পরিণয় পর্ব-১১

0
1315

#পরিণয়
#লেখিকা- শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ১১

কলিং চাপার মিনেট পাচেঁক পর দরজা খুলতেই পল্লবী চমকে গেল আনায়নার অবস্থা দেখে। কারণ আনায়না নীচে বসে কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতেই হয়তো আনায়না হিসু করে দিয়েছে। আর সে হিসুতে সারা শরীর মেখে আছে। নাক দিয়ে সর্দি পড়ছে। কাঁদতে কাঁদতে সুরটাও যেন ভেঙ্গে গেছে। এভাবে আনায়না কাঁদছে সেদিকে যেন কারও হুশ নেই। পাশেই চেয়ারে রুশি বসে আনায়নাকে কতক্ষণ পর পর ধমক দিয়ে চুপ করানোর চেষ্টা করছে। আনায়না সে ধমক শোনে আরও জোরে চিল্লানি দিতে লাগল। আনায়নার এ অবস্থা দেখে পল্লবীর বুকটা মরুভূমির মতো খাঁ খাঁ করতে লাগল। দৌঁড়ে গেল আনায়নার কাছে। মেঝে থেকে আনায়নাকে কোলে নিয়ে রুশির দিকে তাকিয়ে বলল

– বাচ্চা মেয়ের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় সেটা কী জানেন না?

পল্লবীর কথা শোনে রুশি রেগে গিয়ে বলল

– আপনার মতো মেয়ের কাছে আমার কথা শিখতে হবে?

– আমার মতো মেয়ে হতেও তোমার সময় লাগবে অনেক। কারণ অন্যের সংসার ভাঙ্গে যে, একটা মেয়েকে যে বাবার কাছ থেকে কেড়ে নেয় তাকে অন্তত কথা শিখাতে গেলেও আমার রুচিতে বাঁধবে।

– পল্লবী…

– চিৎকার করলেই সত্যিটা মিথ্যা হয়ে যাবে না।

পল্লবীর কথা শোনে রুশি একদম চুপ হয়ে গেল।পল্লবী আনায়নাকে বুকে নিয়ে আদর করতে লাগল। মিনেট পাঁচেকের মধ্যে আনায়নার কান্না থেমে গেল। আনায়না পল্লবীর বুকে মাথাটা মিশিয়ে রাখল। মায়ের শরীরে একটা আলাদা গন্ধ থাকে যেটা শুধু সন্তান চিনতে পারে। তাই আনায়নাও মায়ের স্নিগ্ধ স্পর্শে একদম শান্ত হয়ে মিশে গেছে। এমন সময় সাহিল শোবার ঘর থেকে বের হয়ে দেখল আনায়নাকে কোলে নিয়ে পল্লবী দাঁড়িয়ে আছে। পল্লবীকে উদ্দেশ্য করে সাহিল বলল

– এবার আনায়নাকে নিয়ে যাও।

পল্লবী হালকা হেসে বলল

– সেটা তো নিবই। তবে কিছু ফরমালিটিস বাকি। সেগুলো আগে পূরণ করো।

– কিসের ফরমালিটিস?

– একটা চুক্তি পত্রে তোমাকে স্বাক্ষর করতে হবে।

– কিসের চুক্তিপত্র?

– চুক্তি পত্রটা হলো তুমি কোনোদিন মেয়ের দাবি নিয়ে আমার কাছে আসতে পারবে না। মেয়ের সব দায়িত্ব আজ থেকে আমার। মেয়েকে দেখতেও যেতে পারবে না।

– এমন চুক্তি পত্রে আমি স্বাক্ষর করব না।

– স্বাক্ষর না করা পর্যন্ত আমি মেয়ে নিয়ে এখান থেকে যাব না।

পল্লবীর কথা শোনে সাহিলের বাবা মা বলে উঠল

– দেখো মেয়ে এটা কিন্তু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে।

পল্লবী উচ্চ স্বরে জবাব দিল

– কোনটা বাড়াবাড়ি আর কোনটা সঠিক সেটুকু বুঝার ক্ষমতা আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন।

এবার পাশ থেকে রুশি সাহিলকে উদ্দেশ্য করে বলল

– সাহিল চুক্তি পত্রে স্বাক্ষর চাচ্ছে দিয়ে যাও। আর এমনিতেও আনায়নাকে আমার সহ্য হয় না। আমিও চায় না আনায়না আমাদের বিয়েতে বাঁধা হয়ে দাঁড়াক।আর এটাও চায় না আমাদের বিয়ের পর পল্লবী বা আনায়নার সাথে কোনো যোগাযোগ তোমার থাকুক। সুতরাং যা চাচ্ছে তা দিয়ে আপদ বিদায় করো।

সাহিল রুশির কথা শোনে একদম চুপ হয়ে গেল।কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল

– কাগজ কোথায়? দাও স্বাক্ষর করে দিচ্ছি।

পাশ থেকে এডভোকেট জান্নাত জেসি চুক্তিপত্র এগিয়ে দিয়ে বলল

– এই যে নিন।

সাহিল এডভোকেট জান্নাত জেসির কাছ থেকে চুক্তি পত্রটা নিয়ে স্বাক্ষর করে দিল।

স্বাক্ষর শেষে জান্নাত জেসি কাগজটা নিয়ে আর পল্লবীকে নিয়ে বের হয়ে গেল। বাসা থেকে বের হয়ে পল্লবী জান্নাত জেসিকে বলল

– আপনার এ উপকার কখনও ভুলব না। সবসময় মনে থাকবে।

জান্নাত জেসি হালকা হেসে বলল

– আল্লাহ আপনার সহায় হোক। দোআ করি জীবনে অনেক বড় হন। আপনার সন্তান আপনার মুখ উজ্জ্বল করুক।

বলেই দুজন দুজনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজেদের গন্তব্যের দিকে রওনা হলো।পল্লবীর আজকে বেশ শান্তি লাগছে। প্রতিটা মায়ের কাছে সবচেয়ে শান্তির জায়গা হলো নিজের সন্তান। আর সেটা বুকে পাওয়ার আনন্দের কাছে সব আনন্দ যেন ফিকে। উৎফুল্ল মনে পল্লবী আনায়নাকে নিয়ে বাসায় ফিরল। নিরাও আনায়নাকে দেখে খুশি হলো। পল্লবীর আজকে স্বস্তি লাগছে। সব হারিয়ে যেন আজ সব ফিরে পেয়েছে এটা মনে হচ্ছে। ঘুরে দাঁড়ানোর নতুন স্বপ্নের বীজ বুনছে পল্লবী। কাজে মন দিতে হবে, আনায়নার ভবিষ্যৎ সুন্দরের জন্য নিজেকে পরিপাটি হতে হবে। আনায়নাকে মানুষ করতে হবে। পেটের সন্তানেরও যত্ন নিতে হবে। পল্লবীর ঘাড়ে এখন অনেক দায়িত্ব সব পালন করতে হবে। নাহয় এ জীবন যুদ্ধে জয় হওয়া যাবে না। আর সবচেয়ে বেশি যেটা রপ্ত করতে হবে সেটা হলো ধৈর্য ধারণ করা। সবসময় মনে রাখতে হবে সুখ আর দুঃখ পরস্পর পরিপূরক। কেউ দুঃখে আছে তার মানে তার জীবনে সুখ আসতে চলেছে। কষ্টের আগুনে পুড়ে নিজের সমস্ত শেষ না করে একটু এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করায় শ্রেয়। মাঝে মাঝে খুব কষ্ট হয়। সে কষ্ট বিলাস করার জন্য নাহয় শেষ রাতটায় বরাদ্ধ করা হোক। আর বাকিটা সময় সামনে এগিয়ে যাওয়ার চিন্তা করা হোক। তাহলেই হয়তো কাঙ্ক্ষিত সুখ হাত ছানি দিয়ে ডাকবে অন্যথায় এ স্বার্থপর দুনিয়ায় মুখ থুবরে পড়ে মরতে হবে। জীবনের অনাকাঙ্ক্ষিত বস্তু গুলোতে আমরা অতিকাঙ্ক্ষিত করে চেয়ে ফেলি যার জন্য সে চাওয়াটা পূর্ণ না হলে আমরা কষ্ট টা বেশি পায়। আমরা মনে করি সেই অনাকাঙ্ক্ষিত জিনিসটা আমাদের খুব কাছে একদম হাতের কাছে। তবে প্রকৃত দূরত্ব সন্ধান করতে গেলে দেখা যাবে সেটা অনেক দূরে একদম নাগালের বাইরে। তাই অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয়টা অতিকাঙ্ক্ষিত করে চাওয়া বর্জন করতে হবে। জীবন মানেই লড়াই জীবন মানেই বন্ধুর পথটা মসৃণ করে নেওয়ার যুদ্ধ। জীবনের মানে এই না আমাকে সুখ পেতেই হবে। জীবনের মানেটা অনেক সময় এমন হতে হবে আমাকে যুদ্ধ করে বাঁচতে হবে। কাঙ্ক্ষিত সুখটা ছিনিয়ে নিতে শিখতে হবে।

পল্লবী এসব ভেবেই আনায়নাকে বুকে জড়িয়ে চুমু খেতে লাগল। আনায়নাকে গরম পানি করে গোসল করিয়ে সুন্দর জামা কাপড় পড়িয়ে দিল। হালকা খাইয়ে আনায়নাকে ঘুম পাড়িয়ে দিল। তারপর হাতের সব কাজ সেরে নিল। পরদিন আবার কাজে যেতে হবে সে প্রস্তুতি নিতে লাগল। রাতে আনায়নাকে বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে গেল। সকালে উঠেই আনায়নাকে প্রথমে গুছিয়ে নিল। তারপর খাওয়া দাওয়া করে আনায়নার কপালে চুমু একে কাজে যাওয়ার জন্য রওনা দিল। প্রথম প্রথম কাজটা কঠিন মনে হলেও এখন পল্লবীর কাছে কাজটা অতি সহজ মনে হয়। কোনো কিছুর চর্চা মানুষকে সে বিষয়ের প্রতি দক্ষ করে তোলে। কোনো কাজেই প্রথমে সহজ মনে হবে না। তবে নিরলস পরিশ্রম আর প্রতিদিনের চর্চা সে কাজটা সহজ করে দেয়। তাই যেকোনো কাজকে ভয় না পেয়ে সে কাজটা রপ্ত করার চেষ্টা করায় শ্রেয়। কোনো কাজেই ছোট নয়। সমাজে উঁচু শ্রেণীর মানুষ গার্মেন্টস শ্রমিক, রিকশা ওয়ালা, কৃষক, দিনে আনে দিনে খায় মানুষগুলোকে খুব নীচু চোখে দেখে। কিন্তু কেউ এটা বুঝে না এটা প্রকৃতির নিয়ম। সমাজে উঁচু নীচু মানুষ একে অপরের পরিপূরক। সবাই সবার দ্বারা উপকৃত হচ্ছে। কেউ কাউকে ছাড়া সমাজে টিকে থাকতে পারবে না। তাই এসব শ্রেণীর মানুষ গুলোকে আমাদের উচিত প্রাপ্য সম্মান দেওয়া। কারণ আমরা সবাই সবার কাছে নির্ভরশীল।

যাইহোক এভাবেই চলতে লাগল পল্লবীর দৈনন্দিন জীবন। মাস দুয়েক কেটে গেল। পল্লবীর পেটের বাচ্চাটারও চারমাস পড়ল। বেশ ভালোই কাটছে পল্লবীর সাদামাটা জীবন। আনায়না, চাকুরি, পেটের সন্তান সব মিলিয়ে সে ভালোই আছে। এর মধ্যেই পল্লবী তার মোবাইলটা হাতে নিয়ে ফেসবুক আইডিটা একটিভ করল। মাস দুয়েক তার আইডিটা ডিএকটিভ ছিল। একটিভ করতেই পল্লবীর চোখ দুটো ছলছল করতে লাগল। তার আর সাহিলের হাস্যজ্জ্বল ছবি দেখে। সামাজিক মাধ্যম গুলোতে আমরা সবসময় নিজের খুশি গুলো শেয়ার করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। বাসে ট্রামে প্রতিদিন চড়ে গেলেও সেটা কখনও আমরা পোস্ট দিয়ে বলি না যে আজকে বাসে উঠে কষ্ট করে কোথাও গিয়েছি। অথচ একদিন প্লেনে চড়ার সৌভাগ্য হলে সেটা তাড়হুড়ো করে পোস্ট দিয়ে সবাইকে জানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। দাম্পত্য জীবনের ক্ষত্রেও এর প্রভাব বেশ লক্ষ্যণীয়। দাম্পত্য জীবনের কলহ এখানে কেউ তুলে ধরে না সবাই তুলে ধরে হাস্যউজ্জ্বল দাম্পত্য জীবন। সত্যি বলতে ফেসবুকের কেউ পরিপূর্ণ কেউ না। এখানে হাস্যজ্জ্বল চেহারার বাইরেও একটা অন্ধকারময় জীবন লুকিয়ে থাকে।

ছবিটা দেখে পল্লবীর কষ্টটা যেন আরও বেড়ে গেল। তাড়াহুড়ো করে আইডিতে থাকা সকল স্মৃতি ডিলেট করতে ব্যস্ত হয়ে গেল। এর মধ্যে পল্লবীর সামনে পড়ল রুশি আর সাহিলের বিয়ের ছবি। আইডি টা ডিএকটিভ থাকায় কেউ কাউকে ব্লক করতে পারেনি। পল্লবী সাহিল আর রুশির ছবি দেখে অজোরে জল ফেলতে থাকল। কষ্টে যেন বুকটা ফেটে যাচ্ছে তবুও মনকে শক্ত করে কমেন্ট বক্সে গিয়ে লিখে আসলো কংগ্রাচুলেশনস। দম্পত্য জীবন সুখের হোক। কথাটা লিখেই সাহিলকে ব্লক লিস্টে ছুরে মারল। তারপর আইডিটা পুনরায় ডিএকটিভ করে দিল৷ কারণ পুরনো স্মৃতি যত সামনে আসবে কষ্টের মাত্রা তত গাঢ় হতে থাকবে।

আইডিটা ডিএকটিভ করে কিছুক্ষণ চুপ করে শুইয়ে কাঁদল। তারপর আস্তে করে চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে গেল। পরদিন আবার রোজকার মতো কাজে যাওয়ার জন্য তৈরী হয়ে গেল। তৈরী হওয়ার শেষে আনায়নার কপালে চুমু দিয়ে আনায়নাকে নিরা আর নুর জাহান বেগমের কাছে রেখে কাজে চলে গেল। সেখানে যেতেই পল্লবীর চোখ পড়ল একটা নোটিশের দিকে। নোটিশটা ভালো করে লক্ষ্য করল পল্লবী। বেশ চিন্তায় পড়ে গেল নোটিশটা দেখে। কী করবে বুঝতে পারছিল না। কারণ-