#প্রেম_থেকে_অপ্রেম
#পর্ব৩৭
#রাউফুন
ক্ষণে ক্ষনে তীক্ষ্ণ কষ্টের আকুতি ভরা গলার আওয়াজ পাচ্ছে প্রিহান। সে সইতে পারছে না এই আর্তনাদ। কিভাবে পারছে এরকম রিক্ততা দেখাতে? কিভাবে মেয়েগুলো এমন নিষ্ঠুর, কঠিন মনের হতে পারে? মেয়েরা না মায়ের জাত তবে? কিভাবে পারছে তারা এরকম করে নির্যাতন করতে? দু চোখ ফেটে অশ্রু বেরিয়ে আসছে প্রিহানের। বক্ষ মাঝে চিনচিন ব্যথা জ্বলে যাচ্ছে। গলা দিয়ে ঠিকরে কষ্ট গুলো বমি আসার মতো বের করে দিতে চাইছে সে কিন্তু পারছে না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কষ্টের পারদ তরতর করে বাড়ছে। কন্ঠ কুন্ঠিত হয়ে আসছে তার। মালা এসবে আছে সব কিছু মনে পরতেই কোণঠাসা হয়ে আসছে ভেতরটা।
‘মালা তুমি আমার সঙ্গে এরকম করতে পারো না। আমি তো তোমাকে মন প্রাণ উজাড় করে ভালোবাসি তবে তুমি কেন এমন নিঠুরতার পরিচয় দিচ্ছো?’ চেচিয়ে উঠলো প্রিহান।
কিন্তু তার কথা মালার কর্ণকুহরে পৌঁছালো কিনা সন্দেহ। কান্নায় ভেঙে পরলো প্রিহান৷ আবোল তাবোল বকতে লাগলো সে। প্রাণ উজাড় করা ভালোবাসা কি তবে এতোদিন অপাত্রে দান করে গেছে সে? মালাকে ভালোবাসায় কি তবে জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল? এতোটাই ভুল করলো সে? তার আইনী চোখ এভাবে ধোঁকা খেয়ে গেলো?
প্রিহান নিজের হাত পা ছুটানোর চেষ্টায় বিমুখী হয়ে আছে। কিন্তু সে যারপরনাই ব্যর্থ! হৃষ্টচিত্তে ভাবতে লাগলো মালা আর তার সুন্দর মুহুর্ত গুলো। তাদের অতিব ঘনিষ্ঠতা মূহুর্ত, তাদের ভালোবাসার মুহুর্ত, এক সাথে চলা, এক সাথে ঘুমানো, দিনের ব্যস্ততা শেষে রাতের আঁধারে নিশ্বব্দ আলাপন! সব গুলো স্মৃতি মন সাপটে ভেসে উঠছে। ভেতরটা কেমন চৌচির হয়ে যাচ্ছে। সে লোহার চেয়ার টা টেনে সরাতে গিয়ে দেখলো সেটা একদম ফ্লোরের সঙ্গে লাগানো, এটাচ্ করা। এমন ভাবে জায়গা টা বানানো হয়েছে যে এখান থেকে বেরোনো মুশকিল। কিভাবে বের হবে সে এই নরক থেকে? এখান থেকে তো নড়তেই পারছে না সে। তার গায়ের জোর নেই বললেই চলে। ছত্রিশ ঘন্টার বেশি হয়ে গেছে সে অনাহারে আছে। পেটের ক্ষুধায় আর শরীরে শক্তি না থাকায় সে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেলো সেভাবেই।
শেবা এসে প্রিহানের মুখে ঠান্ডা পানি ছুড়ে মারলো।
‘কি রে ভাইয়া উঠ? দেখ আমার সাম্রাজ্য। আমার সাম্রাজ্যের অধিপত্যি একমাত্র আমি।’
পরিচিত কন্ঠ শুনে প্রিহান পিটপিট করে তাকালো। এতো বছর পর এই কন্ঠের মালিককে সে চিনে। সে যখন চোখ তুলে কন্ঠের মালিকের দিকে দেখলো আকাশ সমান বিস্মিত হলো। কিয়ৎক্ষন স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে সে নিজের বোনের পানে। তার কন্ঠ যেনো কাঁপছে। দু-চোখের পানি ঝর ঝর করে পরছে। পুরুষ মানুষের নাকি কাঁদতে নেই কিন্তু পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে যে না চাইতেও দু চোখ ভরে পানি উপচে পরছে। মৃ’ত ঘোষণা করা বোনকে জীবিত দেখে এতোটাই অবাক হয়ে গেছে সে যে কথা বের হচ্ছে না গলা দিয়ে। সে কাঁপা কাঁপা স্বরে বললো, ‘তুই ব-বেঁচে আছিস বোন?’
‘ হ্যাঁ বেঁচে থাকবো না কেন? কি ভেবেছিলি ম’রে গেছি?’
‘ আমরা তো জানতাম তুই জেল থেকে পালানোর সময় পুলিশের তা’ড়া খেয়ে জ্বলন্ত আগুনে ঝা’প দিয়েছিলি! আমাদের তো এরকমই খবর দেওয়া হয়েছিলো তবে তুই এখানে কিভাবে? তোর থেতলে যাওয়া, আগুনে জ্ব’লে যাওয়া লা’শ আমাদের কাছে পাঠানো হয়েছিলো? তাহলে ওটা কার ডেথ বডি ছিলো?’
‘তোর কি মনে হয় আমাকে মা’রা এতো সহজ? ওটা একটা বেয়ারিশ লাশ পুঁ’ড়ি’য়ে তোদের কাছে পাঠানো হয়েছিলো।’
‘তুই যে অন্যায় করেছিলি সেটা কেন মানতে চাসনি বোন? কাউকে খু’ন করা আসামী ছিলিস তুই! তোকে শাস্তি দিতে আমার কলিজায় যে দাগ, যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছিলো, সেটা কি একবারও ভেবেছিলি?’
‘আচ্ছা তোকে একটা প্রশ্ন করি? ঠিক ঠাক উত্তর দিতে পারবি?’
‘কি প্রশ্ন?’ অবাক হয়ে জানতে চাইলো সে।
‘আচ্ছা তার আগে এটা বল তোর সামিয়াকে মনে আছে?’
‘ওঁর নাম টা তো শুনেছি তোর মুখেই। ওঁকে কখনো সামনাসামনি দেখি নি।’
‘তোর সামনে যদি তোর প্রাণের চেয়েও প্রিয় কাউকে কতকগুলো নোংরা লোক তোর বেস্ট ফ্রেন্ডকে নেকড়ের মতো ছিড়ে ফেলার মতো ধ’র্ষ’ণ করে ঠিক তোর কেমন অনুভুতি হবে?’
‘মানে?’
‘মানে টা খুব সহজ। তোর চোখের সামনে যদি আমাকে কেউ ধ’র্ষ’ণ করতো, আচ্ছা এটাও ছাড়।তোর নিজের বোনকে যদি কোনো ছেলে জোর পূর্বক টাচ করে তখন কি করতি? তোর মনে ওই ব্যাক্তির জন্য কি রকম অনুভুতি কাজ করতো? সত্যি টা বলবি!’
‘আমার ইচ্ছে করতো তাকে সেখানেই খু’ন করে ফেলি। জ্যা’ন্ত পুঁতে ফেলতাম সেই নিকৃষ্ট মানুষকে।’
‘এক্সাক্টলি এটাই ঘটেছে আমার সঙ্গে। তুই জানিস? আমার কলিজার বেস্টফ্রেন্ড, সামিয়া শুধু আমার বন্ধু ছিলো না-রে আমার কলিজা ছিলো, আমার আরেকটা বোন ছিলো। আমরা দুই বান্ধবী জঙ্গলের রাস্তা ধরে কোচিং থেকে ফিরছিলাম। সন্ধ্যে হয়ে আসায় দ্রুত হাঁটছিলাম দুইজন। কিন্তু আমাদর পেছনে ছিলো কতগুলো বখাটে ছেলে। সেই সময় আমাদের আশার আলো হয়ে হাকিম আংকেল আসলো আমাদের সামনে গাড়ি নিয়ে। আমরা দুইজনই ভরসা পেয়ে আংকেলের গাড়িতে উঠে পরি। তখনও আমরা দুজনের কেউই বুঝতে পারিনি আমাদের সঙ্গে কি হতে যাচ্ছে। হঠাৎ আংকেল আমাদের অন্য রাস্তায় নিয়ে জোরে গাড়ি চালাতে শুরু করলো। আমরা জিজ্ঞেস করলে তখন তিনি কা’মু’ক দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকাই। আমাদের আর বুঝতে বাকি থাকে না আমরা এক বিপদ থেকে বাঁচতে অন্য বিপদে পরেছি। আমরা চেঁচিয়েও কোনো লাভ হয়নি। একটা ঘণ জঙ্গলে এনে আমাদের দুজন কে ছুড়ে ফেলে হাকিম আংকেল। আর কুটিল হেসে বলে,
‘তোমার এই বন্ধু সামিয়া ওঁকে পাওয়ার আকাঙ্খা আমার অনেক দিনের। তাই তো এতো সব ব্যবস্থা।’
কত আকুতি মিনতি করেছি আমাদের ছেড়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু শুনে নি আমাদের কথা। আমার সতেরো বছরের প্রাণের চেয়েও প্রিয় বোনকে ওই জানুয়ার গুলো ধর্ষণ করেছিলো আমার চোখের সামনে। একেকজন মানুষ নামক পশু হায়েনার মতো খুবলে খুবলে আমার প্রাণের বন্ধুকে ধ’র্ষ’ণ করেছিলো।’
‘এতো কিছু ঘটেছিল আমাদের কে বলিস নি কেন?’
‘কেননা আমি সেদিনই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম ওই জানুয়ার গুলোকে আমি নিজের হাতে শাস্তি দেবো।
সামিয়া যখন আমাকে পালাতে বলে ওই জানুয়ার গুলোর সামনে আমাকে রক্ষা করতে রুখে দাঁড়িয়ে ছিলো , তখন বুঝেছিলাম সামিয়া আমার জন্য কি। আমাকে কসম দিয়েছিলো রে। সামিয়া বলেছিলো ‘আমার কসম তুই এখান থেকে পালিয়ে যা।’ আমি ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে তো ঠিকই ছিলাম কিন্তু সামিয়াকে নিয়ে আসতে পারিনি। আমি শুধু নিরুপায় হয়ে তাকিয়েছিলাম৷ বুদ্ধি করে সেই নৃশংস খু’নের ভিডিও করি কম্পনরত হাতে। তবুও আমি ওঁদের সামনে যাওয়ার মতো সৎ সাহস পাইনি রে। ওরা সংখ্যায় ছিলো চোদ্দজন। ওঁদের সঙ্গে আমি পারতাম না। আমি চেয়েও বাঁচাতে পারিনি সামিয়াকে। পুলিশকে ফোন করেছিলাম আমি সেখানে আসার জন্য। সেদিন আমি একজনেরো সাহায্য পাইনি। কোথায় ছিলো সেদিন তোর আইনের লোক? কোথায় ছিলো তোর আইন। একেকজনের মুখ চিনে রেখেছিলাম আমি। সেই রাতেই ওঁদের দলের এক লোক যখন মদ্যক অবস্থায় ফিরছিলো আমি ঝোপের আড়াল ওই লোককে আক্রমণ করি। খু’ন করি ছু’ড়ি দিয়ে আ’ঘা’ত করে আর তখনই পুলিশ আমাকে ধরে ফেলেছিলো! হাহ্ কি ভাগ্য আমার। এরপরও তুই নিজের হাতে আমাকে শাস্তি দিলি। আমাকে অন্যত্র চালান করার জন্য নিয়ে যাচ্ছিলো তখনই আমি পুলিশকে হাত করি আমার যৌবনের লোভ দেখাই৷ সে আমার কথা মতো সব করে। আমি পালানোর সময় একটা এক বছরের বাচ্চার কান্না আমার কানে আসে। আমি যখন বাচ্চাটিকে দেখি তখনই ওঁকে চিনে ফেলি। কারণ আমি খুব ভালো করেই ওঁকে চিনতাম। আমি চলে আসছিলাম ঠিক তখনই আমার মাথায় বুদ্ধি খেলে যায় আর আমি সেই বাচ্চাকে আমার লোকেটটা পরিয়ে দিয়ে আমার হাত করা পুলিশের কাছে পাঠিয়ে দিয়ে বলতে বলি সে আমার অবৈধ সন্তান।’
অনেক দিন পর কথা গুলো মনে পরতেই কথার মাঝে জড়িয়ে আসছিলো। ঠিক কত বছর, কত বছর পর সে আবার কাঁদলো। প্রিহান নিজের বোনকে এভাবে উম্মাদের মতো কাঁদতে দেখে হতচকিত হয়ে গেলো। নিস্তব্ধ, নিশ্চলভাবে চোখে চেয়ে রইল শুধু।
‘তার মানে ওই ভিডিওটা তোর করা ছিলো?’
‘হ্যাঁ আমার করা ছিলো ওই ভিডিওটা।’
‘তাহলে তুই কেস রি’ ওপেন করেছিলি? কিন্তু এতো বছর পরে কেন?’
‘কেসটা রি- ওপেন করার জন্য আমি মালাকে ইউস করেছি। ভিডিওটাও মালাই তোকে দিয়েছিলো৷ আর এতো বছর পর কেন রি-ওপেন করলাম? কারণ আমি এতোদিন পর্যন্ত নিজের এই সাম্রাজ্য বানিয়েছি। যত ধর্ষক পুলিশের কাছে থেকে ছাড়া পেয়েছে তাদের প্রতিটি মানুষকে আমি এখানে, আমার সাম্রাজ্য এনে শা’স্তি দিয়েছি।’
‘এটা অন্যায় বোন। তুই ভুল করছিস!’
‘যেখানে শুধু আমাকে কেউ বাজে ভাবে টাচ করার কথা শুনেই তোর গায়ে আগুন লেগে যাওয়ার মতো জ্বালা করছিলো সেখানে আমি কি করে স্থির থাকতাম। সেদিনের সেই নির্মম ঘটনা আজ তোর বোনকে আজকের এই নিষ্ঠুর শেবাতে তৈরি করেছে। ওঁদের ক্ষমা নেই। ধ’র্ষকদের ক্ষমা নেই।’
কথা শেষ করেই শেবা সামনে স্টিলের থাকা স্টিলের কলসি সজোরে ছিটিয়ে ফেলে। আগুনের ফুলকির ন্যায় জ্বলে উঠে শেবা বেরিয়ে গেলো সেখান থেকে। হৃষ্টচিত্তে অপলক তাকিয়ে রইলো নিজের বোনের যাওয়ার পানে। তার মানে ঔশী শেবার সন্তান নয়? তবে ঔশী কে? শেবা কেন বললো না ঔশীর পরিচয়?
#চলবে
#প্রেম_থেকে_অপ্রেম
#পর্ব৩৮
#রাউফুন
রাত বারোটা বাজে। এখন সবাই বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। এই সময়টা কেউ-ই জেগে থাকে না গুপ্ত ঘরে। সেই সুযোগটাই মালা কাজে লাগালো। তবুও সে প্রতিটি রুম চেইক করে দেখলো কেউই জেগে নেই। পিনপতন নীরবতা সারা গুপ্তঘর জুরে। সে চাবি নিয়ে পুতুল আর প্রশান্তর ঘরে ঢুকলো। ধীর পায়ে গিয়ে প্রশান্ত আর পুতুলকে ডাকলো। তারা মালাকে দেখে কিছু বলতে গেলে ওঁদের মুখ চেপে ধরে মালা। বললো,
‘ চুপ করে থাকো এখন। কোনো শব্দ করো না।’
পুতুল আর প্রশান্ত কথা মতো শান্ত থাকলো। মালা ফ্লডিং লেডার টা নিঃশব্দে রাখলো। এবং একটা সুইচ চাপলো। তখনই উপর শাটারের মতো কিছু একটা সরে গেলো চট করে। তাদের এই গুপ্ত ঘরের যে ঠিক কত গুলো গুপ্ত রাস্তা রয়েছে সেটা এখানে যারা থাকে তাদের প্রত্যেকের জানা। সেগুলোরই কোনো একটা গুপ্ত পথ খোলা থাকাই সেই পথ দিয়েই প্রিহান এখানে গড়িয়ে পরেছিলো৷ সে তো ইচ্ছে করেই নিজের ফোন লোকেশন ট্র্যাকিং প্রিহানের ফোনের সঙ্গে সেট করে দিয়েছিলো৷
পুতুল আর প্রশান্ত তাকিয়ে দেখলো উপরে খোলা আকাশ। মেঘে ঢাকা চাঁদের ক্ষীন আলোয় অন্ধকার রুম অল্প বিস্তর আলোয় ছেঁয়ে গেলো রুমটা। অদুরে কতক গুলো তারা মিটিমিটি জ্বলছে। মালা সাবধানে মইটা ছড়িয়ে দিয়ে বললো,
‘জলদি উঠে যাও। আমি মইটা ধরছি।’
‘আমরা কেন উঠবো? আবার কোথায়, কোন বিপদের মুখে পাঠাতে চাইছো আপু?’
‘উফফ বেশি প্রশ্ন করো না পুতুল। শুনো, এখান থেকে বেরিয়ে সোজা পূর্ব দিকে ছুটবে। ঘন জঙ্গলের আর্কীণ পেরিয়ে একটা ছোট্ট নদী পাবে। সেটার সরু রাস্তা ধরে বড় রাস্তায় উঠলেই তোমরা নিরাপদ!যাও!’
ওরা ঝটপট উঠে পরলো। মালা ওঁদের হাতে একটা স্প্রে আর টর্চ ধরিয়ে দিয়ে ছুটতে বললো। রাতের অন্ধকারে টর্চ, আর যখন তখন কাজে দেবে স্প্রেটা। ওঁরা দু’জনেই দৌঁড়ে পালালো।
মালা জলদি গিয়ে প্রিহানের দরজা আন-লক করে হাতের বাঁধন খুলে দিতে চাইলো কিন্তু প্লাস পাচ্ছে না। বেশ কিছুক্ষন খুঁজার পর পেলো প্লাসটা। সে সমস্ত শক্তি দিয়ে কে’টে দিলো এলুমিনিয়াম এর কা’টা’তাড়।
‘কি করছো মালা?’
‘চুপ থাকুন। যত কথা কম বলবেন ততই মঙ্গল আপনার জন্য। কথা না চলুন আমার সঙ্গে। ‘
‘আমি যাবো না তোমার সঙ্গে। কোনো বেইমানকে আর বিশ্বাস করবো না আমি।’
‘আমি বেইমানি করিনি কারোর সঙ্গে। অন্তত পক্ষে আপনার সঙ্গে তো নয় ই।’
‘ওহ রিয়েলি আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেও বলছো করো নি বেইমানি। আমাকে কি নিদারুণ ভাবে উপেক্ষা করলে প্রথম দিকে, আমাকে বিয়ে করবে না, আমার থেকে কোনো রকম সাহায্য নেবে না, এমন ভান করলে যেনো তুমি পুরুষ মানুষকে সহ্যই করতে পারো না। এরপর একদিন বলা নেই কওয়া নেই হুট করেই বিয়ে করে নিলে। কেন আমাকে এভাবে আ’ঘা’ত দেবে বলে? আমার বোনের কথায় তুমি এসব কাজ করেছো তাই না? আমাকে ভালোবেসে নয়?’
‘এতো কথা বলার সময় এখন নয়। আমার সঙ্গে আসুন।’
‘আমি এখান থেকে এক পাও নড়বো না। যত্তক্ষন পর্যন্ত আমি সত্যিটা না জানবো।’
‘কি সত্যি জানতে চাইছেন আপনি? ‘
‘তোমার আমাকে হঠাৎ বিয়ে করার সিদ্ধান্ত টা কেন ছিলো? আমাদের বাড়িতে ঢুকতে কেন চাইছিলে? কার ক্ষতি করার জন্য? তোমার আর আমার মধ্যে কি কোনো দিন ও ভালোবাসা ছিলো না? যা ছিলো সবটাই অভিনয়? এই কাজের সঙ্গে তুমি কিভাবে যুক্ত হলে? এই সব প্রশ্নের উত্তর না পেলে আমি প্রিহান হাওলাদার এখান থেকে নড়ছি না। পারলে টলাও দেখি আমাকে। সব উত্তর চাই আমার এক্ষুনি, এই মুহুর্তে।’
‘লাস্ট প্রশ্নের উত্তর টা আগে দিচ্ছি। এই পার্লার টা দেখেছেন? সেটা ছিলো আমার স্বপ্ন। শাহনাজের সঙ্গে ডিভোর্সের পর আমি পার্লারের কাজ শিখি। এবং এই জায়গা টা ভাড়া নিই। কিন্তু আমি জানতাম না যার কাছ থেকে ভাড়া নিয়েছি তিনি আসলে শেবা আপুর সঙ্গে যুক্তিতে এরকম একটা স্থান বানিয়েছিলো। আমি নিজের পার্লারের কাজ ভালো চলবে সেই সুবিধার কথা ভেবেই রাস্তার সঙ্গে অল্প দামে ভাড়া পেয়ে খুশি হয়ে যায়। তখনও এই বিষয় টা জানতাম না যে নিচে কোনো গুপ্ত ঘর আছে। কিন্তু একদিন আমিও পুতুলের মতো ভুল করে এখানে চলে এসেছিলাম। শেবা আপু আমাকে খুব ভালো ভাবেই চিনতেন। কারণ তিনি শাহনাজকে চিনতেন। এক সময় শাহনাজের সঙ্গে শেবা আপুর সম্পর্ক ছিলো। শাহনাজ শেবা আপুকেও ঠকিয়েছিলো৷ সে তাকে বলেনি সে বিবাহিত। তার বউ গর্ভবতী এটা শেবা আপু যখন জানতে পারে না? খুব ভেঙে পরেছিলো সে-সময়। বাকিটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন? এরপর আমাকে এখান থেকে বের হতে দেইনি শেবা আপু নিজের স্বার্থে। আমি যখন এসব থেকে বেরোতে চাইলাম সে আমাকে আমার সন্তানের কথা বলে ব্ল্যাকমেইল করতে থাকে। আমাকে বলবে না আমার বাচ্চা কোথায়, আমার বাচ্চা কোথায় সে জানতো আর তার কথা মতো না চললে আমার বাচ্চার ক্ষতি করবে। তাই আমার বাধ্য হয়েই এসব কাজ করতে হয়। একজন মায়ের কাছে তার সন্তানের চেয়ে বড় আর কিছুই নেই প্রিহান। কিছুই নেই।
আর বাকি সব প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে। অনেক অনেক ভালোবাসি আপনাকে। ঔশীকে রক্ত দেওয়ার সময় যখন অনেকদিন পর আপনাকে দেখলাম না? আপনাকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। খুব কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়েছিলাম। আপনাকে যখন দেখেও না দেখার ভান করলাম , চিনেও না চেনার ভান করলাম, তখন আমার সেই অনুভূতির কথা বলে বুঝাতে পারবো না আপনাকে। জানিনা ভালোবাসার আলাদা আলাদা নিয়ম আছে কি না ? তবে আমি কোন নিয়মে আপনাকে ভালোবেসেছি, তাও জানি না। শুধু এইটুকু জানি, আমি আপনাকে প্রথম দেখাই ভালোবেসে ফেলেছিলাম। আরে আপনার নজরে তো আমি এক বছর থেকে পরেছি কিন্তু আমার নজরে, আমার ভালোবাসার নজরে তো আপনি সেই পাঁচ বছর আগে পরেছিলেন প্রিয়। আমার ভার্সিটির প্রথম দিন আপনাকে দেখেছিলাম আমাদের ভার্সিটিতে। কেন গেছিলেন আপনি সেখানে? সেদিনই তো আমার সর্বনাশ হয়েছিলো এর দায় কিন্তু আপনার। আমি বিবাহিত তো ছিলাম কিন্তু প্রথম প্রেম টা আপনাকে দেখেই পরেছিলাম। কারণ আমি ততদিনে শাহনাজের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে গেছিলাম। আমাকে এতো অত্যাচার করেও কিন্তু শাহনাজ আমার পড়াশোনা বন্ধ করাইনি। কারণ শাহনাজের পড়াশোনা জানা বউ লাগতো। সেদিন ভার্সিটি থেকে আপনার বেরোনোর সময় দেখেছিলাম কোনো একটা মেয়ে ছিলো আপনার সঙ্গে। নীল রঙের ড্রেস পরা ছিলো মেয়েটা।’
‘ তুমি যাকে সেদিন আমার সঙ্গে দেখেছিলে ওঁ আমার বোন শেবা ছিলো। এই এই ওয়েট ওয়েট তুমি আমাকে ঘোলাটে গল্প শোনাচ্ছো হ্যাঁ ? অনেক দিন থেকেই যদি তুমি আমায় ভালোবাসতে সেহেতু আমাকে রিজেক্ট কেন করেছিলে?’
‘আমার মন-মানসিকতা পরিবর্তন হয়ে গেছিলো। এখানে এতো এতো ধ’র্ষ’ক দেখেছি যে পুরুষদের প্রতি আমার ঘৃণা ধরে গেছিলো। সেই টানা পোড়নে আমি আপনাকেও সহ্য করতে পারিনি। তারপর আমি ছিলাম ডিভোর্সি। আমার মনে হয়েছিলো আপনি আমাকে টোপ দিচ্ছেন তাই রিজেক্ট করি। কিন্তু আপনাকে দেখতে দেখতে আমার পুরনো ভালোবাসা আবার জেগে উঠে। তাও আপনাকে আমি বিয়ে করতাম না যদি না আমাকে হুমকির মুখে পরতে না হতো।’
‘হুমকি? তোমাকে কে হুমকি দেওয়ার সাহস পেলো?’ তাচ্ছিল্যের সাথে বললো প্রিহান।
‘ জাকিয়া আপু।’
‘জাকিয়া তোমাকে হুমকি দিতো?’
‘হুম। জাকিয়া আপু ম্যাজিক ভয়েস অপশন অন করে ম্যাল ভার্সনে কথা বলে আমাকে হুমকি দিতো। জাকিয়া আপু আসলে তার বাবা হাকিমকে বাঁচানোর জন্যই এতো কিছু করেছে। জাকিয়া আপু আমাকে হুমকি দিলো যদি আপনার বাড়িতে আমি না যায় তবে ঔশীর ক্ষতি করে দেওয়া হবে। ঔশীর প্রতি আমার কেন জানি না প্রথম দিন থেকেই টান অনুভব করতাম। সেই ভালোবাসা থেকেই আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম। তাই আপনাকে বিয়ে করে ওই বাড়িতে উঠেছিলাম যাতে আপনাকে গোপনে সাহায্য করতে পারি। এরপর আস্তে আস্তে আপনার সব ইনফরমেশন হুমকি দিয়ে চাইতো জাকিয়া আপু। কিন্তু আমাকে দিয়ে জাকিয়া আপুর কাজ হয়নি তাই সে নিজেই বাড়িতে আসে এবং আমাকে হীরের ক্লিপ জোড়া নিয়ে আমাকে ফাসানোর চেষ্টা করে যাতে আপনার কোর্টে যেতে দেরি হয়। আরও অনেক পন্থা অবলম্বন করেছে আপনাকে হারানোর কিন্তু পারেনি আমি ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছি বলেই।’
‘কিন্তু আমার যত দূর মনে পরছে আমার কোনো ইনফরমেশন তুমি লিক করো নি। তাও ঔশীর ক্ষতি হয়নি কেন? তখন তো তুমি ভয় পাওনি।’
‘ভয় পাইনি কারণ ততদিনে আমার জানা হয়ে গেছিলো কে কে ছিলো এর পেছনে। আর আমি কখনোই আপনাকে হা’র’তে দিতে চাইনি। আমার প্রিয় আমার সামনে হারবে এটা তো দেখতে পারি না তাই না। তাছাড়াও ঔশীর প্রতি আমার সব সময় খেয়াল থাকতো। আমার দুটো গার্ড সব সময় ঔশীর উপর নজর রাখতো। এরপরের বাকি সব ঘটনা আপনার জানা। জানা হয়েছে সব? এবার জেদ না করে চলুন ওঁরা জেগে যাবে।’
‘আমাকে তো হারতে দেখতে চাও না তবে এখন কেন দিচ্ছো হেরে যেতে? আমাকে ওই লোকগুলোকে নিয়েই বেরোতে দাও।’
মালা দাঁত কিড়মিড় করে গায়ের জোর খাটিয়ে টেনে নিয়ে গেলো সেই রুমে।
‘ভালো কথার মানুষ আপনি না। আমি আপনার সঙ্গে কখনোই জোর করতে চাইনি। কিন্তু আমাকে এবার জোর খাটাতেই হচ্ছে।’
‘কোথায় নিয়ে যাচ্ছো আমাকে?’
‘শিহহহহ! কথা না। জলদি এই লেডার বেয়ে উঠে এক্ষুনি পালান প্রিহান!’
‘আমি ওই লোকজনকে নিয়েই এখান থেকে বেরোবো।’
‘বেশি বাড়াবাড়ি করবেন না! যান এখান থেকে না হলে ওঁরা জেগে যাবে।’
‘বললাম তো যাবো না। দেখি কি হয়।’
মালা বুঝলো প্রিহান জেদ করছে অযথা। সে জোর করে প্রিহানকে ঠেলে ঠুলে উপরে তুলে দিলো। সে নিজে উঠা শেষ করে তখনই ওর পা লেগে স্টিলের লেডার সপাটে শব্দ করে পরে গেলো। সেই শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো গুপ্ত কোঠরির সবার। মালা আর প্রিহান পালাতে পালাতে রুমি, শেবা সহ সবার চেচামেচি শুনলো। সে নিজে প্রিহানের হাত টেনে ধরে দৌঁড়ে এগোতে লাগলো। সে বুঝে গেলো এখান থেকে পালানো বুঝি আর হলো না। কেন যে এতো কথা বলতে গেলো তখন। জেদি প্রিহানকে মানানোর জন্যই তো ওতো কথা বলতেই হলো।
‘দাঁড়িয়ে যাও মালা। না হলে প্রিহানকে এবং তোমাকে গু’লি করতে বাধ্য হবো।’
‘নাহ আপু আমার যা হবার হবে আপনি আপনার ভাইয়ের সঙ্গে এরকম কিছু করতে পারেন না।’
সামনের দিকে ফিরে উল্টো দৌড়ে যেতে যেতে বলে মালা। আর তখনই সরু কিছু তার গলার এক অংশ ভেদ করে গেলো। টর্চের আলোয় যা দেখলো তাতেই মুহুর্তের মধ্যে হৃদস্পন্দন থেমে গেলো প্রিহানের। সে আকাশ ভুবন কাঁপিয়ে আর্তনাদ করে উঠলো।
#চলবে