ছেড়ে যাওয়া সেইজন পর্ব-১৩ এবং শেষ পর্ব

0
190

#গল্প_ছেড়ে_যাওয়া_সেইজন
#অন্তিম_পর্ব
#রেবেকা_সুলতানা

সাজিদ বাবা মায়ের চোখের পানি মুছে দিলো।জেরিন বলল,”ভাইয়া আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া তোকে ফিরে পেয়েছি।আর আমাদের কিছু চাই না।”

“মা তোমাদের আরেকটা কথা বলার আছে।”

শায়লা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।সাজিদ সিরাতের পাশে দাঁড়িয়ে বলল,”সিরাত শুধু আমার ডাক্তার নয় ও আমার….”

“কি??”

“ও আমার অর্ধাঙ্গিনী। দেশে ফেরার আগে আমরা রেজিস্টি ম্যারেজ করে নিয়েছি।”

শায়লা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,”এ কি বলছিস সাজিদ!!!

“হুম ঠিক বলেছি।”

চিত্রা এতোক্ষণ চুপচাপ ছিলো। সাজিদের বিয়ের কথা শুনে খুশিতে চোখ মুখ জুড়ে আনন্দ বয়ে গেলো।”বাহ এটা তো দারুন খবর। অভিনন্দন সাজিদ ভাইয়া।খালামনি তোমার ছেলে আর ছেলের বউকে দোয়া করবে না?”

শায়লা হুঙ্কার দিয়ে উঠলো।”কিসের বিয়ে !এ বিয়ে আমি মানি না।”

আনোয়ার সাহেব চোখদুটো ছোট ছোট করে শায়লার দিকে তাকালো। শায়লা তো এমন নয়।এ শায়লাকে তার বড্ড অচেনা লাগছে।”শায়লা ছেলে যখন বিয়ে করে ফেলেছে তখন আর তুমি দ্বিমত করো না।ছেলের বউকে সসম্মানে মেনে নাও।”

“তুমি চুপ করো সাজিদের বাবা।ওর যা খুশি তাই হবে নাকি। আমাদের কোনো পছন্দ অপছন্দ নেই।একে তো সব কথা লুকিয়ে গেল এখন আবার এতো বড় কান্ড ঘটিয়ে এসেছে।”

সিরাতের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল।তবে কি তার স্বপ্নগুলো ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে‌।সিরাত কাচুমাচু হয়ে শায়লার সামনে এসে দাঁড়ালো।”আন্টি আপনি আমার মায়ের মতন।আমরা দুজন যদি কোনো ভুল করি তবে আমাদেরকে ক্ষমা করে দিন। আপনি গুরুজন আপনি যা শাস্তি দেবেন আমরা মাথা পেতে নেবো।”

সিরাতের এই অবস্থা দেখে সাজিদের খুব খারাপ লাগলো।মেয়েটা তার জন্য এতটা ত্যাগ স্বীকার করেছে।এতো কষ্ট করেছে। তাকেই অপমানিত হতে হচ্ছে।চিত্রা শায়লার হাত ধরে বলল,”ও খালামণি তুমি এমন রাগ করছো কেন?ওরা দুজন দুজনকে খুব ভালোবাসে। তুমি চাও না ওরা একসাথে থাকুন?”

“চিত্রা মা তুইও ওদের সাপোর্ট করছিস। আমার দিকটা একবারও ভাবছিস না।”

“মা তুমি এতো জেদ করছো কেন বলো তো?দেখো সিরাত ভাবীর মুখটা।ভারী মিষ্টি দেখতে! তুমি এমন মেয়ের উপর রাগ করছো। ভাইয়া ভাবী সুখে থাকাটাই আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।”

“জেরিন থাক মাকে আর কিছু বলিস না।মা এ বিয়েটা মানবে না‌।মা আমার এই অবস্থা জেনে যে মেয়েটা আমার হাত ধরেছে তাকে ছেড়ে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না।যে বাড়িতে সিরাতের জায়গা নেই সেখানে আমার পক্ষে থাকা সম্ভব নয়।তোমরা সবাই ভালো থেকো।আমরা আসছি।”

সাজিদ সিরাতের হাত ধরে চৌকাঠ পেরুবে এমন সময় শায়লা বলল,”দেখেছো সাজিদের বাবা তোমার ছেলে একদম তোমার মতোই হয়েছে। বউয়ের সম্মান কিভাবে রাখতে হয় আমার ছেলে জানে।”

শায়লার কথা শুনে সাজিদ চৌকাঠে দাঁড়িয়ে পড়লো।শায়লা গিয়ে সিরাতের হাত ধরলো।”সিরাত মা তুই আমায় উপর অভিমান করিস না।আমি তোদের সাথে একটু মজা করলাম।আর দেখলাম আমার ছেলেটা তোকে কতটা ভালোবাসে। আমি কিন্তু দজ্জাল শাশুড়ি নই।”

শায়লা এহেন কান্ডে সবার চোখ কপালে উঠে গেল।চিত্রা হেসে বললো,”খালামনি তুমি পারো বটে।”

শায়লা হো হো করে হেসে উঠলো।”কেমন দিলাম বলো? সবাই কেমন ঘাবড়ে গেলে!”

সাজিদ শায়লার কাছে এসে বলল,”মা তুমি তো ভয় পাইয়ে দিলে।”

“হুম তবে আমি কিন্তু মিথ্যা বলি নি।এ বিয়ে আমি মানি না।আমার একমাত্র ছেলের বিয়ে এমন সাদামাটা হবে!তা তো হতে পারে না। সাজিদের বাবা ছেলের বিয়ের কিন্তু ধুমধাম করে দিতে হবে।পুরো শহরকে তাক লাগিয়ে দাও।”

শায়লা চিত্রা আর জেরিন মিলে সিরাতকে রুমে নিয়ে গেল। আনোয়ার সাহেব হেসে বলল,”সাজিদ তোর মায়ের কোনো জবাব নেই।চল বিয়ের আয়োজন করতে হবে তো।দেরি করা যাবে না। তুলকালাম কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলবে।”

সাজিদ আর আনোয়ার মিলে বিয়ের আয়োজন করলো। খুব জাঁকজমকপূর্ণভাবে বিয়ে সম্পন্ন হলো।সাজিদ আর সিরাতের বিয়েতে সবাই খুব মজা করলো।

———————————————————————————————-

পুরনো কথাগুলো ভাবতে ভাবতে কেবিনের দিকে এগিয়ে গেল চিত্রা। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুক চিরে।কাল রাতে বারান্দায় বসে পুরনো অ্যালবামগুলো দেখছিলো।।”হঠাৎ তার ফোনটা বেজে উঠলো।চিত্রা কলটা স্পিকারে দিয়ে কথা বলতে লাগলো।”হ্যালো চিত্রা ম্যাম বলছেন।”

“জি বলুন‌!”

“আমাদের হাসপাতালে আমরা রোগীদের উৎসাহ দেওয়া জন্য একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছি।দেশের কয়েকজন গুণী মানুষকে ডাকা হয়েছে। আমরা চাই আপনি আমাদের প্রোগ্ৰামে আসুন।প্লীজ ম্যাম না করবেন না।”

“আপনাদের প্রোগ্ৰামটা কবে ?”

“আগামীকাল বিকাল ৪ টায়।”

“ঠিক আছে আপনারা আমায় অ্যাড্রেসটা পাঠিয়ে দিন আমি সময়মতো পৌঁছে যাবো।প্রোগ্ৰাম শেষে রোগীদের সাথে কথা বলতে বলতে সাগরকে দেখতে পায়।
সাগরের বেডের দিকে এগিয়ে গেল। পাশে থাকা বয়স্কা মহিলাকে জিজ্ঞেস করলো,”ওনার কি হয়েছে?”

বয়স্কা মহিলাটি চিত্রার দিকে তাকালো।চিত্রাকে ঠাহর করতে পারলো না।হাতের তাসবিহটা পাশে রেখে সাগরের বুকে ফুঁ দিলো। পাশে রাখা গ্লাসটা হাতে নিয়ে ঢকঢক করে পুরোটা খেয়ে নিয়ে বলল,”তুমি কে মা?”

“আমি চিত্রা।”

“ওহ।ও হচ্ছে আমার পালক সন্তান।ছোট বেলা ওর মা মারা যাওয়ার আগে আমার হাতে তুলে দিয়ে যায়। কিন্তু আমি ওকে মানুষ করতে পারি নি।এমন কোনো খারাপ কাজ নেই যা ও করে নি। ওইজন্য আমি ওকে ঘর থেকে বের করে দেই। হঠাৎ একদিন আমি রাস্তা পার হচ্ছিলাম।এমন সময় একটা ট্রাক আমার দিকে ছুটে আসছিলো।আমি কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না।ও বাতাসের বেগের মতো এসে আমায় ধাক্বা মারে। আমি সাইডে চলে যাই।একটু আধটু কাটা ছেঁড়া যায়।রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখি ওর নিথর দেহ পড়ে আছে।মাথা দিয়ে র**ক্ত বের হচ্ছে।ট্রাকটা ওকে চাপা দিয়ে দ্রুত চলে যায়। আশেপাশের লোকজনের সাহায্যে হাসপাতালে নিয়ে আসি। শুনেছি বিয়েও করেছে। কিন্তু বৌমাকে দেখি নি কখনো।আমি বেঁচে আছি ওর জন্য। আমার জন্য আজ ওর এই অবস্থা।কোনো হুঁশ নেই। আমার বাকি দুই ছেলে ওর চিকিৎসার খরচ চালায়।ডাক্তার কোনো আশ্বাস দেয় নি।বলেছে হয়তো কখনো জ্ঞান ফিরবে হয়তো ফিরবে না।”

সাগরের এই অবস্থা দেখে হাসপাতাল থেকে দৌড়ে বেরিয়ে এলো। এতগুলো বছর কেটে যাওয়ার পরও সাগরের প্রতি ভালোবাসা এক বিন্দু ও কমে নি। ভালোবাসার মানুষটা ভুল হতে পারে কিন্তু তার ভালোবাসা তো ভুল ছিল না।মন থেকে সাগরকে ভালোবেসেছে।মন মস্তিক আর হৃদয়ের সবটা জুড়ে সাগর নামক মানুষটার একচ্ছত্র আধিপত্য।সেখানে অন্যকারোর প্রবেশ নিষিদ্ধ। চিরদিনের মতো সে স্থানে চলাচলের পথ বন্ধ করে দিয়েছে চিত্রা।

“মাম্মা মাম্মা।ওখানে কি করছো?”

মা ডাক শুনে চিত্রা পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখে তার আর সাগরের ভালোবাসার শেষ চিহ্ন দাঁড়িয়ে আছে।চিত্রা মেয়ের কাছে গিয়ে বলল,”এই তো আমি ফালাক মামুনি।”

“এখানে কি করছো?আমরা বাড়ি যাবো না? তুমি কি ভুলে গেছো আজ আমাদের আকাশ দেখার কথা।”

“ওহ হ্যা তাই তো!চলো আমরা আজ আকাশ দেখবো।”

ফালাককে গাড়িতে বসিয়ে দিলো। শেষ বারের মতো হাসপাতালের দিকে একপলক তাকিয়ে গাড়িতে বসে পড়লো।চিত্রা মেয়েকে জড়িয়ে ধরল। কিছুক্ষণের মধ্যে ফালাক ঘুমিয়ে পড়লো। চিত্রা জানালার দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,

“তুমি আমার সেই ভালোবাসা যাকে ভালোবেসে দুঃখ কষ্ট পেয়েছি।তবে তোমায় অসংখ্য ধন্যবাদ সেদিন তুমি যদি আমার সামনে তোমার খারাপ রুপে না আসতে তবে আমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারতাম না। তোমার জন্য আমি ফালাক নামক এক টুকরো জান্নাত পেয়েছি।সাগর আমি তোমায় কখনো ভুলতে পারবো না। কিন্তু তোমায় আর আমার জীবনে চাই না। আমার ফালাককে আমি একাই বড় করবো।তুমি স্মৃতির পাতায় লেখা একটা নাম হয়ে থাকবে। দিনশেষে তুমিই আমার প্রথম ও শেষ ভালোবাসা।”

গাড়ি ছুটে চলল নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে।যেখানে হাজারো একটা স্বপ্ন বুনে রেখেছে চিত্রা তার রাজকুমারী ফালাকের জন্য………..!!!

*************সমাপ্ত************