#পরিণয়
#লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-২
পল্লবী কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে কলটা ধরে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে সাহিল বলে উঠল-
– তুমি গহনা গুলো নিয়ে গেলে কেন?
পল্লবী কথাটা শোনে একটু মর্মাহত হলো। একটা সময় সাহিলেই পল্লবীকে ভালোবেসে গহনা কিনে দিত। আর আজকে সাহিল সেটারও জাবাব চাচ্ছে। গহনাগুলো পল্লবী আনত না কিন্তু মেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে গহনা গুলো সে নিয়ে এসেছে। পল্লবী কিছুটা ভেঙ্গে গেলেও নিজেকে সামলে নিয়ে শক্ত গলায় জবাব দিয়ে বলল
– আমার হকের জিনিস আমি এনেছি। এটার জবাব কেন তোমাকে দেবো? আমার দেনমোহরের যে টাকাটা উসল হিসেবে ছিল সেটা গহনার উপরেই ছিল। তাহলে আমার গহনা গুলো আমি নিয়ে যাব নাকি রেখে যাব সেটার জবাব তোমাকে কেন দিতে হবে?
– ওহ আচ্ছা। নিয়েছ ভালো কথা, বলে নিলেই তো পারতে।লুকিয়ে নেওয়ার কি ছিল?
– গহনা গুলো আমার। আমার গহনা কাকে বলে নেব সেটা আমার ব্যপার। সেটার কৈফিয়ত তোমাকে দেবো কেন? আর লুকিয়ে নিয়েছি মানে? নিজের গহনা নিজে নিয়েছি, অন্যের গহনা চুরি করে নিইনি যে লুকিয়ে নেব।
– সে যাইহোক। আনায়না কী করে?
– আনায়না আর আমি অনেক আগেই তোমার কাছে মৃত। সুতরাং এসব জানতে আমাকে আর কল দিবে না। তোমার সাথে আমি যে বন্ধনে ছিলাম সেটা ছিন্ন হয়ে গেছে কিছুক্ষণ আগে। ভুলে যেও না।
– তোমার সাথে আমার বন্ধন ছিন্ন হলেও আমার মেয়ের সাথে আমার বন্ধন এখনও ছিন্ন হয়নি। আমি রুশিকে বিয়ে করার পর আনায়নাকে আমার কাছে নিয়ে আসব। তখন রুশিই হবে আনায়নার মা।
পল্লবী হালকা হেসে বলল
– তাই নাকি সাহিল? আচ্ছা দেখা যাবে সেটা। আমার মেয়েকে আমার থেকে কীভাবে আলাদা করো সেটা আমি দেখে নেব। আপাতত তোমার কন্ঠটা শোনার রুচিও আমার জাগছে না। তুমি ফোনটা রাখতে পার।
পল্লবীর শক্ত জবাবে সাহিল কোনো কথার জবাব দিল না। কিছুটা বিস্মিত হলো বটে। কারন যে মেয়েটা সংসার টিকিয়ে রাখার জন্য গতকালকেও সাহিলের পায়ে ধরেছে সে মেয়েটার এমন কর্কশ কন্ঠ তার মনটাকে একটু নাড়া দিয়েছে। সাহিল কোনোরুপ কথার জবাব না দিয়ে ফোনটা কেটে দিল। সাহিল ফোনটা কাটতেই পল্লবী দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস নিল। চোখে বেয়ে তার পানি পড়তে লাগল। কয়েকদিন পর সাহিল বিয়ে করে নেবে এটা ভেবেই সে কষ্ট পেতে লাগল। চোখ যেন আজ বাঁধা মানছে না। আপন গতিতে চোখের জল পড়তে লাগল। এর মধ্যেই আনায়নার দিকে তাকিয়ে দেখল আনায়না বিছানায় বসে পল্লবীর দিকে তাকিয়ে সামনের গুটি গুটি দুই পাটির দুটো দাঁত কামড় দিয়ে হাসছে। নিমিষেই যেন পল্লবীর কষ্টটা মলিন হয়ে গেল। আনায়নাকে বুকে নিয়ে একের পর এক চুমু দিতে লাগল। তারপর বুকে মিশিয়ে নিয়ে বলতে লাগল
– আমাকে যে তোর জন্য হলেও বাঁচতে হবে। আমাকে যে তোর জন্য হলেও নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হবে। আমার জীবনে যত তুফানেই আসুক তোর জীবনে সে তুফানের কোনো আঁচড় আমি লাগতে দেবো না। সবসময় তোকে আমি জড়িয়ে রাখব নিজের করে। তোকে কেউ আলাদা করতে পারবে না আমার থেকে। তুই যে নাড়ি ছেড়া বুকের মানিক রে মা।
আনায়নাও মায়ের বুকে একদম মিশে আছে। মনে হচ্ছে এ বাচ্চাটাও মায়ের কষ্টটা উপলব্ধি করতে পারছে। এর মধ্যেই অধরা ডাক দিয়ে বলল
– পল্লবী খাবার খেতে আস তো। সকাল থেকে তো কিছু খাস নি। সকাল গড়িয়ে যে বিকেল হলো সে খেয়াল কী আছে?
পল্লবী অধরার ডাকে সাড়া দিয়ে বলল
– আসছি…….
বলেই আনায়নাকে কোলে নিয়ে খাবার টেবিলে বসলো। খাবার টেবিলে বসতেই অধরা আনায়নাকে কোলে নিল। তারপর পল্লবী খাবার খেতে খেতে হালকা কেঁদে বলল
– আমার জীবনটা কেন এমন হলো? এ খাবার তো আমার গলা দিয়ে নামছে না রে অধরা।
অধরা পল্লবীকে হালকা গলায় বলল
– গলা দিয়ে না নামলেও তোকে আনায়নার জন্য খেতে হবে।
– আনায়নার কথা ভেবেই তো কিছু করতে পারছি না রে অধরা। নাহয় এ জীবনটা শেষ করে দিতাম।
– জীবন শেষ করে দেওয়া কোনো সমাধান না।
– আচ্ছা অধরা যেভাবে ছিল সেভাবেই থাকতাম সেটাই তো ভালো ছিল। ডিভোর্স টা না হত।তবুও তো সাহিলের সাথে থাকতে পারতাম। আনায়না তার বাবার আদর পেত। আমিও আমার স্বামীর পরিচয় পেতাম।
– পল্লবী ডিভোর্স হয়েছে খুব ভালো হয়েছে। এর আগের একবছর কী তুই ভালো ছিলি? এভাবেই তো কষ্ট পেয়েছিস। সাহিল জীবনে থাকার পরও তো কষ্ট পেয়েছিস। তিলে তিলে মরেছিস। তিলে তিলে মরার চেয়ে একবারে মরে যাওয়া ভালো। হাজারটা কষ্ট ঝগড়া,অনিশ্চিত নিয়ে সংসার করার চেয়ে আলাদা হয়ে যাওয়ায় ভালো। আচ্ছা আমাকে একটা কথা বল তো আনায়নার যদি পায়ে বিষ ফোড়া হয় তুই কী সেটা আনায়না ব্যথা পাওয়ার ভয়ে অপারেশন করবি না?
– আমার মেয়ের ভালোর জন্য অবশ্যই আমি তার সাময়িক কষ্টের কথা চিন্তা না করে অপারেশন করব। সে হয়তো অপারেশন করলে একবার একটু বেশি কষ্ট পাবে তবে পরে তো তার ব্যথাটা পুরোপুরিভাবে ভালো হয়ে যাবে। আর আমি যদি অপারেশন না করি তাহলে সে সবসয়ম এটার ব্যথা অনুভব করবে আর কখনও ফোড়াটা ভালো হবে না।
– তাহলে তুই নিজেই ভাব। যে সংসারে তুই থেকে কষ্ট পাচ্ছিলি সেটা ঠিক করতে পারছিলি না সে সংসারটা ভেঙ্গে গিয়ে কী ভালো হয়নি?আমার তো মনে হয়েছে তার জীবনে থেকে প্রতিদিন অশান্তি করার চেয়ে তুই আলাদা হয়ে গেছিস এটাই ভালো হয়েছে।
– তা হয়তো হয়েছে। তবে আমার মাটিটা তো এত শক্ত না রে অধরা। আয় করার মতো কিছু নেই আমার। চাকুরি পাব কিনা সেটাও জানি না।
– মাটি শক্ত না হলে শক্ত করে নিতে হয়। নিজেকে সময় দে। যে সংসার শেষ হয়ে গেছে সেটা নিয়ে আর ভাবিস না।চিন্তা ধারা পাল্টা। স্বামীর পরিচয়ে বাঁচতে হবে এমন কোনো কথা নেই। নিজের পরিচয়ে বাঁচতে শিখ। আর একটা সন্তানকে বাবার পরিচয়েই বড় হতে হবে এমন কোনো নিয়ম নেই।তোর মেয়েকে তোর পরিচয়ে মানুষ করবি। নিজেকে শক্ত কর।
পল্লবী অধরার কথাগুলো শোনে একদম চুপ হয়ে গেল। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে খেতে লাগল। খেতে তার একদম ইচ্ছা করছে না তবুও খেয়ে নিল। খাওয়া শেষে আনায়নাকে খাইয়ে দিল। আনায়নাকে খাইয়ে দিয়ে বুকে জড়িয়ে শুইয়ে পড়ল। চোখ দুটো তার ঘুমে ভারী হয়ে যাচ্ছে। আনায়কে বুকে জড়িয়ে নিয়ে প্রথমে আনায়নাকে ঘুম পাড়াল তারপর নিজে একটু চোখ বুজল। এর মধ্যেই ফোনটা আবার বেজে উঠল। ঘুম ঘুম চোখে কলটা ধরতেই….