#পরিণয়
#লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-১
সাত বছরের সম্পর্কের ইতি টানলাম ডিভোর্স নামক সাদা কাগজে স্বাক্ষর দিয়ে। ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল তিনছরের। আর বিয়ের সম্পর্ক চার বছরের। এর মধ্যে কোল আলো করে একটা ফুটফুটে কন্যা সন্তানও আসলো। আমার মেয়ে আনায়নার বয়স মাত্র এক। নিজেকে নিয়ে কোনো হতাশা নেই হতাশা শুধু এ বাচ্চাটাকে নিয়ে। আমাদের পথচলার শুরু হয়েছিল সাত বছর আগে।
সেদিন ছিল মেঘাচ্ছন্ন দিন। চারদিকে কনকনে বাতাস বইছে। হালকা বাতাসে তখন শরীরের লোম কাঁটা দিয়ে উঠছিল। কোনোরকমে এক হাত দিয়ে তার বিপরীত হাতের কনুই আবার অপর হাত দিয়ে অপর হাতের বিপরীত কনুই ধরে ভার্সিটির গেট থেকে তড়িৎ গতিতে হেঁটে ক্লাসের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলাম। এমন সময় হোঁচট খেয়ে সামনের দিকে পড়ে গেলাম। হালকা বৃষ্টিকণায় তখন ঘাস মিশ্রিত মাটিটা স্যাঁতস্যাঁত করছিল। পায়ে কাঁদা আটকে কাঁদায় লেপ্টে গেছে। খানিকটা ঝুঁকেও পড়েছিলাম। ঝুঁকে থেকে উপরে উঠেই সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে থমকে গেলাম। একটা সুদর্শন যুবক বসে আছে । যুবকের মুখে খুঁচাখুঁচা দাড়ি গুলো এভ্রোথেভ্রো হয়ে আছে। খানিকটা আনমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। কোনো পুরুষ যে এত আনমনে আকাশটা উপভোগ করে সেটা জানা ছিল না।
এর মধ্যেই ঘড়ির কাটা জানান দিল ক্লাসে যেতে হবে। আকাশটাও ক্রমে কালো হয়ে গেল। ঝুম বৃষ্টি পরক্ষণেই নামতে শুরু করল। আমি খানিকটা অপ্রস্তুত হয়েই যুবকের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দৌঁড় লাগালাম ক্লাসরুমের দিকে। মিনেট একের মধ্যেই ক্লাস রুমে গিয়ে পৌঁছালাম। ক্লাস রুমে ঢুকতেই পড়শি বলে উঠল
– কী রে তোর পায়ের এ অবস্থা কেন? কাঁদা মাটিতে লেপ্টে আছে ।
– আরে বলিস না হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিলাম।
-আচ্ছা যাইহোক সিটে বস।
বলেই পড়শি ব্যাগ থেকে একটা টিস্যু বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে উঠল
– আগে পা টা মুছে নে।
আমি পড়শির হাত থেকে টিস্যুটা নিয়ে পা টা মুছে টিস্যুটা ছুরে দেই বাহিরের দিকে। টিস্যুটা ছুরার দশ সেকেন্ড পড়েই মনে হলো একটা গম্ভীর কন্ঠ স্বর কানে ভেসে আসলো। কন্ঠস্বরটা বলে উঠল
– আরে দেখে ছুরে মারবেন তো এভাবে নাকে মুখে টিস্যু ছুরে মারলেন কেন?
আমি সামান্য কম্পিত হয়ে সে দিকে তাকালাম। ভয় ভয় চোখদুটো তার দিকে তাক করা। লক্ষ্য করলাম আকাশ বিলাসী সে ছেলেটায় আমার সামনে দাঁড়ানো। যাকে দেখে আমার মনের গহীনে ভালোলাগার বাতাসে শিহরণ জেগেছিল। কিছুক্ষণ তাকাতেই ভয়টা যেন নিমিষেই চলে গেল। হালকা হেসে বললাম
– এটা তো এমনিই ছুরে দিয়েছিলাম। আপনাকে কে বলেছে এমন সময় আসতে। এখন সব দোষ আমার তাই না?
– আরে ভারি বজ্জাত মেয়ে তো আপনি? আমার নাকে মুখে ছুরে দিয়ে বলতেছেন এমন কেন করলাম। ভার্সিটিতে নতুন নাকি?
– হ্যাঁ নতুন। নতুন তো কী হয়েছে?
– কী আর হবে। সিনিয়রদের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় সে শিক্ষা মনে হয় পাননি?
সিনিয়র কথাটা শোনেই আমার মুখটা চুপসে গেল। মনে হচ্ছিল সাঁঝের রক্তিম আভা আমার মুখে ফুটে উঠেছে। আমি হালকা ঢুক গিলে সাহস জুগিয়ে বললাম
– যা করেছি ভালো করেছি।
আমার মধ্যে কোনো অনুতাপ না দেখে সে আমার দিক থকে নজর সরিয়ে নিল। চলে যাওয়ার পর জানতে পারলাম তার নাম সাহিল। অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়ে। একই ডিপার্টমেন্টে। এদিকে সাহিল চলে যাওয়ার পর পড়শি আমাকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলল
– প্রথম দিনেই সিনিয়রদের সাথে লেগে গেলি। তোর যে কী হবে?
– কী এমন হবে? শুধু শুধু পক পক করিস না।
সেদিন ক্লাস শেষ করে ক্লাস রুম থেকে বের হতেই সাহিলের সাথে দেখা। সাহিল হালকা গলায় বলল
– এই যে জুনিয়র নাম কী তোমার?
এবার তার নরম গলার সুর যেন আমার মনকে নাড়া দিল। আমি হালকা গলায় বললাম
– পল্লবী।
– পরিচয়টা ভালো করে দাও।
আমি ভ্রুটা কুঁচকে বললাম
– ভালো করে দেবো মানে?
– ভাইবোন কয়জন তোমার?
আমি বিরক্তি মাখা মুখটা নিয়ে কপালটা পাঁজ ভাঁজ করে বললাম
– আমি পল্লবী বাবা মায়ের ছোট মেয়ে। বড় ভাই আছে একজন।
সাহিল তখন হাতটা ইশারা করে বলল
– ঠিক আছে যাও।
সেদিন থেকেই রোজ ভার্সিটিতে যেতাম আর সাহিলের সাথে খুঁনসুটিগুলো রোজেই হত। সে খুঁনসুটি থেকে আমাদের ভালোবাসার শুরু।
ভালোবাসায় যুগল বন্ধী হওয়ার পর সাহিল গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করে চাকুরি পায়। চাকুরি পাওয়ার পর পরই দুই পরিবার মেনেজ করে বেশ কাঠ খড় পুড়িয়ে দুজন একসাথে হই। বিয়ের দুবছর বেশ ভালোই ছিলাম। একে অপরকে বুঝতাম। তবে আনায়না পেটে আসার পর থেকেই সাহিলের মধ্যে বেশ পরিবর্তন লক্ষ্য করি। কিছুদিন পরেই জানতে পারি সাহিল পরকিয়ায় আসক্ত। কোনো একটা মেয়ের সাথে তার প্রেম চলে তার। এটা নিয়ে সাহিলের সাথে আমার ঝগড়া চলতে লাগল। পারিবারিক অশান্তি দিন কে দিন বেড়েই যেতে লাগল। সাহিল ছিল তার বাবা ময়ের একমাত্র সন্তান। তাই আমি আমার শ্বশুর শ্বাশুরিকে বিষয়টা অবগত করার পর তারাও আঙ্গুলটা আমার দিকেই তুলল। সেদিনেই বুঝে গিয়েছিলাম আমার শ্বশুর শ্বাশুরিও আমাকে চায় না।
এক পর্যায়ে বুঝতে পারলাম সাহিলও আর আমাকে চায় না। ততদিনে আনায়নার জন্ম হয়ে গেছে। আনায়নার জন্য সংসারটা টিকিয়ে রাখার অনেক চেষ্টা করেছিলাম তবুও পারিনি। সে মেয়েটাকে কল দিয়ে অনেকবার বলেছিলাম সাহিলের জীবন থেকে চলে যেতে। কিন্তু সে মেয়েও যায়নি। উল্টা আমার সাহিলকে কেড়ে নিয়ে আমাকে স্বামীহারা আর আমার সন্তানকে পিতৃহারা করল। আর তার জন্যই ডিভোর্স পর্যন্ত পৌছায় আমার আর সাহিলের ভালোবাসা।
কথাগুলো পল্লবী তার খালাত বোন অধরাকে বলেই কাঁদতে লাগল। ডিভোর্স হওয়ার পর বাবার বাসায় না গিয়ে প্রথমেই অধরার বাসায় উঠেছে পল্লবী। অধরা পল্লবীর সবচেয়ে কাছের আর আপন ছিল। যদিও অধরা ডিভোর্সের কাহিনি জানত কেন হয়েছে, তবুও পল্লবী পুনরায় বলে মনটা হালকা করল। পল্লবীর কান্নার শব্দে পল্লবীর বাচ্চা আনায়না উঠেও কাঁদতে লাগল। পল্লবী আনয়ানাকে ধরে জোরে জোরে কাঁদতে লাগল আর বলতে লাগল
– আমি এখন এ বাচ্চাকে নিয়ে কী করব? কোথায় যাব? পরিবারকে কী জবাব দেবো? বিয়েটা তো আমি আমার ইচ্ছায় করেছিলাম।আজকে জীবন্ত লাশের মতো হয়ে গেছি। একা থাকলে হয়তো মরে গিয়ে সমাধান করতাম। এখন সাহিল যে একটা স্মৃতি দিয়ে গেছে সে স্মৃতি তো আর মুছতে পারছি না। কী করব আমি?
বলেই আনায়নাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। অধরা পল্লবীর কান্না শোনে তার কাঁধে হাত রেখে বলল
– পল্লবী তুই এভাবে কাঁদিস না। যতদিন লাগে এখানে থাক। কেঁদে নিজেকে কষ্ট দিস না। বাচ্চাটার কথা চিন্তা কর অন্তত।
পল্লবী হেঁচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে বলল
– বাচ্চাটার জন্যই তো নিজেকে শেষ করে দিতে পারছি না। আনায়নার তো বাবা থেকেও বাবা নেই আর আমি নিজেকে শেষ করে দিলে তো আনায়নাকে দেখার জন্য কেউ থাকবে না। আমি ওর দায়িত্ব কীভাবে নেব বল৷ আমার তো একটা চাকুরিও নেই। এ চাকুরির বাজার যে কতটা ভয়ানক সেটা তো তুই জানিস। আমাকে কে চাকুরি দেবে বল?
– পল্লবী তুই কিছুদিন এখানে থেকে একটা চাকুরির ব্যবস্থা কর। আর চাকুরি হলে বাবার বাড়ি যাস। আপাতত এখানে থাক। কোনো চিন্তা করিস না। নিজেকে সামলে নে। আমরা তো আছিই।
কথাগুলো শোনে পল্লবী আনায়নাকে শুইয়ে নিজের চোখ মুছতে লাগল। এমন সময় পল্লবীর কলটা বেজে উঠল।পল্লবী ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল সাহিল কল করেছে।পল্লবী কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে কলটা ধরে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে সাহিল বলে উঠল-
চলবে…