#প্রেম_থেকে_অপ্রেম
#পর্ব৩৯
#রাউফুন
মালার গলায় সরু ব্লে’ডের মতো ধারালো না’ই’ফ চিড়ে গেছে গলা দিয়ে। গলগল করে র’ক্ত ছিটকে বেরোচ্ছে গলার ফিংকি দিয়ে। মাঝ বরাবর থেকে প্রায় পুরো গলার শিরা কে’টে গেছে। এইতো বন্ধ হয়ে যাবে তার নিঃশ্বাস। সবাই হতবিহ্বল হয়ে গেছে মালার এই অবস্থা দেখে। প্রিহান যেনো কথা বলতে ভুলে গেছে। তার গলায় হাত দিয়ে মৃদুস্বরে কথা বলার চেষ্টা করলো। কিন্তু তার গলা দিয়ে স্বর বেরোচ্ছে না। ঘড়ঘড় আওয়াজের আবহে সবার টনক নড়লো। শেবা চেঁচিয়ে রুমিকে ঝাকাতে ঝাকাতে বলে,
‘এটা তুই কি করলি রুমি? আমি কি একবারও তোকে বলেছিলাম মালাকে অ্যাটাক করতে? কি করলি তুই এটা? আমার ওঁদের কারোরই প্রা’ণ নেওয়াটা উদ্দেশ্য ছিলো না।’
রুমি নিশ্চুপ। তার মুখে অনুতাপের ছাপ নেই বললেই চলে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে অনেক দিন পর সে তৃপ্ত। পুরনো খায়েশ মিটিয়ে শেষ করে দিলো মালাকে। সব সময় মালা তাকে চোখের কোটরে ঘুরাতো। আজ শেষ করে দিলো। শেবা ঠাস ঠাস করে আঘাত করলো রুমির গালে, গায়ে সব স্থানেই। রাগ শরীর জ্বলে যাচ্ছে তার। তবুও রুমি নিঃশব্দে হাসছে অন্ধকারে। শেবা দৌঁড়ে মালার কাছে গিয়ে হাটু মুড়ে তার মাথাটা নিজের কোলে রেখে গালে চাপড় দিলো।
মালা তার রক্তাক্ত গলা থেকে হাত সরিয়ে প্রিহানের দিকে হাত বাড়ালো। র’ক্ত মাখা হাতে সে যখন প্রিহানের হাত স্পর্শ করলো তখন প্রিহানের হুস এলো। সে চিৎকার করে উঠে মালাকে কোলে তুলে নিলো। দুর্বল শরীরে শক্তি নেই বললেই চলে৷ তবুও সে তার পা থামালো না। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে সে অনেকবার পরে গেলো কিন্তু মালার গায়ে আঘাত আসতে দিলো না। তার পা ছিলে গেছে, হাতের চামড়া ছুলে রক্ত বেরিয়ে আসছে, খালি পায়ে দৌঁড়ানোর ফলে তার পা রক্তাক্ত হলো। আলু থালু পায়ে সে সর্বোচ্চ চেষ্টায় পা চালালো।
মালা শ্বাসরুদ্ধ অবস্থা প্রিহানের বুকে মাথা ফেলে শেষ বারের মতো প্রিহানের গায়ের ঘ্রাণ নিলো। আহ কি শান্তি! শেষ হাসি হেসে তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেললো সে। প্রিহান দিক বেদিক ভুলে দৌঁড়াতে লাগলো সামনের দিকে। ঠিক যেভাবে সে এসেছিলো তার রাস্তাটা মনে আছে। কথা বলার ভাষা আন্দোলন তুলে হারিয়ে গেছে। তার কন্ঠঃ এমন ভাবে রোধ হয়ে গেছে টু শব্দ বের হলো না। যেনো মনে হচ্ছে তার গলা কেউ খুব জোরে চেপে ধরে আছে। শরীর তো চলছে কিন্তু প্রিয় মানুষটার এমন করুন অবস্থায় ভেতরটা কেমন দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। খা- খা করছে হৃদয়। আহ! কি সেই হৃদয় বিদারক আর্তনাদ, চোখে দেখার মতো না। প্রিহানের দু-চোখের কোল বেয়ে অশ্রুমালা গলগলিয়ে গড়িয়ে পরছে বাঁধাহীন ভাবে। তার মন মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। তার শুধু একটাই কথা মাথায় আছে মালাকে বাঁচাতে হবে যেভাবেই হোক। না হলে যে সে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না। কোনোদিন ক্ষমা করতে পারবে না। মালা যা করেছে এতোদিন পর্যন্ত শুধু মাত্র নিজের সন্তানের কথা ভেবেই করেছে। সত্যিই তো একজন মায়ের কাছে তার সন্তানের চেয়ে বড় আর কিছুই নেই। ভালোবাসা মাপার জন্য বিজ্ঞানীরা এই পর্যন্ত কোনো মাপকাঠি বানাতে পারেনি! যদি পারতো তাহলে সেইখানে প্রথম স্থানে থাকতো “মা!”নামের নিঃস্বার্থ মহিলাটি।
র’ক্তা’ক্ত হাতে প্রিহানের গলা জড়িয়ে ধরলো মালা। কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে কোনো রকমে মুখ থেকে কতকগুলো শব্দ বের করলো,
‘প্র-প্রিয় আ-আম-আমমার বোধহয় আপনার সঙ্গে সংসার করাটা এ-এ-ই, এ-এই অব্দিই ছিলো। আপনি না আমার কাছে এহএহকটা পরী চেয়েছিলেন? সেহ-সেটা তো পা-পারলাম না তাই আ-আমমি, আমি আপনাকে আপনার ফুহ- ফুল- ফুলকে দিয়ে গেলাম। আমার মেয়েকে আ-আপনি আ-আপ-আপনার পরিচয়ে বড় করবেন। আপনি ওর বাবা হয়ে থাকবেন। তার মাঝে আপনি আমাকে খুঁজে পাবেন। ক-কিন্তু আমার পরিচয় দিয়ে বড় করবেন না। আম-আম-আমার মেয়ে আমাকে মিস্টেরিয়াস মাম্মাই জা-জানবে। আমি চাইনা আমার মেয়ে এটা জানুক তার মা একজন ক্রি’মি’নাল ছিলো। আপনি ক-ক-কথা দিন আমার ম-রে যাওয়ার পর আপনি কাঁদবেন না? আ-আম-আমাকে নিজের হাতে শেষ গোসল করাবেন, স-সআহ-সা-সাদা কাফন আ-আ-আপনি আমাকে পরিয়ে দেবেন প্রিয়। আ-আম-আমার আর কি চাই বলুন তো? এই যে আপনার বুকে মাথা রেখে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারছি! আর কি চা-চা-চাই বলুন? আমার সবচেয়ে শাহ-শান্তির জায়গা তো আপনার এই প-প্র-প্রশ্বস্ত বুক। আ-আই লাভ ইউ প্রিয়। আ-আ-আমাকে ক্ষ-মা ক-ক-রে দিয়েন প্রিয়!’
‘চুপ করো না! এতো কথা কেন বলছো? তোমার তো কষ্ট হচ্ছে। শুধু চোখ, চোখ বন্ধ করবে না। আমার কসম, আমার কসম তোমাকে মালা। তুমি তো আমার হা’র দেখতে পারো না। আমি তোমাকে ছাড়া হেরো হয়ে যাবো। আমাকে, আমার ভালোবাসাকে হারতে দিও না মালা। তোমার প্রিয়কে হারতে দিও না। ক্ষমা করো আমাকে! ‘
‘শেষ এক-একটি কথা রাহ-রাখবেন, শেষ বার ন-নি-জের মেয়েকে এএএকবার জড়িয়ে ধরতেও পা’র’লাম না। আমার হাত নিয়ে আ’মার মেয়েকে জড়িয়ে ধরাবেন আ-আপনি। তাহলেই হবে!’
দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে প্রিহান খেয়াল করলো মালার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। এদিকে হসপিটাল অনেক দূরে। প্রায় আধ ঘন্টা পর প্রিহান নিজের পরিচিত গাড়ি সামনে দেখলো। দু-চোখের পানিতে শার্ট ভিজে যাচ্ছে। তার শরীর এতোটাই দূর্বল যে এএইই অবস্থায় গাড়ি চালানোটাই বেশি টাফ্। হঠাৎ করেই রুপম কোথা থেকে যেনো দৌঁড়ে এলো। ওঁদেরকে এই অবস্থায় দেখে জলদি করে গাড়ি চালিয়ে এগোলো। প্রিহানের হাত পা অনবরত কাঁপছে। দু-চোখ, মন মস্তিষ্ক জানান দিচ্ছে সে জ্ঞান হারাবে। তার জ্ঞান নেই। মালাকে বুকের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে। ছেড়ে দিলেই এই বুঝি পালিয়ে যাবে।
‘এই মেয়ে, এই চোখ খোলো, বন্ধ করো না চোখ, হেই ওপেন ইউর আই’স! আমাকে দেখো শুধু, আমাকে দেখতে থাকো, আচ্ছা, আচ্ছা চলো আজকে একটা কাজ করা যাক, দেখি কে কার দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারে। আমি জানি তুমি জিতবে। চলো এবার চোখ খোলো। খোলো না চোখ আমার ভালোবাসা! আমার ভালোবাসা তো তুমি তাই না? এভাবে কেন চোখ বন্ধ করে আছো? আ-আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি আমি আর কখনোই তোমার সঙ্গে রাগ করে কথা বলবো না। শুধু তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না। আমি -আমি সইতে পারবো না। এই যে, এই দেখো আমি কেমন ভুলভাল কথা বলছি। তোমার আবার কি হবে? তোমার তো কিছু হবে না আমি জানি।’
‘প্রিহান ভাই, ভাই আমার একটু শান্ত হো। ভাবির কিছু হবে না। ভাবির এই অবস্থা যে বা যারা করেছে তাদের পুলিশ এরেস্ট করবেই। পুতুল আর প্রশান্ত আমাদের সব বলেছে ফিরে। আমি পুলিশের ফোর্স পাঠিয়ে দিয়েছি। তোর বাড়ির লোক, মালার বাড়ির লোক, সবাইকে যে আমি কিভাবে সামলেছি শুধু মাত্র আমি জানি। তুই এভাবে ভেঙে পরিস না ভাই আমার। শান্ত হো প্লিজ ভাই।’
‘আরে কি করে শান্ত হবো আমি রুপম? এই দেখ না তোর ভাবি তো কোনো রেসপন্স করছে না। চোখ খুলে না। কেমন নিস্তেজ হয়ে গেছে। একটু জোরে চালা না গাড়িটা।’
রুপম জোরে গাড়ি চালালো। অস্থির হয়ে পরা প্রিহানকে দেখে, তারও ভেতরটা ভেঙে যাচ্ছে। কেমন পা’গ’ল পা’গ’ল, ছন্নছাড়া লাগছে ছেলেটাকে। তারা যখন হসপিটালে পৌঁছায় তখন রাত দুটো বাজে। তারা চেচিয়ে নার্স ডাকলো। কিন্তু নার্সরা কিবা করতে পারবে । হায় কি ভাগ্য এই সময় কোনো ডক্টর-ই নেই যে মালাকে দেখবে! রুপম অবশ্য আসতে আসতে প্রিহানদের পারিবারিক ডক্টরকে কল করেছে। আরও আধ ঘন্টা পর ডক্টর এর দেখা মিললো। তখনও মালার নিথর শরীরটা প্রিহানের কোলে, বুকে চেপে ধরে রাখা। মালাকে স্ট্রেচারে উঠানোর পর ডক্টর যখন মালার পালস পরীক্ষা করেন তখন তিনি দু-কদম পিছিয়ে গেলেন। মালার গলার শিরা চেইক করে দেখলো লাষ্ট শ্বাস আছে কি না। কিন্তু শেষ আশাও নিভে গেলো। নেই শ্বাস তার।
‘নিজেদেরকে শক্ত করুন আপনারা সবাই।’
ডক্টর কম্পনরত প্রিহানের কাধে হাত রেখে বললেন, ‘আ’ম স্যরি প্রিহান তোমার স্ত্রী বেঁচে নেই। আসতে আসতে অনেক ব্লাড লস হয়ে গেছে। তার উপর ওর গলায় শিরা কে-টে গেছে খুবই বাজে ভাবে। এরকম সিচুয়েশনে পেশেন্টকে বাঁচানো অসম্ভব। সময় মতো আনলে হইতো তাকে বাঁচানো যেতো। ইতোমধ্যে অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমাদের হাতে কিছুই নেই।’
ততক্ষণে বাড়ির সবাই চলে এসেছে। মাজহারুল হাওলাদার, লিলি, দাদা, দাদি, খোদেজা, ফারুক হাওলাদার, মালার পরিবারের সকলে এই হসপিটাল চলে এসেছিলো। ডক্টর এর শেষ বাক্য গুলো শুনে লিলি সেখানেই জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পরলেন। বাকি সবাই হাহুতাশ করতে লাগলেন মালার আকস্মিক মৃ’ত্যু’তে । আর প্রিহান, সে যেনো বেঁচে থেকেও মৃত মানুষের মতো পরে রইলো। এই পর্যায়ে এসে তার জ্ঞান নেই!
#চলবে