পরিণয় পর্ব-০৪

0
1830

#পরিণয়
#লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৪

পরশ কোনো কথা না বলেই পল্লবীর দিকে তাকিয়ে দেখল পল্লবীর মুখে ভয়ের ছাপ ফুটে উঠেছে। পরশ পল্লবীকে ভয় পেতে দেখে বলল-

– ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি আপনার মতো নষ্টা মেয়েকে স্পর্শ করতে আসিনি।

পল্লবী পরশের মুখে এমন কথা শোনে স্তম্ভিত হয়ে গেল। মুখ দিয়ে কথা বলতে চেয়েও পারছে না। অবাক নয়নে পরশের দিকে তাকিয়ে রইল। চোখের পলকও ফেলছে না। কারণ চোখের পলক ফেললে চোখের কোণে জমে থাকা পানিটা গড়িয়ে পড়বে। এর মধ্যে পরশ পুনরায় বলে উঠল

– দেখুন আপনাকে আমি সম্মান করি সে সম্মানের জায়গা থেকে বলছি আমি চাই না আপনি এ বাসায় থাকুন। আপনার জন্য অধরার সাথে আমার সম্পর্ক খারাপ হচ্ছে। নিজের সংসারটা গিলে খেয়ে আমার সংসারটা এসেছেন গিলে খেতে।

পল্লবী এবার চুপ থাকতে চেয়েও পারল না। শক্ত গলায় বলে উঠল

– ভুলে যেও না সম্পর্কে আমি তোমায় বড় হই। আর আমার সংসার আমি গিলে খেয়েছি মানে? কথাটা কোন যুক্তিতে বলছো তুমি? সাহিল পরকিয়া করেছে আমি না। সংসার যদি কেউ ভেঙ্গে থাকে সেটা সাহিল করেছে আর সাহিলের নতুন প্রেমিকা রুশি। নষ্টা মেয়ে বলতে হলে রুশিকে গিয়ে বলো। আমার দিকে আঙ্গুল উঠছে কেন?

– আঙ্গুল উঠার মতো কাজ করলে তো আঙ্গুল উঠবেই। কোনো পুরুষ এমনি এমনি পরকিয়া করবে না। নিশ্চয় সারাদিন সাহিল ভাইয়ের সাথে ঝগড়াঝাটি আর অশান্তি করেছেন তাই সাহিল ভাই সুখ খুঁজতে অন্য মেয়ের কাছে গেছে।

– মুখ সামলে কথা বলো। সাহিলকে কী আমার থেকে বেশি তুমি চিন? আর আমি অশান্তি করেছি কী না সেটা তো তুমি জানো না। ধারণা থেকে এতগুলো কথা বলছো কোন সাহসে? তোমাদের মতো পুরুষেই সব দোষ নারীদের দেয় আর তোমরায় দেখা যায় নিজের বউকে রেখে পরনারীতে আসক্ত হও।

– আপনি এবার মাত্রা ছাড়িয়ে কথা বলছেন।

– ও… এতক্ষণ তুমি বলেছ সেটা মাত্রা ছাড়ায় নি? আর এখন আমি বলেছি তাতেই মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে?

– দেখুন আমি চাই না আপনি এ বাসায় থাকুন। সুতরাং আপনি আর এ বাসায় থাকবেন না। এর বেশি আপনার সাথে কথা বাড়ানোর রুচি আমার নেই।

– সেটা আমাকে ভদ্রভাবেও বলা যেত। আগে ভদ্রতা শিখো। ডিভোর্স হয়ে গেছে তার মানে এই না আমি তোমার বাসায় পড়ে থাকব। আমি আজকে এমনিতেও চলে যেতাম। তোমার বলার দরকার পড়ত না। নিজের আচরণ ঠিক করো কাজে দেবে।

– আমার আচরণ আমি ঠিক করে নেব। আপনাকে যা বলেছি সেটা মাথায় রাখবেন। অধরা রান্না ঘরে আছে তাই সে সুযোগে আপনাকে এ কথা গুলো বলতে এসেছি। আশাকরি অধরাকে আমার ব্যপারে এসব বলে সংসারে অশান্তি ডেকে আনবেন না।

– তোমার বলা শেষ হয়েছে?

– হ্যাঁ।

– এবার যেতে পার। তুমি চাচ্ছ না তোমার বাসায় থাকি সুতরাং আমি মরে গেলেও থাকব না। এরপর আমি কাকে কী বলব নাকি বলব না সেটা একান্তই আমার বিষয়। এ বিষয়ে নাক গলানোটা তোমার অনধিকার চর্চা।

– চোরের মায়ের বড় গলা।

বলেই সাহিল রুম থেকে বের হয়ে গেল। সাহিল বের হতেই পল্লবীর চোখ বেয়ে পানি পড়তে লাগল। দোষটা তার না তবুও আঙ্গুল তার উপর তুলা হচ্ছে।ডিভোর্স মানেই এ সমাজ ধরে নিয়েছে মেয়েদের দোষ। আর ছেলেরা দুধে ধোয়া তুলসি পাতা। আর রুশি মেয়েটায় কেমন? একটা মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের সংসার নষ্ট করল। বেশ কষ্ট লাগতে লাগল পল্লবীর। কত কষ্ট করে সংসার গুছিয়েছিল আর আজকে সে সংসার অন্য কারও হবে। এ সময়টাতে যদি শ্বশুর শ্বাশুরি পল্লবীকে সাহায্য করত, পাশে থাকত তাহলে হয়তো এতটা কষ্টের সম্মুখীন হতে হত না আর তার সংসারটাও টিকে যেত। কিন্তু সে সাহায্যটুকুও পেল না। মনের গহীনের ব্যথাটা যেন এসব ভাবতে ভাবতেই তার বেড়ে গেল। ভাবনায় ছেদ পড়ল আনায়নার আধু আধু মাম্মা মাম্মা ডাকে। আনয়নার ডাকটা যেন পল্লবীর মনটা শান্ত করে দিল পরক্ষণেই। নিজেকে সামলে নিয়ে আনায়নাকে কোলে নিয়েই সব গুছাতে থাকল। এমন সময় অধরা এসে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো

– কী রে তুই এত সকালে সব গুছাচ্ছিস কেন?

অধরার কথা শোনে পল্লবী তার এক হাতে থাকা কয়েকটা কাপড় ব্যগের উপরেই রেখে অধরার দিকে তাকিয়ে বলল

– মায়ের কাছে যাব রে। মায়ের জন্য মন ছটফট করছে।

– কিছুদিন এখানে থেকে মনটা একটু শান্ত করে যা। ঐখানে গিয়ে তো আরও অশান্তি হবে। তোর ভাইয়ের বউ যে টাইপ তোরে দেখে তো তেলে বেগুনে ফুলবে।

পল্লবী একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলল

– না রে আর থাকব না। সে যাইহোক মা তো সেখানে আছে। মায়ের কাছে গেলেই মনটা ভালো লাগবে বেশি।

– সে নাহয় বিকেল দিকে যাস। এখন নাহয় একটু রেস্ট নে।

– না রে অধরা আমার মনটা বেশ অশান্ত হয়ে আছে মায়ের মুখটা দেখার জন্য। আমি এখনি চলে যাব।

– আচ্ছা ঠিক আছে আমি নাস্তা তৈরী করে নিয়ে আসছি। নাস্তা খেয়ে যেখানে যাওয়ার যাস।

– নারে অধরা নাস্তা খেতে গেলে দেরি হয়ে যাবে। মাকে দেখার জন্য মনটা বেশ ছটফট করতেছে।

বলেই পল্লবী ব্যাগের উপর রাখা কাপড়গুলো ব্যাগে ঢুকিয়ে নিয়ে বের হওয়ার জন্য প্রস্তুত হলো। পল্লবী কিছু না বললেও অধরা বেশ ভালোই বুঝতে পেরেছে পল্লবী কেন থাকতে চাচ্ছে না। অধরা ভাবছে কালকের কথোপকথন হয়তো পল্লবী শোনে ফেলেছে তাই আর থাকতে চাচ্ছে না। যাওয়ার জন্য এত জেদ ধরেছে। অধরা আর পল্লবীকে আটকাল না। শুধু আনায়নাকে পল্লবীর কোল থেকে নিয়ে কয়েকটা চুমু দিয়ে পল্লবীকে বলল

– আল্লাহ তোর মঙ্গল করুক। তোকে সঠিক পথ দেখাক। তোর সাথে যারা অন্যায় করেছে তারা যেন সবাই কঠিন শাস্তি পায়। তারা যেন সবাই তোর পায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে।

পল্লবী অধরার কথায় চোখের দু ফুটো জল ফেলল। তারপর আনায়নাকে কোলে নিয়ে খালি মুখেই বের হয়ে গেল। একটা সি এন জি ভাড়া করে বাবার বাসায় গেল। বাবার বাসার দরজার সামনে গিয়ে কলিং বেল চাপতেই দরজা খুলল পল্লবীর ভাইয়ের বউ নিরা। দরজা খুলে পল্লবীকে দেখে নিরার হাসি মাখা মুখটা চুপসে গেল। মনে হচ্ছে এক ছটা আলোতে আধার ঘনিয়ে এসেছে। মুখটাকে বাঁকিয়ে বলল

– ওহ তুমি এসেছ। তা কতদিন থাকবে?

কথাটা শোনে পল্লবীর বুকটা ফেটে গেল। এখনো ঘরে ঢুকতে পারল না এর আগেই কতদিন থাকবে সে রফা করছে নিরা। পল্লবী হালকা দম নিয়ে বলল

– যতদিন চাকুরি না পাই ততদিন থাকব।

– চাকুরি তো হাতের মোয়া বললাম আর পেয়ে গেলাম তাই না? মা ও বসে বসে খাচ্ছে। এখন আসছে মেয়ে আর তার সাথে আরেকটা নিয়ে আসছে৷ সব আমার স্বামীর টাকায় খেয়ে আমার স্বামীর টাকা নষ্ট করতে এসেছে।

এসব জোরে জোরে বলতে লাগল আর দরজার সামনে থেকে যেতে লাগল। পল্লবীর বুকটা ফেটে যাচ্ছে। রুমে ঢুকতে আর ইচ্ছা হচ্ছে না তার। তবুও তাকে এত সব সহ্য করে এ ঘরে থাকতে হবে। কারণ সে অপারগ। মনে হাজারটা কষ্ট নিয়ে ঘরে ঢুকল পল্লবী। ঘরে ঢুকতেই মায়ের মুখোমুখি হলো। পল্লবীকে দেখে পল্লবীর মা নূরজাহান বেগম খুশি না হয়ে মুখটা আঁধার করে ফেলল। কোনো কিছু না বলেই পল্লবীকে এড়িয়ে অন্যদিকে চলে গেল। পল্লবী শুধু হালকা দম নিল। নিজের বাবার ঘরটা যেন আজকে বেশ অচেনা লাগছে তার। নিজেকে সামলে নিয়ে মায়ের কাছে গিয়ে বলল

– মা আনায়নাকে খাওয়ানোর জন্য একটু দুধ দাও।

নুরজাহান বেগম পল্লবীর কথা শোনে হালকা কেঁদে বলল

– আমার খাবারেই তারা মেপে দেয় রে মা। দুধ দিবে কী না জানি না রে।

বলেই নুরজাহান বেগম আনায়নাকে কোলে নিয়ে কাঁদতে লাগল। এমন সময় নিরা আসলো তাদের মাঝে।।এসেই বলতে লাগল

– যেই না মেয়ে আসলো ঠিক তখনই মেয়েকে আমার নামে যা তা বলা শুরু করেছেন তাই না?

পল্লবী নিরার মুখের কথাটা টেনে নিয়ে বলল

– মায়ের বয়সী মহিলার সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় সে শিক্ষা কী কখনও পান নি?

নিরা কর্কশ কন্ঠে বলল

– তোমার মতো ডিভোর্সীর কাছ থেকে কী আমার শিক্ষা নিতে হবে?

নিরার কর্কশ গলা শোনে পল্লবীর ভাই আতিক শোবার রুম থেকে বের হয়ে বলল

– কী হয়েছে নিরা? সকাল সকাল এত চিলাচ্ছ কেন?

নিরা গলার স্বরটা আরও বেশি কর্কশ করে বলল

– সকাল সকাল তোমার বোন এসে আমাকে নীতি কথা শোনাচ্ছে।

নিরার চিল্লানোতে আনায়নাও কাঁদতে লাগল। আনায়নার কান্না শোনে নিরা পুনরায় বলে উঠল

– শুধু তোমার বোন আসেনি সাথে একটা টেপ রেকর্ডার নিয়ে আসছে। মাথাটা জ্বালিয়ে দিল পুরো।

পল্লবী আর কিছু বলার সাহস পেল না। হালকা গলায় বলল

– বাচ্চাটা ক্ষুধায় কাঁদছে। ওকে একটু দুধ দেন। খেলেই কান্না থেমে যাবে।

পল্লবীর কথা শোনে পাশ থেকে আতিক বলে উঠল

– ফ্রিজে দুধ আছে আনায়নাকে খাওয়া। শুধু শুধু এ সামান্য ব্যপারে এত অশান্তি নিরার সাথে করার দরকার ছিল না।

তারপর নিরার দিকে তাকিয়ে বলল

– নিরা ঘরে যাও। ওরা মা মেয়ে যা ইচ্ছা করতে থাকুক তুমি ঘরে এসো আমার সাথে। আমি তোমার মাথা মেসেস করে দেচ্ছি। আর বেশি চিল্লাচিল্লি করলে মাথা ব্যথা করবে তোমার। সুতরাং আর চিল্লাচিল্লি করো না। চলো আমার সাথে।

আতিকের কথা শোনে নিরা আতিকের সাথে শোবার রুমে চলে গেল। এদিকে পল্লবীর চোখের জল যেন গড়িয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল। সামান্য দুধের জন্য নিজের ভাই ও কথা বলতে ছাড় দিল না। নিজেকে সামলে নিয়ে বুকে পাথর চেপে দুধ জ্বাল দিয়ে এনে আনায়নাকে খাওয়াল। এর মধ্যে পল্লবীর ফোনে একটা অচেনা নম্বর থেকে কল আসলো-