#পরিণয়
#লেখিকা- শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ১০
সে ভাবল এভাবে চাকুরি খুঁজলে অতি দ্রূত কোনো চাকুরি সে পাবে না। অবশেষে সিদ্ধান্ত নিল সে গার্মেন্টসে চাকুরি করবে। কারণ গার্মেন্টেসে চাকুরি পাওয়া তুলনামূলক সহজ। যদিও কাজটা একটু কষ্টকর। তবে আপাতত এছাড়া কোনো উপায় নেই। এসব ভেবে হালকা একটা নিঃশ্বাস ফেলল। মাথাটা বিছানায় এলিয়ে দিল। আনায়নার কথাটা আজ বেশি মনে পড়ছে তার। আনায়নাকে একটু কাছে পাওয়ার জন্য পল্লবীর বুকটা ছটফট করছে। বেশ কয়েকবার আনায়নার জন্য পল্লবী সাহিলকে কল দিয়েছে। তবে সাহিলের নম্বর ব্যস্ত। হয়তো রুশির সাথে কথা বলছে। এজন্য যেন পল্লবীর কষ্টটা আরও বেড়ে গেল। ভেতরটা তার জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে।শুধু মনে হচ্ছে সব হারিয়ে ফেলেছে। অতীতে যেন মনটা ঘুরপাক খেয়ে বারবার কষ্ট পাচ্ছে। কত চেষ্টায় করছে অতীত থেকে নিজেকে ফিরিয়ে আনতে। তবে পারছে না। মন যেন সেই অতীতেই পড়ে থাকতে চাচ্ছে। এই তো কিছুদিন আগে সাহিলের বউ হয়ে গিয়েছিল ঐ বাড়িতে। কত আশা, কত ভরসা, কত চাওয়া নিয়ে। ভালোবাসায় মুড়ানো ছিল সেদিনগুলো। কত কথা কত বিশ্বাসের চাদর দিয়ে ঢাকা ছিল প্রতিটা মুহুর্ত।আনায়না যখন পেটে এসেছিল তখনও তার আর সাহিলের ভালোবাসার কমতি ছিল না। ভালোবাসার জোয়ারে দুজনেই বেশ ভালো ছিল। তবে সে ভালোবাসায় ভাটা পড়ে পল্লবীর যখন চার মাস পড়ে। পল্লবী তখন প্রায়শয় খেয়াল করত সাহিল আগের মতো তার যত্ন নিচ্ছে না। তাকে বুঝছে না। তার চাওয়া পাওয়া গুলোর মূল্য দিচ্ছে না। সে সময়টাতে অফিসের কাজের বাহানা করে বাইরে কাটাতেই পছন্দ করত। একদিন,দুইদিন,তিনদিন আস্তে আস্তে মাসের পর মাস পল্লবীর উপর এ অবহেলার যন্ত্রণা চলতে থাকে। এর মধ্যে আনায়নার জন্ম হয়। আনায়নাকে নিয়ে সাহিলে আর পল্লবীর সম্পর্কটা আবারও ভালো হতে শুরু করে। পল্লবী ভেবেছিল হয়তো সাহিল পরিবর্তন হয়েছে এখন তার সমস্যা দূর হয়ে গেছে। হয়তো প্র্যাগনেন্সির সময় পল্লবী একটু বেশি পাগলামি করেছে তাই সাহিল বিরক্ত হয়ে এমন করেছে। তবে এ ভুলটা ভেঙ্গে যায় কিছুদিন পর। আনায়নার বয়স তিনমাস হতেই পল্লবী জানতে পারে সাহিল কারও সাথে কথা বলছে। একটা সময় সবকিছু সামনে চলে আসে, তবে ততক্ষণে তা অনেক দেরি হয়ে যায়।
পল্লবীর চোখ ছলছল করছে। বুকের ভেতরটা মোচর দিচ্ছে ঠিক সেদিনের মতো যেদিন সাহিল বলেছিল সে রুশিকে ভালোবাসে পল্লবীকে না। সে রুশিকে বিয়ে করতে চায়। পুরনো অতীত যেন আজকে আবার সামনে চলে আসলো।চাইলেও যেন এড়িয়ে যাওয়া যায় না। মনের গহীনে থাকা হাজারও প্রশ্নের উত্তর পল্লবী মেলাতে পারছে না। বারবার নিজেকে প্রশ্ন করছে আমার দোষটা কী ছিল? উত্তরটা যেন প্রতিবারেই অসম্পূর্ণ। চুপ করে শুয়ে মাথার উপর দেয়ালের দিকে তাকিয়ে চোখের জল ফেলছে।
চোখের জল ফেলতে ফেলতে চোখটা এক সময় বুজে এলো তার। ঘুম ভাঙ্গলো ফজরের আযানের ধ্বনিতে। ঘুম থেকে উঠে অযু করে নামাজে দাঁড়াল। নামাজ শেষে হালকা নিঃশ্বাস নিয়ে বসে রইল। সকাল আট টা বাজতেই হালকা নাস্তা খেয়ে বের হলো গার্মেন্টসের উদ্দেশ্য। কয়েকটা গার্মেন্টস ঘেটে একটা তে কাজ পেল। কাজ হলো কাপড়ে লেভেল লাগাতে হবে। পল্লবী খুশি মনে রাজি হয়ে গেল। মাস শেষে বিনিময়ে ১২ হাজার টাকা বেতন পাবে। এ টাকাগুলোই এখন তার কাছে অনেক কিছু। বাসায় আসতে আসতে বিকেল হয়ে গেল। বাসায় আসতেই আতিকের সম্মুখীন হলো। আতিক পল্লবীকে দেখে বলল
– কী রে কোথায় থেকে আসলি?
– চাকুরি খুঁজতে গেছিলাম।
– পেয়েছিস চাকুরি?
– হ্যাঁ।
– কিসের চাকুরি?
– গার্মেন্টসে।
– মানে?
– হ্যাঁ। গার্মেন্টেসে ড্রেসে লেভেল লাগানোর চাকুরি।
– মাথা কী তোর ঠিক আছে? তুই গার্মেন্টসে চাকুরি করবি? নিরা তোকে কী বলেছে শোনিস নি?
– হ্যাঁ শোনেছি। তবে আমি চাচ্ছি না কারও উপর নির্ভর হতে।
– তাই বলে গার্মেন্টসে? তোর কী মাথা গেছে পল্লবী। মানুষ কী বলবে?
– মানুষের কথা তো কানে নেওয়ার সময় নেই ভাই। সাহিল যখন আমাকে ডিভোর্স দিয়েছিল তখন মানুষ কোথায় ছিল? আনায়নাকে যখন কেড়ে নিয়েছে তখন মানুষ কোথায় ছিল? চাকুরির জন্য যখন হন্নে হয়ে ঘুরেছি তখন মানুষ কোথায় ছিল? মানুষের কাজেই কথা বলা। সেসবে আমি পাত্তা দেবো না। আর গার্মেন্টসে যারা চাকুরি করে তারা কী মানুষ না নাকি?
– সে যাইহোক। তোকে মাসে কত দিবে তারা?
– ১২ হাজার।
– তোকে মাসে ১২ হাজার আমি দেবো তবুও চাকুরির দরকার নেই।
– নাহ ভাইয়া নিজের পায়ে দাঁড়ানোটা জরুরি। আমকে আমার কাজে বাঁধা দিও না।
– তোর যা ভালো মনে হয় কর। তবে সাবধান পেটের বাচ্চার যেন কোনো ক্ষতি না হয় । অনেকে চেয়েও বাচ্চা পায় না। তোকে আল্লাহ দিয়েছে সেটার অবহেলা তুই করিস না। নিরা তোর জন্য তোর পছন্দের খাবার রান্না করেছে। হাত মুখ ধুয়ে খেয়ে নে।
পল্লবী আতিকের দিকে তাকিয়ে হালকা একটা নিঃশ্বাস টেনে পরক্ষণেই তা ছেড়ে বলল
– আচ্ছা।
বলেই ভেতরে যেতে নিবে এমন সময় আতিক পুনরায় পেছন ডেকে বলল
– আনায়নাকে দিবে কবে তারা?
– কথা হচ্ছে। দেখা যাক কী হয়। এক মাসের মধ্যে দিবে বলছে।
– সাবধানে থাকিস।
– আচ্ছা।
বলেই পল্লবী শোবার ঘরে ঢুকে গেল। এর মধ্যেই নিরা খাবার এনে পাশে বসলো। পল্লবী নিরাকে দেখে বলল
– আপনার খাবার আনার কী দরকার ছিল?
– খেয়ে নাও। সারাদিন কিছুই খাওনি। এসময় না খেলে বাচ্চাটার কষ্ট হবে। তোমার জন্য সবকিছু রান্না করেছি খেয়ে নাও।
পল্লবী ছলছল চোখে নিরার দিকে তাকাল। নিরাও পারছিল না পল্লবীর ও চোখে তাকিয়ে থাকতে। পল্লবীর চোখ থেকে চোখ সরিয়ে অন্য রুমে চলে গেল নিরা। পল্লবী নিজেকে সামলে নিয়ে খাওয়া শুরু করল। খাওয়া শেষ করে একটু ঘুমিয়ে নিল।
পরদিন সকালে রওনা দিল কাজের উদ্দেশ্যে। সেখানে গিয়ে কাজ শুরু করল। পল্লবী আগে থেকেই সেলাই কাজ জানত যার জন্য কাজটা করতে তার অসুবিধা হয়নি। তবে অনেকক্ষণ যাবত কাজ করতে করতে সে ক্লান্ত প্রায়। কাজের এক পর্যায়ে আশে পাশের সবাইকে দেখতে লাগল সে, কত শত নারী এখানে কাজ করে। এগুলো দেখে মনে সাহস জুগিয়ে আবার কাজ করতে লাগল। কাজ শেষে বাসায় ফিরল সন্ধ্যা সাত টায়। দুপুরে সেখানে খেয়ে নিয়েছিল। কারণ নিরা খুব যত্ন করে পল্লবীর জন্য রান্না করে দিয়েছিল। বাসায় ফিরতেই নিরা পল্লবীর যত্ন নিতে লাগল। নিরার এ যত্নটা যেন পল্লবীর মনটা প্রশান্ত করলো। এর মধ্যেই পল্লবীর ফোনে সাহিল কল দিল। সাহিলের কল পেয়ে পল্লবী হ্যালো বলতেই সাহিল বলে উঠল
– আনায়নাকে কালকে এসে নিয়ে যাও।
কথাটা শোনে পল্লবীর মনটা প্রফুল্ল হয়ে গেল। কিন্তু মনে একটা খটকা লাগল এটা ভেবে যে হুট করে সাহিল আনায়নাকে দিতে চাচ্ছে কেন? তাই কিছুটা বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করল
– আনায়নাকে স্বইচ্ছায় দিতে চাচ্ছ যে?
– আনায়নাকে নিয়ে রুশির অনেক সমস্যা হচ্ছে। রুশি চাচ্ছে না আনায়না এখানে থাকুক।যেহেতু রুশিকে আমি বিয়ে করছি কিছদিন পর সেহেতু আমি চাচ্ছি না আনায়না এখানে থাকুক।
পল্লবী হালকা হেসে বলল
– বাহ! নিজের মেয়েকে ত্যাগ করতেও এখন বুক কাঁপছে না তোমার তাই না?
– পল্লবী মুখ সামলে কথা বলো।
– আমি কোনো লাগামহীন কথা বলছি না যে মুখ সামলাব। কালকে সকালে এসে আমি আনায়নাকে নিয়ে যাব।
বলেই পল্লবী কলটা কাটল। তারপর এডভোকেট জান্নাত জেসিকে কল দিয়ে সবটা বলল।জান্নাত জেসি সকল ঘটনা শোনে বলল
– কালকে আনায়নাকে আনতে আমিও যাব। আর তারা আনায়নাকে দিলে অবশ্যই একবারের জন্য দিবে। সে কাগজ করে রাখব। কয়েকদিন পর পর আনায়নাকে নিয়ে যাবে দিয়ে যাবে এ নাটক করার সুযোগ দিব না।
– আপনি যেভাবে বলবেন সেভাবেই করব সব।
বলেই কলটা কাটল। পরদিন আনায়না পল্লবীর বুকে ফিরবে এটা ভেবেই যেন পল্লবীর সারা রাত ঘুম হলো না। সকাল হতেই রওনা দিল আনায়নাকে আনার উদ্দেশ্যে। মাঝপথে জান্নাত জেসির সাথে দেখা করে জান্নাত জেসিকে সাথে নিল। দুজন মিলে গেল আনায়নাকে আনতে। পল্লবী আর জান্নাত জেসি সাহিলের বাড়িতে গিয়ে কলিং চাপল। কলিং চাপার মিনেট পাচেঁক পর দরজা খুলতেই পল্লবী চমকে গেল-