পরিণয় পর্ব-০৫

0
1406

#পরিণয়
#লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৫

এর মধ্যে পল্লবীর ফোনে একটা অচেনা নম্বর থেকে কল আসলো। পল্লবী ফোনটা হাতে নিয়ে নম্বর টা চিনতে না পেরে কলটা কেটে দিল। কলটা কাটার সাথে সাথে পুনরায় কল আসলো। এবারও পল্লবী কলটা কেটে আনায়নাকে কোলে নিয়ে দেয়ালে মাথাটা এলিয়ে দিল। পরক্ষণেই আবার কল আসলো। এবার পল্লবী কলটা তুলতেই ওপাশ থেকে এক ভদ্রলোক বলে উঠলেন

– আপনি কী মিসেস পল্লবী বলছেন?

পল্লবী অপ্রস্তুত হয়ে জবাব দিল

– হ্যাঁ মিসেস পল্লবী বলছি। কেন?

– আমি এডভোকেট রাশেদ বলছিলাম।

পল্লবী বুঝতে পারছিল না লোকটা কে? কারণ ডিভোর্স যে উকিলের মাধ্যমে হয়েছে তার নাম রাশেদ ছিল না। তবে এ উকিল কেন কল দিয়েছে পল্লবীর মাথায় ঢুকছে না। তাই একদম চুপ হয়ে গেল। পল্লবীর নীরবতা দেখে এডভোকেট রাশেদ পুবরায় বলে উঠলেন

– আপনি কি আমার কথা শোনতে পারছেন?

এডভোকেট রাশেদের কথা শোনে পল্লবীর ভাবনার ঘুর কাটল। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল

– হ্যাঁ বলুন কেন কল দিয়েছেন?

– আমি কল করেছি এজন্য যে,বাচ্চার দায়িত্ব বাচ্চার বাবা সাহিল রহমান পেয়েছে। উনি কালকে সকালে বাচ্চা নিতে আসলে বাচ্চাটা দিয়ে দিবেন।

কথাটা শোনে পল্লবীর বুকে যেন বান মারল। ইতস্তত গলায় বলল

– আমাকে না জানিয়ে এতকিছু কী করে হলো? আমি বাচ্চার মা আমাকে তো জানানো দরকার ছিল। আমাকে না জানিয়ে আমার সাথে কথা না বলে কী করে এত তাড়াতাড়ি বাচ্চার দায়িত্ব বাচ্চার বাবা পায়?

– দেখুন এত কিছুর কৈফিয়ত আপনাকে দিতে আমি প্রস্তুত না। বাচ্চাকে নিতে আসলে বাবার হাতে দিয়ে দিবেন।

পল্লবী এবার জোর গলায় বলল

– আমার বাচ্চা আমি কাউকে দেবো না। আমার বাচ্চাকে আমার কাছেই রাখব। কোনো কিছুই আমার বাচ্চাকে আলাদা করতে পারবে না আমার কাছ থেকে।

বলেই কলটা কেটে সাহিলকে কল দিল। সাহিল কলটা ধরতেই পল্লবী চেঁচিয়ে বলল

– আমার সাথে বিচ্ছেদ ঘটিয়েও তোমার শান্তি হয়নি? এখন আমার কাছ থেকে আমার বাচ্চাটাকে কেড়ে নিতে চাচ্ছ? এত বড় অন্যায় করতে বিবেকে বাঁধছে না।আমি আমার আনায়নাকে কোথায় দেবো না। আইন তোমার আছে আমারও আছে। দরকার হলে আমিও লড়ব আমার বাচ্চার জন্য।

পল্লবীর কথা শোনো সাহিল হালকা হেসে বলল

– পল্লবী তুমি হয়তো ভুলে গেছ এ দেশে আইন বলতে কিছু নেই। এ দেশের আইন চলে টাকায়। আমি যত টাকা খরচ করতে পারব তুমি তা পারবে না। আমি কালকে আনায়নাকে আনতে যাব। তারপর দেখব কীভাবে তুমি আনায়নাকে আমার কাছ থেকে নাও।

– আমার আনায়নাকে আমি কোথাও দেবো না। তুমি আসলেও দেবো না।

– সেটা কালকে আসলেই দেখা যাবে।

বলেই সাহিল কল কেটে দিল। অপরদিকে পল্লবী কলটা কাটতেই আনায়নাকে বুকে জড়িয়ে কাঁদতে লাগল।পল্লবীর কান্না দেখে পল্লবীর মা নুরজাহান বেগম পল্লবীর কাঁধে হাত রেখে বলল

– কী রে মা কাঁদছিস কেন? কে কল দিয়েছে? আর কী হয়েছে?

পল্লবী কাঁদতে কাঁদতে বলল

– মা সাহিল আমার আনায়নাকে ছিনিয়ে নিতে চাচ্ছে। সাহিল নাকি কালকে এসে আনায়নাকে নিয়ে যাবে। আনায়নাকে ছাড়া আমি কী করে বাঁচব মা।

নুরজাহান বেগম পল্লবীর কথা শোনে একটু চুপ থেকে বলল

– মা রে আনায়নাকে নিতে চাইলে দিয়ে দে।তোর চাকুরি নেই, আয় রোজগার নেই, তুই আনায়নাকে কী খাওয়াবি? এখানে তো হাজারটা কথা শোনে থাকতে হবে। তার চেয়ে বরং আনায়নাকে দিয়ে দে। আর আমি তোর ভাইকে বলে তোর একটা বিয়ের ব্যবস্থা করি। আনায়না থাকলে তো তোকে কেউ বিয়েও করতে চাইবে না ।

পল্লবী মায়ের কথা শোনে কান্না থামিয়ে অবাক নয়নে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল

– মা তুমি একজন মা হয়ে এ কথা কী করে বলতে পারলে? আমি আমার মেয়ের জন্য সব করতে রাজি। দরকার হলে মানুষের বাসায় কাজ করে আমার মেয়েকে খাওয়াব তবুও ওদের কাছে দেবো না। আর কোথায় বিয়ে দিতে চাচ্ছ তুমি? একটা আগুন থেকে বের হতে পারলাম না আরেকটা আগুনে ফেলে দিতে চাচ্ছ? কী করে পারলে মা এমন কথা বলতে?

নুরজাহান বেগম পল্লবীর কথায় একদম চুপ হয়ে গেল। খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলল

– কী করব আমি বল? আমার তো করার কিছু নেই।

বলেই কাঁদতে লাগল। এর মধ্যেই নিরা এসে বলল।

– মা মেয়ের কান্না শেষ হলে কাজ করুন এবার। সকাল পার হয়ে তো দুপুর হতে লাগল। রান্না কে করবে শোনি? সকালে আপনাদের জন্য আতিক নাস্তা খেয়ে বের হয়নি। আমার জামাই এর খাবেন পড়বেন আবার আমার জামাইকে অশান্তিতে রাখবেন। যত্তসব।

নিরার কথা শোনে পল্লবী আনায়নাকে নুরজহান বেগমের কোলে দিয়ে নিরাকে বলল

– আপনি চিন্তা করবেন না আমি রান্না করতেছি।

পল্লবীর কথা শোনে নিরা মুখটাকে বাঁকিয়ে চলে গেল। পল্লবী দৌঁড়ে রান্না ঘরে গিয়ে রান্না করতে লাগল। সারাদিন কাজের ফাঁকে ফাঁকে আনায়নাকে একটু খাইয়ে আবার কাজ করতে থাকল। কাজ শেষ করে পল্লবী আর নুর জাহান বেগমের খাবার জুটে বিকেল ৫ টায়। পল্লবী ভাতের প্লেটটা সামনে নিয়ে তাড়াহুড়ো করে এক লোকমা মুখে দিল। কারন ক্ষুধায় তার পেট ব্যথা শুরু হয়ে গেছিল। মুখে ভাত নিয়ে গিলতে গিয়েই গলায় ভাত আটকাল।পল্লবীর মা পল্লবীর দিকে পানি বাড়িয়ে দিয়ে বলল

– আস্তে খা মা।

বলেই কেঁদে দিল। পল্লবী নুরজাহান বেগমের হাত থেকে পানি টা নিয়ে পানিটা খেয়ে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল।তারপর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল

– মা কাঁদছো কেন?

নুরজহান বেগম চোখের জল মুছতে মুছতে বলল

– ছোট বেলা তুই খেতে চাইতি না তোকে কত গল্প শোনিয়ে খাওয়াতাম।তোর এঁটো করা কত ভাত ফেলে দিতাম। আর আজকে তুই খেতে পারিস কিন্তু তোর কপালে ভাত জোটে না।

মায়ের কথাটা শোনে পল্লবীর চোখ বেয়ে পানি পড়তে লাগল। চোখের পানিটা মুছে মাকে বলল

– মা দুঃখ দিয়েই তো আল্লাহ পরীক্ষা নেয়। দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার একটা চাকুরি হলে আমরা আলাদা হয়ে যাব। তখন আর এত দুঃখ থাকবে না।

– তাই যেন হয় মা।

সুখ দুঃখের কথা বলতে বলতেই মা মেয়ে খাওয়া শেষ করল। এর মধ্যে আতিক আসলো অফিস থেকে। অফিস থেকে এসে ফ্রেশ হয়ে খাটে শুইয়ে পড়ল। আতিক খাটে শুইয়ে চোখটা একটু বন্ধ করতেই নিরার তীক্ষ্ণ কন্ঠস্বর শোনতে পেল। কন্ঠ স্বরটা আতিকের কানে আসতেই সে শুয়া থেকে উঠে বসল। তারপর রুম থেকে বের হয়ে নিরাকে জিজ্ঞেস করল

– কী হয়েছে নিরা চিল্লাচ্ছ কেন?

– চিল্লাব না তো হাসব? আমার এত দামি ম্যাট্রেসের কী অবস্থা করেছে দেখো। আনয়ানার হিসুতে পুরো ম্যাট্রেসটা নষ্ট হয়ে গেছে।

নিরার কথা শোনে পল্লবী নরম সুরে বলল

– ভাইয়া আনায়না তো বাচ্চা। বুঝতে পারেনি। আমি চাদর ধুইয়ে ম্যাট্রেসটা মুছে দিচ্ছি।

পল্লবীর কথা শোনে নিরা জোর গলায় বলল

– এখন ম্যাট্রেস মুছলেই কী সব ঠিক হয়ে যাবে নাকি?

পাশ থেকে আতিক বিরক্ত গলায় বলল

– মেয়েকে তো একটু সাবধানে রাখবি। বাচ্চা মানুষ হিসু করবে এটা স্বাভাবিক। খাটে শুয়ানোর কী দরকার ছিল? নীচে শুইয়ে দিলেই তো হত। শুধু শুধু অশান্তি করিস।

আতিকের কথা শোনে পল্লবী আর কিছু বলল না।চুপ করে বসে রইল। এটুকু বাচ্চার সাথে এমন করবে সেটা পল্লবীর ভাবনার বাইরে ছিল।আনায়নাকে কোলে নিয়ে নীচে নামিয়ে দিল। আনায়না নীচে বসে খেলতে লাগল। এদিকে নিরা আর আতিক হনহন করে নিজের ঘরে চলে আসলো। নিজের ঘরে এসেই নিরা চেঁচিয়ে বলতে লাগল

– তোমার বোনকে কবে বিদায় করবে বলো? একদিনেই তো তোমার বোন আর বোনের মেয়ে আমার মাথা খেয়ে নিল।

– আরে কিছুদিন থাক। তারপর দেখেছি কী করা যায়।

– যা করার তাড়াতাড়ি করো।

এদিকে পল্লবীর কানে নিরা আর আতিকের কথা গুলো আসলেও তেমন পাত্তা দেয়নি। কারন পাত্তা দিতে গেলেই তার কষ্ট টা আরও বেড়ে যাবে। আনয়ানাকে কোলে নিয়ে ঘুম পারিয়ে দিল। তারপর নীচে বিছানা পেতে শুইয়ে পড়ল। এমন দিন দেখতে হবে পল্লবী কল্পনাও করেনি। নিজের মেয়ের কথা ভেবে পল্লবীর আরও কষ্ট বাড়তে লাগল। কাঁদতে কাঁদতেই এক পর্যায়ে ঘুমিয়ে গেল। সকালে উঠে নাস্তা বানানোর কাজে লেগে গেল। এর মধ্যেই কলিং বেলের আওয়াজ কানে আসলো পল্লবীর। পল্লবী দৌঁড়ে গেল দরজা খুলতে। দরজা খুলতেই পল্লবীর বুকটা কেঁপে উঠল। কারন পল্লবীর শ্বশুর শ্বাশুরি আর সাহিল এসেছে। পল্লবীর বুঝতে বাকি রইল না তারা আনায়নাকে নিতে এসেছে। পল্লবী তাদের দেখেই দৌঁড়ে আনায়নাকে কোলে নিয়ে বলল

– আমার মেয়েকে কোথাও দেবো না।

সাহিল পল্লবীর কথা শোনে পল্লবীর কোল থেকে আনায়নাকে জোর করে টেনে নিল।আনায়নাও কাঁদতে শুরু করল। আনায়নাকে টেনে নিতেই পল্লবী সাহিলকে কাঁদতে কাঁদতে বলল

– আমার মেয়েকে দিয়ে যাও। আমার মেয়েকে নিও না দয়াকরে।

পল্লবীর শ্বশুর শ্বাশুরি জোরে জোরে বলতে লাগল

– আমাদের নাতনি আমার নিয়ে যাচ্ছি। খবরদার মেয়েকে আনার জন্য যাবে না।আইন অনুযায়ী আনায়নার দায়িত্ব আমরা পেয়েছি।

বলেই সাহিল আর পল্লবীর শ্বশুর শ্বাশুরি আনায়নাকে নিয়ে বের হয়ে গেল।নুরজহান বেগম শুধু স্থির হয়ে সব নাটক দেখতে লাগল। আনায়নাকে নিয়ে যেতেই পল্লবী দাঁড়ানো থেকে বসে পড়ে কাঁদতে লাগল।এমন সময় পুড়া গন্ধে সারা বাড়ি মুহু মুহু করতে লাগল। নিরা দৌঁড়ে রান্না ঘরে গিয়ে দেখল তরকারি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। নিরার রাগটা যেন বেড়ে গেল। চুলাটা বন্ধ করে দৌঁড়ে পল্লবীর কাছে এসে বলল

– মেয়ের জন্য ন্যাকা কান্না করতে গিয়ে যে তরকারি পুড়িয়েছ সে খেয়াল কী আছে? মেয়ে নিয়ে গেছে ভালো হয়েছে। আপদ বিদায় হয়েছে।এ বাড়িতে থাকতে হলে মেয়েকে ছাড়ায় থাকতে হবে।

পল্লবী নিরার কথা শোনে উঠে দাঁড়িয়ে নিরার গালে কষিয়ে একটা চর মেরে বলল

– এ বাড়িতে আতিক ভাইয়ের যতটুকু অধিকার আছে আমারও আছে।সম্পত্তি ভাগ করলে দুজন সমান পাব। আমার বাড়িতে আমি থাকছি এত কাজ করে কেন থাকব? এ সম্পত্তি এ বাড়িতে মায়েরও ভাগ আছে। ভুলে যাবেন না বাবা সম্পত্তি কারও নামে দলিল করে যায়নি। আর একটা বার আমার মেয়েকে নিয়ে উল্টা পাল্টা কথা বললে জিভ ছিড়ে নিব। এ বাড়িতে আমি কাজের বুয়া হয়ে থাকতে আসিনি। এ বাড়ি অর্ধেক আমার। নাস্তা খাওয়ার এত ইচ্ছা রান্না করে খেয়ে নেন। আরেকবার যদি মাকে আর আমাকে কিছু বলেন জিভ টেনে ছিড়ে ফেলব। এতক্ষণ সহ্য করছি আমার মেয়ের জন্য। এখন আর সহ্য করব না। এ বাড়িতে থাকতে হলে আমি আমার মেয়েকে নিয়েই থাকব। আর ভালোভাবে থাকব। দেখি কী করে আমার সাথে লাগতে আসেন।

পল্লবীর রাগ দেখে নিরা একদম চুপসে গেল। পাল্টা কিছু বলার সাহস আর পেল না। হনহন করে ঘরে চলে গেল। আর এদিকে পল্লবী আনায়নার জন্য আবারও কাঁদতে লাগল। এর মধ্যেই পল্লবীর ফোনে আবারও কল আসলো। পল্লবী ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল