#প্রেম_থেকে_অপ্রেম
#পর্ব১৭
#রাউফুন
মালা অনেকক্ষন থেকেই নিজেকে কন্ট্রোল করছে। কিন্তু তার আর সহ্য হচ্ছে না। সে সহজে রাগ করে না কিন্তু যখন রাগ করে তখন মাথা ঠান্ডা করতে অনেক সময় লাগে। ঘুমন্ত সিংহ কে জাগিয়ে দেওয়া আর তার রাগ তুলে দেওয়া একই ব্যাপার।
তার রাগের উৎস টা হচ্ছে প্রিহানের বান্ধবী জাকিয়া। জাকিয়া মেয়েটা এসে থেকেই প্রিহানের সঙ্গে চিপকে চিপকে আছে। বর তার, মানুষ টার সঙ্গে থাকবে সে তা না ওই মেয়েটা মিনি বিল্লির মতো হাত ধরে সঙ্গে সঙ্গে ঘুরছে। আর প্রিহান ও কিছু বলছে না কেন? এতো মানুষ জন আছে বিধায় মালা কিছু করতে পারছে না। “কেন রে ভাই তুই ওদিকে যা না৷ আমার স্বামীর সঙ্গে কেন থাকবি? সে কি তোর বর নাকি? বরটা তো আমার। সর সর দূরে সর।” এখান থেকেই সে হাত নাড়ছে আর বিড়বিড় করছে। কিন্তু আফসোস শা’ক’চু’ন্নীর মতো হাত লম্বা করে হাত দিয়ে ঠেলে ফেলে দিতে পারলো না। সে শুধু হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে রাগ নিয়ন্ত্রণে আনার প্রচেষ্টায়। রাগে তার চোখ দিয়ে পানি পরছে। এই প্রথম বার তার এমন বিনা লং’কা’য়, বিনা আ’গু’নে, পা থেকে মাথা অব্দি জ্বা’লা করছে।
‘এই আপু তোমাকে কখন থেকে খুঁজছি। এখানে তুমি একা একা দাঁড়িয়ে আছো কেন?’
পুতুলের আগমনে মালার ধ্যান ভাঙে। সে একবার পুতুলের দিকে তাকিয়ে নিজের চোখ মুছে নেই।
‘আরে আপু তুমি কাঁদো কেন?’
‘শা’ক’চু’ন্নী ধরেছে তাই কাঁদি।’
‘এহ কি বলো আপু?’ ভয়ে ভয়ে বললো পুতুল।
‘হ্যাঁ সত্যি বলছি!’
‘তাহলে এখন উপায়?’
‘উপায় কিছু না। তুই কি আমাকে একটা ঝাড়ু এনে দিতে পারবি?’
‘আপু আমি ঝাড়ু কোথায় পাবো?’
‘ওই যে রান্না ঘরে দেখছিস ওখানে ময়না আপু আছে ওঁর কাছে গিয়ে চেয়ে নিয়ে আয়।’
‘আচ্ছা আপু।’
পুতুল সরে এলো ভীতু হয়ে। নিজের বোনের আগাগোড়া পরখ করে নিলো সে। তার কাছেও তার বোনকে অদ্ভুত ঠেকলো। কারণ তার বোন কখনোই তাকে তুমি ছাড়া তুই বলে না। আজকে, এখনই বা কেন বললো? বাসায় এতো মেহমান এসেছে যদি মেহমানের বেশ ধরে শা’ক’চু’ন্নী এসে থাকে আর তার আপুকে অ্যা’টা’ক করে থাকে তাহলে তো স’র্ব’না’শ! তার উপর তার আপু তো সুন্দরী মানুষ হতেই পারে শা’ক’চু’ন্নী তার বোনের উপর ঈ’র্ষা’ন্বি’ত। সে ময়নার কাছে গিয়ে ঝাড়ু চেয়ে নিয়ে এলো। ময়না অদ্ভুত ভাবে পুতুলের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে ছিলো এরপর ঝাড়ু দিলো। মেহমান মানুষ মানাও করতে পারেনি সে।
‘আপু ঝাড়ু।’
‘ওকে যাহ!’ ঝাড়ু নিতে নিতে বললো মালা।
পুতুল ভয়ে দৌড়ে ময়নার কাছে গেলো। আর বললো,
‘ও ময়না আপু শুনেন!’
‘কি হয়েছে ভাবির বোন?’
‘উফফ এভাবে বলত হবে না।’
‘কিভাবে বলবো তাহলে? আমি তো তোমার নাম জানি না।’
‘আমার নাম পুতুল। পুতুল বলেই ডাকবেন।’
‘আচ্ছা! কিছু বলবে? আর কিছু কি চাই?’
‘না না কিছু চাই না আর। আমার মনে হচ্ছে আপুর উপরে শা’ক’চু’ন্নী ভর করেছে।’
‘এহ কি বলো?’
‘হ্যাঁ ঠিকই বলছি। আপু স্বাভাবিক নেই। এই যে ঝাড়ুটা তো আপুই চাইলো। এতো এতো মেহমান এসেছে তার মধ্যে আপুর এই অস্বাভাবিক আচরণ কি মানা যায়?’
‘কিন্তু আমি তো জানি শা’ক’চুন্নীরা ঝাড় দেখে ভয় পাই।’
‘আরে বুঝতে পারছো না ওই শা’ক’চু’ন্নী ব্রিলিয়ান্ট অনেক। আগে থেকেই কায়দা করে ঝাড়ুটা নিজের কাছে রেখে দিলো যাতে অন্য কেউ তাকে আর ভয় দেখাতে না পারে।’
‘তাহলে তুমি ঝাড়ু টা নিয়ে গিয়ে দিলে কেন?’
‘না দিলে যদি আমার ঘা’ড় ম’ট’কে দিতো!’
‘হ্যাঁ তোমার কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু তুমি বুঝলে কি করে।’
‘আরে আপুই তো বললো তাকে শা’ক’চু’ন্নী ধরেছে তাই সে কাঁদছে।’ পুতুল সব কিছু বললো শুরু থেকেই।
‘আচ্ছা চলো দেখি ভাবি কি করে।’
‘চলো আড়াল থেকে দেখি।’
মালা ফোসফাস করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। এই বুঝি দৌঁড় দিয়ে দিবে। ‘এক ‘দুই ‘তিন!’ গুনলো পুতুল।
সত্যি সত্যিই মালা দৌড়ালো। এবং তে’ড়ে গেলো প্রিহান আর জাকিয়ার দিকে। সবাই হা করে নতুন বউয়ের কাণ্ড দেখছে। মালা গিয়েই প্রিহানের হাত ধরে থাকা জাকিয়াকে পেছনে মা’র’তে থাকলো। আকস্মিক আক্রমনে জাকিয়া তো ”ওমা গো, ওমা গো!” বলে চেচাচ্ছে আর দৌড়াচ্ছে। যতক্ষণ পর্যন্ত পারছে মালা ওঁকে ঝাড়ু মে’রেই যাচ্ছে। জাকিয়া যেখানে যাচ্ছে মালাও সেখানে যাচ্ছে। সারা বাড়ির সবাই ওঁদের কান্ডে স্তম্ভিত হয়ে গেছে।
‘এই শা’ক’চু’ন্নী আমার জামাইয়ের ঘা’ড়ে চাপতে চাইছিস? তাকে কে’ড়ে নিতে চাইছিস? আমার জামাইয়ের হাত ধরা বের করে দিবো। দাঁড়া বলছি!’
এর মধ্যে সুজানাও এসে পরেছে মালার সামনে৷ হুট করেই সুজানা মালাকে ঝা’ড়ু হাতে ছুঁটতে দেখে ভেবে নিলো ওঁকে মা’র’তে চাইছে। জামাই কে’ড়ে নেওয়ার কথাটা শুনেছে ওঁ। সে তো মালার জামাইকে কে’ড়ে নিয়েছে এক প্রকার। তাই সে ভেবেই নিলো তাকেই বলেছে। সে দৌঁড়াতে লাগলো ভয়ে। মালা রা’গ, হিং’সা’র প্রলুব্ধ হয়ে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে দুজনকে ঝা’ড়ু পে—টা করছে! শেষ মেষ হাঁপিয়ে গিয়ে জাকিয়া, সুজানা দুজনেই প্রিহানের পেছনে গিয়ে আশ্রয় নিলো!
‘আরো ঘুরবি আমার জামাইয়ের সাথে? হাত ধরে ঘুরিস? চিপকে চিপকে থাকিস? সুন্দর পুরুষ দেখলে মাথা ঠিক থাকে না, তাই না?’
‘স্টপ ইট মালা। বাড়ি ভর্তি গেস্ট এসব কি করছো তুমি?’ বললো প্রিহান!
‘আপনি সরে দাঁড়ান প্রিহান। আজকে ওই ডাকিনির একদিন কি আমার যতদিন লাগে। এই ডাইনি, শা’ক’চুন্নী বের হো৷ আজকে দেখাবো মালার জামাইয়ের দিকে নজর দেওয়ার ফল কি হয়।’
‘প্রিহান বাঁ’চা আমাকে তোর মাথা খারাপ বউয়ের থেকে।’
‘এই ডা’কি’নি তুই আমাকে মাথা খারাপ বললি! আবার আমার জামাইয়ের পেছনে লুকিয়েছিস! সাহস তো কম না।’ পেছনে হাত দিয়েই একটা বা’রি দিলো মালা।
মালার মাথা ঠিক নেই এখন প্রিহান বুঝতে পারলো। হঠাৎ এমন শান্তশিষ্ট মেয়ে এমন উম্মাদ হলো কি করে?
‘এই ডেঞ্জারাস মেয়েটা তো মনে হচ্ছে আমাকে ঝাড়ু মে’রেই বের করে দিবে। বাঁচা প্রিহান!’
‘এই তোর হাত দে। ওই হাত দিয়ে ধরেছিলিস না আমার জামাইকে? ওই হাত আমি ভে’ঙে দিবো আজ।’
‘না দিবো না হাত।’
‘হাত দে বলছি। ওই হাত আমি আজ ভা’ঙ’বই।’
‘ না না। প্রিহান বাঁচা।’
প্রিহান মালার হাত থেকে ঝা’ড়ু টা নিয়ে এক সাইডে ছুড়ে ফেলে মালাকে টানতে টানতে ভেতরে নিয়ে গেলো।
ততক্ষণে সুজানার মাথাটা খুলেছে। মানেটা কি এই মেয়েটা মানে মালা প্রিহানের বউ? এখানে না আসলে তো সে জানতেই পারতো না। এতক্ষণ কি সে তবে এমনিতেই দৌঁড়ালো? মালা জাকিয়াকে তাড়া করছিলো। সে স্বাভাবিক হয়ে অন্য জায়গায় চলে গেলো। কিভাবে কি হলো প্রিহানের বাবার থেকে সব ঘটনা শুনবে বলে সে চলে গেলো তার কাছে।
‘আংকেল এসব কি হচ্ছে?’
জনাব ফারুক সাহেব হা করে দাঁড়িয়ে ছিলেন নতুন বউয়ের এরুপ দেখে। চমকে উঠে তিনি সরে দাঁড়ালেন।
‘আরে আংকেল আমি সুজানা। ভয় পাবেন না।’
‘ওহ তুমি?’
‘হ্যাঁ। আপনি বলেছিলেন প্রিহান বিয়ে করেছে৷ আমার আসতে একটু লেট হয়েছে আর এসেই দেখি এসব লং’কা কাণ্ড। এসব কি হচ্ছে? ওই মালা প্রিহানের বউ?’
‘হ্যাঁ ওঁকেই তো বিয়ে করেছে প্রিহান। এতো ভালো মেয়ে হঠাৎ এমন করলো কেন সেটাই তো বুঝতে পারছি না। ভাগ্যিস বাবা- মা আর ঔশী নেই এখানে। ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম একটু আগে। থাকলে যে কি হতো।’
তাদের কথা বলার মধ্যেই ময়না আর পুতুল এলো।ময়না সাহস করে বললো,
‘খালুজান নতুন ভাবির উপর শা’ক’চুন্নী না হলে জ্বী’নে ভর করছে। অনেক্ষন থেকেই নাকি অস্বাভাবিক আচরণ করছিলো। আমরা তো আরও আগে দেখেছিলাম।’
‘হ্যাঁহ কি বলছিস তুই ময়না? এই দিন দুপুরে জ্বী’ন কোথা থেকে এলো।’
‘তা আর বলছি কি খালুজান। এই ভাবির বোন পুতুল সব বললো আর আমিও দেখেছি ফোসফাস করছিলো কেমন!’
‘তোমাদের বাড়ি থাকতে কখনো এমন করেছে বৌমা?’
‘না তো আংকেল। আজই প্রথম তাই তো এতোটা ভ’য়ং’ক’র!’ জানালো পুতুল।
‘এই মেয়ে এই আমাদের কি বোকা পেয়েছো? এখন গল্প সাজিয়ে নিজের বোনের দোষ ঢাকতে চাইছো তাই না? বহুত ধুড়ন্ধর তো তোমরা।’ ফোস ফোস করে বললো সুজানা।
‘আহ সুজানা চুপ করো তো। সব টা শুনতে হবে ভালো করে।’
‘সত্যিই যদি জ্বীন-ভূত ধরে থাকে তবে তো তাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। না হলে ভালো বৌমা আমার এমন করবে কেন?’
মালার শাশুড়ী মাঝখানে ঢুকে পরলো। তিনি ইশারায় বুঝালেন।
‘হ্যাঁ হ্যাঁ জলদি বুজুর্গ হুজুর ডাকেন।বউকে জ্বী’ন ধরেছে।
‘হ্যাঁ এখন মানুষ শাক’চুন্নীরই অভাব ছিলো এখানে।’
ফারুক সাহেবের কথা শুনে মিসেস খোদেজা কটমট করে তাকালেন স্বামীর দিকে। গটগট করে হেঁটে চলে গেলেন তিনি। বউ রাগ করেছে বুঝতে পেরে ফারুক সাহেব ছুটলেন বউয়ের পিছু পিছু।বউয়ের রাগ আবার তার ভালো লাগে না।
‘আরে শুনো তোমাকে শা’কচুন্নী বলিনি।যেটা বৌমার উপর ভর করেছে তাকে বলেছি।’
মিসেস খোদেজা আরও রেগে গেলেন।তার মানে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে এটাই বুঝানো হলো সে শা’ক’চু’ন্নী আর সেই বৌমার উপর ভর করেছে।পুতুল,ময়না, আর সুজানা হতবুদ্ধির মতো শুধুই তাকিয়ে রইলো। কি হলো কিছুই তাদের মাথায় ঢুকলো না।জাকিয়া ভয় পেয়ে তখনই চলে গেছে।আর এমুখো হবে না সে।
#চলবে