রী নয়তো ইয়ানূর এখানেই জ্ঞান হারাতো।

মেয়েটা বলে চলেছে আমাকে ছারো তোমরা নাচো।আমাকে ছেড়ে দাও আমি নাচতে পারি না। আমার এসব ভালো লাগে না। প্লিজ তোমরা আমাকে ছাড়ো কিন্তু কেউ শুনছেই না। এমনিতেই মেয়েটা খুব আস্তে কথা বলে।তাদের কানে হয়তো ইয়ানূরের কথা পৌছাঁতেই পারছে না। তার উপর গানের সাউন্ড। কয়েকজন এর মধ্যে ইয়ানূরের কথা শুনেও পাত্তা দিচ্ছে না।

ওদের টানাটানি তে সামনের দিকে চলে যায় ইয়ানূর। এরমধ্যে হুট করে গাড়ির ব্রেক করায় নিজেকে সামলাতে পারেনি ইয়ানূর সামনে থাকা ব্যক্তির মুখ আর ঘারেই ধরে নিয়েছে আচমকা।না ধরলে হয়তো এতোক্ষনে রাস্তায় গিয়ে পরতো বাসের দরজা দিয়ে।

ইসরাত ইয়ানূরের মাথায় হাত বুলিয়ে শান্তনা দিয়ে চলেছে। সে পিছনের দিকে ছিলো তাই ইয়ানূর কে নিয়ে এতোকিছু হলো বুঝতে পারেনি। নিজের মধ্যে অপরাধবোধ কাজ করছে তার। একটু নাচার জন্য বান্ধবী কে কেমন বিব্রতকর পরিস্থিতি তে পরতে হলো।
কিছু একটা ভেবে ইয়ানূর কে সে প্রশ্ন করে,,

“নূর তুই তো এখানে বসে পড়ছিলি তাহলে ঐখানে কি করে গেলি দোস্ত? ”

“ইয়ানূর ধীর কন্ঠে বলে,জানিনা হুট করে কে যেনো আমাকে টেনে নিয়ে গেলো বুঝতে পারিনি।”

থাক মন খারাপ করিস না কেমন? সব ঠিক আছে বলেই পাশের সিটে চোখ যায় ইসরাতের ঐখানে বসে তাদের ক্লাসমেট রিতা দাঁত কেলিয়ে হেসে চলেছে। ইসরাতের আর বুঝতে বাকি নেই এইকাজ কে করেছে। কিছু বলতে নিয়েও চুপ করে গেলো ইয়ানূরের কথা ভেবে।তবে চোখ দিয়ে শাসাতে ভুলল না। যেনো ইসরাত চোখ দিয়েই বলে দিচ্ছে তোকে পরে দেখে নিচ্ছি।

রিতা ইসরাতের চোখ রাঙানিতে পাত্তা না দিয়ে মুখ ভেঙিয়ে অন্য দিকে তাকায়।

গাড়ি ব্রেক করেছে সাময়িক সময়ের জন্য। সকলে যেনো একটু বের হয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয়। ইসরাত বলার পর ও ইয়ানূর গাড়ি থেকে নামলো না। গাড়ি এখন পুরাই ফাঁকা। ইয়ানূর কে একা রেখে ইসরাত ও গেলো না।

তালহা স্যারই এসে পানি দিয়ে গেলো। ইয়ানূর যার মুখে খা’বলে ধরেছে লোকটা নাকি তালহা স্যারের বন্ধু। উনি ও নাকি একজন টিচার। তবে কোথাকার তা জানা নেই। তালহা স্যারই নিয়ে এসেছে উনাকে গেস্ট হিসেবে। লোকটা আসার পর থেকেই লোকটা কে নিয়ে সকলের কানাঘোষা। লোকটাই সকলের গল্পের একমাত্র টপিক যেনো। এমন ছেলে যেনো জীবনে দেখেনি কয়েকজন এমনই ভাব। চোখ দিয়েই যেনো লোকটা কে গি’লে খাচ্ছে।

অথচ লোকটার কোনোদিকে কোনো ভাবাবেগ নেই। একমনে কানে হেডফোন গুঁজে চুপটি করে সিটে বসে আছে। পিছনে ফিরে বা আশেপাশে তাকিয়ে দেখার ও প্রয়োজন মনে করছে না।

নির্দৃষ্ট সময়ে বাস এসে সিলেট থামে।গাড়ি থামার সাথে সাথে সকলের নামার যেনো প্রতিযোগিতা লেগে গেছে কার আগে কে নামবে। এতো ভিড় ইয়ানূরের কোনো কালেই পছন্দ না। তাই সকলে বের হলেই সে বের হবে এমন ভাবনা নিয়ে চুপচাপ বসে আছে। আর ইয়ানূর কে ছাড়া ইসরাত ও যাবে না তাই অগত্যা সে ও বসে আছে।

সকলে নামার পর ইয়ানূর উঠে দাঁড়ায়। ইয়ানূরের আগে আগে ইসরাত যাচ্ছে। ইসরাত নেমে গেছে।ইয়ানূর সামনে পৌঁছাতে কারো কন্ঠ শুনতে পায়।

” কাউকে আ’ঘাত করলে সরি বলতে হয়।কেউ কি এটা শিখায় নি? আর এতো বড় বড় নখ কি জমিতে হালচাষ করার জন্য রাখা হয়েছে? ”

ইয়ানূর পিছনে তাকিয়ে দেখে ঐ লোকটা সিটে এখনো বসে আছে। চোখ নিবদ্ধ ফোনের মাঝে।কিন্তু গালে আর গলায় ওয়ান টাইম বেন্ডেজ।

ইয়ানূর বুঝতে পারে ওর জন্যই এমন হয়েছে। কিন্তু সে চেয়েও স’রি বলতে পারলো না। মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। তাই চলে যাওয়া ধরে।পিছন থেকে বিরবির করে লোকটার বলা “ম্যানার্সলেস গার্ল” শব্দটা তার কানে আসতে ভুল করলো না।

চলবে,,,,,