বিকেলের শেষ আলো পর্ব-২+৩

0
608

#বিকেলের_শেষ_আলো
#লেখনীতে_নূরকথা
#পর্ব_২_৩

এই প্রথম আমি তার মুখ দেখতে পেলাম। কিন্তু এই চেনা মুখ তো আমি জীবনের প্রথম দেখছি না। আর এই মুখ দেখার আশায় কি ছিলাম আমি! হাজারও প্রশ্নে বিস্ময়ের অন্ত রইলো না আমার। এদিকে আমি লো প্রেশারের পেশেন্ট। আচমকা চমকে যাওয়ার ব্যাপারটা সহজে হজম করতে পারি না। ফলস্বরূপ আমার দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে আসছে‚ মাথা সহ সমস্ত শরীর যেন অসার হয়ে যাচ্ছে। নিজের দেহের ওপর কাবু রইলো না আমার। কিন্তু যখন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললাম‚ তখন কোথাও ধাক্কা খেয়ে থেমে গেলাম। একটু একটু জ্ঞান থাকায় শুনতে পেলাম‚ “মিষ্টি? কী হয়েছে? শরীর খারাপ করেছে?”

আমি চোখ বুঁজে বুঝতে পারলাম‚ জীবনের প্রথম আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তাআলা আমাকে পবিত্র এক আবাসস্থলে মাথা গোঁজার ঠাঁই দিয়েছে; যার সাথে আমার রক্তের কোনো সম্পর্ক নেই‚ যে একজন পুরুষ‚ সকালেও যে কিনা আমার জন্যে নন মাহরাম ছিলেন। আর এখন সেই পুরুষ আমার জন্য পবিত্র আবাসস্থল‚ আলহামদুলিল্লাহ।

অবচেতন মনেও আমি তার গায়ে মেশানো আতরের গন্ধে আবেশিত হলাম; পবিত্র ঘ্রাণ এবং স্পর্শে বিমোহিত হলাম। এদিকে আমার থেকে সাড়াশব্দ না পেয়ে সে ব্যস্ত হয়ে বারবার জানতে চাচ্ছেন‚ “কী হয়েছে? খুব খারাপ লাগছে? মিষ্টি? অ্যাই মিষ্টি?”

কথা বলতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে তাও তার বুকে পরম শান্তিতে মাথা রেখে আমি মিথ্যা অভিযোগের সুরে জানতে চাইলাম‚ “আপনি এখানে কেন?”

“খুশি হওনি?”

আমি ক্লান্ত স্বরেই বললাম‚ “এটা আমার প্রশ্নের উত্তর নয়।”

“এমন অসুস্থ শরীরেও আমার সাথে ঝগড়া করবে?” কিঞ্চিৎ অবাক আর রাগ মিশিয়ে তিনি জানতে চাইলেন। আমি উত্তর দিলাম না। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন‚ “কী হয়েছে তোমার? আমি তো ঠিক বুঝতে পারছি না। কেমন লাগছে বলো। একটা কিছুর ব্যবস্থা করি।”

“প্রেশার লো হয়েছে। আমাকে মিষ্টি জাতীয় কিছু দিন। ইন শা আল্লাহ ঠিক হয়ে যাবো।”

এতক্ষণ তার আলিঙ্গনে বন্দী ছিলাম। এবার ধীরেধীরে আমাকে ছেড়ে দিয়ে তিনি নিজেই বালিশে শুইয়ে দিলেন। বালিশে একদম মিশে গিয়ে শুয়ে রইলাম চুপচাপ। চমকের ধাক্কার চেয়ে এবার লজ্জা বেশি কাবু করছে আমাকে। একটু একটু শীত করছে— এটা তিনি কীভাবে বুঝলেন আমার জানা নেই। গায়ে কাঁথা জড়িয়ে দিয়ে বললেন‚ “একটু অপেক্ষা করো। আমি এক্ষুনি আসছি।”

বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমি ভাবতে লাগলাম‚ “এই মানুষটার সাথে আমার বিয়ে কীভাবে হলো? আম্মু আব্বু কীভাবে তাকে আমার স্বামী হিসাবে মেনে নিলেন? আর তিনিই বা কেন আমাকে বিয়ে করলেন?” আমার হাজারও ভাবনার ভীড়ে তার আগমন টের পেলাম। তিনি আমাকে ডাকলেন‚ “মিষ্টি?”

আমি উঠার চেষ্টা করছি‚ কিন্তু বেশ কষ্ট হচ্ছে। তিনি আমাকে উঠতে সাহায্য করলেন আর মৃদু হেসে বললেন‚ “আমাকে ক্ষমা করো মিষ্টি। এখনো তোমার দেনমোহর পরিশোধ করা হয়নি অথচ তোমায় স্পর্শ করতে হচ্ছে। আমার ইচ্ছে ছিল দেনমোহর পরিশোধ করেই তোমাকে স্পর্শ করবো। কিন্তু তুমি হঠাৎ এত অসুস্থ হয়ে পড়বে তা ভাবিনি।”

“আমাকে কি কিছু খেতে দিবেন নাকি আপনার কথা শুনিয়েই প্রেশার ঠিক করবেন?”

“তুমি শুধু বাচাল না রাগীও বটে। অসুস্থ শরীরেও তেজ কমে না।” তার এমন কথা শুনে আমি বাঁকা চোখে তাকালাম। চুপচাপ দেখলাম সেই চেনা শান্ত ছেলেটা আজ কত চঞ্চলতা ভাসিয়ে দিচ্ছে তার চোখেমুখে।

“খেয়ে নাও।” বলেই এক প্যাকেট ডার্ক চকোলেট এগিয়ে দিলেন। আমি নিতে যাবো তার আগে বললেন‚ “থাক আর কষ্ট করতে হবে না। আমিই খুলছি।” আরও বললেন‚ “তোমার নাম মিষ্টি হলে কী হবে? মিষ্টি জাতীয় কিছু তো খাও না। ভাগ্যিস চকোলেট আনিয়ে রেখেছিলাম নয়তো এখন সারারাত রোগী নিয়ে বসে থাকতে হতো।”

“আপনি কিন্তু আমাকে অপমান করছেন।” আমি কথা শেষ করতেই তিনি নিজ হাতে আমার মুখে চকোলেট পুড়ে দিলেন। এরপর পরিহাসের সুরে বললেন‚ “চার বছর গোপনে আমার ওপর যে অত্যা* চার করেছো। সেগুলোর কাছে এসব তো দুধভাত।” আমি এ কথার ধার দিয়েও গেলাম না। স্পষ্ট গলায় জিজ্ঞেস করলাম‚ “আপনি এখানে কেন?”

তার হাসি হাসি মুখটা একটু মলিন হয়ে গেল। ঘরে শুরু থেকে কম পাওয়ারের বাতি জ্বালানো ছিল। বুঝলাম না কম আলোয় ঘর আলোকিত করার মানে কী! বাসর ঘর কী এমন করেই রাখতে হয়? তবে আমি তার মুখের ভঙ্গি সব স্পষ্টই দেখতে পারছি।

“তুমি কি আমাকে দেখে সত্যিই খুশি হওনি?” তিনি জিজ্ঞেস করতে আমি গলার স্বরে একটুখানি রাগ ঢেলে দিলাম‚ “বারবার একই কথা কেন জিজ্ঞেস করছেন?”

“তুমিও তো একই কথা জিজ্ঞাসা করছো। আমি তোমাকে বিয়ে করেছি মিষ্টি। তাই এখানে‚ এই যে ঠিক তোমার সামনে বসে আছি।”

“কিন্তু জেনেশুনে একটা বুড়িকে কেন বিয়ে করলেন?” আমার কথা শুনে তিনি যেন আকাশ থেকে পড়লেন। বিস্ময়ে চোখ গোলগোল করে বললেন‚ “বুড়ি! কে বুড়ি? কাকে বুড়ি বলছো?”

“অভিনয় করছেন আমার সাথে? কেন আপনি জানতেন না? আমি যে আপনার সিনিয়র— এটা তো আপনার জানার কথা। তো জেনেশুনে একটা সিনিয়র মেয়েকে কেন বিয়ে করলেন? বলুন এটা জানতেন কিনা?”

প্রথম যখন তিনি ঘরে ঢুকেছিলেন‚ তখন খুব হুকুমের স্বরে কথা বলছিলেন। কিন্তু এখন ধীরেধীরে তার মাথা নত হচ্ছে আর সিনিয়র হওয়ার সুবাদে আমার গলায় কর্তৃত্ব শুধু বেড়েই চলেছে।

“জানতাম।” মনমরা হয়ে জবাব দিলেন। এদিকে আমার প্রেশার ঠিক হয়ে যাচ্ছে। আমি স্বপ্নেও ভাবিনি আম্মু আব্বু আমাকে বয়সে ছোটো একটা ছেলের সাথে বিয়ে দিবেন।

“জেনেও কেন আমাকে বিয়ে করলেন?”

পূর্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন‚ “প্রতি*শোধ নিতে।”

“প্রতি*শোধ! কীসের প্রতি*শোধ?”

“সেটা সময় হলেই জানতে পারবে।” তিনি ভণিতা শুরু করলেন। আমার মাথায় রাগ চেপে বসলো। আমি আন্দাজের ওপর বলে বসলাম‚ “সময়ের অপেক্ষা আমি করতে পারবো না। আর আমি আপনার সংসারও করছি না। কাল সকালেই……..” আর কিছু বলার আগেই তিনি আমার মুখে একটু বেশিই চকোলেট পুড়ে মুখ চেপে ধরলেন। রাগী স্বরে বললেন‚ “অনেক সাধনার পর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তাআলা তোমাকে আমার জন্য হালাল করেছেন। সংসার করবে না? অ্যাই‚ কান খুলে শুনে নাও। শুধু ইহকালে নয়‚ পরকালেও এই আকাশের সংসারই তোমাকে করতে হবে। সেই ব্যবস্থা আমি নিজে অর্ধেক করেছি তাঁর করুণা আর দয়ায়। তাই এখন বাসর ঘরে বসে ঝগড়া করতে পারছো। বাকিটা করার তৌফিকও তিনি দিক যেন মৃত্যুর পর বেহেশতে বসে ঝগড়া করতে পারি। আমি জানি তো আর আজকে ভালো করে বুঝতেও পেরেছি। তোমার সাথে সংসার করা মোটেও মিষ্টির হবে না। কিন্তু আমার এতে একটুও আপত্তি নেই। দরকার পড়লে রোজ নিয়ম করে তিনবেলা কা*মান দা*মান নিয়ে যু*দ্ধ করে সংসার করবো। তাও যদি আর কোনোদিন বলেছো‚ সংসার করবো না। তাহলে শান্ত আকাশের অশান্ত রূপ দেখতে পারবে। আমি ধর্মকর্ম করা মানুষ তা বলে মারপিট করতে পারবো না— এটা ভুলেও ভেবো না। বউ পি*টিয়ে কীভাবে ঠিক করতে হয় তা আমার ভালোই জানা আছে। বুঝলে?”

এক নাগাড়ে এতগুলো কথা বলে তিনি আমাকে ছেড়ে দিলেন। আমি মুখ ভর্তি চকোলেট নিয়ে এতক্ষণ শুধু শুনেই গেছি। এখন ছাড়া পেয়েও খাওয়ার কথা মনে আসছে না কারণ তিনি এত শক্ত কথা বলতে পারেন তা আমার জানা ছিল না। সত্যি বলতে সবকিছু এলোমেলো লাগছে; কেমন যেন নাটকীয়! আজকে কি সত্যিই আমার বিয়ে হয়েছে! সত্যিই কি আমি এখন বাসর ঘরে আছি!

………. চলবে ইন শা আল্লাহ

#বিকেলের_শেষ_আলো
#লেখনীতে_নূরকথা
#পর্ব_৩

“খাচ্ছো না কেন? তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করো। নামায পড়াও বাকি। ইন শা আল্লাহ দুই রাকাআত নফল নামায পড়বো একসাথে। তোমার অসুস্থতা আর ঝামেলায় তো কথাই বলা হলো না।” বিরক্তির সুর কথাবার্তায় ভাসলেও তার চেহারায় সেই আভাস পাওয়া গেল না। স্তম্ভিত হয়েও দেখেছিলাম তাকে একবার কোনো এক ফাঁকে।

এক গ্লাস পানি বিছানার পাশে থাকা ছোট্ট টেবিলের ওপর রেখে আবার বললেন‚ “পানি পান করে নিয়ো। আমি ফ্রেশ হয়ে আর ওযু করে আসছি। একসাথে নামায পড়বো।” আমি কোনো জবাব দিলাম না কলের পুতুলের মতো চকলেট চিবিয়ে খেতে লাগলাম।

প্রায় মিনিট দশেক পর তিনি ফিরে এলেন। গায়ে সাধারণ পাঞ্জাবী পায়জামা আর হাতে ঝোলানো রয়েছে জায়নামাজ। আমার দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে জিজ্ঞেস করলেন‚ “শ*ক থেকে কি এখনো বের হতে পারোনি?”

কিছু না বললেও সব বুঝে নিচ্ছেন। সামান্য লজ্জা পেলাম। মুখের আদলে কোনোরূপ ভঙ্গিমা না ফুটিয়ে চোখ নামিয়ে নিলাম। এতক্ষণ কত পটরপটর করেছি‚ কিন্তু এখন কথা বলার ইচ্ছে কেন জানি মরে গেছে।

“নেমে এসো। নামায পড়বো। রাত তো অনেক হলো।” তার হুকুম মতো নেমে পড়লাম। তিনিই সুন্দর করে জায়নামাজ বিছিয়ে দিলেন। জীবনের প্রথম কোনো পুরুষের পাশে দাঁড়িয়ে নামায পড়বো আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তাআলার মেহেরবানিতে। সারা গায়ে কেমন যেন কাঁ*টা দিয়ে উঠলো।

আলহামদুলিল্লাহ নামাযের শেষাংশে যখন মোনাজাত শেষ হলো তখন তিনি আচমকা আমার দু’হাত পরম যত্নে বুকে আগলে ফুঁপিয়ে উঠলেন। স্তম্ভিত আমি শুরু থেকেই‚ কিন্তু এখন তার এই রূপ দেখে আমি যেন প্রাণহীন পাথর হয়ে গেলাম।

আমার কোনো ভাই নেই। আম্মু আব্বুর একমাত্র মেয়ে আমি। আব্বুকে শুধু একবার কান্না করতে দেখেছিলাম‚ যখন আমার দাদা মারা গিয়েছিলেন। এছাড়া আমি কোনোদিন কোনো পুরুষকে কাঁদতে দেখিনি। ছোটোবেলা থেকে জেনে এসেছি‚ ছেলেদের কাঁদতে নেই। কিন্তু তিনি কাঁদছেন কেন? একই মানুষের এত রূপ কেন! চার বছর আগে এই মানুষটাকে চোখের সামনে দেখে মনে হয়েছিল কোনো এক শান্ত নদী‚ একটু আগের রূপে যেন সে কোনো এক বৈশাখের নাটকীয় ঝড় আর এখন এমন ঝর্ণা ঝরছে কেন তার শীতল চোখের কোল বেয়ে?

“আমি কি জানতে চাইবো তার কাছে? কাঁদছে কেন সে এমন ফুঁপিয়ে?” চুপচাপ বোকার মতো বসে যখন এসব ভাবছিলাম‚ তখন তিনি মাথা তুলে আমার দিকে তাকালেন। ভেজা চোখ‚ মুখ ভর্তি দাঁড়ি‚ মাথা টুপি পরা শ্যামলা মুখখানি— মাশাআল্লাহ! আম্মু আব্বুর পর আরও একটা পবিত্রতা ছড়িয়ে থাকা মুখ দেখার সৌভাগ্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তাআলা করে দিলেন আমাকে।

“কিন্তু এত সৌভাগ্য তিনি আমাকেই কেন দিলেন?” মনে আসা এই প্রশ্নের উত্তর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তাআলা সম্মুখে বসে থাকা মানুষটার মাধ্যমে আমাকে জানিয়ে দিলেন। কান্না ভেজা কণ্ঠে তিনি আমাকে জানালেন‚ “গত চার বছর ধরে রোজ রাতে নামায পড়ে আল্লাহ তাআলার কাছে তোমাকে হালাল ভাবে চেয়েছি। আলহামদুলিল্লাহ তিনি আমাকে নিরাশ করেননি। তোমাকে আমার করে দিয়েছেন; হালাল ভাবে দিয়েছেন। আজ থেকে তুমি এই অধমের অর্ধাঙ্গিনী।” এই বলে আলতো করে আমার মাথা টেনে নিলেন। পবিত্রতা এবং আবেশ ছড়িয়ে দিলেন আমার ললাটে। আমি আবেশিত হলাম ভীষণ ভাবে‚ কিন্তু মনে মনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তাআলার কাছে জানতে চাইলাম‚ “হালাল সম্পর্কে এত আবেশ আর অনুভূতি ছড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও কেন আমাদের মনে হারাম সম্পর্কের মোহ জন্ম নেয়?”

“বলো………. দেনমোহর হিসাবে কী চাই তোমার? আমি নিজে থেকে কিছু ভাবিনি। ইন শা আল্লাহ তুমি যা চাইবে তা দেওয়ার চিন্তাই করে রেখেছিলাম।” তিনি আমার মাথা ছেড়ে দিলেন‚ কিন্তু হাত দু’খানা এখনো বন্দী করে রেখেছেন। যতই ঠোঁট কাঁ*টা স্বভাবের মেয়ে আমি হই না কেন? এমন পরিস্থিতিতে চেনা একটা পুরুষকে স্বামী হিসাবে পাওয়ার পর কি মুখে আর কোনো কথা ফোটে? কিন্তু একটু আগে অত কথা বললাম কী করে!

“মিষ্টি?” তিনি ডাকলেন। কতক্ষণ পরে তা আমার জানা নেই‚ কিন্তু এবার আমার মুখ দিয়ে কথা ফুটলো‚ “জি।”

“আমাকে স্বামী হিসাবে পেয়ে তুমি কি সত্যিই খুশি হওনি? গত চার বছরে তোমার মন কি আমার জন্য একটুও ব্যাকুল হয়নি? একবারও কি মনে হয়নি‚ তুমি আমাকে হালাল ভাবে পেতে চাও?” পরপর কত প্রশ্ন তিনি করে চলেছেন‚ কিন্তু আমি ব্যর্থ উত্তর দিতে। আচমকা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তাআলা আমার কথা বলার শক্তি যেন হরণ করেছেন।

“বলো মিষ্টি। চুপ করে থেকো না। তুমি কি আমাকে স্বামী হিসাবে মেনে নিতো পারছো না?” তিনি ব্যাকুল হলেন। কিন্তু আমি তো কিছুই বলতে পারছি না। আসলে আমি বুঝতে পারছি আমার মন কী চাচ্ছে আর আগে কী চেয়েছিল। আর ৮/১০টা মেয়ের মতো স্বামী আর সংসার নিয়ে আমিও কত-শত স্বপ্ন দেখেছিলাম। কিন্তু ঘুনাক্ষরেও ভাবিনি তার সাথে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তাআলা আমার ভাগ্য নির্ধারণ করতে পারেন। তিনি যে মহান‚ তাঁর চেয়ে বেশি আর কে জানবেন? তাই না জানাই স্বাভাবিক।

“কেন ছবি দেখলে না বিয়ের আগে? আমি তো তোমাকে কোনোরূপ ধোঁ*কা দিইনি। জানিয়েই বিয়ে করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি আমার ছবি দেখলে না। এটা জানার পরই ভেবেছিলাম বাসর ঘরে তোমাকে চমকে দিবো। আমাকে দেখলে তুমি হয়তো খুশি হবে। কিন্তু তোমার নীরবতা আর মলিন মুখ বলছে তুমি আমাকে মেনে নিতে পারছো না। হযরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও তো নিজের চেয়ে বড়ো একজন রমণীকে স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর স্ত্রী তাঁরই পদতলে সমস্ত ঐশ্বর্য সমর্পণ করে স্বামীর সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। তাহলে তুমি কেন পারছো না আমাকে মেনে নিতে? মাত্র তো দুই বছরের ব্যবধান।” তিনি থামলেন। এতক্ষণ ধরে উত্তেজনা আর ব্যাকুলতা কাজ করলেও তার কান্না থেমেছিল অনেক আগেই।

সরু চোখে তাকিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন‚ “তুমি কি ভাবছো আমি তোমার ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে পারবো না? তোমাকে যত্নআত্তি করতে পারবো না? মিষ্টি‚ আমি স্বাবলম্বী। বউ চালানোর যোগ্যতা আমার আছে। বাবার ব্যবসায়ের পাশাপাশি আমি নিজেও ব্যবসায় দিয়েছি। আর যত্নআত্তি?………. এটা এমনভাবেই করবো ইন শা আল্লাহ আমাকে ছাড়া আর কিছু মাথায় ঢুকবে না।” শেষ কথায় কেমন যেন অন্যরকম ইঙ্গিত পেলাম। আমার চোখজোড়া নামানো ছিল। এই কথা শুনে চোখ তাকালাম। দেখলাম শান্ত নদী হিসাবে চেনাজানা পুরুষের চোখে আজ নির্লজ্জ সমুদ্র খেলা করছে। এই মানুষ যে সহজসরল নয় তা বুঝতে আমার একটুও বিলম্ব হলো না।

বহুকষ্টে নিজেকে সংযত করলাম। আগের রূপে ফিরে গিয়ে তার সম্পর্কে জানতে চাইলাম‚ “এটাই তাহলে আপনার আসল রূপ?”

“কোনটা?”

“ইউনিভার্সিটির চত্ত্বরে ভদ্র সুপুরুষ অথচ আজকে রগচটা‚ নির্লজ্জ আর……….” আমি থেমে গেলাম। কিন্তু তিনি জানতে চাইলেন‚ “আর কী?”

“ঘুমাবো আমি।” উত্তর দিয়ে নিজের কাছেই মনে হলো আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।

“আগে আমার কথার উত্তর দাও। ত্যাড়ামি কোরো না নয়তো আজকে থেকেই মা*রপিট শুরু করবো। সইতে পারবে না।”

আমি পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালাম তার দিকে। জিজ্ঞেস করলাম‚ “যদি বলি স্বামী হিসাবে পেয়ে খুশি হইনি। তাহলে কি মুক্তি দিয়ে দিবেন?”

তার চোখের চঞ্চল সমুদ্রে এবার মেঘ জমতে শুরু করলো। কিন্তু পুরুষ মানুষ তো তাই নিজেকে বাঁধ দিয়ে রাখতে পারলো। গাম্ভীর্যের সঙ্গে বললেন‚ “আমি জানি তোমার উত্তর এটা কোনোদিন হবে না। আমার প্রতিপালকের ওপর আমার পরিপূর্ণ বিশ্বাস আছে। তুমি আমার জন্য হালাল বলেই আজ আমরা তাঁর ইশারায় মুখোমুখি বসে আছি।”

“চার বছর আগেও তো একদিন মুখোমুখি বসেছিলাম। সেটাও তাঁর ইশারাই ছিল। তা বলে কি আমি আপনাকে স্বামী হিসাবে মেনে নিয়েছিলাম সেদিন? নাকি স্বপ্ন দেখেছিলাম আজকের দিনটার?”

……….চলবে ইন শা আল্লাহ