বিকেলের শেষ আলো পর্ব-১০ এবং শেষ পর্ব

0
425

#বিকেলের_শেষ_আলো
#লেখনীতে_নূরকথা
#পর্ব_১০

হাসিখুশি মুখে হঠাৎ নীরবতা নেমে এলো। তিনি ডাকলেন বটে। কিন্তু আমি জবাব দিলাম না। কেমন এক মোহে বিভোর হয়ে শুধু তাকিয়ে রইলাম। তার চোখ জোড়া নামানো ছিল। এখন সেই চোখ জোড়া তুলে তিনি আবার বলতে লাগলেন‚ “তোমাকে হালাল ভাবে আমার করে পাওয়াটা সহজ ছিল না বটে। কিন্তু আমি তোমাকে পেতে কোনোরূপ ছল করিনি মিষ্টি। সবকিছু ঠিকঠাক হওয়ার পর আমি বারবার করে বলেছিলাম‚ আমার ছবি যেন তোমাকে দেখানো হয়। কারণ তোমারও তো একটা পছন্দ অপছন্দ করার স্বাধীনতা আছে। কিন্তু তুমি তো ছবি দেখলে না। এরপর আর কী? না দেখে আর না জেনেই আমার সাথে পবিত্র বন্ধনে জড়িয়ে গেলে।” কথা শেষ করে তিনি হাসলেন। কিন্তু এই হাসিতে কষ্টের একটা ছাপ দেখতে পেলাম।

কী জানি কী হলো আমার। অজানা ঘোরে এবার আমি তার ডান হাত পরম যত্নে আগলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম‚ “এত কিছু করলেন?” আমার চোখে মুখে যতটা না বিস্ময় ফুটেছে তারচেয়ে অধিক দুষ্ট হাসিতে এক নিমিষেই মত্ত হলেন তিনি। ঘোরের জন্য কিছুই ঠাওর করতে না পেরে প্রশ্ন করলাম‚ “হাসছেন কেন?”

মুখে তেমনই দুষ্ট হাসি জিইয়ে রেখে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করলেন‚ “হাত না ধরে কি কথা বলতে পারো না?” এ কথা শোনার পর আমি এক ঝটকায় তার হাত ছেড়ে দিলাম। প্রায় সাথে সাথে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। আমার সমস্ত গায়ে এখন বেড়ে উঠা লজ্জা এবং রাগ দৌড় প্রতিযোগিতা করছে যেখানে রাগেরই জয় হলো। আর আমার মুখাবয়বে তীব্র রাগ ভেসে উঠলো। এসব তিনি ভালোই বুঝতে পারছেন। সেজন্য তো সমস্ত মনপ্রাণ উজাড় করে হাসছেন আর সুযোগের সদ্ব্যবহার করছেন।

এখানে বসে থাকতেও অসহ্য লাগছে। কিন্তু চট করে তো উঠে যাওয়াও যায় না। আমি চুপচাপ বসে রইলাম। একটু আগেও কষ্টের ছায়া দেখলাম যার চোখেমুখে‚ এখন সে-ই আমায় অপদস্ত করছে লাগামছাড়া হয়ে।

একটু সময় নীরবে পেরিয়ে গেল। তিনি হাসি থামিয়ে যখন আমার হাত ধরতে প্রস্তুত হচ্ছেন‚ তখন আমি নিজের হাত পিছনে নিয়ে রাগী চোখে তাকালাম। জানতে চাইলাম‚ “মতলব কী?”

“কিছুই না।” দায়সারা জবাব তার।

“তাহলে হাতের নড়াচড়া বন্ধ করুন। সুযোগ পেলে যে ছাড় দেয় না তার আর আমার হাত ধরতে হবে না।” তিনি হেসে উঠলেন। মানুষটা এত হাসতে পারে! বললেন‚ “বউ গো বউ। এমন বাচ্চামিতে মাতলে কেন? একটু না হয় খোঁচা মেরেছি। তাই বলে এত বড়ো শাস্তি! বাঁচবো না বউ। তোমার হাত ধরতে না মারলে নির্ঘাত মারা পড়বো। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যে আমার হৃদয় শীতল করার ক্ষমতা তোমার দু’খানা হাতে দিয়ে রেখেছেন। বুঝলে?”

“এত বুঝে আমার কাজ নেই।” মুখ ঝামটা মেরে আমি হনহন করে বারান্দায় চলে এলাম। কত বছর পর জানি না। তবে এমন বাচ্চামিতে মত্ত হয়ে ভালো লাগলো। বারান্দায় দাঁড়াতেই চাপা লজ্জায় হেসে উঠলাম। বিড়বিড় করলাম‚ “ইস! এমন বাচ্চামি কেউ করে?”

“মিষ্টি? রাগ করলে বউ?” বারান্দায় দাঁড়িয়ে খুব সুন্দর দৃশ্য দেখা যায়। আমি তা দেখতেই ব্যস্ত ছিলাম। তাই বারান্দায় তার আগমন টের পাইনি বিধায় কিঞ্চিৎ চমকে উঠে তাকালাম। তিনি আমার পাশে দাঁড়িয়ে আবার জিজ্ঞেস করলেন‚ “ভয় পেলে নাকি বউ?”

মেকি রাগের স্বরে আমি প্রতিবাদ করলাম‚ “এত বউ বউ করবেন না।”

“কেন? বউকে বউ বলবো না তো কি বলবো?”

“দেনমোহর কিন্তু এখনো বাকি আছে— এটা ভুলে যাবেন না।” একটু কৃর্তত্ব ফুটিয়ে বললাম। তিনিও সায় দিলেন‚ “তাই তো। একদম ভুলে গেছি। দেনমোহর নিয়ে এখনো আলোচনা করাই শেষ হয়নি।”

“জি। সেজন্যই বলছি‚ এত বউ বউ করবেন না। আগে দেনমোহর পরিশোধ করুন। এরপর ভেবে দেখবো।” বেশ ভাব নিয়ে কথাগুলো বললেও ভেতরে ভেতরে ভীষণ হাসি পাচ্ছে আমার।

“তাই নাকি বউ বউ বউ?” কী আজব মানুষ! মানা করার পর আরও বেশি করে ডাকছে। আমি অবাক চোখে তাকালাম তার দিকে। তিনি আমার কপালে মৃদু টোকা দিয়ে বললেন‚ “না চমকে এখন বলো তো। দেনমোহর পরিশোধ করে ফেলি ইন শা আল্লাহ। এটা ঝুলিয়ে রাখা ঠিক না।”

“যা বলবো‚ তা-ই দিবেন?”

“ইন শা আল্লাহ তা-ই দিবো। বলো তুমি।” তার কথা শুনে মনটা কেমন করে উঠলো। একটু কাতর গলায় তাই এবার জিজ্ঞেস করলাম‚ “চাওয়ার পর আবার আপত্তি করবেন না তো?”

আলতো হাতে আমাকে তার মুখোমুখি দাঁড় করালেন। আমার চিবুক তুলে নরম গলায় বললেন‚ ”যাকে ইহকালে আর পরকালে পাওয়ার জন্য অবিরাম আল্লাহ তাআলার কাছে চেয়ে চেয়ে মরছি। আমি তার চাওয়াতে আপত্তি করতে পারি বউ? বলো তোমার কী চাই। আমি তো বলছি‚ তুমি যা চাইবে আমি ইন শা আল্লাহ তাই দিবো।”

খুশিতে আমার হৃদয় থৈথৈ করে উঠলো। আমি এমন খুশিতে কবে সিক্ত হয়েছিলাম আমার জানা নেই। তবে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তাআলার কাছে মনে মনে শুকরিয়া আদায় করে ডান দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম। দেখলাম গাছের ভীড়ে এক টুকরো আলো দেখা যাচ্ছে। সেদিকে হাত বাড়িয়ে আমি তাকে বললাম‚ ”আমি দেনমোহর হিসাবে বিকেলের শেষ আলো চাই।” এবার তার দিকে ফিরে জানতে চাইলাম‚ “দিবেন আমায়? বিকেলের শেষ আলো।”

“মানে?” কপালে কুঞ্চন সৃষ্টি করে তিনি প্রশ্ন করলেন।

আমি ধীর গলায় জবাব দিলাম‚ “জান্নাতে আপনার পাশে দাঁড়িয়ে আমি রোজ রোজ বিকেলের শেষ আলো দেখতে চাই। ইহকাল আর পরকালে আপনার মাঝে আবদ্ধ থাকতে চাই। দিনে অন্তত এক ওয়াক্ত নামায হলেও আপনার সাথে পড়তে চাই। আপনার বুকে মাথা রেখে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে চাই।”

“মানে? তারমানে তুমি আমাকে স্বামী হিসাবে মেনে নিয়েছো?” খুশিতে আত্মহারা হয়ে তিনি আমাকে একপ্রকার ঝাঁকি দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন। এদিকে মুখ ফুটে এসব বলতে পেরে লজ্জায় আমার চোখ বুজে আসছে আর ঠোঁটে ভাসছে লাজুক হাসি।

“বউ‚ অ্যাই বউ। বলো না আমি তোমার স্বামী কিনা? একবার মুখ ফুটে বলো। আর কখন মেনে নিলে? তুমি তো বাসর ঘরে বললে যে সংসার করবে না। তাহলে এখন এসব!” মানুষটা কেমন পাগলাটে আচরণ করছে। একবার ব্যাকুল হচ্ছে তো একবার বাচ্চাদের মতো ছটফট করছে।

হালকা হেসে আমি বললাম‚ “বাসর ঘরে আপনাকে দেখে চমকে ছিলাম— এটা সত্যি। তবে এরপর আমার সব কথাবার্তা আর আচরণ ছিল স্বেচ্ছায় সাজানো। আসল কথা তো হলো‚ যেদিন আপনাকে প্রথম দেখেছিলাম‚ সেদিনই মনে মনে আল্লাহর কাছে চেয়েছিলাম‚ ‘আপনার মতো একজন মানুষই যেন আমার স্বামী হোন।’ কিন্তু ঘুনাক্ষরেও টের পাইনি যে আপনিই আমার স্বামী হয়ে বসবেন।”

“তুমি কি এসব সত্যিই বলছো মিষ্টি?”

“জি। সত্যিই বলছি। আর আপনি হযরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিয়ের বিষয়টা টেনে আমাকে বারবার বোঝাতেন না যে নিজের থেকে ছোট পাত্রকে বিয়ে করা যায়?” তিনি মুখে কিছু না বলে ‘হ্যাঁ’ বোধক মাথা নাড়ালেন। আমি মৃদু হেসে বললাম‚ “তাঁর উম্মত হিসাবে এটা কি আমার অজানা বলুন? বরং যবে থেকে জেনেছি‚ তবে থেকে তো……….” থেমে গেলাম। লজ্জায় গলা ধরে আসছে আমার। কিন্তু তিনি জিজ্ঞেস করলেন‚ “তবে থেকে কী? বলো মিষ্টি। আজকে আর চুপ করে থেকো না।”

নিজেকে সামলে নিলাম। কিন্তু দৃষ্টি নতই রইলো। বললাম‚ “তবে থেকে নিজের চেয়ে বয়সে ছোট জামাই পাওয়ার লোভকে নিজের অন্তরে ঠাঁই দিলাম।”

খুশিতে তৃপ্ত মানুষটা দুই হাতে আমার মুখ তুলে তৃষ্ণার্ত পাখির ন্যায় আর্জি জানালো‚ “অ্যাই মিষ্টি‚ তাহলে একবার বলো না। আমি নিজের কানকে শুনিয়ে তপ্ত হৃদয়কে শীতল করি যে আমিই তোমার স্বামী।” আর কোনো আপত্তি নয়। আমি তার দুই হাত চেপে বলতে লাগলাম‚ “আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তাআলাকে মনের মধ্যে রেখে‚ বিকেলের শেষ আলো দৃষ্টি সীমানায় ছড়িয়ে‚ আমি মিষ্টি আজ আপনাকে বলছি জনাব‚ আপনিই হলেন আমার একমাত্র জুনিয়র স্বামী। ইহকাল আর পরকালে আমার একমাত্র সঙ্গী ইন শা আল্লাহ।” কথাটুকু বলার সময় কেন জানি আপনা থেকেই আমার চোখ বুজে গেল। তাই তার উচ্ছ্বাস আমার আর দেখা হলো না। তবে পরম আকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি যখন আমাকে আলিঙ্গন করলেন এবং বললেন‚ “আজ আমি পরিপূর্ণ বউ। আল্লাহ তাআলা আমাকে পূর্ণতা দিয়েছেন………. তোমায় ভালোবাসে বউ; এই আকাশ তোমায় অনেক ভালোবাসা। আল্লাহ তাআলা আমাদের এই বন্ধন পরকালেও অটুট রাখবেন তুমি দেখে নিয়ো।” তখন তৃপ্ত চিত্তে আমি অস্ফুটস্বরে কেবল একটা শব্দই উচ্চারণ করলাম‚ “ইন শা আল্লাহ।” আর মনে মনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তাআলাকে জানালাম‚ “আলহামদুলিল্লাহ।”

……….সমাপ্ত